অনেক ধরনের হারানো বিজ্ঞপ্তি আমাদের ছাপতে হয়। কিন্তু এই প্রথম একটি হাতের সন্ধান চেয়ে কেউ বিজ্ঞাপন দিলেন। ছাপা হয়েছে আজ আট দিন হলো। বিজ্ঞাপন বিভাগ প্রথমে এটি নিতে চায়নি। কিন্তু বিজ্ঞাপনটি তিনি দেবেনই—যে কোনো মূল্যে। পত্রিকাগুলোতে বিজ্ঞাপনের যে আকাল পড়েছে তাতে কেউ বিজ্ঞাপনের জন্য জোর করলে আপত্তি করা তো দূরে থাক খুশিই হওয়ার কথা। কিন্তু বিজ্ঞাপনের ভাষা লিখতে গিয়ে বিপদে পড়ে গেল বিভাগটির লোকজন। সহকারী সম্পাদক হলেও মাঝেমধ্যে দুয়েকটি বিজ্ঞাপনের ভাষা আমাকে ঠিক করে দিতে হয়।
বিজ্ঞাপনদাতাকে আমার রুমে পাঠানো হয়েছে। দেখেই বোঝা যায় বয়স আশির কম হবে না। কিন্তু এখনো বেশ শক্ত আছেন। চেহারার দৃঢ়তা বলে দেয় জীবনের কোনো এক যুদ্ধে তিনি জয়ী হয়েছেন এবং সেই গর্ব শরীরে খোদাই করে রেখেছেন। সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বললাম, আপনি বসতে পারেন। উনার সঙ্গে কিভাবে কথা বলা উচিত হবে সেটা বুঝে ওঠার চেষ্টা করছিলাম। উনি তখনই বসলেন না। দেয়ালে নদীর ছবি আছে। আঁকা। বরফে জমা কোনো ইউরোপীয় নদী। ওরা হয়ত লেক বলে। উনি সেদিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ।
আমি চা দিতে বলি? উনাকে জিজ্ঞাসা করি।
চা খাই না অনেক দিন হলো। তিনি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন। আমি যে চেয়ারটা দেখিয়ে দিয়েছিলাম তার পাশেরটাতে বসলেন। ওটাতে গদি নেই। শক্ত কাঠের চেয়ার।
আপনি কি বিজ্ঞাপন দিতে এসেছেন?
আমি সরাসরি কাজের কথায় চলে যাই।
না। একটি ঘোষণা। এক ধরনের অনুসন্ধান বলতে পারেন। তিনি বললেন।
কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে আপনি বিজ্ঞাপন দিতে এসেছেন? আমি বলি।
সেটা আপনার পত্রিকার ভাষায় হতে পারে। প্রয়োজনে আমি টাকাপয়সা যা লাগে দিয়ে অনুসন্ধানের বিষয়টি ছাপতে চাই শুনে আপনার অফিসের লোকজন আমাকে বিজ্ঞাপন বিভাগে পাঠিয়েছিলেন।
আচ্ছা, ওরা ভুল করেনি। আপনি কিসের অনুসন্ধানী বিজ্ঞাপন দিতে চান, বলেন? আমি জানতে চাইলাম।
একটি হাতের সন্ধান চেয়ে বিজ্ঞাপন দিতে চাই।
তিনি বলেন কার হাত? আমি কম্পিউটারের কিবোর্ডটা হাতের কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করি।
কার হাত জানা থাকলে তো আর বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রয়োজন হতো না। তিনি নরম স্বরে বলেন।
তাহলে আপনি হাত নয়, একজন ব্যক্তির সন্ধান করছেন? আমি পয়েন্টে আসার চেষ্টা করি।
সম্ভবত—বলে তিনি আস্তে করে মাথা ঝাকান। ঠিক ব্যক্তিও না, আমি আসলে ঐ হাতটির পরিচয় জানতে চাচ্ছি। তিনি কিছুক্ষণ থেমে যোগ করেন।
আচ্ছা। আমি সম্পূর্ণ না বুঝেও বুঝেছি এমন ভান করে উত্তর দিই। তাহলে বিজ্ঞাপনে কি লিখতে চান সে সম্পর্কে কি আপনি কি কিছু ভেবেছেন? জানতে চাই আমি।
একটি হাতের পরিচয় জানতে চেয়ে বিজ্ঞাপন। তিনি বলেন।
এক্ষেত্রে হাতের কোনো বিবরণ দিতে চান আপনি? মানে ফর্সা না কালো, হাতটি লম্বা না মোটা? অন্যান্য কোনো বিবরণ? বিশেষ কোনো চিহ্ন? এই ধরুন কাটার দাগ বা জন্মদাগ জাতীয় কিছু? আমি জানতে চাই।
আমি জানি না ওরকম কিছু ছিল কিনা। তিনি বলেন।
তাহলে চিনবেন কেমন করে কোন হাত সেই হাত?
