আগুন পাখি ।। হাসান আজিজুল হক

 

                            ভাই কাকালে পুঁটুলি হলো

আমার মায়ের য্যাকন মিত্যু হলো আমার বয়েস ত্যাকন আট-ল বছর হবে। ভাইটোর বয়েস দেড়-দু বছর। এই দুই ভাই-বুনকে অকূলে ভাসিয়ে মা আমার চোখ বুজল। ত্যাকনকার দিনে কে যি কিসে মরত ধরবার বাগ ছিল না। এত রোগের নামও ত্যাকন জানত না লোকে। ডাক্তার-বদ্যিও ছিল না তেমন। মরবার আগে মুখে যেদি ওষুধ পড়ততাই কতো! পেরায় পিতি বছর কলেরা-বসন্তেই কতো যি লোক মরততার সীমাসংখ্যা নাই। আমার মা যি কলেরা-বসন্তে না মরে অজানা কি একটো রোগে মারা গেল তাই কত ভাগ্যি!

মায়ের মত আমার পষ্ট মনে পড়ে। এক বাদলের রাত-দোপরে জান গেল। কদবার পয্যন্ত লোক নাই। বাপজি দখিন-দুয়ারি ঘরের উসারায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকলে। তার এক খালা ছিলআমি দাদি বলতমসেই দাদি এসে সব দেখাশোনা করলে। আমার মনে আছেঘরে জ্বলছে রেড়ির ত্যালের পিদিমদেড় বছরের ভাই ঘুমিয়ে আছে অঘোরেগায়ে একটো কাঁথা চাপানো। মাঝে মাঝে ঘরে ঢুকছে বাদুলে হাওয়া। পিদিম নেবে নেবে। তা সকাল না হলে তো করার কিছু নাই। মওতা সারা রাত অমনি করে থাকলেএকটো পুরনো শাড়ি চাপা দেওয়ামুখ মাথা ঢাকা। মনে হছিল দুনিয়ায় আমাদের কেউ নাই। সবই ছিল আমাদেরতবু মনে হছিল

মা মরার পরে ভাইটি সেই যি আমার কোলে উঠল আর তাকে নামাইতে পারলম না। যেখানে যাইসে আমার কাকালে আছে। ইদিকে বাড়ি ফাঁকাদেখার কেউ নাই। অতো বড় বাড়ি! উঁচু-উসারা-অয়লা দখিন-দুয়োরি ঘরটো ত্যাকন করা হয়েছে। তা বাদে বিরাট লম্বা এনেতার দখিন মাথায় আর একটা বড় ঘর। ই ঘরটো উত্তর-দুয়োরি। ত্যাকন ঘরটো পড়ে থাকে। দখিন-দুয়োরি ঘরেই আমাদের ওঠা-বসা। বাপজি ঘরটো বানিয়েছিল খুব যত্ন করে। হোক মাটিরআমাদের দ্যাশের পেরায় সব বাড়িই তো মাটির ঘরটোর মাটির দেয়াল ছিল খুব চ্যাওড়াখরানির কালে ঘর যেন ঠান্ডা হিমঢুকলেই জানটো একেবারে তর হয়ে যেত। ছাউনি খ্যাড়েরগরম হবে কোথা থেকেখ্যাড়ের চালের তলায় কাঠামো ছিল লোহার মতুন কালো কুচকুচে সারি তালকাঠের

তা অ্যাকন আমি বাড়িতে দিনরাত থাকি কেমন করেবাপজি দিনের বেলায় কততক্ষণই বা বাড়িতে থাকত! দখিন-দুয়োরি ঘরের উসারার ছামনেই আঁজির গাছ। ঐ পেয়ারাইআমরা বলতম আঁজির। ই আঁজির গাছটো ঠিক যেন মাহারুহপেল্লায় বড়। পেয়ারা গাছ কুনোদিন অতো বড় হয় না। মণ মণ আঁজির হতেভেতরটা ছিল গোলাপি লাল আর মিষ্টি যেন গুড়। ভাইকে নিয়ে এই আঁজির গাছের তলাতেই দিন কেটে যেত। দখিন-দুয়োরি ঘরটোর ঠিক পেছনেই ছিল আর একটা ছোট ঘর। ঐ ঘরে থাকত আমার ঐ দাদিবাপজির খালা। তিন কুলে কেউ নাই। সোয়ামি-ছেলেমেয়ে সব মরে-ঝরে যেয়ে দাদি একা। ছোট ঐ ঘরে সারাদিন খুটুর খুটুর করে বেড়াত। ঘরের ভেতরটা আঁদারএকটিমাত্র দরজা ঘরে ঢোকার লেগেকুনোদিকে কুনো জানে নাই। ঘরের বাইরে উসারার এক পাশে একটো মাটির চুলো। রান্নাবাড়া সব ঐখানে। ঘরের ভেতরে শুদু হাঁড়ি সাজানো। কালো কালো হাঁড়িবড়-ছোট হিসেব করে একটোর ওপরে আর একটো বসানো। সার সার শুদু হাঁড়িঅতো হাঁড়িতে কি যি থাকত কে জানে! একটো মোটে মানুষকি-ই বা থাকবে?

দাদি আমাকে খুব ভালোবাসত। আমিই বা আর কোথা যাইভাই-কোলে দাদির কাছে কাছেই থাকতম। বয়েস তো ত্যাকন অ্যানেকটোই হয়েছেদাদির এটা-ওটা ফাইফরমাশ খাটতম। কিন্তুক ভাই কি কোল থেকে নামবেসব সোমায় আমাকে আঁকড়ে ধরে আছে। কাকালে আমার ঘা হয়ে গেল। দাদি বুড়ি মানুষ। খুব ফরশামুখে বসন্তের দাগ। অমন মানুষ হয় না। ফল-পাকুড় যা পেত আমার হাতে তুলে দিত। পেরায়ই আমাকে বলতআমার যা আছে সব তোকে দিয়ে যাব। কি-ই বা এমন ছিল তারসেই দাদির দেওয়া বড় একটো কাঁসার জামবাটি এখনো আছে আমার কাছে। দাদির ঐ একমাত্র জিনিশ আজও টিকে আছে

আমার বাপ দাদির ইসব দেওয়া-থোয়া তেমন পছন্দ করত না। খুব রাশভারি মানুষ ছিলকাউকে তেমন গেরাহ্যি করত না। মাহা বেপদ হলেও কাউরি কাছে যেয়ে কিছুতেই কুনো ব্যাগোতা করত না। তাই বলে বাপজির কিন্তুক মেজাজ গরম ছিল না। বরং উল্টোখুব আস্তে আস্তে তার কথা। হড়বড় করে কিছু বলত না কুনোদিন। তেমন একটো হাসত নাতবে ভেতরে ভেতরে মজা ছিল খুব কথায়। তা সি যা-ই হোককে এসে কি হাতে দেবে ছেলেমেয়েরবাপজি তা তেমন ভালোবাসত না। তা বলে কি আপন খালার ওপর রাগ করবেতা লয়

দাদি পড়ে থাকত এক কোণে। এই গতরমিশিমাখা দাঁত। দাঁতে দাঁত দিত যি! কুনো পাউডার ত্যাকন ছিল না। গায়ে-মাখা সাবান তা-ও ত্যাকন তেমন পাওয়া যেত না। দাদি কুনো গন্ধ কি কুনো বাস একটুও সইতে পারত না। বোধায় ফুলের গন্ধও নাকে গেলে থু থু করে থুতু ফেলত। কুনো ভালো গন্ধ কি কুনো বাস যেদি দাদির নাকের ছামনে ধরেছি মজা দেখার লেগেদাদি অমনি কাপড় দিয়ে নাক চেপে ছুটে যেয়ে ঘরে ঢুকত। তা-বাদে শুকুইয়ের হাঁড়ি শুকে তবে তার ধড়ে জান আসত। এমন মানুষের ওপর কেউ কুনোদিন রাগ করতে পারে! আমরা দুই ভাই-বুন ছেলম তার জানের জান। বাপজি তাইলে তার খালাকে আর কি বলবেসে তো নিজেই বুঝতে পারছে যিসোংসার অচল হয়ে গেয়েছে। কে রাঁধেকে খেয়ে দেয়কে ঘর ঝাঁট দেয়সব যি আঁদার। আমি নাইলে এট্টু বড় হয়েছি কিন্তুক ঐটুকু ভাইটিকে কে দেখেকে লাওয়ায়খাওয়ায়?

শেষতক বাপজিকে আবার বিয়ে করতে হলো। লতুন মা এল ঘরে। পাতলা কালো মেয়েআমার চেয়ে সাত বছর বড় হবে। মাথায় লম্বা কালো চুলহেঁটোর নীচে পড়ছে। বড় বড় চোখদুটিতে ভারি মায়া। নিজের মা গেলে কি আর মা পাওয়া যায়! সি কথা সত্যি বটে। মা ফিরে প্যালম না ঠিকইতবে মায়েরই মতুন আর সেই সাথে সখির মতুন একজনকে প্যালম। সংসারে আবার ছিরি ফিরল

কিন্তুক ভাইটি আমাকে ছাড়লেআঁকড়ে ধরে থাকলে। কোল থেকে তাকে আর নামাইতে পারি না। নতুন মা অ্যানেক চেষ্টা করলে ওকে কাছে টানতে। সে কিন্তুক হরগেজ আমাকে ছাড়বে না। খাবে আমার কাছেশোবে আমার কাছে। আমার কাকালে সে যেন সব সোমায়ে একটো পুঁটুলি!

বিছেনা ছেড়ে একদিন আর উঠলে না

দাদি আমার বাপজিকে একটুকুনি ভয়ই করত। যেদি কিছু খেতে দেবেএকটো লাড়ুবাতাসা কি পাটালি কিংবা চিনির কদমাআড়ালে ডেকে নিয়ে যেয়ে লুকিয়ে দিত। লতুন মা য্যাতোদিন ছিল নাবাপজি ত্যাতোটো খেয়াল করত না। সারাদিন বাড়িতেই থাকত নাতা খেয়াল করবে কিলতুন মা এলে বাড়ি আবার ঠিকঠাক হলোঘর-দুয়ারে ঝট পড়তে লাগলঘরের মেজে-দেয়ালে আবার লাতা দেয়া হতে লাগল। লিয়ম ধরে রাঁধা-বাড়া চলল। সসাংসার আবার ঠিক হলে আমাদের হাতে দাদির দেওয়া খাবার-দাবার দেখলে বাপজি যেন অখুশি হতো। তবে ঠান্ডা মানুষ তো! য্যাতেই রাশভারি হোক,চ্যাঁচামেচি কুনোদিন করত না। কিন্তু তার অখুশির কথা বুক যেন ছাদা করে দিত। তা সহ্যি করা খুব কঠিন। আমি জানতম বলেই দাদিকে বলতমসবকিছু আমাদের দিতে যাস ক্যানে দাদি?

তু যি আমার জান বুন। ই দুনিয়ায় আর থাকা কিসের লেগেতিন কুলে আমার কেউ নাই। সোয়ামি নাইপুত নাইমেয়ে নাইভাই নাই। খালি তুই আছিস। আল্লা জানেতুই আছিস তাই আমার দুনিয়ায় থাকা

ই কথার কি কুনো জবাব আছেদাদি যি বলত আমার যা আছে সব তোরতা আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দ্যাখতম দাদির কি আছে। ঐ কেঁদাকাটা আঁদার ঘর আর কালো কালো মাটির হাঁড়ির সার আর তো কিছু দেখি নাই দাদির। তবে দাদি য্যাকন আমাকে বলতআমার জানের জানত্যাকন বোঝতম দাদির জান আছে। ঐ একটো জিনিসই আছেআর সেটা আমার। আঃহায়রেসেই জানটো কি আমার

একদিন ঠিক সকালবেলায়কাক ত্যাকন ডেকেছে কি ডাকে নাইআমি যেয়ে দেখি দাদি ত্যাকননা ওঠে নাই। আমকাঠের ভাঙা দুয়োরটো ঠেসানো। ভাবলম এমন তো কুনোদিন হয় না! দাদি ওঠে সুয্যি ওঠার আগে আঁদার থাকতে। ই কেমন কথা হলোআমি যেয়ে দরজাটো ঠেলা দিয়ে খোললম। ঘর আঁদার। ঘরের ভেতরে কিছুই দেখা যেছে না। তাপর একটু একটু আবছা দেখলম খেজুরপাটির ওপর কাঁথার বিছেনায় দাদি শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে ডাকলমঠ্যাললমসাড়া দিলে না। ত্যাকন আমি চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠলম। দাদি আর বিছেনা ছেড়ে উঠলে না। মরে কাঠ হয়ে আছে!

বাপজির খালা য্যাকনত্যাকন দাদির লিশ্চয় অ্যানেক বয়েস। তা কতে হবেকে বলবে সি কথাত্যাকনকার দিনে লোকে নিজের বয়েস জানত না। মরা নিয়ে কারও কুনো ভাবনা ছিল না। মওত ত্যাকনকার জ্যান্ত মানুষের পেছু পেছু ঘুরে বেড়াত। বয়েসের কথা ভেবে আর কি হবেতবে মনে হয়,অ্যানেক বয়েস হয়েছিল দাদির। চার-কুড়ি বছরেরও বেশি হবে

দাদি চলে গেল যেন দুনিয়ার সব গাছের পাতা শুকিয়ে ঝরে গেল। আবার দাদি নিজেও কতোদিন বাদে শুকনো পাতার মতুনই কোথা হারিয়ে গেল! অ্যাকন আর কিছুই মনে পড়ে না। তবে বুকটোকে চিরলে সোনার পিতিমে আমার দাদিকে আজও দেখতে পাওয়া যাবে লিশ্চয়। কোথা দাদির কবর অ্যাকন আর কেউ জানে না। আমিও জানি না। অথচ আমি ঠিক জানতম কবরটো কোথা। কিন্তুক সি জায়গায় গেলেও অ্যাকন আর বলতে পারব না

বাপজি ছেলেমেয়ে ঘর-সংসার কুনো কিছুকে যি ভালোবাসত তা চোখে দেখতে পাবার উপয় ছিল না। কুনোদিন বাপজির কোলে উঠেছি বলে মনে পড়ে না। গায়ে মাথায় হাত দিলে কি দুটো মিষ্টি কথা বললেকখনো এমন দেখি নাই! কথাই তো বলত কম। মা য্যাকন গেল ত্যাকন তো আমি বেশ বড় হয়েছিকই বাপজি তো একবারও কাঁদলে নাচোখ থেকে দু-ফোটা পানি ফেললে নাত্যাকনকার ভাবই ছিল এইরকম। বউ মরলে কাদলে সেই পুরুষের খুব নিন্দে

মনে পড়েঘরের ভেতর ছেঁয়া-ছেঁয়া আঁদারে বাপজি খালি গায়ে খেতে বসেছে। পরনে শুদু একটো ধুতি পরা। বেরাট মানুষফরশা ধপধপে গায়ের রঙ। বেরাট কাঁসার থালায় ঝিঙেশাল চালের ভাতবড় বড় কঁসার বাটিতে নানারকম তরকারি। মাছ-গোশতো ত্যাতে লয় কিন্তুক। সব শ্যাষে জামবাটি ভরা ঘন দুধকলা আর আখের গুড়। বাপজির গায়ের বলও ছিল তেমনি। এই নিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে কতো গপ্পো! অত বলকিন্তুক কুনোদিন একটি লোকের গায়ে হাত তোলে নাই। জেনে-শুনে একটি পিপড়ের ক্ষেতিও করে নাই। কুনোদিন কুনো মানুষকে একটো অকথা-কুকথাও বলে নাই। তবু কত যি কথা ছিল তাকে নিয়ে। একবার একটো আখমাড়াইয়ের কল দশজনা মিলে সরাইতে পারছে না। যিখানে আখমাড়াই হবেসাল হবেগুড় উঠবেসি তত বছরের একটো উচ্ছবই বটেকলটোকে গরুর গাড়িতে তুলে সিখানে নিয়ে যেতে হবে। ঐ কল পুরোটা লোহা দিয়ে তৈরি। চার ধারে শুদু চারটে শালকাঠের পায়া। দশজনায় সি কলটোকে কিছুতেই জুৎ করতে পারছে না। দেখতে দেখতে বাপজির কি যি হলোআস্তে আস্তে বললেসন্ দিকিনি তোরা। এই বলে একাই সেই লোহার কল সাপুটে ধরে মাটি থেকে চাগিয়ে তুলে ফেললে। এই আচ্চয্যির কথা এখনো সবাই বলে

ইদিকে ল্যাখাপড়া জানা মানুষবাংলা জানতফারসি জানত। গাঁয়ে ত্যাকন পাঠশালা হয়েছে বটে কিন্তুক বাপজি কোথা থেকে ওসব শিখেছিলতা জানি না। ল্যাখাপড়া শেখার লেগে ত্যাকনকার দিনের মানুষ কোথা কোথা সব চলে যেত। বাপজি-ও লিশ্চয় কোথাও যেয়ে শিখেছিল ল্যাখাপড়া। ফারসি বয়েত বলত মাঝে মাঝে আর একটো বাংলা শুভঙ্করি বই লিখেছিল। ইসব অ্যানেকদিন দখিন-দুয়োরি ঘরের চ্যাঙরিতে টাঙানো ছিল। পরে আর দেখি নাই

জমিজমা আমাদের বেশ ছিল। খাওয়া-পরার অভাব হতো না। কিন্তুক ঐ জমিই সবআর কিছু নাই। কঠিন চুম না করলে কিছুই পাবার উপয় ত্যাকন ছিল না। জান-পরান দিয়ে খাটলে ভাতের অভাব নাই। নিজে খাওগরিব-দুখিকে দাও। নুন আর মশলাপাতি ছাড়া কিছুই তো কিনতে হতো না। পরের কালে দেখলম কেরাসিন কয়লা আর মিলের শাড়ি কিনতে হতো

আমাদের ছেলেবেলায় ধুতি আর শাড়িও কিন্তুক তাঁতিবাড়িতে কিনতে পাওয়া যেত। ই কথার মানে হচে,কম-বেশি জমি যার আছে তার সব আছেতার আর কুনো ভাবনা নাই। সবরকম আনাজপাতিচাল-গম-আটাতেল-ডাল-গুড়মিষ্টি-দুধ-দই-ছানা কিছুর অভাব নাই। তবে গরিবের অভাব সব কালে। জমি-জিরেত না থাকলে উপোস না করে কি উপয়তবে একটা কথা না খাটতে পারলে তোমার শত জমিজমা থেকে কিন্তু কিছু পাবে না। তা তুমি নিজেই খাটো কি মুনিষ-মাহিন্দার খাটাও

বাপজি সব কাজ জানত। এমন কাজের লোক আমি জেবনে দেখি নাই। ই কি আচ্চয্যিহ্যানো কুনো কাজ নাই যা বাপজি পারত না। চাষবাসের য্যাতো কাজজমি চষারোয়ানিড়ননাধান কাটাগম কাটাঝাড়ামরাই তৈরি করাইসব কাজ তো বটেইজাল বোনামাছ ধরাবাঁশের কাজকাঠের কাজবিশ্বসসাংসারের সব কাজ তার জানা ছিল। তা বলে সব কাজ কি নিজে নিজে করততা লয়। বরঞ্চ আয়েশিই ছিল খানিকটা। ডালপালায় বড় বংশআদ্দেকটো গাঁই আমাদের জ্ঞাতিগুষ্টি ভাই-ভায়াদে ভরা। আর তেমনি দাপট। জমিসম্পত্তি বিস্তর। বড় বড় পুকুরদিঘি ইসব ছিল। সব জমি চাষ হতো নাপড়ে থাকত। গরু-মোষ চরার লেগে জমিভাগাড়ের লেগে আলাদা জমি সব ছিল

বাপজির ভাইদের সব আলো আলেদা সংসারআলো আলেদা বাড়ি। দলিজ খামার সব আলেদা ইয়াদের মধ্যে বাপজির বড় ভাইআমাদের দেড়েল চাচার কুনো সংসার-ছেলেমেয়ে ছিল না। তার কি নোম্বা-চওড়া চেহারা! ভয়ে মুখের দিকে চাইতে পারতম না। মুখভত্তি সফেদ পাকা দাড়ি নাভির নীচে এসে পড়ত আৰু তেমনি ঘের সেই দাড়ির। চোখ আর কপাল বাদ দিলে মুখের! কুনো জায়গা বাদ ছিল না আর তেমনি ঘন নোম্বা গোঁফ। হাঁ-মুখটা দেখতেই পাওয়া যেত। বাঘের মতুন গলার আওয়াজ। আমরা ভেজা দুরের কথাগাঁয়ের কুনো মানুষ তার ছামুতে দাঁড়াইতে পারত না। তা দেড়েল চাচাও কম কথার মানুষচিৎকার চ্যাঁচামেচি কুনোদিন করে নাই। বুজুর্গ মানুষকটো পুঁথিও লিকিনি লিখেছিল। তাকে আমরা দেড়েল চাচা কলতম ক্যানেচাচা য্যাকন পেশাব করতে বসন্তদাড়ি এসে পড়ত ডুয়ে। সেই লেগে দু-হাতে দাড়ি গোছ করে ধরে ডান বগলে ভরে তবে পেশাব করতে বসতে পারত

দেড়েল চাচা কুনোদিন বাড়িতে ঢুকত না। বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে মসিদ দিঘির দখিন পাড়ে আমাদের দলিজ ছিল। সেই দলিজেই থাকত চাচা। দলিজটো উত্তফ্র-দক্ষিণে নোম্বা। মাটির দেয়াল আর টিনের চাল। তাতে তিটো ঘর। দখিন দিকের ঘরটো এমনি পড়ে থাকত। বাকি ঘরটোয় মেহমান কিংবা বিদেশী কেউ এলে থাকতাআর উত্তর দিকের ঘরটোয় থাকত দেড়েল চাচা। একটো তক্তপোেশচাচার বিছেনাবালিশ। এক পাশে কাঠের চৌপাইয়ের ওপর ফরসিকো। ইয়া নোম্বা তার নল। ভুরভুরে গন্ধময়লা অম্বুরি তামুক দিয়ে কঙ্কে সাজিয়ে আগুন ধরিয়ে সেই ফরসি দেওয়া হতো দেড়েল চাচার হাতে। দেড়েল চাচা রাত-দিন ভুরুক ভুরুক তামুক টানতম-ম গন্ধোয় ভরে যেত খানকা। খানকার বাঁ দিকে বেরাট মসিদ দিঘিতার পচ্চিম-পাড়ে ভাঙা কিন্তুক পাকা মসিদ। পুবদিকটো একদম খোলা। বাঁ দিকে খানিকটা দূরে খাঁ-দের খামারের ঘরদুয়োর খানিকটো দেখা যেত

ঘরের ভেতর পুবমুখো বসে দেড়েল চাচা ফরসিতে তামুক টানছে। দোপরবেলায় দস্তরখানা কাঁধে ফেলে খাঞ্চা করে ভাত-তরকারি নিয়ে যেছে আব্যশ চাকর। রেতে খাবার নিয়ে যেচে ঐ আব্যশই। দিনে-রেতে আর কুনো লোকই চাচার কাছ ঘেঁসতে সাহস পেত না। সি একটু কেমন বেপার নাআবার কথা শোনো। ক ক রোদে কাকপক্ষী নাইগরম হাওয়ায় ধুলোয় দম আটকিয়ে যায়এমন সোমায় কোন্ গাঁয়ের কোন্ বেল্লিক ছাতা মাথায় দিয়ে দলিজের ছামনে দিয়ে যেছে। দেড়েল চাচা শুদু হেঁকে উঠলেকেকে যায়আবশধরে নিয়ে আয় তো! দেখি কোন্ লায়েক ছাতা মাথায় আমার খানকার সামনে দিয়ে যায়। বেয়াদপ!

আর বলতে হতো নাছাতামাতা গুটিয়ে সি লোক তো ভয়ে কাপতে শুরু করত। লোকে বলতআমাদের দেড়েল চাচা কামেল মানুষ ছিল। কেউ বলতদু-দুটো জিন তার ফরমাশ খাটত। আমরা সিসব জানি না। তার ছামনে পড়তম না কিছুতেই। দেড়েল চাচার মওত হলে ঐ দলিজের উত্তর দিকেই পুকুরের পাড়ে তার মাটি হয়েছিল। কেন যে গোরস্থানে হয় নাই তা আমরা কেউ জানি না

যাকগোভাই-বেরাদরে বিরাট এই বংশ। কাউরির সাহস ছিল না একটো কথা বলে। কিন্তু বাপজি নিজে কাউরির সাথে মাখামাখি পছন্দ করত না। ভাইচাচাতো ভাইদের সাথেও না। মা মরার পরে বিয়ে আবার করলে বটে তবে ঐ একলা স্বভাবটা ঠিকই রইল। বিয়ের কিছুদিন পর লতুন মায়ের প্যাটে আবার একটো ভাই হলো আমাদের। তারপরে হয়েছিল আরও তিন বুন। লতুন মায়ের মতুন ভালো মানুষ দুনিয়ায় দেখা যাবে না। সব দিকে নজর তার। তবে সবচাইতে বেশি নজর আমার আর আমার ছোট ভাইটোর দিকেতার পরে তার নিজের ছেলেমেয়ে। কালোপানা মানুষটির চেহারা-ছবি যেন পটে আঁকা। আর কি যি তার হাতের গুণ! ঐ হাতের রাঁধা যে একবার খেয়েছেসে কুনোদিন ভুলতে পারবে না। মাটির ঘরের দেয়াল কেমন করে যি লেপতসি আর কেউ পারবে না। গরুর গাড়ি করে লাল মাটি আনিয়ে রাখত এরোলের মাঠ থেকে। সেই মাটি দিয়ে ছোট ছোট ম্যাঘের গায়ে ম্যাঘের মতুন দেয়াল লেপত। ঠিক যেন লাল কোদালে কুড়ুলে ম্যাঘের আসমান

লতুন মায়ের খোঁকাটি জন্মানোর পরেই দু-কোশ দূরের আমার নানার বাড়ির গাঁ থেকে মামুরা এসে বললেএক মেয়ে এক ছেলে রেখে আমাদের বুন মরতে না মরতে দামাদ-ভাই আবার বিয়ে করেছে। সি ভালো কথালতুন খোঁকার জন্ম হয়েছেসি-ও ভালো কথাতবে আমরা আমাদের ভাগ্নেকে নিয়ে যাব,তাকে মানুষ করব। ভাগ্নিটো এখানে থাক্। তার মানে হচেআমার মায়ের প্যাটের ভাইটোকে মামুরা নিয়ে যাবেআমি বাপের সোংসারেই থাকব। আমার দু-তিন মামু ত্যাকন বেঁচেখালারাও আছেনিজের নানা আর ত্যাকন বেঁচে নাই। তাদের আবস্তা তেমন ভালোও লয়মন্দও লয়। বরং এট্টু গরিবই বটে। তবে নামকরা বড় বংশচাষাভুষাে লয়। নিজের হাতে চাষবাস কেউ করে না। কেউ পাঠশালে মাস্টার,কেউ মক্তবে ওস্তাদজিবিদ্বেনবংশ আর কি! কেউ কেউ ছিল অকম্মাই গাঁ উ গাঁয়ের দিঘিতে মাছ ধরে বেড়াত সারা বছরকেউ পুঁথি লিখতকারুর শখ ছিল নানারকম তামুক খাবার। কতরকম তামুক আর কতোরকম তার সরঞ্জামসি আর কি বলব! মেয়েদের তো রাঁধাবাড়া আর ছেলে মানুষ করা ছাড়া আর কুনো কাজ ছিল না। বিয়ে আবার সব ঘরে ঘরে মেয়েরা কেউ বংশের বাইরে যায় না। বাইরের মেয়ে কেউ আসেও তেমন। মোসলমান মিয়ে মোকাদিমদের মদ্যে এইরকমই চল ছিল

তা আমার ভাইটিকে নিয়ে যাবার পেস্তাব য্যাকন করলেবাপজি একটো কথা বললে না। তার স্বভাবই ছিল ঐরকম। ছেলে নিয়ে যাবি যা। আমার সোংসারে মানুষ হবে নাখেতে পাবে না মনে করছিসকর গা। এমন চাপা মানুষএ কথাগুনোও বললে না। শুদু বললেআমার ইখানে কুনোদিন ভাতের অভাব হবে না। তবে সৎ-মায়ের কাছে ভাগ্নেকে রাখতে চাও নাআমি কিছু বলব না। যা করার তোমরাই করবেছেলের কাছ থেকে আমার কুনো পিত্যেশ নাই

সত্যিই আমার কাকাল থেকে ভাইটিকে ছিড়ে নিয়ে চলে গেল মামুরা। বাপজি ঘর থেকে কোলে নিয়ে ঝর ঝর করে চোখের পানি ফেললে

ভাইকে নিয়ে মামুরা চলে গেল

 

আমার বিয়ের ফুল ফুটল

দাদি ত্যাকন আর নাই। ভাইটিও কাছে নাই। লতুন মা-ই তার নিজের খোঁকাটিকে দেখেআমাকে তেমন আর ওকে নিয়ে বেড়াতে হয় না। এই করতে করতে একদিন আমি হঠাৎ কেমন করে যি বড় হলোমতা নিজেই জানতে পারি নাই। কবে একদিন ফালি ছেড়ে মোটা তাঁতের শাড়ি ধরেছি। তাঁতিবাড়ি থেকেই পাওয়া যেত ত্যাকনকার দিনে শাড়ি ধুতি। শাড়ি ধরার পর আর তেমন বাড়ির বাইরে যাই না

পুকুর-ডোবা গাছপালা আর পাঁজর-বেরুনো মাটির বাড়ি দেখে বোঝা যেত আমাদের গাঁ-টো খুব পুরনো। পাকা সয়রান হয়েছিল এই সিদিন যুদ্ধর সোমায়। দিনে দুটোসকালে একটো আর সাঁঝবেলায় একটো-এই দুটো মটরগাড়ি যেত ঐ পাকা রাস্তা দিয়ে।ইছাড়া সারাদিন শুনশানগাঁ-টোকে মনে হতো ই দুনিয়ার লয়। আমি তো চিনি গাঁ-টোকে! গেরস্ত বাড়ির ছামনে অত বড় পাকুড়গাছই কি অলক্ষুনে লয়পাকুড়গাছ থাকবে মাঠের মাঝখানেনাহয় গাঁয়ের মাঝখানটোয়যেখানে লোকজন এসে বসবেতামুক খাবেতা লয়পাকুড়গাছমাহারুহ গাছবাড়ির এগৃনের ওপর। ই অলক্ষুনে লয়কাকচিল তো বসছেই,শকুনিও এসে বসছে। মরা গরু-বাছুরের হাড়বেড়াল-কুকুরের ছেড়া চামড়া এইসব পড়ছে বাড়ির এগনেয়। ভিন পাড়ায় যাবার সোমায় বেলগাছের মাথায় দুটো শাকচুন্নিকে আমি অ্যানেকদিন দোপরবেলায় পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখেছি। কারুর বাড়ির মাছভাজা খাবার যুক্তি। ই গাঁয়ের বাতাসটোই এমনি। মাঠের বড় পুকুরটোর ধারে প্যাক্তা তত যে খুশি দেখতে পেত সাঁঝবেলাটা পার হলেই। লোকে ইসব জানত। তবে এদের ঘরের লোক বলেই মনে করত। লোকে যেন মনে করত মানুষ দুরকমমরা মানুষ আর জ্যান্ত মানুষ। একসাথে তো থাকবেই। যেসব জ্যান্ত মানুষ ঘরে-বাইরে ঘুরে বেড়াইছেতাদের মদ্যে দু-একটো মরা মানুষ যি নাই তা কে বলবেচেনবার তো বাগ নাই। কি রূপ নিয়ে কার ভ্যাকে জ্যান্ত মানুষের সাথেই যি জিন-ভূত আছে তা কেউ বলতে পারবে না। আমার ছোট মামুর ঘরেই একটো জিন থাকততার কথা আমি নিজের কানে শুনেছি। সে ছিল ভালো জিনবাড়িতে হঠাৎ মেহমান এলে সরু গলায় ক্যান ক্যান করে বলতউসারায় তক্তপোশে মিষ্টি আছে দ্যাখো গা। বাড়িতে অমুক এয়েছেমিষ্টি লাগবে না?

মিষ্টি লাগবে তো আপনি আনতে গেলেন কেনমামু জিজ্ঞাসা করলে

বাড়িতে মেহমান এলে মেহমানদারি করতে হয়মেহমানের খেদমত করতে হয়

তা তো হয়তা আপনি কোথা থেকে কার মিষ্টি নিয়ে এলেন?

আমরা জিনআমরা সব পারি

কার না কার মিষ্টি এনেছেনদাম দিয়েছেন?

