আমেরিকার স্পিকার নেন্সি পেলোসি তাইওয়ান সফর এই অঞ্চলে এক ভয়াবহ সংকটের জন্ম দিয়েছে। এই সফরকে চীন স্পষ্ট উস্কানি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অনেকের মনে হতে পারে উস্কানি কেন হবে? তাইওয়ান একটা স্বার্বভৌম রাষ্ট্র; চীনই বরং তাইওয়ানকে দখল করে তার স্বার্বভৌমত্ব অস্বীকার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এখানে তাইওয়ান স্বার্বভৌম রাষ্ট্র কি না, কিংবা চীন তা স্বীকার করে কি করে না, সেটা প্রশ্ন না। প্রশ্ন হচ্ছে, আমেরিকা কি ভাবে তাইওয়ানকে কূটনৈতিক ভাবে দেখবে, এই সফরে সেটা রক্ষা করলো কি করলো না সেটা। শুধু আমেরিকা নয়, জাতিসঙ্ঘ কি ভাবে তাইওয়ানকে দেখে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
চিনের অফিসিয়াল নাম পিপলস রিপাবলিক অব চায়না, আর তাইওয়ানের নাম রিপাবলিক অব চায়না। চায়নার সাথে ১৯৭৯ সালের এক চুক্তিতে আমেরিকা পিপলস রিপাবলিক অব চায়নাকে চিনের একমাত্র আইনি সরকার বলে স্বীকৃতি দেয়। তার মানে হচ্ছে রিপাবলিক অব চায়না বা তাইওয়ান আলাদা কোন দেশ নয়। চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকা সেটা স্বীকার করে নিয়েছে এবং তাইওয়ানের সাথে শুধুমাত্র আনঅফিসিয়াল সম্পর্ক রাখবে বলে প্রস্তাব রাখে। সেটা যদি সত্যি হতো তবে নেন্সি পলোস্কি চীনের স্বীকৃতি ছাড়া তাইওয়ান সফর করতে পারে না। কারণ সে আমেরিকার ক্ষমতা কাঠামোর তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে সফরটা অফিসিয়াল হয়ে যাচ্ছে। চীন আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে "এক চীন নীতি"। "এক চীন নীতি" না মানলে চীন কারও সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে না।
মাও সেতুং এর জীবদ্দশায় ১৯৫৮ সাল থেকে কমিনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে “সাংস্কৃতিক বিপ্লব” নামে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির পথে যাত্রা শুরু করে। এর ফলে চীনে ব্যপক বিদেশি বিনিয়োগের দ্বার খুলে যায় এবং পশ্চিমাদের বিনিয়োগ বেড়ে যায় বিশাল জনগোষ্ঠীর চাইনিজ বাজার ধরার জন্য। তবে এই সুযোগ দেবার আগে পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় চীন আমেরিকার সাথে দরকষাকষি করে। সেই দরকষাকষিতে ছিল জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ কমিনিষ্ট চীনকে বা নয়া চীনকে দিতে হবে। আমেরিকা তাতে ভেটো দিবে না। জতিসংঘের ১৯৭১ সালে যে ভোটাভুটি হয়েছিল তাতে আমেরিকা ভোট দানে বিরত থাকে এবং সদস্য দেশগুলোকে চীনের পক্ষে ভোট দিতে লবি করে। এতে করে চীন জাতিসঙ্গে ভেটো ক্ষমতাসহ সদস্যপদ পেয়ে যায়। কারণ তার আগে আমেরিকা সবক্ষেত্রেই ভোট এবং ভেটো দিয়ে তাইওয়ানকে সমর্থন করত।
এরপর ১৯৭২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন সাত দিনের চীন সফরে গিয়ে সব আলোচনা সেরে আসেন এবং যা ১৯৭৮ সালের ১ জানুযায়ি থেকে নতুন সম্পর্কের যাত্রা শুরু হয়। এবং জাতিসঙ্ঘের সেই স্বীকৃতি থেকে তাইওয়ান চীনের অংশ হয়ে যায়। একেই বলে “এক চীন নীতি”। আর আমেরিকা সেই “এক চীন নীতি”তে স্বাক্ষর করা দেশ। এই চুক্তির কারণেই ১৯৭১ সালে আমেরিকা-চীন বাংলাদেশের বিপরীতে থেকে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল।
পরবর্তীতে আমেরিকা তাইওয়ানের সাথে একটা আন্তঃসম্পর্ক এক্টে স্বাক্ষর করে। যে চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকা তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে পারবে। এমনকি তাইওয়ানের আত্মরক্ষায় সামরিক ভাবেও অংশগ্রহণ করতে পারবে। যদিও আগের চুক্তি অনুযায়ী তাইওয়ানের সাথে শুধু আনঅফিসিয়াল সম্পর্ক রাখবে বলে কথা দিয়েছিল। যদিও ১৯৮২ সালে আমেরিকা এক বিবৃতিতে চায়নাকে আশ্বস্ত করে যে আমেরিকা তাইওয়ানে অস্ত্র বিক্রি বাড়াবে না বরং কমিয়ে আনবে। অন্যদিকে এই বিবৃতির পর তাইওয়ান রুষ্ট হলে তাকে “সিক্স এসিউরেন্স” নামে ছয়টি নিশ্চয়তা দেয় আমেরিকা। সেখানে সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও অস্ত্র বিক্রি চালিয়ে যাবার ইঙ্গিত থাকে।
চলতি মাসে ক্রমবর্ধমান চাইনিজ আগ্রাসনের মোকাবেলার জন্য ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফর করে। বিশ্লেষকরা বলছেন আসলে সামনের মধ্যবর্তী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনে সুবিধা করতেই পোলস্কির এই সফর। কারণ জরিপ বলছে ডেমোক্রেটরা ভালো অবস্থানে নেই। ভোটারদের আস্থা ফেরাতে প্রতিদ্বন্দ্বী চিনের সাথে কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে চাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো চীন কি এনিয়ে তাইওয়ানের সাথে যুদ্ধে জড়াবে? এটা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। চীন খুব সতর্ক ভাবে সামনে এগিয়ে চলছে এবং নিজেদের অর্থনীতি শক্তিশালী করছে। এছাড়া বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বৈশ্বিক যে মন্দাভাব দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে চীন নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী না করে যুদ্ধের মতো খরচে পথ বেছে নেবে বলে মনে হয় না। তবে ইতোমধ্যে তাইওয়ানের সীমানায় চীন সামরিক তৎপরতা দেখাচ্ছে। বিষয়টা এই তৎপরতার মধ্যেই সীমাবন্ধ থাকার সম্ভাবনা বেশি। এই বাইরে গিয়ে এমুহুর্তে যদি চীন যুদ্ধে জড়িয়ে যায় তা হবে অনভিপ্রেত।
0 Comments