কোনো উত্তর করেন না তিনি। ফের দেয়ালের ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিছুই দেখিনি আমি। শুধু দেখেছি কটা লম্বা আঙুল আমার বেগুনি পাড়ের শাড়িটা ছাড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন যেন ওখানে কিছু লেখা আছে সেটা পড়ে শোনাচ্ছেন।
তার মানে আপনার শাড়ি কোথাও আটকে গিয়েছিল? একটা হাত সেটা ছাড়িয়ে দিয়েছে? আমি জানতে চাই। এখনো কিছুই পরিস্কার না আমার কাছে।
আমি তারকাঁটা টপকাতে গেলে শাড়ির নিচের দিকটা আটকে যায়। খেয়াল করিনি। লাফ দিতে যাবো তখনই একটা হাত এসে শাড়িটা ছাড়িয়ে দিলো। দেয়ালের ছবি থেকে চোখ সরিয়ে বলেন তিনি। আমি লক্ষ করি তিনি ঘরের ভেতরে আর কোথায় তাকিয়ে থাকতে পারেন সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।
আপনার অচেনা কেউ?
আমি জানি না। তিনি এমন করে উত্তর দেন মনে হয় যেন অন্যকারো সঙ্গে কথা বলছেন।
আপনি তার নাম জিজ্ঞাসা করেননি? খানিকটা বিরক্ত চলে আসে আমার কথায়।
তখন নাম জিজ্ঞাসা করার মতো সময় না। যে যার জীবন নিয়ে পালাচ্ছে।
মানুষটাকে দেখলে কি চিনতে পারবেন?
লাফ দেওয়ার পর পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি কোথাও কেউ নেই। তিনি বলেন। এক চোখের পাতা অকারণে কাঁপছে। অন্যচোখের পাতা স্থির। আমি ভালো কওে চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করি। তিনি আমার মাথার উপর দিয়ে কিছু একটা দেখছেন।
আপনি শাড়ি পরে তারকাঁটা লাফাতে গেলেন কেন? আমি জানতে চাই।
আমরা ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল বের করেছিলাম। ব্যারিকেড ভাঙার সময় পুলিশের লাঠিচার্জে আমার পিঠের দিকটা টনটনে ব্যথায় ফেটে যাচ্ছিলো। টিয়ারশেলে চোখদুটোর অবস্থাও ভালো না। এরপরও পুলিশের সব রকমের বাধা অমান্য করে আমরা অ্যাসেম্বলির দিকে অগ্রসর হই। বলে থামেন তিনি। টেবিলের কাচের নিচে রাখা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন।
তারপর? আমি জিজ্ঞাসা করি। মনে মনে ভাবি মাথায় কোনো সমস্যা আছে কিনা কে জানে!