আমাদের দাম দিতে হয় না

মামু মক্তবের ওস্তাদজিএট্টু রাগ করে বললেআর কোনোদিন আনবেন না

টিনের চালে ত্যাকন খুব শব্দ হতে লাগলজিন-ও রেগেছে বুঝতে পারা গেল। তা সি যাকগোলোকে জানে নাআমরা জানি যি রাতদোপর আর দিনদোপর একরকমকুনো তফাত নাই। নিশুতি রাতদোপর যেমন ছমছম ছমছম করেদিনদোপরও তেমনি। পেত্যয় হলে জষ্টি মাসের দোপরবেলায় ত্যাকনকার দিনের গাঁয়ের ভেতরে ঢুকতে হবে। দোপর ঠিক নিশুত রেতের মতুন। সারা গাঁ খাঁ খাঁ করছেরাস্তায় একটি লোক নাইকুনো পেরানির সাড়া-শব্দ নাইগরুর গোয়ালের আঁদার মাচান থেকে উই যি গাওড়া খটাশটো রাস্তায় গরম ধুলোর ওপর দিয়ে বাপ বাপ বলে ডাকতে ডাকতে যেচে কে বলবে ওটো খটাশ লয় আর কিছুআর ঐ যি গাঁয়ের ই কোণে উ কোণে একটো-দুটো পুরনো মাটির ঘর ছিল যিগুনোয় কুনো মানুষ বাস করত নাআলকাতরা মাখানো আমকাঠের দুয়োর শেকল-তালা দেওয়া থাকতঐ ঘরগুনো কি একদম ফঁকাদেয়ালঘেরা এগনেঘরের পিড়ে কি একদম শুন্যিতা লয়তা লয়। ঐসব ভিটে ঐসব ঘর ক্যানে ছেড়ে যেত লোকেতা কেউ বলতে পারবে না

আবার এই একই গাঁয়ে সকালে কিংবা বৈকালে যাওকি সোন্দর! মানুষ যেচে-আসচেকথা বলছেছেলে-পিলেরা খিলখিলিয়ে হাসছেপাড়ার মেয়েগুনো অমনিই কুনো ভিটেতে ঝাল-ঝাপটি খেলছেকোথা ভূতকোথা জিনকেউ কোথাও নাই। বিহানবেলায় কোদাল কাধেগরু-মোষের লাঙল নিয়ে জোয়ান মরদ ছেলে-ছোকরারা মাঠে যেচেওস্তাদজি পোক্কার একটো খাটো ধুতি পরে মোটা পাঞ্জাবি গায়ে পাঠশালে যেচেকচি কচি ছেলেরাও যেচে পাঠশালে। কি সোন্দর! তাই বলছেলম একই গাঁতার কতোরকম রূপ

আমি কিন্তুক একদিনও পাঠশালে যাই নাই। বাপজি যেতে দেয় নাই। মেয়ে আবার পাঠশালে যেয়ে ল্যাখাপড়া শিখে কি করবেখানিকটো বেয়াদপ হবেমুখের ওপর কথা বলবেএই তোএর লেগে পাঠশালে পড়ার কি দরকারএইরকম দিন যি ছিল একদিনঅ্যাকন আর আমারও পেত্যয় হয় না। ত্যাকন লোকের কুনো নড়াচড়া ছিল না। কেউ কোথাও যেত না। সারা জেবন সবাই একসাথে থাকত। গাঁ থেকে এক কোশ দূরেও কেউ যেত না। মাঠের জমিধানফসলআবাদপুকুর ঘুরে যে যেখানেই যাকঠিক সাঁঝের বেলায় ফিরে আসবে-ইয়ার কিছুতেই বে-লিয়ম হবে না। ক্যানে যাবে মানুষ! হাটে যেতে হতে পারে কুনোদিনগরুর গাড়িতে ধান বেচতে যেতে পারে গঞ্জে কিংবা মোকামেনাহয় কুটুমবাড়ি যেত দু-চার গা পেরিয়ে। ল্যাখাপড়া শিখে কি করবে গাঁয়ের মানুষবাপজি তাই মনে করত কার লেগে ল্যাখাপড়া রে বাপু!

তা পাঠশালে তো গ্যালম নাতাই বলে বয়েস কি বসে থাকবেহঠাৎ একদিন শুনতে প্যালম আমার বিয়ের সম্বন্ধ এয়েছে। ত্যাকন আমার বয়েস চোদ্দ কি পনেরো। ত্যাকনকার দিনের হিসেবে অনেক বয়েস। এই আমাদের বয়সের মেয়েদের কুনো একটা ভুল হয়ে গেলে মা-চাচিরা বলতশরম লাগে না ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতেবিয়ে হলে এতদিনে যি দুই ছেলের মা হতিস। তাইলেআমার বিয়ের সম্বন্ধ যি এল তা আর আচ্চয্যির কথা কিসম্বন্ধ এলকথাবাত্তা হতে লাগল কিন্তুক আমাকে কেউ একটো কথাও শুদুলে না। শুদুবেই বা ক্যানেই ব্যাপারে আমার তো কুনো কথা নাই। মুরব্বিরা যা করবে তা-ই হবে। তারা যেদি মনে করে একটো কলাগাছের সাথে আমার বিয়ে দেবেআমাকে তাই মানতে হবে। এইরকমই ছিল ত্যাকনকার দিন। ছেলে হয়তো ত্যাতোটা লয়মেয়ে হলো বাপের আঘিন্নে দায়। বাপ যেদি মনে করে মেয়েকে কেটে পানিতে ভাসিয়ে দেবেতাতে কারু কিছুই বলার নাই। সেই লেগে বলছি,মেয়ে ই কথা শুদুতেই পারবে না যি কার সাথে তার বিয়ে হচে। রূপ-গুণের কথা দূরে থাকপাত্তরের বয়েসটোও শুদুতে পারবে না। বুড়ো হোকধুরো হোকমেয়েকে মেনে নিতেই হবে। ষাট বছরের বুড়োর সাথে পনেরো বছরের মেয়ের বিয়ে ত্যাকনকার দিনে আকছার হতো। দোজবরে তেজবরে হেঁপোরুগি মাতাল চোয়ার কাউরির বিয়ে করার লেগে সোন্দর মেয়ের অভাব হতো না। সিদিক থেকে আমার তো মাহা কপালের জোর যি শোনলমপাত্তরের বয়েস মাত্তর এক কুড়ি আট বছর। ইয়ার চেয়ে ভালো যোগ ত্যাকনকার দিনে আর কিছু ছিল না। হলোই বা আমার দ্বিগুণ বয়েস বিয়ে যে হচে এই পরম ভাগ্য! অ্যাকনকার দিনে ছেলে পেথম বিয়েই করছে দু-কুড়ি বছর বয়েসে। তাতে কুনো দোষ নাই

শোনলম চার কোশ দূরের এক গা থেকে সম্বন্ধ এয়েছে। একটু দূর হয়ে যেছে বটে তবে মটরে আর র্যালে খানিকটা রাস্তা যাওয়া যায়। শুকনো দ্যাশ তোগরুর গাড়িতে মাঠে মাঠে একবেলার মদ্যেই যাওয়া যাবে। তা দূরেই হোক আর কাছেই হোকই সম্বন্ধ ছাড়া যাবে না। নামজাদা বেরাট বংশআবস্তাটো অ্যাকন একটু পড়ে এয়েছে বটে কিন্তুক ভাত-কাপড়ের অভাব কুনোদিন হবে না

আমি শুদু এইটুকুই শোনলম। পাত্তর কেমনকি করে ইসব কথা কেউ তুললেও নাআমিও আর কিছু জানতে প্যালম না! ত্যাকন কি আর জানি এমন সোয়ামি আমার কপালে ছিল। ছিপছিপে ছোটখাটো শামলা রঙের মানুষআসমানের বাজের মতুন শক্ত। তবু সে সোনার মানুষ। কিন্তুক আমার লেগে মুটেই লয়আর সবার লেগে। মা-বাবাভাই-বুনআত্মীয়স্বজনের লেগেই শুদু লয়সারা দিগরের মানুষের লেগে। আমার কথা আর কি বলবআমাকে সে সারা জেবন হেনস্তা করেছেকতো কুবাক্যি বলেছেহাত ধরে ঘর থেকে বার করে দিতে চেয়েছেতবু আমি মনের ভেতরে ঠিকই জানি ভেতরে ভেতরে কি সনমান সে আমাকে দিয়ে গেয়েছে। কিন্তু সে শুদু ভেতরে ভেতরেনাইলে তামাম লোকের ভালো করবেশুদু আমার দিকে চেয়ে দেখবে না

বিয়ে হয়েছিল বৈকালি। সাঁজ রেতে একসাথ করা হলো। তা শেষ হতে না হতে লোকজন নিয়ে পালকি করে নিজের গাঁয়ে ফিরবে। একবার কি দুবার বলার পর আর কারুর সাধ্যি হলো না রাতটো থেকে যেতে বলতে। হাজার হলেও মাঠ ভেঙে পালকি নিয়ে এই এতটা পথ যেতে হবে। দিনকাল ভালো লয়সঙ্গে সোনাদানা আছেবেপদ হতে কতোক্ষণ?কুনো কথাই সে কানে তুললে না। সঙ্গে কজন লেঠেল আছে আর বাউরি কাহাররা তো সবাই লেঠেল। ভাবনা কিছু নাই। মিশমিশে আঁদার রেতে মিশমিশে কালো চার মুশকো বাউরি কাহার বাতাসের বেগে পালকি নিয়ে ছুটল মাঠের ওপর দিয়ে। কাহারদের হাতে এই বড় বড় লাঠিএক একজনা যমদূতের মতুন। কে তাদের ছামনে দাঁড়াবেসঙ্গের বরযাত্রী লোক-লস্কর সেই আঁদারেই তাদের সাথে সাথে ছুটল। খালি একজনার হাতে একটা ডেল্লাইটের আলো

লতুন মায়ের ত্যাকন আবার ছেলেপুলে হবে। এইটুকুনি মানুষ। তেমন লড়তে-চড়তে পারছে না। ইয়ার মদ্যে তার এক খোঁকা হয়েছে। লিয়ম মতুন লতুন মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলে। আমিও কদলম। এইরকমই লিয়ম ছিলগলা জড়িয়ে কাঁদতে হবেনাইলে নিন্দে হবে। তবে কেউ কাঁদত লিয়ম মতুনএকটু হুঁ হুঁ করলেফোঁ ফোঁৎ করে মিছে নাক ঝাড়লেআবার কারু কারু বুকের কবাট ফেটে যেত যেন। আমার ঠিক তা-ই হলো। এই মাএই ভাইএই বাড়ি-ঘরঘাট-পুকুরএই আসমান-জমিনসব ছেড়ে চেরকালের লেগে বিদেয় লিছি। কতো কথা মনে পড়ছে। কোথা থাকল মাকোথা থাকল বাপকোথা থাকল ভাই! লতুন মা আওয়াজ করে কাঁদতেও পারলে না। পেটের ভারে সে ত্যাকন হাঁসফাঁস করছে। গড়গড়িয়ে চোখে পানির ধারা নামল

বছরে দু-মাস করে আমার কাছে থাকবি। আমি নিয়ে আসব

তা মনে হয় আমার বিয়ের পর থেকে শেষ ছেলেটো হওয়া পয্যন্ত এই লিয়মের তেমন লড়চড় হয় নাই। ঐ মা যি আমাকে আমার নিজের মায়ের শোক ভুলিয়ে দিয়েছিল!

ক-দণ্ডের মদ্যে সেই রেতে রেতেই কাহাররা বিয়ের পালকি পৌঁছে দিলে আমার শ্বশুরবাড়ি। আমি আমার জন্মস্থান থেকে চেরবিদায় লেলম

 

মাটির রাজবাড়িতে আমার আদর

বিহানবেলাতেই আবার বাউরি কাহাররা এল। পালকি সাজাতে লাগলে তারা। আমাকে রাজবাড়িতে নিয়ে যাবে। সি আবার কি বেপার! কেউ কিছু বলে না আমাকে। লতুন বউশুদুবই ঝ কাকেশ্যাষে কত্তা এসে ঘরে ঢুকে ঘাড়টো একটু অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললেরাজবাড়ি গাঁয়েই বেশি দূরে নয়। এপাড়া থেকে ওপাড়া। কিন্তু গরুর গাড়িতে সেখানে গেলে মান থাকবে না। পালকিতেই যেতে হবে তোমাকে। গয়না যেখানে যা আছে সব পরো। বিয়ের লাল বেনারসিটা পরে নতুন বউ সেজেগুজে যেতে হবেবুঝেছএরা রাজার আত্মীয়

কত্তা ঐ বাড়িতে ছেলের মতুন। সেই লেগে নতুন বউ দেখাতে নিয়ে যাওয়া হচে। এই আমি পেথম কত্তাকে কাছ থেকে ভালো করে দেখলম। কেমন পোষ্কার কথা! তেমন করে কথা আমি তো এ জেবনে আর কাউকে বলতে শোনলম না। আমাদের মতুন গেঁয়ো ঘড়ে কথা কুনোদিন তার মুখে শুনি নাই। ইদিকে আবার সহজ মানুষ। হায়ত্যাকন কি আর জানিঐ সহজ মানুষ কি কঠিন মানুষ

পালকি তুললে কি হিঁদুপাড়ায় এক বাড়ির সিং-দরজায় নামালে। পালকিতে বসেই দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলম দু-তিনটে বড় বড় বাঁধা ঘাটঅয়লা পুকুরের ঘাস-ঢাকা পাড় আর বড় বড় বিরিক্ষের পাশ দিয়ে লহমার মদ্যে পালকি এক বেরাট দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কত্তা কিন্তুক হেঁটেই একটু আগে সেখানে হাজির। আমি পালকির ভেতর থেকে চোখ তুলে যাকে দেখতে প্যালমসাথে সাথে বুঝতে পারলম সে-ই হলো ই বাড়ির গিন্নি। খুব ফরশা মোটা মানুষবেশি নোম্বা লয়। বয়েস হয়েছেসেই লেগে কোমর অ্যানেকটো পড়ে গেয়েছে। এই ভেরোলো মুখচাইতে ভয় লাগে। মাথায় ছোট ছোট শাদা চুল। মোটা কুঁজো মানুষ আবার বুড়ি! ইনি লিকিনি রাজার ভাগ্নি

আগে কিছুই জানতম নাঅ্যাকন জানলমএই গাঁ-ই রাজার শ্বশুরবাড়ি। হিঁদুদের মদ্যে রাজা লিকিনি জেতে তেমন উঁচু লয়। নিজের জেতের মদ্যে তেমন মেয়ে পেছিল না যি বিয়ে করে। শ্যাষে ই গাঁয়েই এক গরিব ঘরে নিজের জেতের একটো সুন্দরী কন্যে পেয়েছিল। তাকেই লিকিনি বিয়ে করে। আবার সেই লেগেই নিজের ভাগ্নির ই গাঁয়েই বিয়ে দেয়। তাইলে ই গাঁ হলো রাজার শ্বশুরবাড়ি। সেই লেগে ই গাঁয়ে আছে পাকা শিবতলাসিখানে তিনটে পাকা মন্দিরআছে পাকা ইশকুল। এমন ইশকুল ইদিকে আর অ্যাকটোও নাই আর সেই ইশকুল চালানোর লেগে আছে বেরাট এক দিঘি আর বিস্তর জমিজোমা। গাঁয়ে আরও এক ঘর রাজার আত্মীয় আছে। বোধায় রাজার ভাই-ভায়াদদের কেউ। তারাই সব জমি-সম্পত্তি ভোগ করেদেখাশোনা করেভাগ্নি তেমন কিছু পায় না। সেই ঘরের সাথে এই ভাগ্নি বাড়ির তেমন পোট নাই

ইসব কথা পরে শুনেছি। ত্যাকন হাঁ করে তাকিয়ে থাকলম কত্তামার মুখের দিকে। মুখে কি এটুও হাসি আছেশুদু বললেএসো। তার সাথের ঝি-বউরা আমাকে পালকি থেকে নামিয়ে নিলে। কত্তামা মুখ ফিরিয়ে থপথপ করে হাঁটতে শুরু করলে আমরাও তার পেছু পেছু বাড়িতে ঢোকলম

এই বিরাট এনে! এগনে শুদ্ধ গোটা বাড়ি মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সব নিখুঁত ছিমছাম। এগনের ভেতরে ইদিকে-উদিকে জাম গাছপেয়ারা গাছআমড়া গাছতা-বাদে গ্যাদাসন্ধ্যামণিপাতরকুচিতুলসীএইসব গাছ। সারা উঠোনে হেঁয়া। পরিপাটি করে এনে লিকোননাএকটি শুকনো পাতা পড়ে নাই। এগ্‌নের উত্তর দিক ঘেঁসে দখিন-দুয়োরি মাটির দোতলা বড় কোঠাঘর। তার চাল খ্যাড়েরকড়িবরগা শাল আর তাল-কড়ির। দেখেশুনে মনে হয় এমন ঘর চেরকাল থাকবে। আরও সব রান্নাঘরহেঁশেলবৈঠকখানাসবই মাটির বটে কিন্তুক মনে হচে সবলতুনমনে হচে মাটির ঘরে বাস করবে বলেই সব মাটির করেছেনাইলে পাকা বাড়ি করা এদের লেগে কিছুই লয়

এগ্‌নে পেরিয়েদোতলা কোঠাঘরের চ্যাওড়া উসারা পেরিয়ে অ্যাকটো ঠান্ডা আঁদার আঁদার ঘরে নিয়ে যেয়ে আমাকে অ্যাকটো কাঠের পিঁড়িতে বসাইলে। কামার পরনে সরু পাড়ের শাদা মিহি ধুতি। বেধবা তো! গায়ে কিন্তুক বেলাউজ নাই। ত্যাকনকার দিনে গাঁয়ের বউ-ঝিরা বেলাউজ পরত না। কত্তামা এত বড় ঘরের বউ। ভেবেছেলম তার গায়ে কি বেলাউজ থাকবে না?

ঘরের কোণে একটো পেল্লায় কঁঠালকাঠের দবজ চেয়ার পাতা ছিল। কত্তামা এসে সেই চেয়ারে বসলে। দেখলমএনার পা দুটিও খালি। হ্যাঁমাহারানীর মতুন লাগছে বটে! ধবধবে শাদা মোটা মানুষচেয়ার জুড়ে বসেছেকোথাও একটু ফাঁক নাই। সেই চেয়ারে বসে একজন মাঝবয়েসি বউকে হাতের ইশারা করলে। বউটোর সিতিতে চ্যাওড়া করে সিঁদুর লেপা। ঘরের এক কোণে রাখা একটো গয়নার বাসো নিয়ে এসে বউটি আমার ছামনে রাখলে। কত্তামা ত্যাকন আমার দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে বললেবউমাতোমার গায়ের গয়নাগুলি একটি একটি করে খোলো। আমার গয়না দিয়ে তোমাকে সাজিয়ে একবার নয়নভরে দেখি তো মা কেমন লাগে! এই কথার পরে সব ভুলে কত্তামার মুখের দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে আমি একটি একটি করে আমার গয়নাগুলিন খুলতে লাগলম। সব খোলা হয়ে গেলে কত্তামা আবার চোখের ইশারা করতে সেই মাঝবয়েসি বউটি কাঠের গয়নার বাসো খুলে একটি একটি গয়না বার করে আমাকে পরিয়ে দিতে লাগল। আঁদার-আঁদার ঘরে ঐসব খাঁটি সোনার ভারী গয়না ঝকমক করতে লাগল। কেরূমে কেরমে কঙ্কণবাজুকানপাশাফাঁদি নথটায়রাগোটভারী বিছেহার সব আমাকে পরানো হলো। আরও গয়না ছিলতবে সি আর পরানোর জায়গা নাই। কত্তামা বললেবউমাএখন আর এইসব গয়না খুলো না। ঐ বাসোয় আরও গয়না আছেতোমার গয়নাও এখন ঐ বাসায় থাকুক। যাবার সময় পালকিতে তুলে দেবে

কত্তামার এই কথার পরে বউটি আবার আমার সব গয়না সেই বাসোয় ভরে বাসোটা বন্ধ করে চাবি আমার ছামনে রেখে দিলে। কি বাহার সেই গয়নার বাক্সোর! তার সারা গায়ে হাতির দাঁতের কাজকেমন সব মনোহারী নকশা। আর চন্দনকাঠ দিয়ে তৈরি বলে সেই বাসো হাতে করলেই সুবাস। সেই গন্ধ সেই নকশা আর এই পিথিমিতে নাই। কুথাও কুনোদিন উ আর কেউ পাবে না

গয়না পরা হয়ে গেলে শাদা পাথরের বড় এক থালায় নানারকম সন্দেশ-মিষ্টি সাজিয়ে আমার ছামনে রেখে দিলে। ইমিষ্টি গাঁ-ঘরে মেলার কুনো কথাই নাইশহর থেকে আনাতে হয়েছে। তাপর পায়েসক্ষীর আরও কতো কি যি এল হিশেব নাই। কামা শুদু বললেবউমাখাও

অত মানুষের ছামনে একা কি কিছু খাওয়া যায়কুনোমতে এক-আধটু খেয়ে আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকলম

সব শ্যাষে কত্তামা কষ্ট করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেবউমামনে রেখোতুমি আমার বড় ছেলের বউ। তোমার কিন্তু দেওর-ননদ আছে। তারা সব ছোট। তাদের যখন বিয়ে-থা হবে তখন আমি হয়তো থাকব নাতোমাকেই সব দেখেশুনে নিতে হবে

কত্তামা-ও দেখলম পেঁয়োভাষায় কথা বলে না। আমি পালকিতে ওঠার পরে কত্তাকে নাম ধরে ডেকে বললেবউমা আমার সোনার পিতিমেখবরদার তাকে কোনোদিন কষ্ট দিবি না। তাতে তোর ভালো হবে না

একটো মজার কথা বলি। এত যি কাণ্ড হলোকত্তামা কিন্তুক একবারও আমার গায়ে হাত দিলে নাছুঁলে না। জানা কথাসব মিটে গেলে কত্তামা আর একবার গা ধুয়ে কাপড় বদলে তবে ঘরের কাজ করবে

 

বড় সোংসারে থই মেলে না

লতুন বউ আমি এসে ওঠলম ডোবা থেকে দিঘিতে। বড় সংসারকিছুতেই থই মিলছে না। আমাদের বংশও বড় ছিল বটেগাঁ-জোড়া। বংশ। তবে সিসব আলো আলেদা ভাই-ভায়াদের সোংসার। আমাদের নিজেদের সোংসার ছোটমা য্যাকন বেঁচে ত্যাকনো ছোট। তার মরার পরে কিছুদিন তো আরও ছোট। লতুন মা আসার পরে একে একে ভাইবুনগুলিন হতে হতে য্যাকন আমার বিয়ের সোমায় হলোত্যাকন সোংসার কতকটা বড় হয়েছে বটেতা বলে ই বাড়ির মতুন লয়। কত্তারা পাঁচ ভাই। আমাকে নিয়ে বউ দুটো। মোটে বড় আর মেজ এই দুই ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে। আর আর ভাইয়ের ত্যাকননা বিয়ে হয় নাই। ছোট ভাইটি তো খুবই ছোটআট-ল বছরের হবে। চার বুনের মধ্যে দুজনার বিয়ে হয়েছে। বড় বুনটি স্বামী-সংসার নিয়ে গাঁয়েই থাকে। মেজজনার পোড়া কপাল। মাত্তর ল-বছর বয়েসে বেধবা হয়ে এই সোংসারেই ফিরে এসেছে। বাকি দুজনার অ্যাকনো বিয়ে হয় নাই। এত লোক সোংসারেতবে সবার ওপরে আছে আমার শাশুড়ি। তার বয়েস হয়েছে বটে কিন্তুক ত্যাকনো খুব শক্তদু-চারটা চুল পেকেছেদাঁত একটিও পড়ে নাইগোটা সুপুরি চিবিয়ে খেতে পারে। শাশুড়ি ফিট শাদাকত্তার মতুন শামলা লয়। বেধবা মানুষশাদা ধুতি পরনেকপাল পয্যন্ত লাজ-কাড়াঠিক বউমানুষের মতুন। দেখার সাথে সাথে বুঝতে পারলম এই শাশুড়ি-ই ই বাড়ির গিন্নি। তার পরের গিন্নি ঐ বেধবা ননদ। ল-বছরেই বেধবা হয়ে ভাইদের সোংসারে এয়েছে। ই বাড়ির লিয়ম ঠিক হিঁদুদের মতুনবেধবার বিয়ে নাই ই বংশে। এই ননদ ত্যাকন ভরা যোবতী। আমার চেয়ে বড় বটেতবে বেশি বড় লয়। বয়েসে চার-পাঁচ বছর বেশি হতে পারে

আমি লতুন বউ হয়ে থাকলম আর কদিনকানে তুলো পিঠে কুলো চোখে ঠুলি লাগিয়ে সোংসারের ঘানিতে জুতে গ্যালম দু-দিন যেতে না যেতেই। তবেএই এক সুবিদাই সোংসারে আমার দেখার কিছু নাই। বাড়ির গিন্নি আছেসেই দেখবে। যা করবার সেই-ই করবে। বড় বউ আর আমি শুদু ঘুন্নিপাক খেলেই হয়ে যাবে। হ্যাঁসেই যি ঘানি টানতে লাগলমসারা জেবন একবারও আর থামতে পারলাম না। ডাইনে বললে ডাইনেবাঁয়ে বললে বাঁয়ে। শুদুই হুকুম তামিল করা। অ্যাকন মনে হয়জেবনের কুনো কাজ নিজে নিজে করি নাইনিজের ইচ্ছা কেমন করে খাটাতে হয় কুনোদিন জানি নাই। আমি কি মানুষনা মানুষের ছেয়াতা-ও কি আমার নিজের ছেয়া?

তবে নিশ্চিন্তি বটে! কুনো কিছু তো নিজেকে ঠিক করতে হবে — যা করবারযা বলবার গিন্নি করবেগিন্নি বলবে। আর সি কি যে-সে গিন্নি! ঐটুকুন মানুষশাদা শাড়িতে কপাল পয্যন্ত ঢাকাশরীলের কোথাও এতটুকু ধুলোবালি লেগে নাই। এত পোষ্কার থাকে কেমন করে মানুষ তাই ভাবতম। মুখে একটি-দুটি কথাভালোবেসেও লয়মন্দবেসেও লয়। আর না-পছন্দ কুনো কিছু করলে দু-একটি বাকি যা বলত তা যেন কল্‌জে ছাদা করে দিত। এইটোতেই ভয় লাগত বেশি। তবে বিচের ছিল বটে। একটি অন্যায় কাজ লয়অন্যায্য কথা লয়। কুনো কিছু নিয়ে দুই দুই করা লয়। একেবারে সুক্ষ্ম ষােলো আনা ন্যায্য বিচের। এমন না হলে কি অত বড় সোংসার থাকেসেই লেগে বলি শাশুড়ি যেন ই জগতের লোক ছিল না

ইদিকে সোংসারের কত্তা কিন্তুক মেজ জনাআমার সোয়ামি। তার বড় ভাইআমার ভাশুরকত্তার চাইতে ক-বছরের বড় হলে কি হয়সে ছিল খুব আলাভোলা মানুষনেতান্তই ভালো মানুষ। বিষয়-সম্পত্তির কুনো কিছুতেই তার আঠা ছিল না। জেবনের শ্যাষ দিন পয্যন্ত সে যেন কত্তার ছোটই থেকে গেলকুনো দায়-দায়িত্ব নিলে না। ছোট ভাইকে যেন এট্টু ভয়ই করত মনে মনে। তার ছিল খাওয়ার শখজামা-কাপড়ের শখ। তবে সি আর কতোটুকুনি! ছেলেপুলে হলো না কুনোদিনভাইবুনদের ছেলেমেয়েরাই ছিল তার সব। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কি ভালোই যি বাসত! বিশেষ আমার ছেলেমেয়েদের। পর পর দুই খোঁকার পরে আমার একটি খুঁকি হয়েছিল। সেই খুঁকি ছিল তার জান। বাড়িতে সে থাকতই না পেরায়। অ্যানেক দিন পরে পরে য্যাকনই বাড়ি আসতসঙ্গে থাকত হাঁড়িভরা মিষ্টি। মিষ্টি ছাড়া বাড়ি ঢুকত না। হয়তো ব্যাবসার টাকা লষ্ট করে কিংবা টাকা ধার করে ছেলেমেয়েদের লেগে মিষ্টিখ্যালনা এইসব আনত আর কত্তার কাছে মুখ শুনত এই লেগে। কত্ত বলত শুদু শুদু টাকা লষ্ট করবে কেনকঠিন কঠিন কথা শুনে ভয় আর লজ্জা নিয়ে এমন করে দাঁড়িয়ে থাকত ছোট ভাইয়ের ছামনেযেন চোরের দায়ে ধরা পড়েছে। কিন্তুক ঐ পয্যন্তই। কথা এক কান দিয়ে শুনলে আর এক কান দিয়ে বার করে দিলে। বাড়িতে ঢুকলেই ছেলেপুলেরা কেউ ঘাড়েকেউ মাথায়। কেউ তো আর তাকে বড় চাচা বলত নাবলত বড় বাপ। সোংসারের সব দায় ঐ মেজ কত্তার হলেও আবার ইদিকে দ্যাখো তেমন দরকার পড়লে সে খবর দিয়ে বড় কত্তাকে বাড়িতে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করত অমুক কাজটা করবে কি না। বড় ভাই-ও তেমনিতার শুদু একটি কথামন হলে করো গাভালো মনে হলে করো গা। আমাদের এমন অবাক লাগত! য্যাকন-ত্যাকন বড় ভাইকে এই বকা তো সেই বকা! আবার তেমন তেমন ব্যাপার হলে তার কাছেই হুকুম চাওয়া। কিন্তুক ইকথাও বলতে হবেছোটকে যি কতোটা সমীহ করতে হয়যেদি ছোট তেমন সনমানের যুগ্যি হয়তা-ও দেখেছি এই সোংসারে

কত্তাকে ঐ বয়সে যি অতো দায়িত্ব নিতে হয়েছিল তার কারণ হলোআমার শ্বশুর আট-লটো ছেলেমেয়ে আর বেধবা স্ত্রী রেখে অল্প বয়সেই মারা যায়। কথাবার্তা শুনে আমার মনে হয়শ্বশুর বোধায় খানিকটা আমার ভাশুরের মতুনই বিষয়-সম্পত্তি দেখে রাখবার মানুষ ছিল না। তবে সে আলাভোলা ছিল না। এলেকার হিঁদু-মোসলমান বড় বড় মানুষের সাথে তার ওঠাবসা ছিল। শখ-সাধও ছিল বোধায় তেমনি। নিজের পালকি ছিলছয় বেহারার পালকি। সেই পালকিটি দলিজঘরের বারেন্দায় ভেঙেচুরে পড়ে ছিল অ্যানেকদিন। তা বাদে নিজের আরবি ঘোড়া ছিল তো বটেই। ঘোড়ায় চড়ে ইগাঁয়ে উগাঁয়ে বড় বড় লোকের বাড়িতে যেমন যেততেমনি তারাও সবাই ই বাড়িতে আসত। শাশুড়ির ঠেয়ে শুনেছি মানুষজনের আসা যাওয়ার কামাই ছিল না। কোর্মা পোলাও দই মিষ্টি দেদার খরচ হতো। এমনি করে করেই জমি সম্পত্তি কতক বিক্রি হলোকতক বেহাত হলো। শ্বশুর য্যাকন মারা যায়ত্যাকন লিকিনি সোংসারের বেহাল অবস্তা। শাশুড়ি বলতসোংসার য্যাকন ভেসে যায়-যায় হয়েছে ত্যাকন তার এই মেজ ছেলেই এগিয়ে এসে হাল ধরলে। তা নাইলে সব যেত। কত্তার ত্যাকন কতোই বা বয়েসবিশ বছর হয়েছে কি হয় নাই। সে সব আমোদ-আল্লাদ বাদ দিয়ে ভাইবুনগুলিন আর মাকে নিয়ে জান-পরান দিয়ে এই সোংসারটোকে রক্ষা করলে। ই সোংসারে এসে তাই দেখলম বটে। সোংসারের ভেতরে যা করবে সব মা। মা ছাড়া কথা নাই। নিজের ইস্ত্রী তো বটেই পরে পরে যিসব ভাইয়ের বিয়ে হলো তাদের পেত্যেকের বউকে চোখকান বুজে শাশুড়ির কথা মেনে চলতে হবে। শাশুড়িকে একটি কথা ঝাঝিয়ে বলেছে কিম্বা কাজ করতে করতে ঘটি-বাসন মাটিতে একটু ঠুকে আওয়াজ করেছেআর রক্ষা নাই। কত্তা সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকে বলবেযে এরকম করলে সে আর একবার যদি এমন করেতাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে। তা কত্তাকে লাগত নাআমার শাশুড়ির শাসনই য্যাথেষ্ট ছিল

বউ হয়ে আসার পর থেকে অবশ্যি দেখছি সোংসার অ্যানেকটোই ঠাউরেছে। শ্বশুরের মিত্যুর পরে সাত-আট বছর কত্তাকে কেউ বিয়ের কথা বলতে সাওস পায় নাই। আমার শাশুড়ি-ও লয়। সেই লেগেই এত দেরিতে বিয়ে। সংসারে ঢুকে দেখলম ত্যাকন একমাত্তর সেজ জনার বিয়ের বয়েস হয়েছেবাকি ভাইবুনরা সব ছোট। বেধবা বুনটোর পরে তার আর দুই ছোট বুনের বিয়ের বয়েস হব-হব। কিন্তুক কি কপালএই সোমায় ঠিক ঘোটর বড় যেটি সেই বুনটি মারা গেল। কি অসুখ কে বলবেমাস দুই-তিন কিছুই পেরায় খেলে না। খাবার দেখলেই বলত অরুচি লাগছে। এই করে শুকিয়ে শুকিয়ে লেয়ালির দড়ি হয়ে গেল। কাটি কাটি হাত পা। তাপর একদিন আমাদের সকলের চোখের ছামনে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলে। আহাকতোই বা বয়েসসারাটা জেবন তার ছামনেসোয়ামি সোংসার সন্তান কিছুই জানলে নাঅকালে মা ভাই বুন সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল। ত্যাকনকার দিনে মরে যাওয়াটো যেন কিছুই লয় এমনি ভাব ছিল মানুষের। দু-চার দিন কেঁদেকেটে সব ভুলে যেত। ডাক্তারবদ্যি তো তেমন ছিল না। যা বা ছিল শহরগঞ্জেপাড়াগাঁয়ে তার কিছুই মিলত না। কঠিন অসুখ হলে যার অসুখ সে যেমনতেমনি তার সোদররাও সব আশা ছেড়ে দিয়ে মিত্যুর লেগে ঠায় অপেক্ষা করত। কলেরা আর বসন্ত ই দুটো মাহামারীতে বছরে কতো লোক যি মরত তার আর সুমার নাই। অত কাদবে কেকেঁদে কুনো লাভ নাই। যি কঁদছে সে-ই দুদিন বাদে মরবে কি না কে বলবেকলেরা-বসন্ত বাদ দিয়ে আর একটো অসুখ ছিলবুকের ব্যায়রামযক্ষ্মা। উ রোগ হলে চিকিচ্ছের চেষ্টাও ছেড়ে দিত মানুষ। এক-একটো বংশ নিব্বংশ হয়ে যেত ই রোগে। যার হয়েছে ই রোগসে হয়তো হা হা করে হাসছেযা মন চায় তাই খেছেতাপর একদিন টুকুস করে মরে গেল। মানুষ যি জান ভরে কাঁদবে তা কি করতে কাদবেদুদিন বাদে সে-ও যে টুকুস করে মরবে

 

আমার একটি খোঁকা হলো

বিয়ের এক বছরের মাথায় আমার একটি খোঁকা হলো। সি দিনই লিকিনি দোপরবেলায় এক কড়াই দুধ উথুলে পড়ে গেয়েছিল। গাই দুয়ে এনে জ্বাল দেবার লেগে দুধ চুলোয় বসিয়েছিল। কেউ আর খেয়াল করে নাইআঁতুড়ঘরে আমাকে আর লতুন খোঁকাকে নিয়েই সবাই বেস্ত ছিল। এই ফাঁকে সেই উজ্জ্বলন্ত দুধ সব উথুলে উঠে কড়াই থেকে পড়ে গেল। তাই দেখে আমাদের বুবুসেই বেধবা ননদ হায় হায় করে উঠলে শাশুড়ি শুদু বললেদুধ নষ্ট হয়েছে হয়েছে। কেউ কোনো কথা বোলো না। বাড়িতে নতুন মানুষ এলএ সোংসারের পেথম খোঁকাআর দুধ উথুলে পড়ে গেল! এ বড় সুখের কথা। এবার সোংসারে ধন-দৌলতসুখ আনন্দও উথুলে পড়বে। তোমরা কেউ এই নিয়ে আর কথা বোলো না

তা কথা সত্যি বটেবংশের পেথম ছেলেলতুন ঝাড়ের গোড়াপও। পেথম ছেলে পেথম লাতিন। আনন্দে সবাই ভাসতে লাগল। ই ছেলে যেন একা আমার ছেলে লয়। কত্তা ত মনেই করলেনা যি তার ছেলে হয়েছে। উ ছেলে তো সবারইই বংশের ছেলে। মা বলে আমার খাতির বাড়লশাশুড়ি আড়লে আবডালে সবার কাছে বলতে লাগলঐ মেজবউ সাংসারের লক্ষ্মীঐ বউটি আসা থেকে সোংসারের বাড়-বাড়ন্ত শুরু হয়েছে। খুব পয়া আমাদের বউ। তা আমার খাতির আর আদর বাড়ল বটেতা বলে খোঁকাকে একা আগুলে রাখতে পারলাম না। সে হলো সবার চোখের মণি। ঘুরেফিরে সবাই এসে খালি তাকে দেখতে চায়। খোঁকাটি আমার শামলাবাপের রঙ পেয়েছিলছেয়ালো ছেয়ালো হাত-পাডাগর ডাগর চোখফুলের পাপড়ির মতুন ঠোঁট। সি যি কি সোন্দর! এমন ছেলের মুখ একবার দেখতে পেলে মায়ের এক লাখ বছর দুনিয়ায় বাঁচা হয়ে যায়। সবাই বলতে লাগল আসমান থেকে এক ফালি চাদ নেমে এয়েছে আমার কোলে। বড়ও হতে লাগল চাঁদের মতুন। আজ একটুকাল একটু। আজ এট্টু আলো দেখি মুখেকাল দেখি চোখে

দিন যায়দিনের পর দিন যায়দিন গড়িয়ে মাস যায়মাস গড়িয়ে বছর যায়। সোংসার কেরূমে কেরূমে বড় হতে লাগল। সেজ দ্যাওরের বিয়ে হয়ে গেল। বাড়িতে লতুন বউ এল। তাপর একদিন শ্যাষ ননদটিরও বিয়ে হলো মাহা ধুমধাম করে। বিয়ে হলো দশ কোশ দূরের এক গাঁয়ে। সি ঘরও খুব আবস্তাপন্ন

দু-একটো কষ্টের কথা সব মানুষেরই থাকে। আমারও কি ছিলছিল বৈকিপিতিকার হোক আর না হোক বলতে পারলে তো মনটা এট্টু খোলসা হয়। তা কাকে বলবইসব কথা তো শাশুড়ি-ননদকে বলার লয়। হয়তো তাদের নিয়েই কথাতাদের বলব কি করেএক কত্তাকে বলা যায়। তা সে এমন লোক যি ছামনে দাঁড়ালেই মনে হয় ই লোককে ইসব কথা বলা যায় না। মনে হয়আমার আবার আলাদা কথা কিনিজের লেগে ইয়াকে আবার কি বলবসারা দিনে তাকে দেখতেই প্যাতম না। দেখা হতো শুদু অ্যানেক রেতে। শাশুড়ি য্যাতোকাল ছিল আমি ছেলম ঠিক যেন লতুন বউ। এতগুলিন ছেলের মা হয়েও লতুন বউ

তা আমি আমার কথা বলব কিএকদিন রেতে কত্তা হঠাৎ বললেএকটা কথা বলি শোনো। ছোটবেলায় পাঠশালায় যাও নাই যাও নাই। তা বলে কি চিরকাল মূখ হয়ে থাকবেএকটু লেখাপড়া শেখা কি খারাপ?

কথা শুনে আমি তো সাত হাত পানিতেই আবার কি কথা! অ্যাকন আবার আমি কি ল্যাখাপড়া শিখব?

লেখাপড়া শেখার কোনো বয়েস নাই। একটু পড়তে লিখতে শিখলেই বুঝতে পারবে দুনিয়া কেমন করে চলছে

তা জেনে আমার কি হবেসোংসারে খাটতে খাটতে জান গেল। জানিএই করেই জেবন যাবে। এই বয়েসে আমি কি আবার বি.এ. এম.এ. পাশ দোব?

লেখাপড়া শিখতে গেলে বি.এ. এম.এ. পাশ দিতে হয় না। যাই হোকআমি বই কিনে আনবদেখবে কদিনের মধ্যেই অক্ষর শিখে যাবে

উ অ্যাকন আর আমি পারব না

পারতে তোমাকে হবেই

কত্তার মুখ দেখে বুঝতে পারলমউ মানুষ যা করবে ঠিক করেতা নিয়ে স্ট্যাচামেচি করে নাভেতরে ভেতরেই ঠিক করে। আমি চুপ করে থাকলম। একটু বাদে কত্তা আস্তে আস্তে শ্যাষ কথাটো বললেআলো আর আঁধারের যে তফাতঅক্ষর জানা আর না-জানা মানুষের মধ্যে ঠিক সেই তফাত

কি আতান্তরে যি পড়লম! কত্তা আমাকে কি বেপদের মদ্যে ফেললে! কিন্তুক সি মানুষকে যে চেনে নাই,সে চেনে নাই। একদিন ঠিকই আনলে বিদ্যেসাগরের বন্নপরিচয়ের পেথম ভাগএকটো সেলেট আর পেনসিল। কত্তা এটুন শৌখিন ছিলসারা বাড়িতে রেতে জ্বলত পিদিম আর লণ্ঠনকত্তার ঘরে জ্বলত একটো হেরিকেন। হেরিকেনের ত্যাকন অ্যানেক দাম। কত্তার ঘরে ছিল একটো বিদ্যাশি দামি হেরিকেন। কেউ জানতে পারলে নাঅ্যানেক রেতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ঘরের দরজা বন্ধ করে সেই হেরিকেনের আলোয় ল্যাখাপড়া শেখাতে লাগলে আমাকে। সারাদিনের খাটা-খাটনির পরে চোখ জড়িয়ে আসত ঘুমেকিছুতেই জেগে থাকতে পারতাম না। কিন্তুক কত্তার কুনো মায়া নাইসি কি তার তর্জন-গর্জন। শোয়া-ছেলে তিকুরে তিকুরে উঠত

খোঁকা যি জেগে উঠবে?

তা উঠুক। মাথায় কি আছে কি তোমার! অক্ষরটা কি চোখে দেখতেও পাচ্ছ নাপেনসিল হাতে বসে আছহাত কি ঘুরছে না স্লেটের ওপর?

কি জানি মাথা কেমন গোলমাল লাগছে

বুঝতে পারছিঘুম আসছে। যাওওঠোচোখে পানি দিয়ে এসোনাহলে চোখে দু-ফোটা রেড়ির তেল দাওঘুম চলে যাবে

বললে কেউ পেত্যয় যাবে নাইকটু ইদিক-উদিক হলে মায়া-দয়া তো করতই নাবোকা গাধা মাথায়-গোবর ইসব বলে গাল তত দিতইচুলের গোছ ধরে টানকানের লতিতে.একটা মোচড়ইসবও ছিল। একদিন তো গালে ঠোনা মেরে হাত ধরে টেনে তুললে। সি কি রাগ বাপরে বাপযাও বেরিয়ে যাও ঘর থেকেকখনো আসবে না এদিকে। একটা সামান্য কথা মাথায় ঢুকছে না তখন থেকেযাওবেরিয়ে যাওদরকার নাই লেখাপড়ার

কি আর করিঘর থেকে বেরিয়ে যেয়ে দুয়োরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলম। খানিক বাদে নিজেই আবার এসে ঘরে নিয়ে যেয়ে বললেযাওশুয়ে পড়োআজ আর পড়তে হবে না

হুঁএমনি করে আমি পড়তে শিখেছেলম। বিদ্যেসাগরের অ আ ক খ বইয়ের পিতিটি অক্ষর আমার চোখের পানিতে ভেজা বলে চোখ বুজলেই সেইসব অক্ষর দেখতে পাই। কালো কালো যত ছবি ছিল বইয়ে সব মনে পড়ে। আকননা সেইসব দিনের কথা মনে পড়লে বুকের ভেতরটা হু হু করে। দু-মাসের মাথায় পড়তে লিখতে শেখা হয়ে গেল। পেথম পেথম বানান করে করেপরে এমনিতে সব পড়তে পারতম। বাড়িতে বঙ্গবাসী’ বলে একটো কাগজ আসত পোেস্টাপিস থেকে। ভালো বুঝতে না পারলেও সেটা কখনো-সখনো পড়তম। কিন্তুক সবই লুকিয়ে লুকিয়ে। বাড়ির কেউ কিছু জানত না। কত্তা কিন্তুক কিছু বারণ করে নাই। তবে ননদ-শাশুড়িকে ইসব বলতে আমারই কেমন শরম লাগত

আমাদের সোংসারের লেগে সেই সোমায়টো ছিল উঠতির সোমায়। সব সসাংসারে এমন হয়। একটো উঠতির সোমায় আর একটো পড়তির সোমায়। শ্বশুরের মিত্যুর পর সোংসারে খারাপ দিন এয়েছিল। শ্বশুর গত হবার সাথে সাথে ভাই ভায়াদেরা সব সোংসার আলো করে নিলে। সবাই ভিনো হয়ে গেল। ঐ যি শ্বশুর অনেক বিষয়সম্পত্তি লষ্ট করে ফেলেছিলসেই লেগে সম্পত্তি ভাগ হবার সোমায়ে ভাইয়েরা নিজের নিজের সম্পত্তি পুষিয়ে নিলে। আমার বেধবা শাশুড়ির ভাগে পড়ল খুবই কম জমি। কিন্তুক তার ভাগে পড়েছিল সব ধনের সেরা ধনএক পুতুর। সিরকম ধন থাকতে আবার ভাবনা! শুদু একটো ভয়ইরকম ধন কারুর একার নয়এমনকি শুদু একটো সসাংসারেরও লয়। মায়ের তেমন পুত্রুর গোটা চাকলার। আমার শাশুড়ি সি কথাটো বুঝেই তবে দুনিয়া থেকে গেয়েছে

কেমন করে সোংসারের উন্নতি-বরকতের অরম্বটো হলো সি কথাটা ইবার বলছি। আমার বিয়ের সোমায় বাপজি গয়নাগাঁটি যা দেবার তা দিয়েছিল। ত্যাকুনি জানা গেয়েছিল আমার সেই দাদিবাপজির খালামরবার আগে আমার নামে তার সব জমিযোলে বিঘে জমি লিখে দিয়ে গেয়েছিল। দাদির তিন কুলে কেউ ছিল। সি কথা আগে বলেছিসেই লেগে সম্পত্তিটো নিয়ে কুনে। হ্যাঙ্গামা-ফৈজত হয় নাই। বিয়ের পরে-পরেই ঐ সম্পত্তিটো বিক্রি করে দিয়ে কত্তা নিজেদের গাঁয়ের মাঠে পঁচিশ বিঘে জমি কিনলে। আমার নামে কিনেছিলনা সোংসারের সাজার করে দিয়েছিল ঐ জমিআমি আজও জানি না। সবই তো শাশুড়ির সোংসারেরআমার তোমার কিএই ছিল শিক্ষে। গোড়াতেই জেনে গেয়েছেলম কত্তার ছামনে কুনো জিনিস নিয়ে আমার আমার করা যাবে না। একবার কি একটো নিয়ে এইরকম আমার আমার করে কথা বলতে যেতে দেখেছেলমকত্তা একদিষ্টে আমার দিকে চেয়ে আছে। মনে হলোই মানুষ আমাকে চেনে নাএখুনি হাত ধরে ঘর থেকে বার করে দেবে। সেই আমার চেরকালের লেগে শিক্ষে হয়ে গেল

বারে বারে কত্তা কত্তা করছিতা বলে কেউ যেন না মনে করে যি কত্তা বি.এ. এম.এ. পাশ দিয়েছিল। আমার শ্বশুর লিকিনি খুব ল্যাখাপড়া-জানা আলেম মানুষ ছিল। কিন্তুক কত্তা কোথা থেকে কি শিখেছিল আমি জানি না। আমাকে কুনোদিন বলে নাই। ক-বছর। লিকিনি বাড়ি ছেড়ে বিবাগী হয়ে গেয়েছিলনদী পেরিয়ে পুবের কুন গাঁয়ে কুন এক পীরবাবার কাছে ফারসি পড়ত। এই গপ্পো অ্যানেকবার শুনেছি। তবে সিসব ডানপিটেমির গপ্পোল্যাখাপড়ার কথা নয়। যা-ই হোকআমার খালি মনে হতো,এই মানুষ জানে না এমন কিছু কি ভূভারতে আছেএই সোমায় সে গাঁয়ের ইশকুলে ছেলে পড়াইত। সেটো চাকরি ছিল কি না জানি নাপড়াইত এই জানি আর কত্তামার ছোট ছোট ছেলেটিকে লিয়ম ধরে পড়তে বসাইত

একদিন দেখি বাড়ির ভেতরে এসে মায়ের সঙ্গে কি নিয়ে কথা বলচে। এমনিতে কিছুতেই বাড়ির ভেতরে ঢুকত নাথাকত তো বাইরের একটো ঘরে। বাড়ির ভেতরে এলে বুঝতে হতো গুরুতর কুনো কথা আছে। তা মায়ের সাথে কথা বলছেআমাদের কারুর কাছে যাবার হুকুম নাই। দূর থেকে দেখছিছেলে কিসব বলচে আর মা খালি ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলচেনা বাবাতা হয় না। তা কোরো না। কি যি কথা হলো কিছুই বোঝলম না। বোঝলম রেতে। হেঁশেলের। কাজকম্ম সেরে শেকল তুলে বাইরের ঘরে য্যান অ্যালমকত্তা দেখলম ত্যাকননা বিছেনায় শোয় নাই। বসে আছে। খোঁকা তার। বিছেনায় অসানে ঘুমুইছে। খুব ঘেমেছে দেখছি গলার কাছটোয় ভিজে গেয়েছে। ঠান্ডা লাগবে না কি হবেআঁচল দিয়ে ঘামটো মুছিয়ে দিচি ত্যাকন কত্তা বললেশোনোকথা আছে। গলার স্বর খুব মোলায়েম। কথা কত্তা এমন করে তো বলে না। এট্টু অবাক হয়ে কাছে যেয়ে বসলম। কত্তা বললেজীবনে সুযোগ দুর্যোগ দুই-ই আছে। সব সময় সুযোগ আসে নাআর সুযোগ আসে যেমন আচমকাতেমনি চলেও যায় আচমকা। তা একটা সুযোগ এসেছে। পঁচিশ-তিরিশ বিঘে। জমি একলাটে আছে। কদিন বাদে সেটা নিলাম হবে। রায়েদের জমি

রায়েরা আবার কারা?

রায়েরা এ গাঁয়ের জমিদার। ওদের রবরবা আমাদের ছেলেবেলায় একআধটু দেখেছিতবে আমাদের বাপচাচারা আরও ভালো জানত। এখন অবস্থা খুব পড়ে এসেছে। খেতে জোটে না। তাদেরই পঁচিশ-তিরিশ বিঘে জমি নিলাম হবেন-কড়ায় ছ-কড়ায় বিকিয়ে যাবে

তা উ নিয়ে আমাদের কি ভাবনাআমরা কি উদের কুনো উবগারে লাগব?

কথা শোনোআমাদের এত বড় সোংসারটেনে চলা খুব কঠিন। বাপজি তো সব প্রায় শেষ করে দিয়ে চলে গিয়েছে। নিলামটা ধরতে পারলে কাজ হয়। রায়েদের জন্যে খারাপ লাগছে খুবহাতি খাদে পড়েছে। মানুষের দুর্দিনের সুযোগ নিতে নাই আমি জানি কিন্তু রায়েরা কিছুতেই এ জমি রক্ষা করতে পারবে না। আমি না নিলে আর কেউ নেবে

কথা কটি বলে কত্তা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে। আমি তো অবাকজমি নিতে হলে নাও গা— আমাকে শুদুবার কি আছেআমি সঙ্গে সঙ্গে বললমই তো খুব ভালো কথানিলেম ডেকে নিতে পারলে সোংসারের লেগে খুব ভালো হয়। আমাকে আবার ই কথা শুদুইছ ক্যানে?

নিলাম তো আর খালি হাতে ডাকা যায় নাটাকা লাগবে নাঅত টাকা কোথা থেকে পাবকাঁচা টাকা আমার হাতে নাই। সংসারে কারও কাছে একটি পয়সা নাই। পয়সাকড়ি যা থাকে আমার কাছেই থাকে। খোরাকির বাইরে ধান যা আছে তা বিক্রি করে আর কতো টাকা পাওয়া যাবেবলে কত্তা আবার আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলে। আমি ফের অবাকটাকাপয়সার কথা আমার কাছে ক্যানেউ বিষয়ে তো আমি কিছুই জানি না। আমিও কত্তার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকলম

টাকার কথা আমি কি বলব?

আমার এই কথার পরে কত্তা এতক্ষণ বাদে আসল কথাটি বললেদ্যাখোগয়না তুমি অনেক পেয়েছবাপের বাড়ি থেকে পেয়েছকত্তামার কাছ থেকেও পেয়েছ। কি হবে গয়না নিয়েকবার পরবে ঐ ভারী গয়নাএকটু বয়েস হলে হয়তো আর কোনোদিন পরবে না। ঐ ওজনের লোহা বাড়িতে লুকিয়ে রেখে দিয়ে ভাবলেই হলো গয়না সবই আছেএকই কথা হলো না?

কথা শুনে আমি বোকার মতো তার দিকে তাকিয়ে আছি

দু-একটা পরার মতো গয়না রেখে দিয়ে সংসারের এমন একটা কাজে বাকি গয়নাগুলো দিয়ে দিলে কি হবে তোমারসবাই জানবে সংসার গড়ে তুলতে কোন্ এক পরের বাড়ির মেয়ে এই মেজ বউ-ই এত বড় কাজ করেছে!

কত্তার কথা শুনে আমার চোখ ফেটে পানি এল। এত নিষ্ঠুরহায়রে এত কঠিন জান আমার সোয়ামিরকলজেটা ছিড়ে নিলেও তো এত কষ্ট হতো না। মেয়েমানুষের গয়না ছাড়া আর কি আছে! স্বামী চলে গেলেও গয়না থাকবে। আমার সেই গয়না আকন সব কেড়ে নেবেচোখ-ভরা পানি নিয়ে কত্তার মুখের দিকে চেয়ে দেখতে গ্যালমঝাপসায় কিছুই দেখতে প্যালম না। তবে আমি এই ভবসংসারে কার ঠেয়ে যেয়ে দাঁড়াবশুনতে প্যালম কত্তা বলছেকেঁদো না। তুমি না দিলে গয়না আমি তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেব না। তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি মেয়েমানুষের কাছে গয়না কি! সন্তান গেলেও তারা গয়না ছাড়বে না

কত্তার এই শেষ কথাটো যেন আগুনের ছ্যাকা দিয়ে আমার কলজেটো পুড়িয়ে দিলে। ই কি কথাই কি কথাহায় হায়! চোখের পানি ত্যাকন ত্যাকনই শুকিয়ে গেল। একবার ঘুমনো ছেলের দিকে তাকালমবালাইষাটআমি হাজারবার লাখবার মরি তোর জানের লেগে! একবার কত্তার দিকে তাকালম। হেরিকেনের আলোয় অ্যাকন তার মুখটো দেখতে পেছি। দেখি কিসি মুখে এটুও রাগরোষ নাই। আমার দিকে চেয়ে রয়েছে যে চোখদুটি তাতে কি যে ভরসা! তাই বটেতাই বটেমেয়েমানুষ এইরকমই বটেনিরুপায়। আমি বললমগয়না সব নিয়ে যাও। আমি মন খোলসা করে বলছি একটি গয়নাও আমি রাখতে চাই না

না নামোটা কঙ্কণ দুটো রেখে দাও। নিজে না পরোছেলের যখন বউ হবেতাকে দিয়ে দিয়ো

সেই রেতেই একটি একটি করে সমস্ত গয়নাগাঁটি পুঁটলিতে বেঁধে কত্তার হাতে তুলে দেলম। কদিন বাদেই জানতে পারলমরায়েদের কাছ থেকে তিরিশ বিঘে জমি নিলেমে কেনা হয়েছে। কত্তা টাকা কি করে জোগাড় করেছিল সি আমি জানি নাগয়না বিক্রি করেছিল,

বন্দুক রেখেছিল তা আর কুনোদিন শুদুই নাই তাকে। এমন মানুষযিদিন নিলেমে জমি পাওয়া গেল,সিদিন বাড়িতে ঢুকে পেথম মাকেই ডেকে বললে,, সংসারের আরও তিরিশ বিঘে জমি হলো

এই পেথম দেখলম আমার শাশুড়ি এগিয়ে যেয়ে ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বললেচিরজীবী হও বাবাআল্লা তোমার হায়াত দরাজ করুক। এই বলে আঁচল দিয়ে চোখ মুছলে। অথচ রেতে য্যাকন ঘরে গ্যালম কত্তা শুধু বললেশুনেছ তোনিলাম ডাকা হয়ে গিয়েছে?

হিসেব করে ত্যাকন দেখলম দাদির ঠেয়ে পাওয়া আমার যোলো বিঘে জমিশ্বশুরের জমিআর এই নিলেমের জমি একাই করলে পেরায় আশি-নব্বই বিঘে জমি সংসারের হয়েছে। গাঁয়ে এত জমি আর কারও নাই। সবারই সাধারণ অবস্তা। মোসলমানপাড়ায় দশ-পনেরো বিঘের বেশি জমি কারুর নাই। হিঁদুপাড়াতেও তাইখুব বেশি হলে দু-চারজনার চল্লিশ-পঞ্চাশ বা ষাট বিঘে। মহারাজার যে দুটি আত্মীয় ই গাঁয়ে আছেতাদের জমি এট্টু বেশি বটেতবু ষাট-সত্তর বিঘের বেশি হবে না। ইসব কথা কত্তার কাছেই শোনা। মন হলে কখনো কখনো ইসব কথা বলত

কত্তাকে সারা জেবনে কুনোদিন নেশা করতে দেখি নাই। শখ করে কুনো সোমায় পান খেতে দেখেছি। তেমন সময়ে ফরসি হুঁকো টানতেও দেখেছি। খেত নাখেত নায্যাকন খেতত্যাকন খুব আয়েশ করেই খেত। দামি অম্বুরি তামুক আনাতপানের লেগে কিমাম কিনত। দেখে মনে হতোএই বুঝি কত্তা পান ধরলে কিম্বা তামুক ধরলে। কিন্তুক এসব দু-মাস তিন মাস। তাপর তামুক হঠাৎ ছেড়ে দিলেফরসি হুঁকোটোও কোথা পড়ে থাকল। এমনি আজব মানুষ! তবে ইকথা বলবয্যাকন পান ধরত কিম্বা হুঁকো খেতমেজাজটো খুব শরিফ থাকত। কথা যা ঐরকম সোমায়েই বলত বেশি

রায়েদের জমি যি কত্ত নিলেমে কিনে নিয়েছিলতাতে আমার মনটো খুব খচখচ করত। মাঝে মাঝে মনে হত কত্তাও বোধায় এই নিয়ে আমাকে দুটো কথা বলতে চায়। কাজটো সে করেছে বটেকিন্তু সি যেন নেহাত বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে বলেই করেছে। কথাটো এই যি জমি কি রায়েদের থাকত আমরা নিলেম না ডাকলেকত্তা একদিন এমন করে রায়েদের কথা বললে তাতে মনে হলো যেন কেচ্ছা শুনছি। ফরসি টানতে টানতে শুরু করলেএ গাঁয়ে মিদার যদি কেউ থাকেতাহলে সে রায়েরা। এরা উঁচু বংশবামুন বংশ। গাঁয়ের আদ্দেকটার মালিক ছিল ওরাই। যেমন উঁচু মনতেমনিই বেহিসাবি খরুচে। খাওয়া-পরায় সবই উড়িয়ে দিত। কিন্তু এদের কেউই মেজাজি ছিল না। সবাই বড় ঠান্ডা মানুষ। যে যা চাইতধরে বসতদিয়ে দিত। এই করতে করতে সব শেষ করে দিলে। ছেলেপুলেরা কেউ গাঁ ছাড়লে নালেখাপড়া শিখলে নাচোখের সামনে দেখলাম পঁচিশত্রিশ বছরের মধ্যে সব শেষ করে দিয়ে ফতুর হয়ে গেল। জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর অনেকেই এখন গা ছেড়ে চলে গিয়েছেছেলেদের কেউ কেউ কলকাতা-টলকাতা গিয়ে বাড়ির চাকর বা রাঁধুনি-বামুনের কাজ করছে। ভিটেমাটি পড়ে আছেসাপ-খোপ বাসা করেছে। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পাকা বাড়ি-ঘরপুজোর মন্দির। ছাদ ফাটিয়ে বট-পাকুড় গাছ উঠেছে। বেনা ঘাসগোয়াল-লতাকন্টিকারির জঙ্গলে কাছে যাবার উপায় নাই। এই তো অবস্থা! দেখবে আর দুদিন বাদে ছোট রায় ঝুলি হাতে ভিক্ষে করতে বেরুবে। জমিগুলি আমি কিনলামখুবই খারাপ লাগে বটে তবে নিয়তি ঢুকেছে বংশে। মানুষের সংসারে নিয়মই এইউঠতে উঠতে আকাশে ঠেকবে মাথাতারপরে পড়তে পড়তে একদিন মাটিতেই আশ্রয়। এ হবেইসব বংশেই হয়। নিয়তির পথ কেউ বন্ধ করতে পারবে না

আস্তে আস্তে ফরসি টানতে টানতে ইসব কথা একদিন কত্তা বলেছিল আমাকে। কথা বলতে পারত বটে মানুষটোঅমন আর কোথাও শুনি নাই। ইসব কথা চেরকালের লেগে মাথার ভেতরে ঢুকে গেল : দেখোকদিনের মধ্যেই জমির টাকা খেয়ে ফুরিয়ে দেবে রায়েদের ছোট তরফবড় বড় আইবুড়ো মেয়েদের বিয়ে পর্যন্ত হবে না

ঠিকই তাইকদিন বাদেই শোনলমছোট রায় তাদের বেরাট বাড়িটো ভেঙে সেগুনকাঠের কড়ি-বরগানোকশা-করা কাঠের সাজ আর আর যা কিছু আছে নকড়ায়-ছকড়ায় বিকিয়ে দিচে। সব ঘর ভেঙে দিয়ে একপাশে মাত্তর একটি ঘর রেখে সেখানে বাস করবেএগনের এক কোণে রান্নার লেগে বানিয়ে নেবে একটো ছোট চালাঘর। যাকগোই বাড়ি থেকে রায়েদের বাড়ির আর একটিও জিনিশ কেনা হলো না

 

সোয়ামি সোংসার নিয়ে আমার খুব গরব হলো

যে শাশুড়িকে যমের মতুন ভয় করতমমুখের দিকে তাকাইতে পয্যন্ত সাহস করতম নাসেই শাশুড়ি একদিন বৈকালবেলায় আমাকে তার ঘরে ডাকলে। খোঁকা ত্যাকন খানিকটো ডাগর হয়েছেসে-ও সেই সোমায় আমার কাছে ছিল। ঘরে যেয়ে দাঁড়াইতেই শাশুড়ি আমার কাছে এসে বললেমেতর-বউআমি একটা কথা বলি। এই বাড়ির লক্ষ্মী তুমিতোমার পয়েই সবকিছু আবার হবে। তোমার শ্বশুরের মিত্যুর পর সোংসার ভেসে যেছিলছেলেমেয়ে নিয়ে অগাধ পানিতে পড়েছেলম। আমার ঐ মেজ ছেলে সব আবার ফিরিয়ে আনলে। সেই ছেলের বউ তুমি। আমি সব জানিগায়ের গয়না খুলে দিয়েছ তুমি। আল্লা তোমার ভালো করবে। দোয়া করি তোমাকে। দ্যাওরননদজা সবাইকে তুমি দেখো। চিরকাল ওরা তোমাকে ভক্তি করবেমেনে চলবেআমি জানি। তোমার এই খোঁকা আমার বংশের মানিক। ওর হায়াত দরাজ হোকএই দোয়া করি আমিএই বলে শাশুড়ি আমার মাথার ওপর হাত রাখলে

ঐ একবারই অমনি করে কথা বলেছিল আমার শাশুড়িআর কুনোদিন লয়। এমনিতে কথা পেরায় বলতই না। পাতলা পাতলা দুটি ঠোঁট চেপে থাকতআমাদের সাথে য্যাকন কথা বলত কি কাঠ কাঠ যি লাগত! তা সি যাকগোসেই থেকে আমি জানিসব সোমায় নিজের নিজের করলে কিছুই আর নিজের থাকে না

সোংসারের আয়-বরকত বেড়ে গেল। কত্ত একদিন তার মাকে হিশেব করে বুঝিয়ে দিলে যে চাষের জমি সব মিলে এক-শো বিঘে না হলেও আশি-নব্বই বিঘে হয়েছে। আউশ জমি কুড়ি-পঁচিশ বিঘেতা থেকে আউশ ধান কিছু তো পাওয়া যাবেইতা-বাদে সোমবচ্ছরের যবগমআলুপেঁয়াজতিলসরষে যা যা সংসারের দরকার তার সবই পাওয়া যাবে। জমিতে আখ লাগিয়ে চোত মাসে শাল করে যা গুড় পাওয়া যাবেতাতে সোংসারের পেয়োজন মিটিয়ে অ্যানেকটো বেচাও যাবে। ডাল যা লাগছেমুগ মুশুরি মাস মটর ছোলা আইরি সব ডালই সারা বছরের লেগে হবে। খোঁরো ডিঙিলি পটল ইসব তরিতরকারিও করা যাবে। আর সত্তর-আশি বিঘে জমির আমন ধানে বছরখোরাকি তো হবেইসোংসারের দরকারে ধান কিছু বিক্রিও করা যাবে

চার-পাঁচটো নাঙলের লেগে কেনা হলো আট-দশটো মোষ। এই এলেকার মাটি ভালো লয়এঁটেল মাটিইদিকে গরুর নাঙল চলে না। এই বড় বড় চ্যাঙর ওঠে জমিতেসি চ্যাঙর ভোলা গরুর কম্ম লয়। হাতি হাতি মোষ দরকার। মোষের নাঙলে-তোলা ঐসব চ্যাঙর আবার টানা দিয়ে ভাঙতে হয়

চাষের লেগে একটা-দুটো করে আট-দশটো মোষ কেনা হলো। সেই সাথে গরু-বাছুরও বাড়তে লাগল। বাড়িতে এত লোকছোট ছেলে বলতে অবিশ্যি আমার খোঁকাগরুর দুধ তো কম লাগে না। তাই গাই-গরু অ্যানেকগুলিন হলো। তাদের আবার এঁড়ে বকনা বাছুর যি কতো! সব নিয়ে গোয়াল ভত্তি। পেতলের বড় বড় বালতিতে দুধ আনা হয় দু-বেলা। বড় বড় লোহার কড়াইয়ে জ্বাল দেওয়া হয় সেই দুধ। তাপর বাড়িতে পেঁয়াজের বড় পাহাড় হয়রাখার জায়গা নাই। বাড়তি পেঁয়াজ বেচেও কুনো লাভ নাই। দু-পয়সা চার পয়সা সের। নেবেই বা কেপাঁচ কামরার কোঠাঘরের একটো ঘরের মেজেয় পেঁয়াজ রাখা হয়েছে। সব পচে বাড়ি একদম দুর্গন্ধে ভরে গেল। শুধু পেঁয়াজ কানেগুড়ের আবস্তাও তাই। খানা রাঁধার বিরাট তামার হাঁড়িতে গুড় রাখা হয়েছে। ঘরে রাখার জায়গা নাইপিঁড়ের এক কোণে রাখা হয়েছেঢাকনা পয্যন্ত নাই। একদিন সবাই দ্যাখেএই বড় একজোড়া ইদুর মরে তার মদ্যে পড়ে রয়েছেমাগো কি ঘিন্না! সেই গুড় ফেলে দিলে গুড়ের ঢল বয়ে গেল গোটা এনে জুড়ে। একেই বলে উপছে-পড়া সোংসার। ধান নিয়েও কুনো কুনোবার মুশকিল হতো। অত বড় খামার এক-একটো একশো-দ্যাড়শো মণ ধানের মরাইএকটা-দুটো তো লয়আট-দশটো সারা খামার জুড়েছেলেপুলেরা লুকোচুরি খেলতে পারততা এক-এক বছর সেই খামারেও খ্যাড়ের পালুই আর মরাই করার জায়গা থাকত না। এইসব কথা অ্যাকনকার লোকের পেত্যয় হবে না কিন্তুক ইসবই আমি নিজের চোখে দেখেছি

বাড়িতে ইদিকে মানুষ বেড়েই যেচেবেড়েই যেচে। কাজের মানুষ আলেদা পাওয়া যেত না। গরিব পাড়া-পড়শিভাই-ভায়াদআত্মীয়বেধবা কিম্বা গরিব বউরা বাড়িতে এসে থাকতএটো ওটো করতদুটো খেতে পেত। গামছা দিয়ে ঢেকে বাড়িতে ভাত-তরকারি নিয়েও যেত। কিন্তুক কেউ রেতে থাকত না। গরু মোষ মাঠে নিয়ে যাওয়াচরানোআবার বাড়িতে আনার লেগে সোমবচ্ছরের রাখাল রাখা হতোমাহিন্দার থাকত দুজন। এই সবাই কিন্তুক ঘরের লোক মতুনতবে রেতে নিজের নিজের বাড়িতে ফিরে যায়। বাড়িতে কেউ থাকে না

এমনি অ্যাকটো পরিবার একবার এল ভিন গাঁ থেকে। বাপটো কুটেএকগাদা ছেলেমেয়ে নিয়ে মা হিমশিম খেছে। কত্তা খামারের পাশে ছোট খামারে ঘর বাঁধার লেগে তাদের জায়গা দিলে। কুটে বাপটোকৃঞ্চি-কাবারি দিয়ে চালের ওপরে খ্যাড় চাপিয়ে ঘর একটো বানাইলে বটেতা কাকেও তার চাইতে ভালো বাসা বানায়। সেই ঘরে সবারই জায়গা হলো। বড় ছেলেটো হলো মাহিন্দারছোটটোসে একদম ছোটসে হলো রাখাল। বাপ ঘরের ভেতর দিনরাত শুয়ে থাকেতামুক খায় আর কাশে। তিন-চারটো মেয়ে নিয়ে মা মাঠেঘাটে চরে বেড়ায়। তা বলে কেউ উপোস থাকত নাদুটো ভাত সবারই জুটত। তিন মেয়ের নোম্বা নোম্বা চুলকুনোদিন ত্যাল পড়ে নাই তাতেকটা শণের মতুন রং। বৈকালবেলা মা-টো এই তিন মেয়ের চুলের উকুন বাছতে বসত আর তারা নড়লেই পিঠে মারত গুম গুম করে কিল। খেতে পেলে তবেই না এমন করে উকুন বাছা!