মেডিকেল মোড়ে আসতেই শুনি গুলির শব্দ। আর কোনো শব্দ শোনা যায় না। একটু পর গুলির সঙ্গে সঙ্গে কতগুলো পাখির উড়ে যাওয়ার শব্দ শুনি। খানিক দূরে মানুষের আর্তচিৎকারের সঙ্গে সুর মেলাতে চেষ্টা করে একটা কুকুর। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর পেছন ফিরে দেখি আমি একা হয়ে গেছি। কেউ কেউ হয়ত গ্রেফতার হয়েছেন, কেউ কেউ গুলিবিদ্ধ। বলে তিনি থামেন। পানির গ্লাসটা হাতে তুলে নেন। মুখের কাছে তুলে কি যেন ভেবে আবার নামিয়ে রাখেন।
আপনি তখন কি ভাবছিলেন? আমি প্রশ্ন করি।
কিছু ভাবার সময় তখন না; আমি বোধশূন্য হয়ে দৌড় শুরু করি। আহত হওয়ার কারণে কিনা ভয়ে জানি না, ঠিকমতো দৌড়াতেও পারছি না। ফের থামেন তিনি। টেনে এমন করে নিশ্বাস নেন যেন অক্সিজেন পেতে তার সমস্যা হচ্ছে।
এসিটা কি বন্ধ করে দেবো? আমি জানতে চাই।
বন্দি বাতাস আমার সহ্য হয় না। জানালাটা খোলা যাবে? মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ আলো দেখিনি। তিনি বলেন।
খুলতে পারি। কিন্তু ওপাশের বিল্ডিং থেকে এসির গরম ভাপ আসে। আপনি চাইলে এসি বন্ধ করে ফ্যানটা ছেড়ে দিতে পারি। আরো দুটো লাইট আছে ঘরে, আলোটা বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। আমার এই কথায় তিনি কিছুটা সময় ভাবেন। চুপচাপ থাকার পর বলেন, চা হবে? অল্প চিনি। একদিন খেলে কিচ্ছু হবে না।
আমি চা আনতে বলি। তখনই কি প্রাচীর টপকাতে গেলেন? আবার মূল প্রসঙ্গে যাই।
গুলির শব্দে যেদিকেই পা বাড়াই মনে হয় গুলিটা ও-পথ ধরেই আসছে। মেডিকেলের মোড়ে শানে পাঞ্জাব রেস্তোরাঁর আড়ালে থামি। গুলি তখনো চলছে। এভাবে পথে থাকলে আমার আর ঘরে ফেরা হবে না—হয় গুলি খেতে নয়তো গ্রেফতার হতে হবে। রেস্তোরাঁর পেছন দিকে ড. গণির বাড়ি। তারকাঁটা দিয়ে ঘেরা। টপকাতে পারলে এ যাত্রা বেঁচে যাই। কিন্তু শাড়ি পরে ওতো উঁচু তারকাঁটা ডিঙিয়ে যাওয়া সহজ কাজ না। শরীরের অর্ধেক শক্তি নেই। চোখেও ঝাঁপসা দেখছি। কানের ভেতর কারা যেন ড্রাম বাজিয়ে চলেছে অনবরত। মনের শক্তিতেই তখন ভরসা। কোনো মতে তারকাঁটার উপরে উঠে লাফ দিয়েছি, শাড়ি গেল আটকে। তিনি থামেন। টানা কথা বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেছেন। চায়ে চুমুক দিয়ে বন্ধ জানালার দিকে তাকান। কিছুটা ক্লান্ত মনে হয় তাকে। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি অনেকক্ষণ। আর কথা বলেন না। এটা সেটা জিজ্ঞাসাও করি, আমার কথা শুনছেন বলে মনে হলো না।
উনি বসে থাকতে থাকতেই বিজ্ঞাপনের সংক্ষিপ্ত একটা খসড়া দাঁড় করিয়ে ফেললাম। কিন্তু সময়টা জানা প্রয়োজন। কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে একটি হাতের সন্ধান করা হচ্ছে কিন্তু সেই ঘটনার নির্দিষ্ট করে দিন-তারিখ উল্লেখ না থাকলে মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারে।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম। আমার চোখের দিকে একবার তাকিয়ে পানির গ্লাসটা হাতে তুলে নিয়ে বললেন, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি।
উৎসর্গ: ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু—সেই হাতের সন্ধান তিনি এখনো পাননি।
0 Comments