ছুটো-ছাটা কাজের মানুষ আরও ছিল। তিন-চার আনা দৈনিক মজুরিতে সারা দিনের লেগে মুনিষ দুটো-একটো পেরায় দিন থাকত। তারাও সব গরিব আত্মীয়স্বজন। পানি খাবার বেলা ভরপেট বাসিভাত নাইলে মুড়ি আর দোপরবেলায় ভরপেট গরম ভাত এদের জোগাতেই হতো

ইসব হলো সারা বছরের ব্যবস্থা। কিন্তুক বর্ষাকালে ধান রোপার সোমায় আর পোষ মাসে ধান কাটার সোেমায় একদম আলাদা বেবস্তা। ত্যাকন দশ থেকে পনেরো জনা মুনিষ পেত্যেকদিন কাজ করত। আবাদের সোমায় টানা বিশ-পঁচিশ দিন থেকে এক মাস পয্যন্ত তাদের থাকতে হত। ধান কাটার সোমায়েও তাইশ্যাষ না হওয়া পয্যন্ত তারা থাকত। অত লোক কোথা পাওয়া যাবেভিন গাঁ থেকেউত্তরের সব গরিব গাঁ থেকে আসত মুনিষরা। তা বাদে সেই কোথা ছোটনাগপুরের দুমকা জেলার সাঁওতালদের এলেকা থেকে সাঁওতাল মেয়ে-মরদ আসত কাজের লেগে। বর্ষাকালে ধান রোয়া হয়ে গেলে কিম্বা জাড়কালে ধানকাটা শেষ হলে এরা আবার সব নিজের নিজের জায়গায় ফিরে যেত। কত্তার ভাইরা চাষবাসের কাজ দেখাশোনা করত বটে কিন্তুক হাতে মাটি লাগাত না কেউই। একমাত্তর আমার সেজ দাওর নিজের হাতে কিছু কিছু কাজ করত। কিন্তু কত্তাকে তেমন কেউ দেখতেই পেত না। তবু এত বড় যজ্ঞি সে-ই সামলাত। সারা দিন সে বাড়িতে না থাকলেও গাঁয়েই পেরায় থাকত। স্কুল ছিলকত্তামার বাড়ি ছিল। শহরেও যেত মাঝে মাঝে। শহরে গেলে ধোপ-দোরস্ত জামাকাপড় পরে ভোরবেলায় বেরিয়ে যেতফিরত রেতে। জামা-কাপড় আর কিএই ধুতি আর শাটকখনো কখনো পিরেনশীতকালে কাশ্মীরি শালইসবই পরত। কিন্তুক যেখানেই যাকরেতে ফেরা চাই। চেরকাল এই দেখে অ্যালমরাত কখনো বাইরে কাটাত না। মেঘঝড়বিষ্টি কোনো কিছুই মানামানি নাইশতেক বেপদ ঘাড়ে নিয়ে হলেও বাড়ি ফিরবে। এক কোশ দূরে র্যাল ইস্টিশন। সিখানে যাবার পথঘাট নাই বললেই চলে। মাঝে মাঝে ধানের জমির আলপথ ধরে কিম্বা ডাঙামির বনবাদাড় ঝোপ-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে হতো। চারদিক সাপ-খোপে ভরা। গরমকালে ভায়ানক ধুলো আর বর্ষাকালে বেপজ্জয় কাদা। এরই মধ্যে সে যাতায়াত করত। বোধায় অত কষ্ট পেয়েছিল বলেই আর ক-বছর বাদে সোন্দর সড়ক করিয়েছিল গরমেন্টকে দিয়ে। দশ গাঁয়ের যোগাযোগ হয়েছিল র্যাল ইস্টিশনের সাথে

আমরা আর কি বুঝবকিন্তুক বড় বড় মানুষ আর বড় বড় শহরের সাথে কত্তার যি যোগাযোগ হচে তা যেন একটু একটু বুঝতে পারতম। তা না হলে অত শহরে যেত ক্যানেবাড়িতেও দেখি অচেনা-অজানা লোজন আসার কামাই নাই। আমাদের মতুন মেয়েমানুষদের অজানা-অচেনা তো হবেইকত্তাই মাঝে মাঝে বলতঅ্যামন লোকও য্যাকন-ত্যাকন বাড়িতে আসে কত্তা যাদের চেনে না। আত্মীয়-কুটুম ছাড়া গাঁয়ে-ঘরে কার বাড়িতে আবার কটো অচেনা লোক আসেতাইলে ই বাড়িতে এত লোক আসবে ক্যানেভয়ে আমার বুক দুরদুর করেকি জানি এত বেগানা লোক ক্যানে আসে বাড়িতে!

ল্যাখাপড়া এট্টু এট্টু য্যাকন শিখছিত্যাকন কত্তা একদিন বলেছিল ই দ্যাশ পরাধীন। উ কথার মানে ত্যাকন কিছুই বুঝি নাই। কত্তাকে শুদিয়ে জেনেছেলম যিই দ্যাশ মাহারানীর রাজত্ব। দ্যাড়শো বছর ধরে ই দ্যাশ পরাধীন। তার মদ্যে তিন কুড়ি বছর ই দ্যাশ শাসন করেছে এই মাহারানী। সেই রানী মরেচে পেরায় বিশ বছর হলো। অ্যাকন তার ছেলে রাজা। কি আচ্চয্যিকোথাকার কোন্ দ্যাশের লোক রাজা-রানী হয়ে ই দ্যাশ শাসন করছে!

ইসব কথার কিছুই বুঝতে পারতম না। রানী শাসন করছেনা রাজা শাসন করছেচোখে দেখতেও পেচি নাকানে শুনতেও পেচিশাসন করছে তা আমার কিআমার বিয়ের সোমায় শুনেছেলম একটো যুদ্ধ হচে সারা দুনিয়া জুড়ে। সি তো শোনা কথাযুদ্ধ কিছু দেখি নাই। তা আজকাল দেখি কত্তা বলছেসারা দুনিয়ার এই যুদ্ধ জিতে রাজা লিকিনি মুসলিম জাহানের খলিফা যি দ্যাশে থাকে সি দ্যাশ থেকে তাকে তাড়িয়ে দেবে

কত্তার কথা তেমন বুঝতে না পারলেও কেমন ভয় ভয় করতে লাগল আমার। এইসব লেগেই কি বাড়িতে অত অচেনা-অজানা মানুষ আসছেএই লেগেই কি কত্তা পেরায় পেত্যেকদিন শহর-গঞ্জে যেচে?

ইদিকে বাড়িতে সুখের অন্ত নাই। দুধ ঘি মাখন মাছ গোশতো তরি-তরকারি চাল-ডালে ভেসে যেচে বাড়ি। দিনদিন লোক বাড়ছে। মুনিষ-জনবছর-কাবারি মাহিন্দারে বাড়ি ভরা। কত্তা আজকাল পেরায়ই বাড়ির ভেতরে মা-বুনের কাছে আসে এটো-ওটো কথা বলার লেগে। কুনোদিন এসে বলেমাতুমি জানো বাপজির তাজি ঘোড়া ছিলনিজের ছয়-বেহারা পালকি ছিলবাউরি-পাড়ায় সোমবচ্ছরের জন্যে বেহারাদের ঘর ঠিক করা ছিল। সেসব কোনদিকে কি হয়ে গিয়েছে। পরচালির খুঁটিতে ঘোড়ার পুরনো জিনটা দেখি আর ভাবিসব আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। পালকি আবার নতুন করে তৈরি হবে। গিগাঁয়ের ছুতোরমিস্ত্রিরা দুদিন বাদে আসবে। পুরনো পালকিটা নতুন করে ফেলব। নতুন ছাউনি হবে,নতুন ভঁপনতুন রঙ হবে। আর ঐ সঙ্গে গরুর গাড়ির নতুন একটি বড় টপ্পরও করিয়ে নেব

ঘরের কাজ করতে করতে আড়চোখে চেয়ে দেখিশাশুড়ির মুখে বড্ড খুশি। মুক্তোর মতুন জিরি জিরি শাদা দাঁত দেখা যেছে কি যেছে না। ছেলের লেগে শতেক দোয়া যেন ঝরে পড়ছে চাউনি থেকে। শাশুড়ি বলছেসে তো ভালো কথা বাবা। আমি জানিতুমি আবার সব করবে

হ্যাঁসব আমার নতুন করে হলো। লতুন পালকি হলোগরুর গাড়ির লতুন ছই হলো। বাইরে কাজ হতোকাঠের গন্ধবাঁশের গন্ধরঙের গন্ধ বাড়ির ভেতরেও প্যাতম। কাঠ চাচাবাঁশ চ্যাঁচাবেত চাচার শব্দও কানে আসত। সব তৈরি হয়ে গেলে একদিন সিসব দেখেও অ্যালম

কদিন বাদেএক-দু-মাস হবেকত্তা একদিন ঠিক দোপরবেলায় বাড়ির ভেতরে এসে মাকে বললেঘোড়া একটি কেনা হয়েছেআমাদের খামারে বাঁধা আছে। আড়াল থেকে দেখবে চলো

শাশুড়ির বাইরে আসার মন ছিল না। কিন্তুক ছেলে বললে আর কি করবে। বউ-ঝি বিধবা ননদ সবাইকে সাথে যেতে বললে। কত্তার ভাইরা কেউ ছিল কি না মনে পড়ছে না। পরচালির দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলমএই বড় একটো সর্ষে-সর্ষে রঙের ঘোড়া খুঁটিতে বাঁধা আছেমাহিন্দার ছোঁড়াটো একবার কাছে যেচেআবার ভয়ে পিছিয়ে আসছে। ঘোড়ার লতুন সাজনতুন চামড়ার জিনইসব কেনা হয়েছেসি-সবের গন্ধ পেচিচামড়ার ক্যাচম্যাচ আওয়াজও পেচি। শাশুড়ি এট্টুখন দাঁড়িয়ে থাকলেতাপর বাড়ির ভেতরে চলে গেল

আর কিসব তো মোলোকলায় পুন্ন হলো। সবাই এমন ভাব করতে লাগলে যেন সব গরবই আমার। মিছে বলব নাসি আমার খুব ভালো লাগত। তাই বলে দেমাগ আর গরব দেখানোর কুনো বাগ নাই। আমি জানতমউসব করতে গেলে কত্তা আমার নতিজার বাকি রাখবে না। চিনি তো উ মানুষকে। তা আমারও কুনোদিন উসব করতে মন যায় নাই। আমি ছেলের মাআমার তো আর কুনো গরব নাই। এক এই গরবই য্যাথেষ্ট!

 

সোংসার সুখ-দুখের দুই সুতোয় বোনা বই-তো লয়

বিয়ের এক বছরের মাথায় আমার খোঁকা হয়েছিল। তাপর আট বছরের মধ্যে আমাদের সোংসারে আর কুনো ছেলেপুলে হয় নাই। ভাশুরের বিয়ে কত্তার বিয়ের ক-বছর আগেই হয়েছিল। পেথম পেথম মনে হতোবড় বউয়ের ছেলেমেয়ে হতে একটু সোমায় লাগছে। তা-পর এক বছর যায়দু-বছর যায়তিন বছর যায়য্যান ছেলেপুলে হলো নাত্যাকন বোঝা গেল উয়াদের আর সন্তান হবে না। ওষুধ-পত্তর করা হয়েছিল বৈকি। কিন্তুক কেরমে কেরমে সবাই আশা ছেড়ে দিলে। বড় বউ তাইলে বাঁজা। আর বড়কত্তাআমার আলাভুলো ভাশুরউ নিয়ে কুনোদিনই মাথা ঘামাইলে না। সে তো সংসারের কুনো কিছুতেই থাকত না!

সেজ দ্যাওরের বিয়েটা হলো অ্যানেক পরে। তার বিয়ের বয়েস পেরিয়ে গেয়েছিল। তবে এট্টু দেরি হলেও কত্তাই উদযুগ করে বিয়ে দিলে। কিন্তু বিয়ের তিন-চার বছর পরেও তার ছেলেপুলে কিছু হলো না। সেই লেগেই বলছেলম আট বছর ধরে সোংসারে ছেলে বলতে আমার ঐ খোঁকা। তা এই আবস্তায় সে আর একা আমার খোঁকা হয়ে ক্যানে থাকবেসে হলো সবার চোখের মণি জানের জান। একা সোংসারে দিন দিন ছিরিবৃদ্ধি। সবাই মনে করতে লাগল ঐ খোঁকাই এত সুখের মূল। তাকে নিয়ে কি যে করবে সি আর কেউ খুঁজে পেত না। সবকিছুতে আগে বড় খোঁকার কথা। বাড়িতে মন্ডা মিঠাই এলে বড় খোঁকা কইযে য্যাকন বাইরে যেচেকিছু একটো হাতে করে আনছে বড় খোঁকার লেগে। কত্তাই বরঞ্চ খোঁকার দিকে তেমন নজর দেয় না। সে হয়তো সোমায়ই পায় না। হয়তো ভাবতছেলে তো সবারইআমি না দেখলেই বা কিদেখার লোকের কি অভাবছোট বুনটির ত্যাতোদিনে বিয়ে হয়ে গেয়েছিল বটেতবে তারপরের ছোট ভাই দুটির ত্যাকননা বিয়ে হয় নাই। এই ল আর ছোট দ্যাওর দুটি আমার দুটি ভাই-ই ছিলযা বলতম তা-ই শুনত আর খোঁকাকে খানিকক্ষণ না দেখলেই চোখে যেন আঁদার দেখত

এই করতে করতে আট বছর কেটে গেল। কি আচ্চয্যি মাচোখের ছামনে আমার শামলা রঙের খোঁকা আট বছরেরটি হয়ে গেল। কি তার চোখে মায়া কি তারমুখে লাজুক হাসি! সি আর কুনোদিন দেখলম না! ঠিক সোমায়ে তার হাতেখড়ি হলো। কত্তা নিজেই হাতেখড়ি দিলে। এই সোমায়েকি করে আমার মনে নাইগাঁয়ে এক ওস্তাদজি এল। তাকে গাঁয়ে আনা হলোনাকি সে নিজেই এলঅ্যাকন আর বলতে পারব না। তার কাজ হলো খোঁকাকেই পড়ানো। গাঁয়েমোসলমান পাড়ায় তো পড়ার মতুন আর একটি ছেলেও ছিল না। কত্তা মাটির পাঁচির দিয়ে ঘেরা একটো বড় ভিটে কিনেছিল। একটি মাত্তর ছোট মেটে ঘর ছিল সিখানেতাতে কুনো জানেলা নাই। আলকাতরা মাখানো একটিমাত্র দরজা ছিল। সেই ঘরে হলো ওস্তাদজির আস্তানা আর মোটে একজনা পোড়ো আমার খোঁকা। সবাই বলত কালা ওস্তাদজিকানে সে কিছুই শুনতে পেত না। ভারি ভালো লোকতিন-বেলা তার খাবার যেত আমাদের বাড়ি থেকে

খোঁকার জন্মের চার বছর পর আমার একটা সন্তান লষ্ট হলো। সে-ও খোঁকা ছিল। পেট থেকে মরাই জন্মাইছিল। কে আর কি করবেদু-দিন বাড়িটো থম ধরে থাকলশুদু শাশুড়িকে মুখ ফুটে আহাজারি করতে শুনেছেলম। ত্যাকন দুনিয়া কঁকা ছিলগভভভ লষ্ট হলে সবারই খুব গায়ে বাজত। ই ক্যানে হলোই ক্যানে হলোএমন দুর্দৈব ক্যানেশাশুড়ির খালি এই আপসোস! ইদিকে ছেলে হতে যেয়ে আমার পেরায় সব রক্ত বেরিয়ে গেলমরার মতুন হলোম। শরীর শুকিয়ে কাটি হলো। মরা ছেলের মুখটো একবারই দেখেছেলম। সি না দেখাই ভালো ছিল। সোমায়ের অনেক আগেই সে দুনিয়াতে আসতে চেয়েছিল। যিদিন বাড়িতে এই বেপদ ঘটেসিদিন কত্তা বাড়িতে ছিল কি না মনে করতে পারছি না। বোধায় ছিল না। বাড়ির বউয়ের সন্তান হবে ই ছিল মেয়েলি বেপারবাড়ির পুরুষদের ইনিয়ে নিয়ে কুনো ভাবনাই ছিল না। তাদের তো কিছু করার নাই। হাড়িবউ দাই ঠিক করা আছেসি ব্যবস্থা বছরকাবারি। বছরের শেষে দাই একটো সিদে পায়শাড়ি-কাপড় পায়চাল-ডাল পায়পারলে কেউ কেউ নগদ-ও কিছু দেয়। সন্তান হলেও দেয়না হলেও দেয়। বছর শেষে চোত মাসের মদ্যেই দেয়। আর সন্তান হলে তো কথাই নাইত্যাকন অ্যানেক কিছুই পায়। বড়লোকের বাড়ি হলে সোনা-রুপোর গয়নাও পায়। আমার বড় খোঁকা হলে তার দাই সোনার মাকড়ি পেয়েছিল। যাকগোকত্তা সিদিন ছিল কি ছিল না মনে নাইএতটুকুনি মরা ছেলে ন্যাকড়ায় জড়িয়ে একপাশে রাখা হয়েছে। রেতে ফিরে কত্তা কি একবার দাঁড়িয়ে দেখলেকি জানি! ডাক্তারবদ্যির কুনো কথাই ছিল না। তাই ভাবিছেলে মলোমা-ও তো মরতে পারত। তাই যেদি হতোতাইলে কত্তা কি করতব্যাটাছেলে আবার কি করবেমায়ের কথা শুনে দিনকতক বাদে আবার বিয়ে করত। একটো ফল দিয়ে ফলগাছ মরে গেয়েছেতা আবার তার পাশে আর একটো ফলগাছ লাগাতে হবে নাইসব কথা অ্যাকন মনে হয়ত্যাকন কিন্তুক মনে হয় নাই। কত্তার মুখটা কেমন হয়েছিল ত্যাকন দেখি নাইপরেও কুনোদিন কত্তা ই নিয়ে কুনো কথা বলে নাই

বেপদের ছোঁয়া কি চেরকাল থাকেই বাড়িতেও থাকল না। একদিন খবর পাওয়া গেল ছোট যে বুনটির বিয়ে হয়েছিল দশ কোশ দূরের এক গাঁয়েসেই বুনের একটি খোঁকা হয়েছে। যেদিও সি অন্য বংশের বেপারতাদের বাড়িতে পেথম বংশধর এয়েছেতবু মেয়ে তো ই বংশের! সেই লেগে ই বাড়ি আনন্দের সাগরে ভাসতে লাগল। কত্তা তার ছোট বুনদের কি চোখে দেখত সিকথা আগে বলেছি। বিশেষতার এই ছোট বুনটিকে ভারি ভালোবাসত! সোম্বাদ পেয়েই কতো কি সামিগ্রি দিয়ে ঝুড়ি বাঁক ভরে লোক রওনা করিয়ে দিলে আর নিজে ঘোড়া হাঁকিয়ে ছুটল ছোট বুনের বাড়ি। গাঁয়েই যে বড় বুনের বিয়ে হয়েছিলতার ত্যাকন বেশ কটো ছেলেমেয়ে হয়েছেদুটি ভাগ্নে তো ত্যাকন বেশ ডাগরই হয়েছেতবু ভিনগাঁয়ে ছোট বুনের খোঁকা হবার খবরে কত্তা কি খুশি যি হলো সি আমার অ্যাকনো মনে পড়ে

আস্তে আস্তে সব আবার আগে অ্যাকন জোয়ান মরদ হয়ে উঠেছে। দুজনাই বড় স্কুলে পড়ছিল। সেজ-জনা তো ল্যাখাপড়া করলে নাআমার বিয়ের আগেই বোধায় স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল। অ্যাকন দেখছি ল-দ্যাওরের-ও মতিগতি ভালো লয়স্কুল মনে হয় ছেড়েই দেবে। কত্তার কাছে এসে মাথা নামিয়ে দাঁড়ায়পায়ের নোখ দিয়ে মাটি খোঁড়ে আর ব্যাবসা-ট্যাবসা করা যায় কিনা ভয়ে ভয়ে ভাইকে সেই কথা শুদোয়। তবে ছোট দ্যাওরটি মন দিয়ে স্কুলে পড়ছে। আমার খোঁকাও কালা ওস্তাদজির কাছ থেকে ছাড়ান পেয়ে স্কুলে ভত্তি হবে হবে করছে। এই সোমায়ে য্যাকন। সবারই মনে হছিল সোংসারে শিগগিরি আর কুনো ছেলেমেয়ে আসবে নাসেইরকম সোমায় আমারই আর একটি খোঁকা হলো। বড় খোঁকার বয়েস ত্যাকন আট বছর

বড় খোঁকা ছিল শামলাসি রঙ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যেতজানে শান্তি হতো। গরমকালে গাছের ছোঁয়ায় বসার মতুন মনে হতো। আর ই লতুন খোঁকার রঙ হলো গোয়রা ধপধপে। বড় খোঁকা হলো ঠিক তার বাপের মতুনকৰ্ত্তার গায়ের রঙ-ও ছিল শামলালতুন খোঁকা হলো তার মামার মতো

তাইলে সোংসারে ত্যাকননা পয্যন্ত ছেলেপুলে বলতে হলো আমার দুটি খোঁকাই। সেই কালে ছেলেমেয়ে কমবেশি নিয়ে কেউ কিছু ভাবত না। চাকরি করে কঁচা টাকা আয় করে সবকিছু কিনে খাওয়া তো ত্যাকন ছিল না। সবাই গাঁয়ে-ঘরে থাকেবাইরে আর কে যেচেবাড়ির খেচেবাড়ির মাখছে। শুদু কি মানুষগরু ছাগল কুকুর বেড়াল সবারই হক আছে। বলতে গেলে এক থালাতেই সবাই খেচে। পগারেজমিতেড্যাঙ্গায় যিখানে ঘাস হয়েছেসি ঘাস দুটো ছাগলে খেলেও যাদশটো ছাগলে খেলেও তা-ই। ঘাস কি ফুরিয়ে যেচেসব্বারই গরুছাগলে সি ঘাস খেতে পারবে। বাড়িতে একটো ছেলেনা দুটো ছেলেনা দশটো ছেলে সি হিসেব ক্যানে করবে লোকেখাক না সবাই মিলে য্যাতোক্ষণ আছে। তাই দেখতম পেরায় সব বাড়িতেই পাঁচটো-ছটো ছেলেমেয়ে আছেই। দশ-বারোটোপনেরোটা পয্যন্ত ছেলেমেয়ে হত কারু কারু। তবু গাঁ-ঘর ফাঁকাই লাগতঅ্যাকনকার মতুন গিগি করত না

লতুন খোঁকার জন্ম হলো বলে বাড়িতে তাই আনন্দ বাড়ল বই কমল না। শাশুড়ি ননদ আমাকে নিয়েই বড়াং করতে লাগল। তারা বলত মেতর বউয়ের পয়েই সব হচে। আয়-সম্পত্তি বাড়ছেআবার দ্যাখো ক্যানেবংশও বাড়ছে

এই করতে করতে দিন পেরুইচেমাস পেরুইচেবছর পেরুইচেশ্যাষে দু-বছর গেলেআমার পরের খোঁকাটি দু-বছরেরটি হলেএকদিন জানা গেল সেজ বউ বারদার। এই কথা জেনে আমার আনন্দ হলো সবচেয়ে বেশি। এতদিন পেরায়ই মনে হতো সবারই সব সুখ যেন আমি একাই কেড়ে নিয়েছি। সুখ যি ভাগ করে নিতে হয়। নিজের সুখ কম করে নিলে তবে সেই সুখ বাড়ে। আমি সেজ বউয়ের খুব আদর-যত্ন করতে লাগলম। অনেক কাজ আর আমি তাকে করতে দেতম নানিজেই করতম

গাঁয়ের খাওয়াদাওয়া ত্যাকন খুব শাদামাটাএকইরকম খাবার-দাবার সব বাড়িতে। সেই ভাত ডাল তরিতরকারি! মাছ গোশতো খুব কম। মাছ যেদি বা মিলতগোশত খাওয়া খুবই কম। হিঁদুরা বোধায় সারা বছরেও একদিন গোশতো খেত না। মোসলমানরা মুরগি পুষত বলে ডিম আর মুরগির গোশতোটো কখনো কখনো খেতে পেত। সেজ বউয়ের খাওয়াটো যাতে ওরই মদ্যে একটু ভালো হয়আমি সেই চেষ্টা করতাম। তবে সে খুব সামান্য। কারও লেগেকুনো কারণে আলাদা খাবার-দাবারের কথা ত্যাকন কেউ ভাবত না। ছেলেমেয়ে হবেনা হবেভূ-ভারতে রাতদিন হচেইয়ার লেগে আবার হ্যানো লয় ত্যানো করতে হবে ক্যানে। সি যা-ই হোকদুধ আর ডিমটো আমি আলাদা করে সেজ বউকে জোর করে খাওয়াতম। দশ মাস। দশ দিনের মাথায়কে জানে দশ মাসনা ন-মাসসবাই দশ মাস দশ দিনই বলততাই বলছিদশ মাস দশ দিনের মাথায় সেজ বউয়ের একটো মোটাসোটা খোঁকা হলো। আপনাআপনিই হলো। দাইবউ এসে দেখে খোঁকা হয়ে গেয়েছে। মাটিতে পড়ে ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদছে। আমরা সবাই মজাক করে হেসে হেসে বললমদাইবউতোমার ইবার আর কুনো পাওনা নাইআঁতুড়ঘরে ঢুকতেও হলো না। ই ছেলে তোমাকে কি দাই-মা বলে ডাকবে?

কথা শুনে দাইবউ লথ নেড়ে নেড়ে কি হাসতেই না লাগল। ইয়ার পরের কথাটো এইখানেই বলে দিছি। সেজ বউ আর কুনো সোমায় নিলে নাপরের বছরএক বছর হয়েছে কি হয় নাইতার আর একটো খোঁকা হলো

 

ও মামাগোকতোদিন যাই নাইএইবার বাপের বাড়ি যাব

দুই ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ি যেচি। ছোট ছেলেটো ত্যাকন একটু ভঁটো হয়েছে। মাঝখানে পরপর দু-বছর বাপের বাড়ি যাওয়া হয় নাই সাংসারের হ্যাঙ্গামে। বিয়ের পর থেকে পিতিবারেই গরমকালে বাপের বাড়ি যাওয়া হয়েছে। আবার পিতি বছরেই বাপের বাড়ি থেকে ভাদর মাসের শেষেনাহয় আশিন মাসে মা কতো যি খাবার-দাবারপিঠেপুলিফলমূলকাপড়-জামা পাঠাইত তার সীমা নাই। সৎ-মা বলে যি কোথাও গাফিলি হবেতার জো ছিল না। ভারা কাঁধে নিয়ে লোক আসতসঙ্গে আসত বাগদিবউ। অ্যানেকরকম জিনিশ আসত। কুনো কুনো বছর আবার বড় মিরিক লয়তো রুই মাছও আসত। শাশুড়ি ইসব যেমন খুব পছন্দ করততেমনি নিজের কত্তব্যও করত। ফেরত যাবার সোমায় বাগদিবউকে খুশি করে দিত। ভারাটো-ও ফাঁকা যেত না। আমি বাপের বাড়ি যাই আর না যাই মায়ের কিন্তুক উসব পাঠানোর কুনোবছর কামাই ছিল না

মাঝখানে দু-বছর যাই নাই। যাই নাই কিন্তুক ইবার যেই যাবার কথা হলোকত্তাও মত দিলেত্যাকন জান যেন ছেড়ে যেতে লাগল। কি করে ভুলে ছেলম মা! কোন্ নিব্বাসনে পড়ে আছিকাদের নিয়ে কি করতে সোদর ছেড়ে এত দূরে আছিকোথা রইল মা-বাপকোথা রইল ভাই-বুনকোথা রইল গাঁ-ঘরএইসব মনে করে বুকের মদ্যে হু হু করতে লাগল

আমি বাপের বাড়ি য্যাতম আমাদের নিজেদের মোষের গাড়িতে আর ফিরে আসতম বাপের বাড়ির গরুর গাড়িতে। গাড়ি বিহানবেলায় যাবার লেগে তৈরি হলো। গাড়িতে খ্যাড় বিছিয়ে তার ওপর মোটা মোটা চারটো ফুল-তোলা কাঁথা বিছিয়ে বিছেনা তৈরি হলো। নতুন টপ্পরের পেছনের মুখ শাড়ি দিয়ে বাঁধাছামনের মুখ-ও শাড়ি দিয়ে বাঁধা। একবার ভেতরে ঢুকলে আর কিছুই দেখবার উপয় নাই। মাহিন্দার ছোঁড়াটো গাড়ি ডাকিয়ে নিয়ে যাবেপাকা বাঁশের লাঠি নিয়ে পেছু পেছু হেঁটে যাবে হলা বাগদি। পৌছে দিয়ে গাড়ি নিয়ে ফিরে আসবে

দুই ছেলে সাথে করে গাড়িতে উঠে টপ্পরের ভেতরে ঢোকলম,, কবরের ভেতরে ঢোকলম! বড় খোঁকা ত্যাকন অ্যানেকটো সেয়ানা হয়েছে। সে ভেতরে থাকবে ক্যানেগাড়োয়ানের কাছে যেয়ে বসবে। আমি খালি ভাবচি পাড়াটো শুধু পেরুইলে হয়মাঠে যেয়ে পড়তে বাকিটপ্পরের ছামনের শাড়িটো তুলে দোব। গাড়ির কাঁচ কাঁচ আওয়াজ হচেটপ্পর লতুন রঙ করা হয়েছেতার গন্দো আসছেটপ্পরের সরু একটো ফাঁক দিয়ে রাস্তার লাল ধুলো দেখতে পেচি। বোঝলমপাড়াটো পেরিয়ে এসে গাঁয়ের ঠিক বাইরে বড় দিঘিটোর দখিন পাড় দিয়ে যেচি। শুকনো ডহরে হড় হড় করে গাড়ি নেমে আবার রাস্তায় উঠতেই আমি খোঁকাকে বললমছামনের কাপড়টো সরিয়ে দে তো বাপ

কাপড় সরিয়ে দিতেই এমন ভালো লাগল সি আর কি বলব! সকালবেলার হাওয়া এসে গায়ে লাগলজানটো যেন তর হয়ে গেল। ইদিকে নদীনালা তেমন নাইশুদু ধানের জমি। বিরাম জমি লয়সেই লেগে মাঠ ধু ধু করে না। ফসলি ধানের জমির মাঠতার কি অরম্বশ্যাষ নাইযিদিকে তাকাইচোখ যেচে যেচে যেচেকোথাও আটকাবে না। উঁচু-নামো-ও নাই কোথাও। শ্যাষে অ্যানেক দূরে চোখ যেয়ে ঠেকছে কুনো একটো গায়ে। মাথার ওপরের আসমানের মতনই মাঠের আসমান

সেই সোমায় রাস্তাঘাট তেমন ছিল না। পাকা রাস্তা তো লয়-ইকাচা সরান-ও লয়। মাঠের ওপর দিয়ে পায়ে-চলার রাস্তা চ্যাওড়া আলের ওপর দিয়ে। লোকে বলে পথ-আল। আর আছে গরু-মোযের গাড়ি চলার অনেক অ্যানেক রাস্তা। কিলবিল করছে। এঁকে-বেঁকে হয়তো দশটো রাস্তার একটো যেয়ে গাঁয়ে ঢুকেছে। ইসব রাস্তা ধান-কাটার সোমায় জাড়কালে খুব ব্যবহার হয়েছে। অ্যাকন খরানির কালে আস্তে আস্তে ঘাসে ঢেকে যেচে। শুদু একটো-দুটো রাস্তা এক গাঁ থেকে আর এক গাঁ হয়ে মাঠের বুক চিরে কোথা গেয়েছে কে জানে! গাড়ি যেয়ে যেয়ে সিসব রাস্তায় খুব ধুলো। বাতাসে উড়ছেআর বেশি বাতাস হলে ধুলোয় ধুলিষ্কার শাদা মেঘ হয়ে উড়ে বেড়াইচে

মাঠের মাঝে এসে দেখলমকুনোদিকে লোকজন দেখা যেচে না। অ্যাকন থাকবেই বা ক্যানে লোকসেই মাঘ-ফাগুনে ধান কাটা হয়ে গেয়েছে। সব একফসলা বোয়া আমন ধানের জমিধান ছাড়া আর কিছু হয় না। ধান কাটার পরে জমি সব অ্যাকন ফাঁকা পড়ে আছেনাড়াগুলিনও ধুলোয় ঢেকে গেয়েছে। আবার জষ্টি মাসে পানি হয়ে জমিতে বাত না হলে গরু-মোষের নাঙল নিয়ে মানুষ মাঠে নামবে না

আমি তাই টপ্পরের দু-মুখের শাড়িই খুলে দিতে বললম। কে আর দেখছেদুই পুত নিয়ে বাপের বাড়ি যেচিভয় তো কিছু নাই! সঙ্গে লোকও আছে। গাছপালা ইদিকে তেমন নাই বটেতাই বলে বনকুল শেয়াকুলর্যালপাতি ইসবের ঝোপ-ঝাড় কি নাইআর আছে যিখানে সিখানে থ্যালানে থ্যালানে পুকুর। অ্যাকন শুকিয়ে কাঠ। দু-একটোয় সামান্য পানি আছেঅ্যাকটো-দুটো আছে বেশ পানিতে ভরা। সি পানি খাওয়া-ও যায়। ইসব মেঠো দিঘির পাড়ে বেরাট বেরাট বট-পাকুড় গাছ। তাদের হেঁয়ায় খানিকক্ষণের লেগে গাড়ি থামিয়ে গরু-মোষের বিঘ্রাম হয়। উদের পানি খাওয়ানো-ও হয়

আমরা তা-ই করলমঅ্যাকটো বড় পাকুড় গাছের তলায় গাড়ি থামিয়ে গাড়োয়ান মোষদুটোকে পানি খাওয়াইতে নিয়ে গেল। আমি-ও কঁকালটো একটু ছাড়ানোর লেগে ছেলেদুটোকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলম। দ্যাখলমহলা বাগদি ত্যাল-চুকচুকে পাকা বাঁশের লাঠিটি বগলে রেখে দু-হাত জোড় করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ভয় কিছু নাই। জানি যি হলা বাগদি কুনো বেপদ এলে জানকে জান করবে নাতাকে না মেরে আমার কি আমার সন্তানদের গায়ে কেউ একটো আঁচড় পয্যন্ত দিতে পারবে না

আমি এট্টু ইদিক-ওদিক হাঁটছিবড় খোঁকা বটগাছটোকে ঘুরে ঘুরে দেখছে কি কি পাখি আছে। দোপরবেলাতাই পাখি ডাকছে না বটে কিন্তুক অত বড় গাছে অনেক পাখি নড়েচড়ে বেড়াইছে বেশ বোঝা যেচে। গাছটো মনে হচে জ্যান্তকথা বলছে। গাছতলায় খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলম। হ্যাঁঅ্যাকন মনে হচেমাঠের ঠিক মাঝখানে এয়েছি। কুন্ দিকে কুন্ গাঁ তা আর বোঝা যেচে না। ধুলোয় লেপুটে গেয়েছে। অ্যাকন আসমানও লাগছে গোলমাঠও লাগছে গোল। একটু ভয় লাগলক্যানে তা জানি না। খালি মনে হতে লাগল কুনো রাস্তাই আর শ্যাষ হবে না। কি করে কোথা শ্যাষ হবে কে বলতে পারবেমনে হচেঘরবাড়ি পুকুরঘাট সবুজবন আর কি দেখতে পাওয়া যাবে! ইকথা মনে করে নিজের মনেই হাসলম। কতোবার ই পথ দিয়ে বাপের বাড়ি গেয়েছি। যতোদূরই হোকপথ কি ফুরোয় নাইমায়ের কাছে কি যাই নাই?

দোপর গড়িয়ে পেরায় বৈকালবেলায় একটো চটিতে পৌছুলম। আর গাঁ দূরে লয়। কিন্তুক চটিটো তেপান্তর মাঠের মাঝখানেই। ইদিকে-উদিকে দু-চারটো মেটেঘর। মোটে একটো-দুটো ভদ্রাসন। এমন জায়গায় কুনো গেরস্ত কি নিয়ে থাকতে পারেতবু এই তেপান্তরে বাস করছে দু-একটো পরিবার। আর মেটে ঘরগুলিন হচে দোকানমুদির দোকানহাঁড়িকুড়ির দোকান আর মিষ্টির দোকান। যতোবার আসি মিষ্টির দোকানে একবার গাড়ি থামে। ভাইবুনদের লেগে মিষ্টি লিছেলেপুলেরা খায়। মিষ্টি কি-ই বা আর পাওয়া যায়। রসগোল্লামন্ডাজিবে-গজাচিনির ছাঁচকদমা-বাতাসা এইসব। ছেনার মিষ্টি-রসগোল্লা আর মন্ডা খুব ভালো হয়। কুনো ভ্যাজাল থাকে না। উপয় থাকলে ময়রা লিশ্চয় ভ্যাজাল দিতনিরুপায় হয়েই ভ্যাজাল দেয় না। ছেনা আর চিনি দিয়ে মিষ্টিভ্যাজালটো কি দেবেখুব বেশি হলে ছেনায় সুজি দিতে পারে। তা কতোটেই বা দিতে পারে আর সুজি তো খারাপ কিছু লয়। যাই হোকছেলেরাগাড়োয়ান আর হলা বাগদি মিষ্টি খেলে। আমি রাস্তাঘাটে কিছু খাই না। ভাইবুনদের লেগে মিষ্টি নেওয়া হলো শালপাতার বড় বড় ঠোঙায়!

সাঁঝবেলায় মুখ-আঁধারি রেতে বাপের বাড়ি পৌছুলম। সাঁঝ বেলাটোর মুখে কুথাও যেয়ে পৌছুইতে আমার ভালো লাগে না। পিদিম ঘরে ঘরেনাইলে হেরিকেন জ্বালাইচেমিটমিট করে আলো জ্বলছেকিছুই ভালো দেখা যেচে নামনটো খারাপ লাগেবৈকালি এসে পেঁৗছুতে পারলে আমি ছেলেদুটিকে তাদের নানি-খালার কাছে রেখে পাড়া বেড়াইতে চলে য্যাতমনাইলে পাড়ার লোকেরাই আসত বাড়িতে দেখা করতে অ্যাকন আর তা হবার বাগ নাই

বাড়িতে মা বাপজি ছাড়া এক ভাইতিন বুন রয়েছে। সৎ-ভাইটো বেশ বড়সড়ো হয়েছেদুটি বুনও অ্যানেকটো ডাগর হয়েছে। শুদু একটা বুন দুধের শিশু। আমার মা মরে গেলে কি হাল হয়েছিল ই সসাংসারের সব পেরায় ভেসে গেয়েছিল। সৎ-মা এসে আবার ভর-ভরন্ত সোনার সোংসার করেছে। শুদু একটো কথা আচ্চয্যি! বাপজি সি কালের হিসেবে বিদ্বেন লোকবাংলা জানেফারসি জানেফারসি বয়েত পয্যন্ত লিখতে পারেনিজে একটো শুভঙ্করি বই লিখেছে কিন্তুক ছেলেমেয়েদের ল্যাখাপড়ার দিকে ক্যানে তার মন নাই কে জানে! আমাকে নাহয় পাঠশালে পাঠায় নাইমা মরেছেছোট ভাইটো কোলেরসোংসারে বেপৰ্য্যয় বেপদমেয়ের ল্যাখাপড়া না হয় না-ই হলো। তা বাদে মেয়েমানুষের আবার ল্যাখাপড়া কিবারো হাত শাড়িতে মেয়েমানুষ লিকিনি ল্যাংটোইসব পাড়াগাঁয়ের মেয়ে কুনোদিন তো জজ-ব্যালেস্টার হবে নাতাইলে তাদের আবার ল্যাখাপড়া শেখার কি দরকারহ্যাঁবোঝলম ইকথা। কিন্তুক ভাইটো কি দোষ করলেবড়টোর দায়ভার তো নিতে হয় নাইআমার মামারাই সি ভার নিয়েছে। তাইলে ই ভাইটো ক্যানে ল্যাখাপড়া শিখবে নাদেখলম সে আর স্কুলে যায় না। কুনোমতে পাঠশালের পড়া শ্যাষ করেছে। স্কুলে আর যায় নাই। তাকে শুদিয়ে জানতে পারলমস্কুলে ভত্তি হতে টাকা লাগবে। বাপজি বলেছে টাকা আসবে কোথা থেকে! স্কুলে পড়ে কাজ নাই

হঠাৎ একদিন ঠিক দোপরবেলায় ক-ক রোদে আমার ছোট ভাইটি এসে হাজির হলো। অ্যানেকদিন থেকে দেখি নাই। ইয়াকেই দুবছরেরটি রেখে আমার মা দুনিয়া থেকে চলে গেয়েছিল। তাপর বেশিদিন আর বাপজির সোংসারে থাকতে হয় নাই তাকে। মামুরা এসে নিয়ে গেয়েছিল। তারাই তাকে বড় করবে,মানুষ করবেযা যা করার সবই করবে। আপন লোকদের কাছেই গেল বটে ভাইটো কিন্তুক বাপজি ক্যানে ছেলে ছেড়ে দিলেসি আমি ত্যাকননা বুঝি নাইঅ্যাকনো বুঝি নাই। অভাবের সোংসার লয়কিছু লয়। লতুন সোংসার হয়েছে তাতেই বা কিআমি বড় বুনটা তো আছি ভাইকে দেখার লেগে! তাইলে ছেলে দিয়ে দিলে ক্যানেসে মামুদের কাছে চলে যাবার পরে আমার সাথে কমই দেখা হয়েছেমামুদের গাঁয়ের পাঠশালে ভত্তি হয়েছিল। সেখানকার পড়া শ্যাষ হলে আমার শ্বশুরবাড়িতে কত্তার কাছে এয়েছিল। আমার কাছেই আসলে এয়েছিল। বললেমামুরা তো আর পড়াইতে পারবে না। সে সোমায়ে উ গাঁয়ে বড় স্কুল ছিল না। ত্যাকনকার দিনে বড় স্কুল আর কটো ছিলখুবই কম আর যে কটোই ছিল,অ্যানেক দূরে দূরে। সেই লেগে দূরের কুনো গাঁয়ে থাকা-খাওয়া থেকে স্কুলের মাইনে পয্যন্ত যি খরচ হবে তার জোগান দেবার শ্যামতা মামুদের নাই। তারা আর কিছু করতে পারবে না। ইসব কথা শুনে আমি কিন্তু কিছুই বলি নাই। হোক মায়ের পেটের ভাইতবু বাপের বাড়ির আত্মীয়। তার লেগে বলতে যেয়ে আমি ক্যানে শ্বশুরবাড়িতে দোষের ভাগী হব! শাশুড়ি-ননদ য্যাকন বেঁচে আছে। তা আমাকে কিন্তু কিছুই বলতে হলো না। কত্তাই বললেবেশি কথার লোক লয়একটো কথাই বললেআমি দেখছি

তার পরের দিনই ভাইটিকে নিয়ে কত্ত বেরিয়ে গেল আর সেইদিনই অ্যানেক রাতে একা ফিরে এসে বললেট্রেনে কাটোয়া যেয়ে সেখান থেকে দু-কোশ দূরের একটো গাঁয়ের এক নামজাদা ইশকুলে ওকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে আর এক মোকাদিম মোসলমানের বাড়িতে তার জায়গিরের ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়েছে। সে ঐ বাড়িতে থাকবেখাবেছোট ছেলেমেয়েদের পড়াবে আর ইশকুলে নিজের পড়া পড়বে

সেই থেকে সে ঐ ইশকুলেই পড়ছিল। কেমন আছেকি খেচে আমি যি তার খুব খবর লেতম তা নয়। আমার শ্বশুরবাড়িতে সে আসত কমই। য্যাকন আসত সুবিদা-অসুবিদার কথা বলতেই আসত কত্তাকে। তাকে বাপের মতুনই মান্যি করতঠিক যেন বটবিরিক্ষের ছোয়ায় বসে আছে। ইশকুলের ছুটি হলে নানার বাড়িতেই চলে যেত বেশিরভাগ সোমায় বলতে গেলে সিটোই তার নিজের বাড়ি। বাপজির কাছে বোধায় তেমন যেত না। সৎ-মা আছে বলে লয় কিন্তুকবাপজির কারণেই মনে হয় তার উ বাড়ি যেতে মন করত না। সি যি মামুদের কাছে থাকে সিটি বাপজির পছন্দ লয়। সি যি এত কষ্ট করে ল্যাখাপড়া শিখচে সিটিও তার পছন্দ লয় অথচ নিজে কিছু করবে তার লেগে

তা সেই দোপরবেলাকাকচিলের আওয়াজ নাইআসমান থেকে আগুন ঝরছেএমন সোমায় ভাইটি আমার বাড়ি ঢুকে ছামনে এসে দাঁড়ালে। অ্যানেকদিন দেখি নাইহঠাৎ চিনতে পারলম না। কে এই ছেলেটিগোরো ধপধপেগোঁপদাড়ি অ্যাকনো হয় নাইহবে-হবে করছেকে গো এই ছেলেটিপরেই তাকে চিনতে পারলম। দখিন-দুয়োরি উসারায় একটা মোড়ায় তাকে বসালম। মা এলভাইবুনেরা এল। মা আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে পাখার বাতাস করতে লাগল। বড় বুনটো শরবত করে আনলে। এই ভাই তত উদের সবারই বড়। শরবত-টরবত খেয়ে একটু সুস্থ হয়ে সে যা বললে তাতে আমি ভয় পেয়ে গেলম। তার ইশকুলের শ্যাষ ক্লাসের পড়া শ্যাষআর কমাস বাদে শ্যাষ পরীক্ষা। সি পরীক্ষা তো গাঁয়ের স্কুলে লয়সি পরীক্ষা হবে কাটোয়া শহরে। অ্যানেক টাকা লাগবে। কে দেবে এই টাকামামুদের তো দুটো টাকা বার করারও খ্যামতা নাই। যি বাড়িতে থাকেখায়তারা তো আর টাকা দেবে না

দামাদ-ভাই এত করেছেযা করবার সব করেছেতার কাছেই বা যাব কেমন করে। তাই বাপজির কাছে এয়েছি। বাড়িতে মরাই বাঁধা রয়েছেএকটা নয়দু-দুটোক-মণ ধান বেচলেই তো পরীক্ষার ফি-র টাকা হয়ে যায়

তা বেশবাপজি অ্যাকন বাড়িতে নাইআসুকদোপরের ভাত খাবিছাম করতারপর বলিস বাপজিকে

আমার কথা শুনে সে জোরে মাথা নাড়লে। ভাত দোপরে সে খাবে না। বাপজিকে এগু বলে তাপর অন্য কাজ

তাকে তো সবাই চেনেকিছুতেই পয়সা খরচ করতে চায় না। যি লোকের এত বুদ্ধিদুনিয়ার লোককে বুদ্ধি-ফুদ্ধি দেয়টাকাপয়সা : খরচের কথা উঠলেই সি লোকের বুদ্ধি কোথা যায় কে জানে! বাড়িসুদু সবাই কাটা হয়ে থাকলনা জানি আজ কি অঘটন ঘটে

খানিক বাদে বাপজি এল। ত্যাল মেখে গা ধুতে যাবে। অ্যামন সোমায় বড় ছেলে এসে ছামনে দাঁড়িয়ে মাথা হাট করে বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল। বাপজি তার দিকে তাকিয়ে ত্যাল মাখা বন্ধ করে ঠান্ডা গলায় শুদুলেকিছু বলবেকি বলবে বলো। এই কথা শুনে ভাইয়ের আমার গলা কাঁপতে লাগলকথা ঠেকে ঠেকে যেতে লাগল। বহুত কষ্ট করে কুনোরকমে কথাগুলিন সে বললে। তাপর যেন তার সাহস এট্টু বাড়ল

আমার পরীক্ষার ফল খুব ভালো হচ্ছেএই শেষ পরীক্ষাতেও ফল ভালোই হবে। আমি কলেজে পড়ববি এ পাশ করব

সব কথা শুনে বাপজি অ্যানেকক্ষণ চুপ করে থাকলে। মনে হলো। কুনো কথাই যেন সে শুনতে পায় নাই। ওমাতাপর সে উঠে দাঁড়িয়ে দড়ি থেকে গামছাটো তুলে কাঁধে ফেলে গা ধুতে যাবার লেগে উসারা থেকে নামতে নামতে বললেধান বেচা যাবে না। মরাইয়ে যে কটো ধান আছে তা সবারই মুখের গ্রাস। বেশি যা আছেতা বেপদ-আপদের লেগে রাখতেই হবে। ধান বেচা যাবে না

এই কথা বলে বাপজি শা-দিঘিতে গা ধুতে বেরিয়ে গেল। সে-ও গেল আর আমি দেখলমভাইয়ের আমার মুখটি লাল টুকটুকে হয়ে উঠল। কদবার পাত্তর সে লয়ঐ বাপেরই ছেলে তোআস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে একপা-দু-পা করে এনে পেরিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেচেআমরা সবাই যেয়ে তাকে ধরলম। মা বললেআর কিছু হোক আর না হোকভাতের ওপর রাগ করিস নাভাত খেয়ে যা বাপ। মুখ ঘুরিয়ে ভাই ত্যাকন বললেমাতোমার ভাত হলে খেতম। এ যে আমার বাপের ভাত-যেদিন খাব জোর করে খাবনা হলে খাব না। এই বলে আমাদের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে চলে গেল। কিন্তুক বললে কেউ পেত্যয় যাবে নাগা ধুয়ে এসে সব শুনে বাপজি একটিও কথা না বলে খেতে বসলে আর রোজ যেমন খায়তেমনিই খেলে। একটি ভাত যি কম খেলে তা লয়

এই ঘটনার পরে দুটো দিনও পার হয় নাইএকদিন কা এসে হাজির। বাপজি ত্যাকন বাড়িতেই ছিল। সোজা তার কাছে যেয়ে বললেআপনার বড় ছেলের পরীক্ষার ফি-র টাকা লাগবে। নগদ টাকা আপনার কাছে নাই তা জানি। কিছু ধান বেচেই এই টাকা জোগাড় করতে হবে। বিপদ-আপদের কথা বলেছিলেনছেলের এইরকম বিপদের সময়েই তো এই ধান কাজে লাগবে

কথা শুনে বাপজি চুপ করে রইলমুনিষ বৈকালি আসবে মোকামে ধান বেচে বেলাবেলিই ফিরবে

সিদিন দেখেছেলমবাপের কথায় ছেলের মুখ কেমন রেঙেছিলআজ দ্যাখলম জামাইয়ের কথায় শ্বশুরের মুখ কেমন রাঙা টুকটুকে হলো। ই যি বাপজির ভায়ানক চাপা রাগ তা বুঝতে আমার বাকি থাকল না। কিন্তুক বাপজি একটি কথা বললে নাহ্যাঁ কি না একটি আওয়াজ বেরুল না তার মুখ থেকে

বৈকালি লোক এলমরাই ভাঙলে। গাঁয়ের কয়াল এয়েছিলসে ধান মাপলে। কত্তা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলে আর বাপজি দোপরে খেয়ে ঘরে ঢুকে ঘর আঁদার করে সেই যি শুয়ে থাকলেএকবার বেরিয়ে এল না। আমরা সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলমকপাল পয্যন্ত লাজ কেড়ে সৎ-মা হেঁশেলের দরজার আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেসৎ-ভাই আর বুনগুনো ভয়ে কেমনধারা করে চাইতে লাগলেকত্তা কিন্তু কিছুই গেরাজি করলে না

গাড়ি বোঝাই করে য্যাখন ধান মোকামে বেচতে নিয়ে যেচেকত্তাও ত্যাকন আর থাকলে নাবাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। মা তাকে কিছুই বলতে পারলে নারাতটো থেকে যেতে বলবে কি কিছুসিকথা মুখ দিয়ে বার করতেই পারলে না। অ্যামন রাশভারি মানুষ ছিল উ। কত্তা য্যাকন চলেই গেলমা ত্যাকন হেঁশেল থেকে বেরিয়ে বাপজির ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলে। আমিও কি মনে করে মায়ের পেচু পেচু আসছেলম। দরজা পয্যন্ত এয়েচিকানে এল বাপজি বলছেআমার মরাই ভেঙে আমারই ছেলেকে যখন সে পর করে দিলেওর ছেলেকেও আর বেশিদিন স্কুলে যেতে হবে না

হায় কি বললেহায় কি বললেওগোহায় কি বললেদড়াম করে আমি মাটিতে আছড়ে পড়লমহায়ই কি বললেকইআমার মানিকরা কইআমার জাদুরা কই! ওমাআমি এখুনি বাড়ি যাবআমার বুকের ধন মানিকদের নিয়ে এখুনি বাড়ি যাব। ই বাড়িতে আর এক দণ্ড লয়। এই রেতেই যাব

সেই রেতে কি আর আসা হয়সারারাত কিছুই খ্যালম নাপানি পয্যন্ত লয়কারও সঙ্গে একটি কথা বললম নাদু-চোখের পাতা একবার এক করলম নাদুই ছেলেকে বুকে আঁকড়ে ধরে রাতটো কাটিয়ে সকালবেলাতেই শ্বশুরবাড়িতে ফিরে অ্যালম। মা ভাই বুন সব আসার সোমায় সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেচোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে কিন্তুক একটি কথা কেউ উশ্চারণ করতে পারলে না

 

ছেলে চলে গেল শহরে

ফিরে এসে শ্বশুরবাড়িতে কাউকে কিন্তুক সিসব কথা কিছুই বলি নাই। শুদু বললমছেলেদের আর মন টিকছিল নাস্কুলও খুলবে তাই চলে অ্যালম। কত্তা কিছু বুঝেছিল কিনা জানি না। কিছুই শুদোয় নাই আমাকে। উ তো কিছু শুদোবার মানুষ লয়! শাশুড়ি-ননদও কোনো কথা বললে না

বাড়ি এসে শোনলমবড় খোঁকার গাঁয়ের স্কুলে ল্যাখাপড়া ভালো হচে না। উকে শহরের বড় স্কুলে নিয়ে যেয়ে ভত্তি করা হবে। আমার ছোট দ্যাওরটো পড়েছিল শহরের যি স্কুলে সিখানেই পড়তে যাবে খোঁকা। দ্যাওরের ত্যাকন স্কুলের পড়া শ্যাষ হয়েছে। সে আর আমার ছোট ভাইটি তো একসাথেই শ্যাষ পরীক্ষা দেবে। মেট্রিক না এনট্যান্স কি পরীক্ষা যেন। আর এই পরীক্ষার লেগেই আমার বাপের বাড়িতে এত ধুন্দুমার কাণ্ড হয়েছিল। সেই পরীক্ষা হয়ে গেলেই দ্যাওর চলে আসবে বাড়িতে। তা বাদে পাশ যেদি দিতে পারেতাইলে কলেজে পড়বে। স্কুলের কাছে যে বোডিংয়ে থাকতসেই জায়গাটো খালি ইচে। বড় খোঁকা সেইখানে থাকবে আর সেই স্কুলে পড়বে

খরবটো শোনা অবদি কি যি হতে লাগল বুকের মদ্যে! সি আর কাকে বলবপাখি এইবার বাসা ছেড়ে উড়ে যেচে। আর কি বাসায় ফিরবে মায়ের বুকের তলায়আর কি নিশ্চিন্তে ঘুমুবেকিন্তু আমার বড় খোঁকা উড়বে কিতার তো অ্যাকনো পাখাই হয় নাই। অত বড় ছেলেঅ্যাকনো খাইয়ে দিতে হয়। আমি না দিলেও দাদিফুফুনাইলে কুনো চাচি খাইয়ে দেয়। আজকাল কারু কাচে খেতে চাইছে না কিন্তুক নিজে খেতে গেলে ফেলে ছড়িয়ে একাকার। উ ছেলে কি সত্যি বড় হয়েছেকেউ কাছে ডাকলে একেবারে বুকের কাছে চলে যায়কেউ অ্যাকটো ধমক দিলে মুখটো শুকিয়ে কেমন হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি কুনো কাজ করতে বললে এমন হাঁপুচাপু করে যি দেখলে মায়া হয়। ছেলে যেন দুনিয়ার সবার কাছে অপরাধী হয়ে আছে। মুখে কথা নাইদু-একটো কথা যা বলে তা আবার শোনাই যায় না। ই ছেলে কি করে বিদ্যাশ-বিভুঁইয়ে থাকবেমাথায় নোম্বা অ্যানেকটো হয়েছে বটেদীঘল শরীলকাচ-পরানি গায়ের রঙটানা দুটি চোখ যেন ঘুমিয়ে থাকার মতুন

কেউ কি উকে বড় হতে দ্যাখেএকটু একটু করে কেমন বাড়ছেপিতি রেতে চাদের বাড়ার মতুন। জামা-পেন্টুলুন ছোট হয়ে যেচেখালি গায়ের পাঁজর বোঝা যেচে ইসব কি কেউ দ্যাখেআমি যি দেখি। দূর থেকে দেখিকাছ থেকে দেখি। খোঁকা কুনোদিন জানতেই পারে না। উসারার এক কোণে জানেলার ধারে বসে একমনে বই পড়ছেকাজ করতে করতে একবার একবার থেমে আমি একদিষ্টে খোঁকার মুখের দিকে দেখি। চোরের মতুন দেখি। যেই বই থেকে মুখ তুলে ইদিকপানে তাকিয়েছেঅমনি আমি যেন কতোই না কাজে মন দিয়েছি!

বড় খোঁকা য্যাতোদিন ছোট ছিলকুনোদিন দেখি নাই যি কত্তা ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখলে। ছোট ছেলেমেয়েকি আমার কি অন্য মানুষেরসে কুনোদিন ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারত না। আমি মনে করতমমানুষটো কি পাষাণ! তা সেই কত্তাই আমার কাছে একদিন ধরা পড়ে গেল। দেখলমআড়াল থেকে ছেলেকে দেখছে। সি যি এমনি দেখা লয়তা আমি কত্তার দু-চোখের তাকানো দেখেই বোঝলম

তা যাকগোইসব কথা আর বলে কি হবে। ছেলের শহরে যাবার দিন এগিয়ে এল। পরীক্ষা লিকিনি দ্যাওর আর আমার ভাই একসাথেই। দেবে। আজকালেই বড় খোঁকাকে স্কুলে ভত্তি করে দিয়ে আসতে হবে। দেরি হলে হবে না

যিদিন সকালে যাবে সিদিন আর হেঁটে ইস্টিশনে যাবে না। এমনিতে কত্তা হেঁটে যেয়েই ইস্টিশনে টেরেন ধরেআজ ছেলে নিয়ে বিশেষ কাজে যেচেসেই লেগে মোষের গাড়ি করে যাবে। ছেলের লতুন জামা-পন্টুলুন হয়েছেসকালেই গা-ধোয়া হয়েছেজামা-কাপড় পরা হলেওর বাপ মাথা আঁচুড়ে দিলে। আমার কি যি মন হতে লাগল ছেলের চোখে কাজল দিয়ে দিতা ধমক খাবার ভয়ে সি কথা বলতেই পারলাম না

যাবার সময় হলে দাদিফুফুচাচাচাচিরা এলসবাই খোঁকার মাথায় হাত দিলেকপালে চুমু খেলে,দাদি-ফুফুর চোখে পানি এল কিন্তুক আমি কিছুই করতে পারলম না। বুকে কি যেন আটকে গেয়েছে। পাথর লিকিনিকই কঁদতেও যি পারছি না! চারদিকে কি। হচে কিছুই বুঝতে পারছি নাসব ছেয়া হেঁয়া। কত্তা খুব তাড়া দিতে লাগল। এও তার ছল। কেঁদেকেটে একাকার করে যাবার সোমায়টো না লষ্ট করে ফেলে কেউএই লেগে সে অমন তাড়া দেয়। খোঁকাকে নিয়ে সবাই ঘর থেকে বেরুবেএমন সোমায় খোঁকা টুক করে আমার কাছে এল। একদম বুকের কাছে এসে বললেযেচি। চোখের পানিতে সব এমন ছয়লাপ হয়ে গেল যিহ্যাঁ বাপযাওই কথাটিও বলতে পারলম না

গাড়ি খামার পেরিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেলে একটো তরাস এসে বুকে ঢুকল। কিসের যি তরাস তা জানি না। কিন্তুক শুনলে কেউ পেত্যয় যাবে নাসেই তরাস আমার সারা জেবনেও আর গেল না

কত্তা ফিরে এল সেইদিনই অ্যানেক রেতে। এমন আঁদার রেতে ইস্টিশন থেকে এক কোশ পথ হেঁটে কেমন করে যি বাড়ি এলসি সেই-ই জানে। রাস্তা নাইমাঠঘাট ভেঙে আসতে হয়। সাপ-খোপে ভরা ই জায়গা। কিন্তু কুনো ভয়-ভিত ছিল না উ মানুষের। হেরিকেন নিয়ে কেউ এগিয়ে আনতেও তো যেতে পারত ইস্টিশনে! তা-ও কাউকে করতে দেবে না

বড় খোঁকা সিদিনই স্কুলে ভত্তি হয়ে গেয়েছে। বোডিংয়ে থাকার বেবস্থা-ও হয়েছে। বড় খোঁকার চাচা,আমার ছোট দ্যাওরঅ্যাকন-ও তো রয়েছেতার পরীক্ষা শ্যাষ হয় নাইশ্যাষ হলে তার জায়গাতেই থাকবে ছেলেএইসব ঠিক করে এয়েছে কক্স। দেখলমতার মনে খুব আনন্দ। ছেলের ল্যাখাপড়ার ভালো বেবস্থা হয়েছে। সে একদিন নিশ্চয় জজ-ম্যাজিস্টেট হবে! ইদিকে আমি কি করিকি করে থাকিকি করে বাঁচি! সারা দিনে যেদি একবারও তার মুখটো দেখতে না পাইতাইলে কি বাঁচতে পারিহায়!

কেমন কপালঠিক পরের দিনই দোপরের আগে লোক এসে খবর দিলে আমার ছোট ননদের সংকট-ব্যায়রাম। আবস্তা খুব খারাপ হয়েছে। এই খবর নিয়ে রাত থাকতে থাকতে গাঁ থেকে রওনা হয়েছিল লোক। পড়ি-মরি পাঁচ কোশ রাস্তা এসে খবরটো কুনো পেরকারে দিতে পারলে। আমার এই ছোট ননদটি যেমন সোন্দরীতেমনি ভালোমানুষ। ভারি মিষ্টি স্বভাব আর কি সেবা যি করতে পারত মানুষের! সি আবস্তাপন্ন বড় ঘরেই পড়েছিল। আমার পরের খোঁকার জন্মের দু-এক বছর আগেই তার একটি খোঁকা হয়েছেআর এই বছরটাক আগে আরও একটি খোঁকা এয়েছে তার কোল জুড়ে। ভরা সুখের সংসারইয়ার মদ্যে এই মরণ-অসুখের খবর!

খবর শুনে কত্তা কি যি অস্থির হয়ে পড়ল সি আর কি বলব। বড় বড় আপদ-বেপদেও যি লোক স্থির থাকেমাহা ভয় পেলেও যি লোককে দেখে সবাই সাওস পায় সেই লোক কি যি খ্যাপাখেপি করতে লাগল

আমি এখুনি যাবআমার ঘোড়া ঠিক করতে বলোএক কাপড়ে যাব

কথা বলতে বলতে কত্তা ছুটে বাড়ির মদ্যে ঢুকে মা-বুনকে শুদু যেচে এই কথাটি জানালে। শাশুড়ি ননদ পাথরের মতুন দাঁড়িয়ে থাকলেভাইরা যারা বাড়িতে ছিলএকটি কথাও কেউ বলতে পারলে নাকত্তা শুদু ধুতি-জামাটো বদলে আর মনে হলো বাসো খুলে য্যাতো জমা টাকা ছিল সব বার করে নিয়ে খামারে যেয়ে দাঁড়াইলে। ত্যাতোক্ষণে ঘোড়ায় জিন পরানো হয়ে গেয়েছেমাহিন্দারটি লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর কুনো কথা না বলে কত্তা যেয়ে ঘোড়ায় উঠল। ঘরের ভেতর থেকে শুদু ঘোড়া ছোটার আওয়াজ প্যালম

ওমাই কি কাণ্ডসিদিনই রাত দোপরে দেখি কত্তাকে নিয়ে ঘোড়া ফিরে এয়েছে। খামারের দিকে পরচালির ছামনে ঘোড়াটো কখন দাঁড়ালে তা কিছুই বুঝতে পারি নাই। একবার যেন অ্যাকটো হি হি আওয়াজ প্যালম। দরজা খুলে বেরিয়ে আঁদারের মদ্যে দেখিঘোড়া কেমন ছটফট করছে আর তার পিঠে বসে মাতালের মতুন দুলছে অ্যাকটো মানুষ। সাথে সাথে আমি বুঝতে পেরেছি আমার সব্বোনাশ হয়েছে। ত্যাকন একবার এমন চেঁচিয়েছেলম যি বাড়ির সবাই হাউমাউ শোর করে জেগে উঠল। ঘরের হেরিকেন হাতে নিয়ে বাইরে এসে দেখি সবাই খামারে এসে গেয়েছে। ঘোড়া আর ঘোড়ার পিঠে সওয়ারি ত্যাকননা টলমল করে দুলছে। দ্যাওর-রা সব ছিলভাশুরও রয়েছেসবাই ছুটে যেয়ে কত্তাকে ধরলে। ঘোড়া ত্যাকন হাঁটু দুমড়ে বসে। পড়েছে। কত্তার জামা-কাপড় ছেড়াসারা গায়ে ধুলো-কাদাশরীরের নানা জায়গা ছিড়ে ফেটে গেয়েছেসেইসব জায়গা থেকে রক্ত ঝুঁঝিয়ে পড়ছে। ঘোড়ার আবস্তা আরও কাহিল। তারও সারা গায়ে কাদা মাখাইখানে-ওখানে রোঁয়া উঠে গেয়েছেরক্ত ঝরছে তারও দ্যাহ থেকে। তা-পরে যা ঘটল সি কথা মনে হলো আকননা আমার সারা গায়ে কাঁটা দেয়দমটো আটকে আসে। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলমবেশি সোমায় গেল না ছটফট করতে করতে মুখ দিয়ে গাজলা তুলে ঘোড়াটা যেন কলজে ফেটে মরে গেল। কিন্তুক ত্যাকন তাকে নিয়ে কে ভাবে। কত্তাকে নিয়েই তো কান্নাকাটা পড়ে গেল

কত্তা শ্যাষ পয্যন্ত সুস্থির হলো বটে কিন্তুক আজও জানি না কেমন করে এই মাহাবেপদ পার হয়েছেলম। যাবার পথে ঘোড়াকে একবার থামতে দেয় নাই কত্ত। সপাৎ সপাৎ করে খালি চাবুক মেরেছেআর গাঁয়ের ভেতর দিয়েমাঠের ভেতর দিয়েআমবাগান কলাবাগানের মদ্যে দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়েছে। থামতেও দেয় নাইমাঠের পুকুরে পানি খেতেও দেয় নাইএকবার কুনো বটপাকুড়ের হেঁয়ায় দাঁড়ায়ও নাই। এই করে ঠিক বৈকালবেলায় বুনের শ্বশুরবাড়ির গাঁয়ে বড় দিঘির উঁচু পাড়ে যেয়ে সে দাঁড়ালেবাড়িটোকে ওখান থেকে দেখা যায়। দোতলা মাঠকোটাটো-ও দেখা যেছিল। গাঁয়ের একমাত্র টিনের চালের বাড়ি। ঘোড়া থামিয়ে একদিষ্টে কত্তা চেয়েছিল জানের জান ছোট বুনের বাড়ির দিকে। ত্যাকন বহু লোক যেছিল সিদিকে। শুদু একজন এয়েছিল কত্তার কাছে। কত্তা তাকে কিছুই শুদোয় নাইতবু সে বলেছিলউদিকে তাকিয়ে কি দেখছেনউ বাড়ির বড় বউটি এই খানিক এগু মারা গেয়েছে

কত্তা আমাকে পরে বলেছিললোকটোর একটা কথাও ত্যাকন সি বুঝতে পারে নাই। চুপ করে তার দিকে এমন করে চেয়েছিল যিসে ভয় খেয়ে গেল আর যি কথা বলেছিলসি কথাটো আরও একবার বলেছিল। কত্তা তেমনি করেই দাঁড়িয়ে। তা-বাদে কেমন করে কি কথা মাথায় ঢুকল সে বলতে পারবে নাশুদু একটো কথা মাথায় যেন চিরিক করে উঠলইখানে আর লয়উ বাড়িতে যাব নাযাব নাহরগিজ যাব নাবুনের মরামুখ আমি দেখতে পারব না। ঘোড়ার মুখটি ফিরিয়ে চাবুক কষে তাকে ছুটিয়ে দিয়েছিল কত্তা

এমন ঘটনা ঘটে গেল সোংসারেতবু একটো দিন কি থেমে থাকলেদিন ঠিকই চলে গেল। মানুষের সয় না কিসোমায়ে সবই সয়। দুনিয়াদারির দায় কি ঠেকানো যেচেসেই কাজ করতে হবেখেতে হবেশুতে হবেঘুমুতে হবে। কোটো বাদ যেচেশোক একটু সয়ে এলে মাস তিনেক বাদে কত্তা দুই ভাগ্নেকে ই সোংসারে চেয়ে নিয়ে এল। বুন গেয়েছেগেয়েছেতার তো আর কুনো চারা নাই। ভাগ্নেদুটির একটি পাঁচ বছরের আর একটি দ্যাড় বছরের। দুটিই খোঁকা। ফুটফুটে রাজপুত্তুরের মতোন এই দুই খোঁকাই হলো বুনের চেহ্ন এই দুনিয়ায়। চোখ-মুখ চেহারায় বুনের কথাটি মনে পড়ে। অ্যাকন থেকে ওরা ই বাড়িতেই মানুষ হবে। বড় হলে যা তাদের মন চায়তারা তাই করবে। যেতে চাইলে নিজেদের সোংসারে ফিরে যাবে

ছেলেদুটিকে আনতে তেমন কুনো বাধা হয় নাই। বিরাট আবস্তা হলেও বুনটির শ্বশুরবাড়িতে লোকজন তেমন নাই। ছোট ভাই নিঃসন্তান। জানাই গেয়েছে আর ছেলেপুলে হবে না। ইদিকে দুই সন্তান রেখে বড় বউ চলে গেয়েছে দুনিয়া ছেড়ে। লতুন করে আবার বিয়ে-থা সোংসার করার কুনো ইচ্ছা নাই বড় ভাইয়ের। তাইলে নাবালক ছেলেদুটিকে দেখে কেকত্তা বাপ-চাচাকে এইসব বুঝিয়ে ভাগ্নে-দুটিকে এনে নিজের সোংসারের বিধবা-বুনআমার মেজ ননদের কাছে ফেলে দিলে। বললেএরাই এখন তোর দুই ছেলে। এদের তুই মানুষ কর। কথা শুনে বিধবা-বুনকতো ভুক-পিয়াসি ছিলছেলেদুটিকে বুকে টেনে নিলে। ই বাড়ির আর সব ছেলেপুলের মতো তারাও বড় হতে লাগল

 

সব গোলমাল লেগে যেচে

সোয়ামি পুত্তুর ননদ শাশুড়ি দ্যাওর ভাশুর ইদের নিয়ে সোংসার করি। সেই ভোর ভোর ঝুঝকিবেলায় উঠিসুয্যি ত্যাকনো দেখা দেয় নাই। সেই শুরুসারা দিনে একবার কামাই নাই। কাজ কাজ। রেগেমেগে বলি রাবণের গুষ্টি। ঘর-দুয়োর পোষ্কার রাখোকুটনো কোটোবাটনা বাটোরাজ্যের রাঁধন রাঁধোচাকর মুনিষ মাহিন্দার সবাইকে খাওয়াও। ই আবার এক সুখও বটে! আমরা বউ-ঝিরা য্যাকন খেতে বসছিসুয্যি ত্যাকন পাটে বসতে যেচেরোদ লি লি করচে। এমনি করে দিন কাটেদ্যাশ-দুনিয়ার আর কি খবর রাখবনিজের দুটো ছেলের একটো শহরে বোডিংয়ে থাকেতাকে ন-মাস ছ-মাসেও একবার দেখতে পাই নাআর একটো যে কখন খেচেকখন ঘুমুইচে তার কিছুই জানি নাসি জানে তার ফুপু। বাড়িতে অ্যাকন ছেলেপুলে বেড়েছে। মনে হচে সেজ বউয়ের আবার ছেলেপুলে হবে। আমার ননদটির হাত এতদিন ফাঁকাই ছিলতার কাজ ছিল হালকা। অ্যাকন আর তা লয়তার বুনপেপাদুটো সোংসারে এয়েছেআমার খোঁকা রয়েছেসেজর খোঁকা রয়েছেসব অ্যাকন ঐ ননদকেই দেখতে হবে। কেউ বসে নাইসবারই কাজ

সব কাজ সেরে য্যাকন শুতে যাইকত্তা দ্যাশ-ঘরের কথা দু-চারটে বলে বটেতার কিছুই বুঝতে পারি না। অক্ষর শিখেছেলমবই পড়তে শিখেছেলমবানান করে খবরের কাগজ পড়তে পারতমবুঝতেও পারতমঅ্যাকন মনে হচে সব ভুলে গেয়েছি। মনে করেছেলম কত্তাকে একদিন শুদোব সেই কুন দ্যাশের খলিফার চাকরি অ্যাকনো আছে না গেয়েছেসি আর শুদননা হয় নাই। বিছেনায় শুই আর মরার মতুন ঘুমিয়ে পড়ি। কখন শুদোব!

ইদিকে কত্তার গতিক সুবিধে মনে হচে না। পেরায় দিন শহরে যায়। ভোরবেলায় যায় আর এক দণ্ড রেতে ফেরে। গাঁয়ে খুব কমই থাকে। ইশকুলে যাওয়া কি ছাড়লেআর কত্তামার বাড়ি যি কমই যাওয়া হচে সি তো দেখাই যেচে। বাড়িতে আকা লোকজন আসা অ্যাকন অনেক বেড়েছে। কত্তা আগে কথাবার্তা ত্যাতো বলত নাবরং কিছু শুদুলেই কেমন খেকিয়ে উঠত। অ্যাকন দেখছি নিজে থেকেই এটো-ওটো কথা বলে। যিদিন যিদিন লোক আসে বাড়িতে সিদিন শহরে যায় না। তাইলে লোকজন নিশ্চয় বলে-কয়েই আসে আর যারা আসে তারা যে-সে লোক লয়তা তাদের চেহেরাজামা কাপড়পোশাকআশাক দেখেই বোঝা যায়। আড়াল থেকে অনেকদিন দেখেচিখাবার বানিয়ে কাউরির হাতে পাঠিয়ে দিতে যেয়ে চোখে পড়েছে উসব মানুষদের। হিঁদু ভদ্দরলোক তো আসেইআজকাল দেখি যেন মোসলমান মিয়ে-মোকাদিম এট্টু বেশি বেশি আসছে। বড় বড় পাগড়ি দেখতে পাইহেঁটো পয্যন্ত আলখেল্লা গায়ে দিয়ে আসে কেউকারু কারু নোম্বা দাড়িবাবরি চুল। কারা ইয়ারাকি করছেকাদের নিয়ে আছে কত্তাএইসব কথা ভেবে ভেবে মরি

একদিন হঠাৎ কত্তা আমাকে শুদুইলেআচ্ছাহিঁদু-মুসলমানে তফাত কি বলো তো শুনি। ই আবার কি কথাইসব তো কুনোদিন ভাবি নাইভাবতে হবে বলে কুনোদিন মনেও করি নাই। কত্তার কথা শুনে আমি ফ্যাল ফ্যাল করে খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলম। দেখি সে মিটি মিটি হাসছে। কত্তার ই রূপ তো কুনোদিন দেখি নাই। একটু পরে সে বললেএত কষ্ট করে যে পড়তে লিখতে শিখলে তা দিয়ে কি তোমার কোনো কাজই হবে না?

কথা শুনে আমার রাগ-ও হলো দুঃখ-ও হলো। কি কথা বলছে এই মানুষসকাল থেকে রেতে বিছানায় শোয়া পয্যন্ত তার সোংসারের ঘানি টানছিচোখে বেঁধেচি ঠুলিকানে দিয়েচি তুলোপিঠে বেঁধেচি কুলোদোপরের খাওয়া খেতে বসি সাঁঝবেলায় আর সে কিনা বলে লেখাপড়া শিখে আমি কি করলম! রাগে আমি গুম মেরে থাকলমঅ্যাকটো কথা বললম না। একটু সোমায় যেতে কত্তা বললেহিঁদু-মুসলমান সব এক হয়ে এই একবারই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নেমেছিল। মোসলেম জাহানের খলিফাঁকে তাড়ানো যাবে না বলে কত কি করেছিল! শেষ পর্যন্ত কি হয়েছে জানোব্রিটিশদের কিছুই করতে হয় নাই। সে দেশের মুসলমানদের এক নেতাই খলিফাগিরি খতম করে দিয়েছে। এখন এ দেশের হিঁদু-মুসলমান এক হয়ে যাই করুক সব বেকার। দাবিই তো আর কিছু নাই। সব ছত্রখান হয়ে গেল। আবার সেই হিঁদু-মুসলমানের নিজের নিজের দাবি নিয়ে মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়েছে। তাতে তো বিদেশীদেরই পোয়াবারো। সেইজন্যে তোমাকে জিজ্ঞাসা করছিহিঁদু-মুসলমানে তফাত কিএইবার বুঝতে পেরেছ?

কত্তা তো শুদুইলে কিন্তুক আমি কি বলব কিছু খুঁজে পেচি না। সত্যি সত্যিই কথা নিয়ে কুনোদিন ভাবি নাই। তবে বলছে য্যাকনত্যাকন নাহয় এট্টু ভেবেই দেখি। ছোটবেলায় দেখেছিআমাদের গাঁয়ে মোসলমান ছিল বেশিহিঁদু ছিল কম। আর আমার শ্বশুরবাড়ির এই গাঁয়ে হিঁদু বেশিমোসলমান কম। ই হলো গাঁয়ে গাঁয়ে তফাত। তবে সেই তফাতের লেগে উ গাঁয়ে আমাদের কুনো অসুবিদা হয় নাইই গাঁয়েও কুনো অসুবিদা নাই। মারামারি হরহামেশা হিঁদুতে হিঁদুতে হচেমোসলমানে মোসলমানে হচে,আবার হিঁদু-মোসলমানেও হচে

মনে করে দেখলমবিয়ের পরে কত্তামার কাছে গ্যালম। সি তো বড়লোক হিঁদুর বাড়ি। কামা সারা গায়ে গয়না পরিয়ে দিলে। একবারও মনে হয় নাই হিঁদুতে গয়না পরিয়ে দিচে। মনে হয়েছিল ঠিক যেন আপন মেয়েবউকে জান ভরে মা গয়না পরাইচে। দ্যাখো দিকিনিতেমন মনে না হলে কি গয়না গায়ে রাখতে পারতমগা যি আগুনে পুড়ে যেত। আর যেদি বলো উ হচে বড়লোকের গুমরতা হতেও পারে। সি তো বড়লোক মোসলমান মিয়ে মোকাদিমের গুমরও হতে পারে। তাপরে দেখছিহিঁদু কামার কেস্তে কাটারি কুড়ুল বানিয়ে দিচেলাঙলের ইশফাল তৈরি করে দিচেহিঁদু ছুতোর মিস্ত্রি দরজা জানলা তৈরি করে দিচেহিঁদু নাপিতবউ এসে দু-পা ভিজিয়ে কতো যত্ন করে হাত-পায়ের নোখ কেটে দিচেহাড়িবউ এসে সোমায় সোমায় রাত জেগে সন্তান খালাস করে দিয়ে যেচে। সারা জেবন সে সন্তানের মায়ের মতুনই থেকে যেচে। কই হিঁদু বলে তো কিছুই আটকাইচে নাসব কাজই হচে। উদিকে মোসলমানরা চাষের কাজ করছেমুনিষ খাটছেমোসলমান রাজমিস্ত্রি স্কুল বোডিং বানাইচেমোসলমান করাতিরা কাঠ চেরাই করচেঘর ছাইয়ে দিচেসবাই সব কাজ করছে। তফাত কোথা হচে আমি বুঝতে পারছি না। তবে হ্যাঁকতকগুলিন কাজ মোসলমানরাই বেশি করেকতগুলিন কাজ হিঁদুরা বেশি করে। ই গাঁয়েরই স্কুলে একজনাও মোসলমান মাস্টার নাই। ওস্তাদজি তো ইস্কুলের মাস্টার লয়। চাষাভুষাে মুনিষ মোসলমানই বেশি। ক্যানে তা কি আর আমি জানি! যাদের ভদ্দরলোক বলে মোসলমানদের মদ্যে ই এলেকায় তারা এট্টু কম। আবার অন্য এলেকায় হয়তো শ্যা সৈয়দ পাঠান অ্যানেক আছে

তা সি যা-ই হোকহিঁদু-মোসলমানে তফাত আছে কি নাই তা নিয়ে এত ভাবনার কি দরকারসি তো ধম্মে ধম্মে অ্যানেকই তফাত। কেরেস্তানদের সাথে হিঁদুদের তফাত নাইকেরেস্তানদের সাথে মোসলমানদের নাইবলে হিঁদুতে হিঁদুতে কতো তফাত তারই ঠিক নাই! মুসলমানে মুসলমানে কি তফাত নাইএক সোংসারে একজনার সাথে আর একজনার কত তফাত। উসব নিয়ে ভেবে লাভ আছে?

আমি কিন্তুক কত্তাকে ইসব কথা একটো-ও বলি নাই। আমি চুপ করে ভাবছেলমদেখি সে যেদি কুনো কথা বলে। বললে শেষ পয্যন্ত

হিঁদু-মুসলমান এখন নিজের নিজের হিসেব নিয়েই আছে। খালি হিসেব কষছে। হিঁদু-মুসলমান একবার এক হয়েছিল তুর্কির খলিফার দাবিতে। সে দেশের মানুষ নিজেরাই খলিফাগিরি বন্ধ করে দিয়েছে। বাসহিঁদু-মুসলমান আর একসাথে থাকার দরকার কিএকটা বড় দাঙ্গা পর্যন্ত হয়ে গেল সেদিন। ব্রিটিশরা এখন খালি ফাঁদ পাতছেখালি ফাঁদ পাতছে। হিঁদু-মুসলমানের মধ্যে কেমন করে কিসব ভাগাভাগি হবে তার লিস্টি বার করেছে

আমি খুব ভয় পেয়ে গ্যালম। ইসব নিয়ে কত্তা তো আগে কুনোদিন। কথা বলে নাই।তবে কি সে অ্যাকন থেকে উসব নিয়েই থাকবেআমার যেমন ভয় হলোতেমনি রাগও হলো। এট্টু দাঁড়িয়েছে সোংসারজমি-জোমা হয়েছেঘরবাড়ি সহায় জন মুনিষ রাখাল হয়েছেনিজের হাতে আর কাউকে কিছু করতে হয় নাখাওয়া-পরার অভাব নাই।মনের মদ্যে চিন্তা নাইঅ্যাকন এটুল্যাশদুনিয়া নিয়ে থাকলে ক্ষেতি কিএই হলোকত্তার মনের ভাব। কিন্তুক আমি ভাবি কি দরকার ইসবেরজেবন সব্বারই নিজের নিজেরনিজের ছেলে-পুলেমাবোন-ভাই-বেরাদর নিয়ে সোংসার। তার বাইরে যাবার কি দরকারকে কিসের পিতিকার করতে পারে বলে দিকিনি! ই গাঁয়ের জমিদার ছিল রায়েরাতারা অ্যাকন ভিক্ষে করছে আর আমরা কিনে নিয়েছি তাদের জমি। তারা হিঁদুআমরা মোসলমান। কত রকম হিঁদু আছেকত রকম মোসলমান আছে। ক্যানে ইসব ভাবতে হবেবিটিশরা অ্যাকন আছেচেরকাল ছিল নাআবার চেরকাল থাকবেও না

আমি এ কথাগুলিনই বললম। কথা শুনে কত্ত আমার মুখের দিকে একদিষ্টে তাকিয়ে থাকলে বটে,কিন্তুক পষ্ট বুঝতে পারলমতার মন আমার কথার দিকে নাই। কি যি সে ভাবছেসেই জানে। আমি আবার বললমউসব কথা কানে বলছ?

তুমি তো সংসার করছনা কিকেউ তোমাকে বারণ করছে না। ছেলেমেয়ে আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শি এইসব নিয়ে তোমার সংসার। সব ঠিকতবে তোমার সংসারই কি সবআর কিছু নাইসংসারের বাইরে গাঁ আছেএকটি-দুটি নয়হাজার হাজার লাখ লাখতেমনি আছে তোমার দেশহাজার দেশসারা দুনিয়া। দুনিয়ায় কতো মানুষ! সবাই যদি শুধু নিজের নিজের কথা ভাবততাহলে দুনিয়ায় আর মানুষ থাকত নামারামারি কাটাকাটি করে সব মারা পড়ত

ভালো বুঝতে পারছেলম না কত্তার কথা। কিন্তু তার পরের কথা কটি জানের ভেতরে যেয়ে লাগল

কাগজে কাগজে বেরিয়েছেনিজে তো আর দেখি নাইহাজার হাজার ছেলেমেয়ে ঘরবাড়ি মা-বাপ ছেড়ে চলে এসেছেইংরেজ না তাড়িয়ে আর ঘরে ফিরবে না। দ্যাখোতারা কিছুই চায় নাচায় শুধু জান দিতেরক্ত দিতে। তাতে হয়তো ব্রিটিশের কিছুই হবে না। সব তারা জানেজানে তাদের জেল হবেজরিমানা হবেফাসি হবে। তা হোকফাঁসির দড়ি কষ্ট করে গলায় পরিয়ে দিতেও হবে নানিজেরাই গলায় পরিয়ে নেবে। এসব কথার কথা নয়এসব হচ্ছে। কি করে সম্ভব বলতে পারো পনেরো-ষােলো বছরের একটি মেয়ে নিজের হাতে বন্দুক চালিয়ে ইংরেজ খতম করলেতারপর ধরা পড়তে যাচ্ছে দেখে কঠিন বিষ খেয়ে সাথে সাথে মরে গেল। কত বয়েস এই মেয়েরধরো তোমার বড় খোঁকার বয়েসি

খোঁকার কথা শুনে এতক্ষণ বাদে জানটো আমার ধড়াস করে উঠল। কত্তাকে কি আজ ভূতে পেলে?তাড়াতাড়ি করে আমি বললমআর কথা বোলো না। আমার সব গোলমাল হয়ে যেচে। অনেক দিন ছেলের খোঁজখবর পাই না। কালই একবার যেয়ে খবর নিয়ে এসো

এতক্ষণে কত্তা হাসতে হাসতে বললেযাব যাব। আমার কথা শুনে তুমি মনে কোরো না আমি ঘর-সংসার ভাসিয়ে দিয়ে না জানি কিসব করব ঠিক করেছিমোটেই তা নয়। যাই-ই করিআমি নিজে কোথায় আছিনিজের ভালো-মন্দ না বুঝে কিছু করব না

 

খোঁকা ভালো আছে তবে সোময়টো খারাপ

আমার কথাটো রাখলে। কত্তা পরের দিনই শহরে গেল খোঁকার খবর আনতে। কাল রেতে খোঁকার কথা মনে হবার পর থেকে আমার বুকের ভিতর কি যি করছিল সি আমিই জানি। এই একটো জায়গায় খেয়াল করিক আমার মনের কথাটো ঠিকই বুঝতে পারে। রাগ-ঝাল যা-ই করুককথা শুনে কখনো কখনো মনে হবেবুঝি মানুষ লয়পাষাণকিন্তু আসল কাজটো শ্যাষ পয্যন্ত ঠিকই করবে

কত্তা গেল সকালে আর ফিরে এল সাঁঝের টেরেনে। এবার দেখিমুখে তার হাসি ধরছে না। পেথমে সে খবর দিলে বড় খোঁকা ভালোই আছে। আর বেশি কিছু বললে না। তাপর রেতে য্যাকন সোমায় হলো কত্তা বললেখোঁকার কাছে যখুনই যাইকিছু না কিছু হাতে করে নিয়ে যাই সে তো তুমি জাননা। এবার আর তেমন কিছু না নিয়ে শহরের দোকান থেকে এক হাঁড়ি মেঠাই কিনে নিয়ে গেলাম। খোঁকাকে দেখে ভালো লাগল। বোধ হয় নিজের যত্ন নিজে নিতে একটু শিখেছে। হাফ-প্যান্ট আর হাফ-শার্ট পরে আছেসে দুটি বেশ পরিষ্কার। মনে হয় সেদিনই কাচা। কিন্তু কেচে দেবে কেতাহলে কি সে নিজেই কেচে নিয়েছে। নিজের হাতে কোনো কাজ তো তোমরা ওকে করতে দাও নাইছেলেকে অকম্ম করে রেখেছ। সেই ছেলে শহরে গিয়ে নিজের কাজ নিজে করছে এ কি কম আনন্দের কথা! খোঁকার টেরি-কাটা ছিমছাম চেহারা দেখে খুব ভালো লাগল। আবার একথাও মনে হলো ছেলে বড় হলেই আলাদা মানুষসে কি তখন আর বাপ-মায়ের থাকেখোঁকাও বড় হচ্ছেচুপ করে থাকলে কেমন গম্ভীর লাগছে

মেঠাইয়ের হাঁড়ি তার হাতে দিয়ে বলোমখেয়ো যেননা খেলে তোমার মা বাড়িতে বসেই জানতে পারবে। মেঠাই তোঠিকমতো রাখলে দু-একদিন তা থাকবে। আমার কথায় সে মাথা হেলিয়ে বললেখাব। জানি তো ওকেমুখে কথা খুব কমআমার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই পারে না। যাই হোকআর দু-একটি কথা বলে চলে এলামবাইরে এসে খানিক দূরে গিয়েই মনে হলোএই যাঃভুলে গেলাম খোঁকার হাতে তো কিছু টাকা দিয়ে আসা হলো না! জানি টাকা সে নিজের জন্য কিছুই খরচ করবে না। তবু বাড়ি থেকে দূরে একা থাকেওর ছোট চাচা এখন থাকে না। কখন কি লাগে না লাগে এইসব ভেবে কটি টাকা দিতে আবার খোঁকার বোর্ডিংয়ে ফিরে গেলাম। গিয়ে দেখি ঘরে সি এক লন্ডভন্ড কাণ্ড। সারা বোর্ডিংয়ের সব কটি ছেলে এসে ঢুকেছে খোঁকার ঘরে। চৌকির ওপর মেঠাইয়ের হাঁড়িটা খোলাএক-একটি ছেলে আসছেথাবা দিয়ে মেঠাই নিয়ে মুখে ভরছেকতক খাচ্ছেকতক পড়ছে। সে কি হুল্লোড়সবাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা ঘর জুড়ে আর এক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার খোঁকা এইসব দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে। সে নিজে কিন্তু তখনো মিষ্টিতে হাত দেয় নাই। বন্ধুরা আনন্দ করে এই মেঠাই খাচ্ছে। তাতেই তার সুখ

আমি ঘরে ঢুকতেই সবাই একদম চুপযেন পাথর হয়ে গিয়েছে আর তোমার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সে মুখ ভয়ে নীল। আমার দিকে সে তাকিয়ে আছেতার দুই চোখে যেন পলক পড়ছে না। জানোখোঁকার ঐ চাউনিটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। তবে হ্যাঁসাথে সাথে আমার মনে হলোআর ভাবনা নাইছেলে মানুষ হতে পেরেছে। ওর কাছ থেকে দুনিয়ার কোনো মানুষের কখনো কোনো ক্ষতি হবে না। বি.এ. এম.এ. পাশ দিক আর না দিক

তাড়াতাড়ি করে আমি তার দিকে এগিয়ে গেলামমাথায় হাত দিয়ে বলোমঠিক আছে বাবাঠিক আছে। ভুল তো আমারই হয়েছেআগে ওরাই খাবে। আমারই বলে যাওয়া উচিত ছিল সবাইকে ঘরে ডেকে নিয়ে আগে খাওয়াতে। তারপরে তো তুমি খাবে। তুমিই ঠিক করেছআমার ভুল হয়েছিল। আমি এই কথা বলতেই কি যে একটি হাসি ফুটে উঠল খোঁকার মুখে সে আর কি বলব! সব ছেলে তখন খোঁকাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছেমিষ্টির হাঁড়ি যেমনকার তেমনি পড়ে আছে। শেষে একটি ছেলে এগিয়ে এসে এক থাবা মিষ্টি নিয়ে খোঁকার মুখে তুলে দিলে। আমিও আর দেরি না করে চলে এলাম। এই হলো যেয়ে তোমার খোঁকার গপ্পো

কথা শুনে আমার ভাবনা গেল বটে কিন্তুক ই কেমন ছেলে তা নিয়ে আবার ভাবতে বসি। ই তো কিছুই নিজের লেগে রাখবে নাসব দিয়ে দেবে! তাই যেদি সে সারা জেবন করেতাতে নিন্দে হবে

বরং লোক তার মায়েরই গুণগান করবে এমন ছেলে প্যাটে ধরেছি বলে। কিন্তুক অ্যাকন সে কি যি করে বসে তা কি করে জানবকত্তা আর কবার যায়বরং আমার ভাশুর আর ল-দ্যাওরই বেশি যায় খোঁকার কাছে এটো-ওটো নিয়ে। ভাশুরের ছেলেপুলে নাইদ্যাওরের এখনো বিয়ে-থা হয় নাইতারা পেরায়ই যেচে ছেলের কাছে। যা-ই নিয়ে যাকখাবার কি পরার জিনিশসিসব তাহলে সে কিছুই নিজের লেগে রাখে না! এইসব কথা ভেবে আমার ভারি দোনোমানো হতে লাগল। একবার মনে হচে এতটো ভালো লয়শুদু কি জিনিসপত্তরই দেবেশ্যাষ পয্যন্ত ছেলে সব্বস্ব দিয়ে দেবে! সেই যি সিদিন রেতে কত্তা বললে খোঁকারই বয়েসি কে অ্যাকটো মেয়ে কোথা বন্দুক চালিয়ে বিটিশ মারতে মারতে ধরা পড়ে যেছিল বলে কঠিন বিষ খেয়ে মরেছিলআমার খালি থেকে থেকে সেই কথা মনে পড়তে লাগল। কি কাল এল মাদ্যাশদ্যাশের লোক চালাইছেনা বিদেশীরা চালাইছেতা তো ঘরের ভেতর থেকে কিছু বুঝতে পারি না। কে চালালে ভালো হয় আর কে চালালে মন্দ হয়সি পাল্টাপাল্টি না চালাইলে বুঝবই বা কেমন করেকত্তা যাকন বলেতোমার সোংসার তুমি না চালিয়ে আর একজনা ফোপরদালালি করে চালিয়ে দিলে তুমি কি মানবেত্যাকন মনে হয়তাই তোএকবেলা খেচিআধবেলা খেচিনিজের খেচিআর একজনা দরদ দেখিয়ে কোর্মা-পোলাও দিলেই কি ভালো লাগবেসি কোর্মা-পোলাও কি বিষ-বিষ লাগবে নাআমার হয়ে আর একজন আমার ছেলেকে ভালোবাসলে কি আমার জান ভরবেলোকে বলে নাসেই যি ভিখ করার নাম করে ডানবুড়ি বাড়িতে ঢুকে লোভ করে ছেলের দিকে চায়ভিস্থ নিয়ে চাইতে চাইতে চলেও যায় কিন্তু তার পর থেকেই ডাগর-ডোগর ছেলে দিনদিন যি কেমন শুকিয়ে যেচেডানের চোখ পড়েছে আর কি রক্ষা আছেছেলে শুকুইচেপেত্যেকদিন শুকুইচেশুকিয়ে বাঁশপাতা হেনশ্যাষে বিছেনার সাথে মিশে একদিন দুনিয়া থেকে চলে গেল। ডানের চোখ এমনিমিছে মায়ের চোখে তাকাইলে কি হবেত্যাকন মনে পড়ল দ্যাশের দিকে বিদ্যাশিদের বিলাতিদের তাকানো তাহলে ডানের তাকানো! কত্তার কাছে শুনেছেলমজানকে জান মনে করে নাইকতো লোকসায়েব মারতে গেয়েছেসায়েব হয়তো মরেছেহয়তো মরে নাইনিজের নিজের জান বিলিয়ে দিয়েছে যেন খোলামকুচি। উদিকে যি সায়েব মরেছে কি লোভে সি সাত সমুদ্র পেরিয়ে ই দ্যাশে এয়েছে তা কে বলবেতা সি-ও তো কুনো না কুনো মায়ের পুতসেই মা-ও তো একদিন জানবে যি তার বুকখালি হয়েছে!

যিদিন কত্তা আমাদের সবারই লেগে খুব মোটা কাপড় এনে দিলে পরার জন্যেসিদিন ভারি অবাক হয়েছেলম। খুব দামি কাপড় বাড়িতে আনা হত তা লয়তবে ওরই মদ্যে এট্টু হালকা-মিহি সুতোর শাড়ি আমরা পরতম। কিন্তুক ই যি ভারী চব্বরভিজলে যি গায়ে নিয়ে টানতেই পারব না। কেউ লিকিন আর বিদ্যাশের কুনো জিনিশ ব্যাভার করবে না। কতো জায়গায় বিটিশদের জিনিশ ভঁই করে পুড়িয়ে ফেলছে। এরা বেনে বেসাতির জাতশ্যাষ পয্যন্ত সব কিছুই উদের ব্যাবসা। সেই ব্যাবসা জব্দ করতে হবে বলে উদের জিনিশ আর কেউ কিনছে না। দিশি জিনিশ খাবদিশি জিনিশ পরব। মোটা ভাতমোটা কাপড়। সেই লেগেই এই কাপড়। এই আমাদের পরতে হবে। তা পরছি সেই কাপড়কত্তারাও পরছে মোটা খদ্দর। তাই বলে বাড়িতে আর চরকায় সুতো কাটতে পারি নাই। যাকগোকতো হুজুগ দেখলম এই বয়সে

মাঝে মাঝে মনে করতমসবকিছু তো আমার লয়কুনো কুনোটি আমার। সব্বার ছেলে তো আমার লয়আমারটোই শুদু আমার। আজকাল পেরায়ই মনে হচে কুনো কিছুই শুধু আমার লয়। আমার ছেলেটিও আমার শুদু লয়। ঐ যি মেয়েটি ধরা পড়ার পর মানের ভয়ে কঠিন বিষ খেয়ে মরলঐ মেয়েটি কারউ কি শুদু ওর বাপ-মায়েরউ কি আমারও মেয়ে লয়উ আমার হলে দোষ কি। উকেই যেদি জিঙ্গাসা করা হতোতুমি মেয়েটি কার গোতাইলে সি মেয়ে কি জবাব দিতমরবার আগে সি কি বলতকারু মেয়ে সি লয়সি ই দ্যাশের সব মানুষের মেয়েসি সারা পিথিমির মেয়ে!

ভাবতে ভাবতে কোথা থেকে কোথা চলে অ্যালমআমার গা শিউরে উঠল। অ্যাতো অস্থির লাগছে ক্যানেসবকিছু অস্থির। আমাদের গাঁয়ের স্কুলের ছেলেরাও লিকিনি দুদিন পড়া ছেড়ে বেরিয়ে গেয়েছে। দ্যাশে অ্যাকন রাজার আইন না মানা চলছে। স্কুলের কতোটুকুন কতোটুকুন ছেলেতারাও আইন মানছে না। তাইলে তো শহরেও ইসব হচে। কই কত্তা তো কিছু বললে না। খোঁকা কি তাইলে আবার কত কি ভাবলম। একবার ভাবলামখোঁকা এইটুকুন ছেলেশান্তঠান্ডা। উ আবার কি করতে যাবেআবার ভাবলমকরলে করুকগোউ নিয়ে ভাবতে যাই ক্যানে?

তা বললেই কি ভাবনা যায়দ্যাওর আর ভাইটি অ্যাকন আর শহরে থাকে না। আর ল্যাখাপড়া হলো না তাদের। দ্যাওর বললেতার আর পড়ায় মন যেচে নাএকটো চাকরি-বাকরি পেলে বরং কত্তার পাশে দাঁড়াতে পারবে। সারা জেবন ভাই কি সংসারের বোঝাই শুদু বইবে! সে আর তা হতে দেবে না। এইসব বলে সে। বাড়িতে অ্যাকন বসে আছে। দ্যাওরের এই কথাকিন্তুক ছোট ভাইটির খুব ইচ্ছা আরও পড়া। তার মাথা ভালোপড়লে অনেক ওপরে উঠতে পারত। তা হলে হবে কিখরচ জোগাবে কেএকবার তো এই নিয়ে বাপের সাথে হুলুস্থুল কাণ্ড হয়েছিল। আর দরকার নাই। তাই সে কত্তার কাছে এসে বললে,কলেজে আর সি ভত্তি হবে নাএকটো কুনো চাকরি-বাকরি হয় কিনা চেষ্টা করবে। সি-ও অ্যাকন মামার বাড়িতে ফিরে গেয়েছে

ঠিক এই সোমায়েই একদিন খবর এলযা ভয় করেছেলমতাইখোঁকা স্কুলের আর সব ছেলেদের সাথে ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। আইন মানবে না বলে কিসব করতে গিয়েছিল রাস্তায়সিখান থেকে তাদের দলসুদু ধরে জেলে নিয়ে গেয়েছে!

 

ছেলে আনো বাড়িতেআর পড়তে হবে না

এত কথা ভাবলম কিন্তুক যে-ই শোনলম বড় খোঁকাকে ধরে জেলে নিয়ে গেয়েছেঅমনি সব ওলোট-পালোট হয়ে গেল। ছেলেকে জেলে নিয়ে গেয়েছেদড়ি দিয়ে বেঁধেছেনা শেকল দিয়ে বেঁধেছেলাঠির বাড়ি মেরে টানতে টানতে নিয়ে গেয়েছেউ ছেলে কুনোদিন কারু হাতে মার খায় নাইকেউ ওর গায়ে হাত দেয় নাই কুনোদিনসেই ছেলে পুলিশের লাঠির বাড়ি খেচে কি জানিসারাদিন উপোস করে আছে না কি,ভোক্ সহ্য করতে পারে না সি তো আমি জানিকেউ হয়তো এট্টু খাবার দেয় নাই তাকেতবু মুখ ফুটে তো একটি কথা সি বলবে না কখনো এইসব হক না-হক কথা খালি বুকের মদ্যে উথথাল-পাতাল করতে লাগল আর খানিক বাদে বাদে দোম যেন আটকে যেতে লাগল। আমি কেবলই বলতে লাগলমআমার ছেলে এনে দাওযেমন করে পারো আমার ছেলে এনে দাও। যেন ছেলে বলতে আমার একটিই। ইদিকে পরের খোঁকাটি আট বছরের হয়েছেচাঁদের মতুন একটি মেয়েও হয়েছেঅ্যাকন ছ-মাসের সিসব কথা মনে হলো না। উরা যি ছামনেই রয়েছেতাই খেয়াল হচে না। খালি মনে হচেআমার নাড়িছেড়া ধনটিই আমার কাছে। নাইআমার কেউ নাইআমার বিশ্ব-ভোবন আঁদার

তবে কত্তা গেয়েছেআমি একটু নিশ্চিন্তি। উ লোক সামান্য লয়উ মানুষ বটবিরিক্ষিতামাম মানুষকে হেঁয়া দিতে পারে। ঠিক তা-ই হলো। তিমি-সাঁঝের বেলা খোঁকাকে নিয়ে ফিরলে কত্তা। অন্য অন্য দিন সে ফিরে নিজের বাইরের ঘরেই থাকেআমরাই পা-ধোয়ার পানিশরবত নিয়ে যাই। আর খুব কিছু বেপার হলে সে বাড়ির ভেতর মা-বুনের কাছে আসে। আজ সে তা-ই করলেছেলেকে নিয়ে সোজা বাড়ির ভেতরে এসে মায়ের কাছে বড় খোঁকাকে ঠেলে দিয়ে বললেছেলে যে পথে যাচ্ছে এই বয়েস থেকেকেন যাচ্ছেকি করতে যাচ্ছেএইসব কথা ওর কাছ থেকেই শোনো। তারপর তুমিই ঠিক করোওকে বারণ করবে কি করবে না। নেহাত কম বয়েসতাই দয়া করে এবার ছেড়ে দিলেদু-বছর জেলও দিতে পারত। ব্রিটিশদের রাজত্ববড় কঠিন শাসন মা। এই শাসন এখন দেশের লোকও আর মানতে চাইছেঘর-সংসার বাপ-মা ভাই-বোন লেখাপড়া ছেড়ে দলে দলে সব বেরিয়ে আসছেএরই মতন খোঁকা সবকিছুই মানছে না,কারুর বারণ শুনছে নাঝাঁকে ঝাঁকে মরতে যাচ্ছে। কি এখন বলবে বলো দিকিন। আইন তো ছাড় কথা এখানে বোমা ফাটাচ্ছেওখানে সায়েব মারছে আর যতো জেল হচ্ছেফাঁসি হচ্ছেততো তাদের রাগ বাড়ছে। আগুন জ্বলছে দেশেকি করা যাবে বলো তোগিন্নি দেখি চুপ করে আছেতার আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে বেধবা ননদটি। কেউ কুনো কথা বলছে না। বড় খোঁকা কত্তার পাশে মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়েতার একটো হাত কত্তার হাতে ধরা। আমি আর থাকতে পারলম নাছুটে যেয়ে ছেলের গায়ে হাত দিয়ে দেখিগা-গরমজ্বর এয়েছে। আমি চেঁচিয়ে ওঠলমই কিই-যি অ্যানেক জ্বর! বাপ না ছাইকত্তা এই ছেলেকে শহর থেকে নিয়ে এয়েছেকতোবার গায়ে-পিঠে হাত পড়েছেছেলের জ্বর সি কিছুই ট্যার পায় নাই

আমার চিচকার শুনে গিন্নি এগিয়ে এসে খোঁকার কপালে হাত রাখলে। সে তো অস্থির হবার মানুষ লয়,যাতে বেপদই হোকমাথা তার ঠান্ডা। কপালে একবারবুকে একবার হাত দিয়ে গিন্নি আমার দিকে চেয়ে বললেহাজ্বর অনেক। তা এত হ্যাঙ্গামা-হুঙ্কুতে জ্বর আসবে না! কেন ভাইএসবের মধ্যে থাকছ তুমিতা যাকঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এয়েছেজ্বর নিয়ে ভাবতে হবে নাআপনা-আপনিই চলে যাবে। যাওমেজ বউউত্তর-দুয়োর ঘরে বিছেনা করে দাও

সাঁঝবেলার আঁদারে সব ভূতের মতুন দাঁড়িয়ে আছে।পিদিম কিল কিছুই ত্যাকননা জ্বালানো হয় নাই। তখন-তখুনি বিছেনা করব কিআগে একটো রেড়ির ত্যালের পিদিম জ্বালিয়ে উত্তর-দুয়োরি ঘরে ঢোকলম। এমন লাগচে ক্যানে মা! এত আঁদার লাগচে ক্যানে। ঘরের এক কোণেপিদিমটো রাখলমসারা ঘর যেমনকার তেমনি আঁদার। শুদু পিদিমটো মিটমিট করে জ্বলতে লাগল এক কোণে। খুঁজে খুঁজে বারুণ আনলমতিমি-সাঁঝে ঝট দিতে নাই। তবু ঘরটো একবার ঝট দেলমখেজুর পাতার নকশা করা শেতল পাটিটো পাতলমতাপর হাতের আন্দাজে খুঁজে খুঁজে সিন্দুকের ভেতর থেকে সুজনিটো বার করে পাটির ওপর পাতলমআহা ত্যাকননা জানি নাজাদু আমার কি কষ্ট করে ঘরের ভেতরে আঁদারের মদ্যে দাঁড়িয়ে আছে। যি ছেলে সহজে নিজের কষ্টের কথা বলে নাসেই ছেলে য্যাকন বললেমাআর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি নাত্যাকন আমার হুশ হলো। এই যি বাপএই হয়ে গেল বলে তাড়াতাড়ি করে আমি খোঁকাকে ধরে আস্তে আস্তে শুইয়ে দিতে দিতে বললমহ্যাঁ বাপপুলিশ কি তুকে মেরেছেআমার কথা শুনে খোঁকা হাসলেআবছা আঁদারে তার হাসিটি আমি দেখতে প্যালম না। ঐরকম করে হাসতে হাসতেই সে বললেনা নাগায়ে হাত দেবে কেনগায়ে। হাত দেয় নাই। এক পুলিশের অফিসার আমাকে বললেতাড়াতাড়ি ছাড়া যদি পাওঘরের ছেলে ঘরে যাওএ পথে থাকলে মরবেযারা তোমাদের এসব কাজে লাগাচ্ছে তাদের কিছুই হবে না। মাঝখান থেকে তোমরাই মারা যাবে

খোঁকাকে বিছেনায় শুইয়ে পিদিমটো এনে তার মাথার কাছে রাখতে যেয়ে দেখলমচোখদুটি তার লাল টকটকে। কপালে হাত দিয়ে দেখলমজ্বর হু হু করে বাড়ছে। গিন্নি এসে সব দেখেশুনে বললেখোঁকার মাথাটো একবার ঠান্ডা পানিতে ধুইয়ে দাও মেজ বউদিয়ে খানিকক্ষণ কপালে জলপটি দাও। তাইলে জ্বর কমে যাবে

তা-ই করলম। চাচারা সব এল-গেলকতো কথা বললে খোঁকাকেকতো আদর করে কতো কথা বললেবারে বারে গিন্নি আর বুবু এসে খোঁকার কাছে বসলে। তা-বাদে বাড়ির সব লোকদের খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে আমাকে গিন্নি কতোবার বললে রেতের ভাত খেতে! আমি খোঁকার শিয়র থেকে নড়লম নাজলপটি দিতে দিতে আমার কতোবার ঝিমুনি এলঝুঁকে ঝুঁকে পড়তে লাগলমতবু খোঁকার কাছ থেকে যেতে পারলম না। অ্যানেক রেতে মনে হলোজ্বরটো যেন এট্টু কম হয়ে এয়েছে। খোঁকা আর ত্যাতটো অস্থিরও করছে না। একটু বাদে ঘুমিয়ে পড়ল সে

সকালবেলায় মনে হলো জ্বরটো আর নাইছেলেকেও অ্যানেকটো চনমনে লাগছে! কাল রেতে কিছুই খায় নাই। তাকে ধরে আস্তে আস্তে পিঁড়েয় নিয়ে বসিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে দেলম। কাল রেতে ছেলের লাল টকটকে চোখ দেখে ভয় পেয়ে গেয়েছেলম। অ্যাকন দেখলমমুখচোখ শুকিয়ে গেয়েছে বটেতবে চোখের সেই লাল টকটকে ভাবটো আর নাই

লিশ্চিন্ত হয়ে আছিযাকগোজ্বরটো খারাপ জ্বর লয়। ত্যাকনকার ডাক্তার-বদ্যি খুব কমলোকে সহজে তাদের ডাকতে যেত না। আর ডাকতে চাইলেই বা পাবে কোথা। পাশ করা কুনো ডাক্তার দশ গাঁয়ে খুঁজলেও পাওয়া যেত নাদু-একজনা যা থাকত সি শহরে। গাঁয়ের মানুষ কি তাদের কাছে যেতে পারেই গাঁয়ে উ গাঁয়ে হয়তো বদ্যি দু-একজনা ছিলডাক্তার বোধায় একটোও লয়। কেউ হয়তো কুনোদিন কুনো ডাক্তারের কাছে দিনকতক ছিলএটো-ওটো নাড়াচাড়া করেছেকষ্টমষ্ট করে ইঞ্জিশন খুঁড়তে পারেনাইলে দু-দাগ মিকচার বানিয়ে দিতে পারেসে-ই হলো ডাক্তার। তা ইসব ডাক্তারও কি সব গাঁয়ে আছেতা নাই। আমার বাপের গাঁয়ে কুনো ডাক্তার-কবরেজ ছিল না। তিন কোশ দূরের গাঁয়ে একজনা ছিলসকালে তাকে ডাকতে গেলে বৈকালি বা সাঁঝবেলায় একটো বুড়ো ঘোড়ায় চেপে হটর হটর করে সে আসত। তা সে-ই হলো যেয়ে বড় ডাক্তার। আমার শ্বশুরবাড়ির গাঁ ইদিক থেকে খুব ভালো। আছে একজন অ্যালাপ্যাথিপাশ-টাশ দেয় নাইতবে খুঁড়তে পারেবড়ি-মিকচার দিতে পারে। আর একজন হলো হেমাপ্যাথিশিশিতে পানি ভরে দু-ফোটা করে ওষুধ দিত। এক-আধ আনা পয়সা কেউ তাকে দিতকেউ দিত না। ইদিকে অসুখ-বিসুখ রাতদিন লেগে আছেকে আর অত ডাক্তারের কাছে যায় জ্বরজ্বারি নিয়েদু-চার দিন বাদে আপনিই চলে যাবে। সর্দি-কাশিতে জ্বরফেঁড়ার তাড়সে জ্বরবদহজমে প্যাটে যন্তন্নাউসব কিছু ধত্যবের লয়গা-গরম। তবে কঠিন কিছু হলে কি আর করবে মানুষরুগির ঘরে যেয়ে চেয়ে চেয়ে দেখত। অসুখ-বিসুখ হামেশা হচেআপনা-আপনি সেরেও যেচেআবার মরেও যেচে অ্যানেক মানুষ

অসুখ কঠিন না সহজবোঝবার বাগ ছিল না সি-সময়ে। বড় খোঁকা সকালে কিছু খেলে না। বললে মুখে মজা নাই। অত জ্বর ছিল রেতেমুখে কি মজা থাকেতবু সকালে খই-মুড়কি খেলেদোপরবেলায় ভাতও দুটি খেলে। আমি লিশ্চিন্ত মনে ঘরের কাজকৰ্ম্ম করছিবাড়ির আর সবাইও লিশ্চিন্ত— সাঁঝবেলার খানিক এণ্ড ঘরে যেয়ে দেখিখোঁকা বিছেনায় শুয়ে আছে। বললমএই অবেলায় শুয়ে ক্যানে খোঁকাএকটু উঠে হেঁটে বেড়াওবলতে বলতে দেখিবলব কিতার মুখের দিকে চাওয়া যেচে নাঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছেছেলে খুব হাঁসফাস করছে। ঠিকঅ্যানেক জ্বর গায়ে। আবার ক্যানে জ্বর এলমনে একটু ভাবনা হলোবাড়ির সবাইকে জানালম। খবর পেয়ে কত্তা জ্বরকাঠি নিয়ে ঘরে এল। বগলের তলায় জ্বরকাঠি দিয়ে দেখলেহ্যাঁ অ্যানেক জ্বর

এই যি জ্বর এল আর ছাড়লে। সকালবেলাটোয় কমমনে হতো বুঝিন গেয়েছেপেথম দিন যেমন মনে হয়েছিল। কিন্তুক ঐ জ্বরকাঠি দিতেই দেখা যেত জ্বর আছেছাড়ে নাই। তিন-চার দিন এই রকম গেলসকালে কমরেতে অ্যানেক জ্বর। খাওয়ারও রুচি নাইতা-বাদেএই কদিন পাইখানা বন্ধ ছিলএকদিন খুব শক্ত পাইখানা হলোতাপর ঘন ঘন লরম বাজি আর প্যাটে যন্তন্না। কত্তা গাঁয়ের অ্যালাপ্যাথি ডাক্তারকেই আগে ডাকলে

জ্বরটো যাচ্ছে না কেনতিন-চার দিন হয়ে গেলকত্তা শুদুইলে ডাক্তারকে। লাঙলা চাষার মতুন চেহারা ডাক্তারেরদেখলে পছন্দ হয় না। তা মিছে লয়নিজের হাতে চাষবাস করে ডাক্তারদরকার হলে লাঙলের মুটোও ধরে। দুই পায়ের আঙুলে হাজাহাতের আঙুলগুলিনও এই মোটা মোটা! কি করে পছন্দ হবে এমন ডাক্তারখানিকক্ষণ সে খোঁকার নাড়ি টিপে চোক বুজে থাকলেতারপর বললেজিভ বার করে অ্যা অ্যা করো। সব দেখে শুনে শ্যাষে বললেহাঁ জ্বর আছেকিসের জ্বর তা তো এখন বলতে পারা যাচ্ছে না। জিবে ময়লা পড়ে রয়েছে। যা-ই হোকটাইফয়েড সন্দেহ করছিআর দু-চার দিন যাকরোগ ঠিক বেরিয়ে পড়বে। ওষুধপত্তর কিছু দিচ্ছি। শক্ত খাবার একদম বন্ধসা-বালি খাবেতাতে দুধ দেওয়া চলবে নাজল দিয়ে রান্না করতে হবে। ডাবের জলটা খেতে পারবে আর বেদানার রস। এইরকম চলুক

এইসব বলে চার আনা ভিজিট নিয়ে ডাক্তার চলে গেল। কথা শুনে কত্তা লিশ্চিন্ত হতে পারলে না,হেমাপ্যাথি ডাক্তারটি বন্ধু লোকতাকে ডেকে নিয়ে এল। ই ডাক্তারের পরনে একটো হেঁটো ধুতিকাঁধে একটো মোটা চাদর। সি যি কতো কথা শুদুইলে তার আর অন্ত নাই। অত কথার জবাব খোঁকা আর কি দেবেঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা শোনছেলম। কত্তাই সব কথার জবাব দিচেশেষে সে বললেতোমার কি মনে হচ্ছেডাক্তার বললেসর্বাংশে কিছু নয়আমি তিনটি পুরিয়া দেববাসআর কিছু লাগবে না

ঐরকম করে কথা বললে কি কিছু বোঝা যায়। আমি কিছু বুঝতে পারলম না। আরও দুটো দিন গেল কিন্তুক জ্বর একবারও ছাড়লে না। সকালের দিকটোয় একটু কম থাকেগায়ে-মাথায় হাত দিয়ে মনে হয়,জ্বর নাই আর জ্বরকাঠি বগলে দিলেই দেখা যায় এট্টু জ্বর লেগেই আছে। ক্যানে জানি নাআমার মন খুব কু ডাক ডাকতে লাগল। কিন্তুক কাকে কি বলব বেশি কিছু বলতে গেলেই লোকে বলবে মেতর-বউ বাড়াবাড়ি করছে। অসুখ-বিসুখ যি মানুষের গা-সওয়া। সবাই জানে অসুখ আছে চিকিচ্ছে নাই-সেই লোগে অসুখে কেউ গা করত না। বলত উ কিছু লয়গা-গরমএমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। ভালো কি আর হতোহাজার কিসিমের রোগ-বালাইয়ে হর-হামেশা লোক মরত। কতোরকম অসুখই না ছিলঝি-বউদের সূতিকা রোগছোট ছোট ছেলেমেয়ের পুঁয়ে-লাগা রোগদিন দিন শুকিয়ে যেচেশুকিয়ে যেচেশেষে একদিন মরে গেলআর একটা রোগ হুপিং কাশিবাবা রে কি কাশিকাশতে কাশতে চোখে রক্ত পয্যন্ত জমে যেততাপর বড়দের হাঁপানির ব্যায়রাম-ইসব রোগের কুনো চিকিচ্ছে ত্যাকন হতো না। ওগুনো যেন রোগই লয়। দু-একটো মরে গেলেও কুনো শিক্ষে নাই। তেমনি বাতাস লেগে মওতবাণ মেরে মানুষ মারা ইসবও ছিল। আর ছিল দুটি অসুখসি হলে কেউ চিকিচ্ছে করাত নাকুনো চিকিচ্ছে ছিলও না। একটি হলো কুটহাতে-পায়ে কুটই ভালো হবার লয়কুনো চিকিচ্ছে নাই। সবচাইতে খারাপ শাপ হচে তোর মুখে কুট হোক। আর একটো হচে ক্ষয়-কাশিউ হলে মওত আসবেইচিকিচ্ছে কিছুই নাই। সব শ্যাষে আর ছিল দুটি রোগহুড়মুড়িয়ে এসে পড়ত। একটি হলো নামুনে-কলেরা আর একটি গুটি-বসন্ত। এই দুটি রোগ আপনা-আপনি হতো না। দুই হারামজাদি মাগী এক গাঁ থেকে আর গাঁয়ে নিয়ে যেত। এক মাগীর নাম মা-শেতলাআর এক মাগী ওলা-বিবি। একজনা বসন্তেরআর একজনা নামুনেরএকজন হিঁদুআর একজনা মোসলমান। দুজনায় মিলে কি মাহা-কাজই না করত! ত্যাখন আর হিঁদু-মোসলমান বাছত না। এক-একটো গাঁয়ে দশ-পনেরোদিন থাকত। কতো বংশ যি নিব্বংশ হতো! বিরান হয়ে যেত গাঁ-কে গাঁ। পরে আর একটি গায়ে যেত। এই দুটি মাহামারী রোগ এলে লোকে চিকিচ্ছে আর কি করাবেদু-হাতে মাথা চাপড়াত

আমিও খোঁকার অসুখটোকে মনে করেছেলম এমনি জ্বর। দু-দিন বাদেই সেরে যাবে। অ্যাকনো তা-ই মনে হচে। যি রোগের কথা ঐ হেঁটো-ধুতি পরা বামুনটো বলে গেলসি লোগ আমার ছেলের হতে যাবে ক্যানেকার কাছে কি দোষ আমি করেছিকার কি শাপ আমি কুড়িয়েছি যি আমার বড় খোঁকার উ রোগ হতে যাবেউ কি য্যাকন-ত্যাকন যার-তার হয়জাতসাপের কামড়ের মতুন উ হলো কালরোগ। পাড়াগাঁয়েরও সব লোক জানে সান্নিপাতিক জ্বর হলে রুগি বাঁচে না। ঐ একজ্বরী সান্নিপাতিক এমনি জ্বর যি একনাগাড়ে একুশ দিননা-হয় আটাশ দিননা-হয় ছাপ্পান্ন দিন গায়ে লেগে থাকবেকিছুতেই ছাড়বে নাশত ওষুধ-পত্তরে কুনো কাজ হবে না। ঐ মেয়াদের মদ্যে রুগি মরে গেল তো গেলমেয়াদ পয্যন্ত যেদি বেঁচে থাকে তত সুস্থ হবে বটে কিন্তুক একটি অঙ্গ হয় একটি চোখনা-হয় একটি হাত কিংবা একটি পা লষ্ট হবেই হবে। এমনি কঠিন রোগ! আমার ছেলের কি সেই রোগ হয়েছেতা ক্যানে হবেএই দিন-দুনিয়ার সব মানুষ ভালো থাকুকসব মায়ের পুত!

কিন্তুক সাত দিন পেরিয়ে গেলছেলের জ্বর ক্যানে যেচে নাপ্যাটটোও খারাপ হলোতলপেটে দরদও খুব। কত্তা বরং একবার শহর থেকে ডাক্তার নিয়ে আসুক। আমি আর থির থাকতে পারছি না

 

যা ভয় করেছেলম তা-ই হলোই সান্নিপাতিক জ্বর

কি করে শহর থেকে বড় ডাক্তার আনা সোম্ভাব হলোআমি জানি না। বোধায় জমিই খানিকটা বেচতে হলো। দ্যাওর-রা সব ঘেঁকে ধরলে কত্তাকে।গিন্নি আর ননদও দুটো কড়া কথা শুনিয়ে দিলে তাকে। ছেলেই যদি চলে গেলসম্পত্তি ধুয়ে কি পানি খাবে কত্তাছোট দ্যাওর তো কেঁদেই ফেললে। গলা তুলে একটি কথা কুনোদিন সে বলে না কত্তার কাছেসিদিন কঁদতে কাঁদতে বললেদু-দিনের মধ্যে শহর থেকে বড় ডাক্তার যদি তুমি না আনোআমি বিষ খাব বলে দিচ্ছিএই সংসারের ভাত আমার হারাম হয়ে যাবে

যা-ই হোকপরের দিন বৈকালির টেরেনে ডাক্তার এল। ইস্টেশনে মোষের গাড়ি গেয়েছিলকত্তা ডাক্তারকে নিয়ে বেলা থাকতে থাকতেই বাড়ি এল। হাত-মুখ ধোবে নাকিছু খাবে নাহ্যাট-কোট পরা ডাক্তার সোজা রুগির ঘরে চলে এল। ঘরের বাইরের উসারা থেকে আমরা সব দেখছি। ডাক্তারের বয়েস খুব বেশি লয়সোন্দর মুখফরশা চেহারা। অনেক রকম করে রুগি দেখলেতাপর দেখা হয়ে গেলে এমন চুপ করে খানিকক্ষণ বসে থাকলে যি সি দেখে আমার হাত-পা প্যান্টের ভেতর সেঁদিয়ে যেতে লাগল। হ্যাঁ,ই সান্নিপাতিক জ্বরই বটেএই কথাটি য্যাকন সি উশ্চারণ করলেমনে হলো আমার কলজেয় যেন একটো কালসাপ ছুবলে দিলে।তাইলে গাঁয়ের অ্যালাপ্যাথি ডাক্তার যা সন্দ করছিলতা-ই ঠিককি হবে অ্যাকনই রোগের কি চিকিচ্ছে নাইশোনলমঘরের ভেতর ডাক্তার বলছেসান্নিপাতিক জ্বরের কুনো চিকিচ্ছে নাইই কথা ঠিক লয়। মেয়াদি জ্বর তো-একুশ দিনআটাশ দিনকুনো কুনো সোমায় ছাপ্পান্ন দিনও ই জ্বর থাকেতাপরে ছেড়ে যায়

জ্বরের মেয়াদের সময়টায় আমরা দেখি রুগির দেহে যেন শক্তি থাকেজ্বরটা সহ্য করতে পারে। সবচেয়ে দরকার হলো যত্ন আর সেবা। এই দুটোই হলো আসল ওষুধ। মুশকিল হচ্ছেনাড়ির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। হজম করার ক্ষমতা থাকে নানাড়িতে দগদগে ঘা তো! আবার। শক্ত খাবার কিংবা পুষ্টিকর খাবারও কিছু দেওয়া যায় না

ওষুধ যা দেবার আমি দিচ্ছিরকম বড়ি থাকবেমিকশ্চার থাকবে। রুগিকে আপনারা ডাবের জল দেবেন। জল দিয়ে রান্না করা সাগু-বার্লি দেবেনকখনো বেদানার রস দেবেনতবে বেশি নয়পেট খারাপ হয়ে। যেতে পারে। মাঝে মাঝে ঠান্ডা জলে মাথা ধুইয়ে দেবেন

এইসব বলে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ঘরের চারিদিকে চেয়ে ডাক্তার বললেরুগির ঘর একবারে আলাদা হবেযখন-তখন কেউ ঘরে ঢুকবে না। ঘরে বেশি আলো থাকবে নাআবার হাওয়া চলাচল যেন থাকেদেখবেনবলতে বলতে ডাক্তার ঘরের বাইরে এসে সবাইকে সাথে নিয়ে চলে গেল। ত্যাকন গিন্নি আমাকে ডেকে বললেমানুষের সোংসারে ঝড়-বিষ্টি আপদ-বেপদ আসবেই। চিরকাল কারু সুখেও যায় নাদুখেও যায় না। শোনো মেজ বউছেলের দায়িত্ব তোমার আর মহুদার। ঘর-সোংসারের কাজ যা পারবে করবেনা পারলে করবে না

এইসব দায়িত্ব নিয়ে লেলম আমি আর আমার বেধবা ননদ। উত্তর-দুয়োরি ঘরটোই বাড়ির সবচেয়ে ভালো ঘর। কারুকাজ করা মেহেগোনি-কাঠের একটি দরজা আর ঐ উত্তরেই একটি বড় জানে। ঘরের ভেতরটো একটু আঁদার-আঁদার পুবে জানেলা নাই। দক্ষিণে টানা দেয়ালকুনো জানেলা নাইপশ্চিমেও নাই। তবু এই ঘরটিই সবচাইতে ভালো। সেইখানে লতুন করে বিছেনা পাতলমসব জোগাড়যন্তর। করলম। ফল-পাকুড় ছেলে যা যা খেতে পারে সব আনা হলো। বেদানা-নাশপাতিনেবুএইসব ফল এলডাবের পাহাড় জমল। সারা বাড়িতে সাড়া-শব্দ নাইকেউ কথাবার্তা বলতে চায় না। দু-একটা কথা বলে ফিসফিস করেছেলেমেয়েরা পয্যন্ত কঁদতে ভয় পেচে। বাড়িতে অ্যাকন ছেলেমেয়ে তো খুব কম লয়আমার দুটিপরের খোঁকা আর মেয়েটিসেজ বউয়ের দুটি খোঁকা আর ভাগ্নেদুটি আছেই। কখনো কখনো কোলের খুঁকি কিংবা সেজ-র ছোট খোঁকাটি চিচকার করে কেঁদে উঠলে চমকে উঠি। দোপরবেলায় সব শুনশানবাড়ির লোকজন সব ঘরেকারু মুখে রা নাই। কানে আসত কা কা কাকের ডাক মনে হতো যেন ই জগতের লয়অন্য কুনো দুনিয়া থেকে কাক ডেকে যেচে। কুরুর কুরুর করে ঘুঘু ডাকততাও মনে হতো অন্য কুনো জগৎ থেকে ডাকছে। গা ত্যাকন শিউরে উঠতমনে হতো এখুনি একবার খোঁকাকে দেখে আসি। মা নাইএই ফাঁকে কে না জানি কি করছে! মা হাজির থাকলে আজরাইলও কিছু করতে পারবে না ছেলের। ছুটে চলে য্যাতম রুগির ঘরে। আঁদার ঘরে হঠাৎ ঠাওর হতো না খোঁকা কুত্থানে আছে। তাপর আঁদার চোখে সয়ে এলে দেখতে প্যাতম ঘরের এক কোণে বিছেনায় শুয়ে আছে খোঁকা। বিছেনায় যেন মিশে গেয়েছে ছেলেমুখ শুকনোশুদু চোখদুটি টকটক করছে। কিছু খাবে বাপনা। মাথা টিপে দেবনা। যা শুদুই তাতেইনা। কাউকে তো কুনোদিন বেস্ত করতে শেখে নাই। নিজের লেগে কিছুই যি চায় না সে। তবু মাথায় হাত দি। জ্বর অল্পইকিন্তুক এট্টু না এট্টু লেগেই আছে

এমনি করে একটি একটি দিন পার হতে লাগল। অ্যাকটো করে দিন যেচেনা অ্যাকটো করে যুগ কেটে যেচে। সকালে সুয্যি উঠে দিন শুরু হলে মনে হচেএই দিন আর শ্যাষ হবে নাসুয্যি আর ডুববে না। আবার সাঁঝবেলায় আঁদার নেমে রাত অরম্ব হলে মনে হচেই রাত বোধায় আর কাটবে না

সকাল দোপর রেতে রাঁধা আছেখাওয়া আছে। বাড়ির লোক আসচে-যেচেখেচেসবই করছে। জন-মুনিষরাও কাজকম্ম করতে যেচে। তবু মনে হচে সব চুপসব থম মেরে আছে। বাড়িতে হাসি নাইগান নাইকথা নাই। বাপ-চাচাদের দেখে মনে হচে তারা যি জানে ধরে বেঁচে আছেই বড় শরমের কথা। মনে হচে কতো অপরাদই তারা করছেলুকিয়ে লুকিয়ে চুরি করে অ্যাকনো বেঁচে আছে! বংশের বড় ছেলেমোলো বছর চলছেমানুষের মতুন মানুষ হয়ে গেয়েছেসি ছেলে মরণরোগে পড়ে আছেতাইলে তারা ক্যানে বেঁচে থাকবেখানিক বাদে বাদে একজন করে খোঁকার বিছেনার কাচে আসছেচুপ করে খানিক দাঁড়িয়ে থাকছেতাপর কথাটি না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেচে। অ্যাকন দেখছিই-বাড়ি উ-বাড়ি থেকেও লোক আসচে খোঁকাকে দেখতে। হিঁদুপাড়া থেকেও লোক আসছে। শুদু যি কত্তাকে তারা চেনে,মান্যিগন্যি করেসেই লেগেই যি আসচে তা তো নয়আমার উ ছেলে সারা গাঁয়ের পিয়সেই লেগেই তারা সব না এসে পারছে না। একদিন কত্তামা-ও পালকি করে এসে দেখে গেল। য্যাতো লোক আসে,ত্যাতো আমার কলজে খামচে খামচে ধরে। তাইলে কি খোঁকা আমার ই দুনিয়ায় থাকবে না?ই তাইলে কি মিত্যুরোগ-ই কি হলো গো! আবার এক-এক সোমায় ভাবিআমি মাআমি বাঘিনিকইকে নিবেনিয়ে যাক তো আমার ছেলে আমার ছামনে থেকে!

চিকিচ্ছের কামাই নাই। গাঁয়ের অ্যালাপ্যাথি ডাক্তার পেত্যেক দিনই আসে। তার কাছ থেকে শুনে কত্তা একদিন-দুদিন বাদে বাদে শহরে যায়বড় ডাক্তারকে জানায় আর ওষুধ-পথ্য নিয়ে বাড়ি আসে। খোঁকা আর ওষুধ খেতে চায় নাপথ্যও কিছু খেতে চায় না। পথ্যই বা কিডাবের পানিসাবুবার্লি ইসব কি কেউ দিনের পর দিন খেতে পারে! দিনদিন ছেলে শুকিয়ে যেতে লাগলঠিক যেন বাঁশপাতাবিছেনার সাথে মিশে গেয়েছে। অ্যাকন আর উঠে বসতে পারে নাদাঁড়াতে পারে না। পায়খানা-পেশাব খুব কম হয়ে গেলকিছুই খাওয়া নাই তোহবে কোথা থেকেবেশিরভাগ সোমায় চোখ বন্ধ করে রাখেমনে হয় যেন চোখের পাতা খোলারও খ্যামতা নাই। সারা দিন-রাত ছেলের মাথার কাছে বসে থাকি আর আকাশ-পাতাল ভাবি।তবে কি তাকাবে না-তবে কি থাকবে নাযেদি নাই-ই থাকেতাইলে আমি বাঁচব কি করেয্যাতেই বাঁচতে চাইকি করে বাঁচবনিজের জান তো তুশ্রুতামাম দুনিয়া দিলে যেদি খোঁকা বাঁচেতাইলে তা-ই হোক। আমি বিরলে বসে বাছার মুখ নিরখি

একুশ দিনের দিন আমার হঠাৎ মনে হলো কত্ত যেন কেমন হয়ে যেচে। শহরে যাবার কথা ছিলসিদিন সে আর শহরে গেল নাকারও সাওস হলো না তার কাছে যেয়ে একটি কতা বলে। খানিকটা বেলা হলে সে নিজে যেয়ে হেমাপ্যাথি ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এল। হেঁটো-ধুতি পরাচাদর-গায়ে সেই বন্ধু ডাক্তারটি রুগির ঘরে এসে দাঁড়াইলে

তুমি বলেছিলে এ কোনো রোগই নয়দুটো পুরিয়া দিলেই জ্বর পালাবে। আমি সব ওষুধ বন্ধ করে দিচ্ছি,দাও তোমার পুরিয়া। আমি দু-দিন দেখবজ্বর যদি না ছাড়েখুন করব তোমাকে

কত্তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ভয় পেয়ে গ্যালমাই কেমন মুখের চেহারা! হেমাপ্যাথি ডাক্তারও বোধায় ভয় পেয়ে গেল। সে বললেএসব কি কথা বলচরোগব্যাধি নিয়ে এমন কথা কি বলতে আছে। যা-ই হোকঅনেক দেরি হয়ে গিয়েছেতবু ওষুধ আমি দিচ্ছি। অন্য কোনো ওষুধ বন্ধ করতে হবে নাএকসাথেই সব চলুক

সেই কথামতো সিদিন থেকে অ্যালাপ্যাথির সাথে হেমাপ্যাথিও চলতে লাগল

এত কিছুর মদ্যে এক মাহা আশ্চর্য হচে আমাদের গিন্নি। সারা বাড়ির এই-আবস্তায় কারুরি মাথা ঠিক নাইকেউ অস্থিরকেউ পাথরহাঁ-চা নাইগোটা গাঁ যেন পেমাদ গুনছেইয়ারই মদ্যে আমাদের গিন্নি যেমনকার তেমনিসেই পোষ্কার মোটা ধুতিটি পরনেকপাল পয্যন্ত ঘোমটা। খালি পাতবু দু-পায়ে এক কণা ধুলো নাই। ঘড়ির কাঁটার মতুন নিজের কাজগুলিন করে যেচে। সিদিন এই পেথম দেখলমকত্তাকে কাছে ডেকে তার মাথায় হাত দিয়ে আস্তে আস্তে বললেখোদার ওপর ভরসা রাখো বাবা!

কত্তা কুনো কথা বললে নাশুদু মায়ের মুখের দিকে কেমন করে একবার তাকাইলেতাপর মাথা হেঁট করেই সিখান থেকে চলে গেল। খোদার ওপর ভরসা যিদিক দিয়েই রাখি না ক্যানেঅ্যাকন আমি জানিআশা নাইআর আশা নাই। আমার বুকের ভেতরে তাকিয়ে দেখিসিখানে কুনো আশা নাই। খোঁকা কি নিজেও সি কথা জানতে পেরেছেসব খাওয়া ছেড়েছে সে। মাঝে-সাঝে এট্টু পানি চেয়ে খায়মুখে চাইতে পারে নাচোখের চাউনিতে চায়। ডাবের পানি দিতে গেলে মাথা নাড়েশুদু পানিই খাবে। তার মুখের কথা শুনতে গেলে কান পাততে হয় মুখের কাছে। বুকের দু-পাশের পাঁজর একটি একটি করে গোনা যায়মুখখানি এইটুকুনিশুদু ডাগর দুটি চোখের চাউনি আগের মতুনই আছে বরং তার রোশনাই যেন আরও বেড়েছে। নাআশা আর করব না। যেদি তাকে যেতেই হয়তাইলে আর এত কষ্ট ক্যানে তারতাড়াতাড়িই নিয়ে যাক তাকে আল্লাআমি আর সইতে পারছি নাপারছি না

একদিন এই দুনিয়াতেই দেখলম যে বেহেস্তের ছবি– সি কুনোদিন ভুলব না।খোঁকার অসুখ সারা সংসারকে অচল করে দিয়েছে। বাড়িতে যি আরও ছেলেমেয়ে আছে সব ভুলে গেয়েছি আমরা। যারা এট্টু বড় হয়েছেতারা ভয়ে কথা বলে নারাগ করে নাবায়না করে না। কিন্তুক কি করে ভুলে গিয়েছেলম যি বাড়িতে আমার একটি ছ-মাসের মেয়ে আছেসি মেয়ে কার কাছে থাকেকি খায়,কখন ঘুমোয় সি যেন দেখেও দেখতে পাই না আমি। কখনো এসে জড়িয়ে ধরে। বুকে মুখ রাখে। আমার খেয়াল-ও থাকে না। সিদিন বৈকালবেলায় রুগির ঘরে ঢুকতে যেয়ে দেখিআমার খুঁকি কখন হামাগুঁড়ি দিয়ে ঘরে ঢুকেচে। অ্যাকন থপ থপ করে একটি-দুটি পা ফেলে হাঁটতে শিখেছেআবার তাড়াতাড়ি করতে গেলে সাথে সাথে বসে পড়ে হামাগুঁড়ি দিয়ে এগিয়ে যাওয়াও জানেএমনি চালাক। তা ঘরে ঢুকে দেখিখুঁকি বড় খোঁকার মাথার কাছে খানিকটা উবুড় হয়ে দাঁড়িয়ে দু-হাত দিয়ে তার মুখে-চোখে থাপড়াইছে। আর হি হি করে হাসছে। খানিকক্ষণ থাপড় মারছেআবার চুল ধরে টানছে আর হেসেই যেচে। আমি ভাবছিনা জানি খোঁকার চোখে খুঁকির আঙুল ঢুকে যাবে না কিনা কি নোখের আঁচড় লাগবেকিন্তুক আমি এগুইতে পারলম না। সিখানে দাঁড়িয়েই দেখতে লাগলমখোঁকা হাসছেখোঁকা কথা বলছে। খোঁকার ঐ হাসি কতদিন দেখি নাইযেন আর জন্মে দেখেছেলম খোঁকা হাসছে আর বলছেবুবু আর মেরো নাআর মেরো নাউঃ খুব লাগছেয্যাতো সে এইরকম বলছেখুঁকি ততোই খুশি হয়ে হাসছে আর ভাইকে থাপড়াইছে। খোঁকা আমাকে দেখে নাইসে বলে যেছেবুবুদাঁড়াওআমার অসুখ করেছে তোভালো হইতোমাকে কতো জায়গায় নিয়ে যাবতোমাকে কত কি এনে দেবকতো খেলনাকতো খাবার দেব

আমি একঠাঁই দাঁড়িয়ে দেখছিএই ঘরে সুয্যির আলো আসে না। অ্যাকন দেখছি সারা ঘরে আলো। বছরের এই সোমায়টোই উত্তরের জানেলা দিয়ে সামান্য এট্টু রোদ ঘরের মেঝেয় এসে পড়েতাতেই যেন সারা ঘর আলো। আমি ত্যাকন এগিয়ে যেয়ে খুঁকিকে কোলে তুলে লেলম। আমাকে দেখে লাজুক হাসি হেসে খোঁকা বললে,দ্যাখো মাবুড়ি আমাকে কেমন করে মারছেউঠতেবলছে। চোখ ভরা পানি নিয়ে আমি তাকে একটি কথাও বলতে পারলম না

দু-দিন কি তিন দিন পর,একুশ দিন পার হয়েছে ত্যাকনতবে আটাশ দিন হয় নাইসকাল থেকেই রুগির আবস্তা খুব খারাপ। সিদিন তাকে কুনো খাবার খাওয়ানো গেল নাওষুধও খাওয়ানো গেল না। ডাকলে। সাড়া নাইচোখও খুলছে না। সিদিন বাড়ির সব কাজকম্ম বন্ধ রইল। রাঁধা-বাড়ার কাজেও কেউ গেল না। দেখলম গিন্নিও এসে ছেলের শিয়রের কাছে ননদের পাশে বসল। আমি খোঁকার বালিশটোকে সরিয়ে তার মাথা কোলে নিয়ে বসলম

আর আমি উঠব না। আর বুঝতে বাকি নাই সে আর থাকবে না। গত দু-দিন থেকেই সিকথা বুঝতে পারছি। চোখে আর পানি নাই যি কঁদিচোখ যেন গলে গেয়েছেকিছুই ভালো দেখতে পেচি না। নাআর পানি নাইনাআর কাঁদব না। অ্যাকন যেদি কাঁদিখোঁকা চলে গেলে কি করবত্যাকন যি চোখ ফেটে রক্ত ঝরবে গো! তাই লেগে দু-ফোটা পানি যেদি থাকে তো থাকুক

বুঝতে পারছি আজ উ যাবে। সারা গাঁ-ও কি তাই জানেতা নাইলে এত লোক আসছে কোথা থেকেঘর ভরে গেলএগনে ভরে গেল। কিন্তুক সবাইকে দেখছিকত্তাকে তো কোথাও দেখছি না। তবে কি সে বাড়িতেই নাইকত্তামার দুই ছেলেকেও দেখছিসে তাইলে কোথা গেল?

বেলা বাড়ছেরোদ চড়ছেঘরের ভেতর গুমোট গরমকে ঘরের মানুষদের সরতে বলেখোঁকার যি অ্যাকন এট্টু বাতাস দরকার। দ্যাওরদের কেউ বোধায় বুঝতে পেরেছেসে সবাইকে সরিয়ে দিলেকিন্তুক একজন সরছে তো আরও তিনজনা ঘরে ঢুকছে

দোপরটো যি কেমন করে পেরুইলো তা বলতে পারব না। সিদিন দোপটোই আজরাইল হয়ে এয়েছিল। বুকের ওপর সেই যি বসল আর সরলে না। গোটা জেবন পেরিয়ে যেচেতবু দোপরটা যেচে না। তবু এক সোমায় সুয্যি পচ্চিমে নামতে লাগলরোদের ত্যাজ এট্টু মরে এলআর মনে হতে লাগল দোপরটাও বুক থেকে নেমে যেচে। ত্যাকন আমার মনে শান্তি। খোঁকার তাইলে যাবার সোমায় আসছে। অ্যাকন আর অস্থির হতে নাই। সে শান্তিতে যাক। শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলমঅ্যামন মায়ায় ছেলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে যেন মওত-ও সেই চাউনি দেখতে পেচে। যে নিশ্বেস নিতে এত কষ্ট হচিল খোঁকারসেই নিশ্বেসও যেন সহজ হয়ে এল। খুব আস্তে আস্তে ফিসফিস করে গিন্নি আমাকে বলছেমেজ বউ,ছেলের মুখে একটু পানি দাও। কি যি হলো আমারক্যানে গোযাদু কি চলে যেচেবলে এমন চেঁচিয়ে ওঠলম যি ঘরসুদ্দ লোক চমকে উঠল। গিন্নি আমাকে বললেচুপ চুপও কি করছখোঁকার মুখে পানি দাও। এখন নয়কাদার অনেক সোমায় পাবে

আমি ত্যাকন বড় কাঁসার চামচে পানি ঢাললমখোঁকার মুখ একটু হাঁ করিয়ে পানি দেলম। হ্যাঁসবটুকু পানি খেলে সেআর এক চামচ ঢেলে ফের দিতে গেলমইবার কতক খেলে আর কতক কষ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল

একদম শেষ সোমায়টো আমার কিছুতেই মনে পড়ছে না। কুনোদিন মনে থাকল না। খুব জোরে হিঙুরে উঠে একবার কি নিসে নিয়েছিলকেউ যেন শুনতে না পায়শুদু আমি শুনি এমনি করে কি বলেছিলমা যাইকিছুতেই মনে পড়ে না। আমার কোলে ছিল মাথাশুদু দেখলমকাত হয়ে কোল থেকে গড়িয়ে পড়ল। ঐ শেষ। খোঁকা চলে গেল! বেলা ত্যাখনো খানিকটা ছিল। সারা গাঁয়ের লোক ভেঙে পড়ল বাড়িতে

 

সারা জাহান খাঁ খাঁহায়রে শোধ তোলা

যিসব গাঁয়ে আমাদের আত্মীয়কুটুম জ্ঞাতিগুষ্টি থাকতসেই রেতেই সিসব গাঁয়ে খবর দিতে লোক চলে গেল। গরমকালের দিনে লাশ বেশি সোমায় থাকবে নায্যাতো তাড়াতাড়ি মাটি হয়ে যায় ত্যাতোই ভালো। যা গরমমনে হচে কাল সকাল পয্যন্ত লাশ থাকে কি না সন্দ। কিন্তুক আত্মীয়কুটুম এসে না দেখলে তো মাটি দেওয়া যাবে না। তাতে খুব নিন্দে হবে। এত বড় একটো সব্বোনাশ হয়ে গেলসেটো কিছু লয়। কিন্তুক খবর না পেলেলাশের দাফনের সোমায় এসে হাজির হতে না পারলে নিয়ে কান পাতা যাবে না। দোপর পয্যন্ত লাশ রাখতেই হবেতাতে লাশ গলুক পচুকযা-ই হোক

উত্তর-দুয়োরি ঘরেই রয়েছে খোঁকার লাশ একটো চাদরে ঢাকা। অ্যাকন আর ওখানে থেকে আমি কি করবয্যাতোক্ষণ সে ছিলআমি তো তার কাছেই ছেলমকোথাও যাই নাই। অ্যাকন আর সে নাইযে আছে সে তত লাশ। উ নিয়ে আর আমি কি করব?শরীল শুকিয়ে কঙ্কালসেই কঙ্কালটো চামড়া-ঢাকা পড়ে আছে। খানিক বাদে ঐ চামড়া ফুলে ঢোল হবেরসানি গড়িয়ে পড়বে সারা শরীল থেকেদুর্গন্ধ ছড়াবে। লাশ বলতে তো এই! সব লাশই ঐরকমগলে-পচে হেজে থাকে কবরের ভেতর। কবর না দিলে ঘরেও তা-ই হবে। উয়ার সাথে আমার সোনার যাদু বড় খোঁকার কি সম্পক্কআর আমি দেখতে চাই না। তার সোনার মুত্তি আমার মনেই থাক

তবে কেঁদেছেলম বৈকি। চোখের পানি তো কবেই শুকিয়েচে। কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙে গেল কিন্তুক চোখে যি আর পানি নাই! সবাই কাঁদছিলআমিও কাঁদছেলম। বাড়িতে কাল রেতে খাওয়া-দাওয়া হয় নাইসব বন্ধ ছিল। ই বাড়ি উ বাড়ির বউ-ঝিরা এসে চিনি নাইলে গুড়ের। শরবত এক ঢোক করে সবাইকে খাইয়েছে। ঘরের ভেতর অতো লোককতো আর খাওয়াবেমাঝরেতের পর লোক অ্যানেক কমে গেল। তবে গিন্নি ত্যাকন আর ঘরে নাই। ননদ-দ্যাওর-জায়েরা আছে। কাঁদন ত্যাকন আর নাই। হেরিকেনের কাঁচে এমন ধুমো জমেছে যি ঘরে আলো পেরায় নাই বললেই চলে। ত্যাকন আমার বুকের ভেতরটো পাষাণ। আমি সেই আলোয় দেখলম ছায়াবাজি। কতোবার খোঁকা এল গেলকতো কি করলেগলা জড়িয়ে ধরলেতার মুখে আমি চুমো খ্যালম। দেয়ালে আমি সব দেখছি

আত্মীয়কুটুম দোপরের আগেই এসে পৌঁছুল। লাশ লাওয়ানো থোয়ানো হলো। সবাই বললেতেমন লিকিন খারাপ হয় নাই লাশ। সব বেবস্থা হয়ে গেলে আর একবার সবাইকে ডাকলে শ্যাষবারের মতুন মুখ দেখাবার লেগে। দেখলম বটে সবারি সাথে। খোঁকার মুখ আর কি আমার দেখবার দরকার আছেউ মুখ যি আমি চোখ বুজে য্যাকন খুশি ত্যাকন দেখতে পারি। অ্যাকন ঐ নষ্ট হওয়া মুখ দেখে আমার কি হবেতবু বললমযাও বাপযেছে যাওকিন্তুক মায়ের কাছ থেকে আর কোথা যাবেযেখানেই থাকো মা ডাকলেই আসতে হবে

দাফন করে সবাই ফিরে আসতে আসতে দোপর গড়িয়ে গেল। তাপর খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে হতে দিনই পেরায় ফুরিয়ে এল। সবাই এসে বাড়ির ভেতরে উত্তরের ঘরের উসারায় বসেছে। আত্মীয়কুটুম এয়েছেলতুন মা তার ছেলেমেয়ে সবাইকে এনেছে। নানার বাড়ি থেকে আমার ছোট ভাইটিমামুরাখালারা সব এয়েছে। কত্তারও যিখানে য্যাতো আত্মীয়গুষ্টি ছিলকেউ বাদ যায় নাইসবাই হাজির। আর এয়েছে আমার বাপজি। বাপজি বাড়ি ছেড়ে কোথাও বড় একটো যেত নাএকটু অ্যাকলফেঁড়ে ঘরকুনোই ছিল মানুষটো। আমার বিয়ের পরে একবার কি হয়তো দু-বার মেয়ের বাড়ি এয়েছে তার বেশি হবে না। তবে ই বাড়িতে যা ঘটে গেলতাতে কি বাপজি না এসে পারেনাতিটিকে যি বড্ড ভালোবাসত! এই গত ক-বছর বাপের বাড়ি যেতে পারি নাইতার এ ফি বছরই গেয়েছেলম। বড় খোঁকা সবারই জান কেড়ে নিতঅমন চুপচাপ রাশভারি নানাও তার খুব বশ হয়েছিল

সেই আমার বাপজি এয়েছেআমাকে অ্যাকনো একটা কথা বলে নাইবলতে পারে নাই। উত্তর-দুয়োরি ঘরের পিড়ের পচ্চিমধারে চুপ করে বসে রয়েছে। কঁদতে তো পারে না মানুষটোপব্বতের মতুন বসে আছে। শাদা গায়ের রঙ-মুখে চাপ দাড়িপরনে শাদা লুঙ্গি আর শাদা পিরেন

কত্তা ত্যাকন ছিল না। কোথা থেকে এল বাড়ির ভেতরে। ই কদিন যি মানুষটোকে দেখে ভয় পেয়েছেলম,অ্যাকন দেখলম সে আবার সেই আগের মানুষ। শোক-তাপ যেন কিছুই নাই। বাড়ির উঠনে দাঁড়িয়ে সে একবার সবাইকে দেখলে। তাপর আস্তে আস্তে এগিয়ে এল বাপজির কাছে। বাপজি বটগাছের মতুন বসে আর কত্তা দাঁড়িয়েছে তার ছামনে

সে ছিল আপনার যোগ্য নাতিআপনি বলেছিলেন আপনার ছেলেকে আপনার কাছ থেকে পর করে দিচ্ছি বলে আমার ছেলেকেও বেশি দিন স্কুলে যেতে হবে না। আপনার নাতি আপনার কথার মান। রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আপনার কথাকে সে মিছে হতে দেয় নাই

হায়কি বললেহায় কি বললেওগো হায় কি বললেআসমান থেকে যেন বাজ পড়ল আর যে যিখানে ছিল সাথে সাথে পাথর হয়ে গেল। কত্তার মুখের দিকে আমি তাকিয়ে রয়েছিতাকিয়ে রয়েছিযেন যুগ কেটে গেল। তাপর গুড়গুড় করে একটো আওয়াজ উঠলযেন মাটির তলা থেকে আসছে। আমি শুনছিসেই আওয়াজ হুঁ হুঁহো হোও হো হো করে বাপজির বুকের ভেতরটা খান খান করে ভেঙে দিয়ে পেলয় বেগে বেরিয়ে আসছে। অতো বড় পব্বতের মতো মানুষটো উসারা থেকে গড়িয়ে উঠনের ওপর যেয়ে পড়ল

 

সোংসার কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না

আমার বড় খোঁকা চলে গেল। দুনিয়াদারিতে আর আমার মন নাইনাই নাই নাইতবু কি মওত এলসোংসার কি ক্ষ্যামা দিলেছুটি কি প্যালমবড় খোঁকা গেল তো পরের খোঁকাটি বড় খোঁকার জায়গায় চলে এল। কবে এল তা জানিও না। দেখতে দেখতে সে-ও বড় হয়ে গেল। মোটেই বড় খোঁকার মতুন লয়গড়ন-পেটন একদম আলাদা। তারও খুব রূপ। কাঁচা সোনার মতুন গায়ের রঙ। এতদিন কিছুই খেয়াল করি নাইএকদিন হঠাৎ দেখি ওমাও-ও তো বারো-তেরো বছরের ছেলে হয়ে গেয়েছে। তাপরমেয়েটি বাড়ির পেথম মেয়েসি-ও তিন-চার বছরের হয়ে গেল। মাজা-মাজা রঙআঁকা-আঁকা চোখমুখএইটুকুনি কপালমাথাভত্তি এলোমেলো কালো চুলওমাআমার কি হবে মা গা থেকে যেন ননী গলচে! অ্যাকন এদের নিয়ে কি করবপোড়া সোংসার কি জিনিস কে বলতে পারে বলো! শুদু কি তাইসোংসার ইদিকে আপনা-আপনি বড় হচে। তা সোংসার বড় হবে কি ছোট হবে তাতে তো কারুর হাত নাই। ছেলেমেয়ে কম হোকবেশি হোকসবই আল্লার ইচ্ছায়। অ্যাকন যেমন নিজের ইচ্ছায়তেমন লয়। আট-দশ-বারো-তেরোটা করে ছেলেময়ে হচেকিছুই করার নাই। আল্লা দিচে তা কে কি করবেখেতে না পেয়েরোগে ভুগে কুকুর-বেড়ালের ছানার মতুন এন্ডি-গেন্ডিগুনো মরে যেচে। ফল পাকার পরে যেমন কলাগাছ মরেতেমনি করে এদুরি-পেদুরি ছেলেমেয়ে প্যাটে ধরতে ধরতে মা-গাছটো মরে যেচে। ছেলে হতে যেয়ে মরছেকি অন্য অসুখে মরছেকিছুই করার নাইদুখ-দরদও কিছু নাই। পুরুষমানুষ আবার একটো বিয়ে করে আনছে আবার এক পাল জম্মাইচে। ই বাড়িতেও তাই হলো। সেজ বউয়ের দুটি খোঁকাঐ দুটি খোঁকাকে রেখে সে একদিন চোখ বুজলে। কি রোগ তার হয়েছিল তা কেউ বলতে পারলে না। চিকিচ্ছে আর কি হবেগাঁয়ের ডাক্তার ওষুধ দিলেটোটকা-মোটকা যে যেমন পারলে দিতে কসুর করলে না। ঝাড়ফুঁক পানিপড়া কিছুই বাদ পড়ল না। তাসেজ বউ বেশি সোমায় নিলে না। কুনো কিছু গেরাহ্যি না করে সে সব ফেলে চলে গেল। খোঁকাদুটিকে অ্যাকন কে দেখে এই কথা বলে সেজ দ্যাওর ছ-মাস যেতে না যেতে আবার একটি কচি মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে আনলে। যে দুই দ্যাওরের বিয়ে বাকি ছিল এইবার তাদেরও বিয়ে হলো আর বিয়ের পর বেশিদিন যেতে না যেতে তাদেরও ছেলেপুলে আসতে শুরু হলো। সোংসারে কখনো কখনো একজন-দুজনা করে কমছে বটে কিন্তুক বাড়ছে অনেক বেশি। হাতে-পায়ে গলায়-মাথায় লেয়ালির দড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে জড়িয়ে যেচে

কিন্তুক যাই হোক আর তাই হোককত্তার খেয়াল সব দিকে। আগের মতুন অ্যাকন আর তাকে সবকিছু নিজেকে দেখতে হয় নাসোংসারের দায়দায়িত্ব এমন করে সে ভাগ করে দিয়েছে যে সব আপন মনেই ঠিকঠাক চলছেপান থেকে চুন খসবার জো থাকছে না। সবাই নিজের নিজের কাজের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে। সেজ দ্যাওর এট্টু আবরের মতুনঠিক গোঁয়ারগোবিন্দ লয়তবে নিজের বুদ্ধিতে কিছু করার ক্ষ্যামতা তার নাই। সোজা মানুষকারুর সাথে লাগল তো মারামারি করে নিজে জখম হলোকি আর কাউকে জখম করে ফেললে। চাষবাসআবাদের দায়দায়িত্ব ছিল এই সেজ ভাইয়ের ঘাড়ে। মাঝে মাঝে এর তার সাথে গোলমাল-ফ্যাসাদ করে ফেললেও সবকিছু দেখা-শোনাটা সে ভালোই করত। তবে খুব বুদ্ধি ছিল ল-দ্যাওরেরসে দেখতে যেমন সুপুরুষ ছিলবুদ্ধিসুদ্ধিও তেমনি ভালো ছিল আর কাজে-কম্মেও ছিল চালাক। জমির খবরআবাদের খবরফসলের খবর তার চেয়ে ভালো ই গা তো ই গাঁআশপাশের চৌদ্দ গাঁয়ের কেউ ভালো জানত না। সেজকে বুদ্ধি পরামশ্য সব তার কাছেই নিতে হতো

রাতদিন টেনে করে শহরে যেতে হতো বলে কত্তা ইস্টিশনের কাছে এক কোশ দূরে ছিল ইস্টিশনদু-বিঘে জমি কিনে সিখানে একটো ভিটে আর বেরাট একটা মুদিখানার দোকান করা হলো। গঞ্জে একটো বাড়িও হলোব্যাবসার লেগে একটা দোকানও হলো। কত্তা এই কাজটো দেখার ভার দিলে ভাশুর আর ল-দ্যাওরের ওপর। নামেই থাকল বড় কত্তাআসল দায়িত্ব ল-দ্যাওরকেই নিতে হলো। আমি যাকন বিয়ে হয়ে ই বাড়িতে আসিএই মানুষটি ত্যাকন একেবারেই ছেলেমানুষ। আমার চেয়েও বয়েসে ক-বছরের ছোট তো! বড় খোঁকা য্যাতোদিন বেঁচে ছিলসে ছিল এই দ্যাওরের চোখের মণি। সে চলে গেলে তার বুকে যি কেমন বেজেছিল তা আমি জানি। তারপর থেকে এমন করে সে ব্যাভার করত যেন সেই আমার বড় খোঁকা। অ্যাকন যি তার বিয়ে দেওয়া হয়েছেঅ্যাকনও সে তেমনিই আছে

এই সিদিন ছোট দ্যাওরের-ও বিয়ে হয়ে গেল। উ আর কিছুতেই কলেজে ল্যাখাপড়া করলে না। কত্তা কতো বুজুইলেসে খালি কাঁদতে লাগলেবড় খোঁকাই চলে গেয়েছেআর কিসের ল্যাখাপড়া! চাকরি-বাকরি একটো খুঁজে নিয়ে কত্তার পাশে দাঁড়ানো দরকার। তা বিয়ের আগেই চাকরি একটো পেলে সে। কত্তা আর আপত্তি করলে না। শহরে বাসা করে দিয়ে ছোট বউকে সেখানে পাঠিয়ে দিলে। আমাকে বললেএই প্রথম গাঁ ছেড়ে শহরে বাড়ির একজন বসবাস করবে। তা করতে হবে নাচিরকাল কি সবাই কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকবেদুনিয়াটাকে দেখে-শুনে নিতে হবে না?

সোংসার যাকে বলে ভরা-ভত্তি। চাষের জমি একশো বিঘের ওপর। চারজনা কাজের মুন্যি সারা বছর আছে। সোম্বছরের রাখাল আছে। একটো গোয়ালে গরু-ছাগলের জায়গা হয় নাআর একটো করতে হয়েছে। বাড়ি সব সোমায় গমগম করছে

তবে যতো বড়ই হোক সোংসারগিন্নি কিন্তুক সেই আমাদের শাশুড়ি। কত্তা সেই যি বলেছেমাসব হবে তোমার হুকুমেসেই কথাটির নড়চড় হবার উপয় নাই। আমি জানিএতটো বয়েস হয়ে গেলঅ্যাকনো যেদি গিন্নির কথার এতটুকুনি অগেরাজি করিনতিজার অবদি থাকবে না। কত্তা ঠিক হাত ধরে বাড়ির বাইরে দিয়ে আসবে। ভিন্ ভিন্ গাঁ থেকে লতুন বউ-ঝিরা আসছে। তারাও ছেলেপুলের মা হয়ে যেচেতবু তাদের কেউ যেদি গিন্নির ছামনে হাতের বালা ঘোরাইছেএকটু ঠোসক কি গরব দেখাইছেকত্তা ঠিক তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবে

আকন আমার মনে হয়কত্তার সারা জেবনের কাজ যেন আগের থেকে বাঁধা। বেঁধেছে সে নিজেইকারু কথা শুনে লয়। কারু কথা শোনার লোক সে লয়। বোধায় পেথমেই ঠিক করে নিয়েছিলবাপ মরার পরে ভাইবুনদের কেউ যেন বুঝতে না পারে যি বাপ মরেছেমা যেন না মনে করতে পারে যিবাপ চলে যাবার পরে এতিম ছেলেমেয়েগুনো পানিতে ভেসে যাবে আর লোকের দয়ায় বেঁচে থাকবে। আরও একটা কথা কত্তা ভেবে রেখেছিল যিসোংসার যতো খুশি বড় হোকবরং য্যাতো বড় হবে ত্যাতোই ভালোসবাই একসাথে থাকবেলোকজনে আত্মীয়কুটুমে বাড়ি সব সোমায় গমগম করবে। কিন্তুক সে নিজে থাকবে দূরেনিজে থাকবে একা। সত্যিইকিছুতেই বাড়ির ভেতর আসত না। মা ডেকে পাঠাইলে আসতখুব বড় বেপদ-আপদরোগ-শোক বা খুশির খবরে আসতআবার খানিকক্ষণ বাদেই চলে যেত তার বাইরের ঘরে। বাইরের ঘরেমানে বৈঠকখানা নয়দলিজ তো আলাদাবাড়িরই একটো ঘর এট্টু অ্যাকানে ছিলকত্তা সেই ঘরে থাকতশুত। এই ঘরেরই বাইরের দিকে একটো পরচালি ছিলসেখানে চেয়ার পেতে বসে থাকত বেরাট খামারের দিকে মুখ করে। সি জায়গাটো খুব ঠান্ডা হেঁয়াকুনো মানুষজন সিদিকে যেত নাবোধায় গরুছাগলও সিদিকে যেতে ভয় করত

এত বড় সোংসারের কত্তাবাড়ির ভেতরে এত লোকএত কাচ্চা-বাচ্চার চাঁ ভাকত্তা নিজেই এত বড় সোংসার গড়েছেতবু সে নিজে থাকত দূরে। মানুষজন তেমন পছন্দ করত না। মজা-ফুত্তি করে অনেক মানুষের সাথে তাকে কুনোদিন গল্প-গুজব করতে দেখি নাই। তার ছামনে গেলেইসে যে-ই হোকতার পা কাঁপতকথা আটকে যেত। পথেঘাটেবাড়ির ছেলেই হোক আর পাড়ার ছেলেমেয়েই হোককত্তাকে দেখলেই ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত। কিন্তুক কত্তা ঘরের কিংবা বাইরের কুনো ছোট ছেলেমেয়েকে বকেছে বলে আজ পয্যন্ত মনে করতে পারি না। এমনিই রাশভারি মানুষ ছিল সে। ঐ যি ঘরে থাকতসকালে দোপরে রেতে তার খাবার বয়ে নিয়ে যেতে হতো ঐ ঘরে। তার খাবার সামান্যএই এতটুকুকিন্তু সে যা বলে দিত তাই রাঁধতে হতো। এইসব লেগে মনে হতো কত্তার সবকিছুই আগে থেকে বাঁধা। সোংসারের সব বিলি-বেবস্থা করে দিয়েযার যেমন কাজ তাকে তেমন ভার দিয়ে কত্তা য্যাকন দেখলে আর কুনো গোলমাল হবে নাসোংসার ঠিকমতো চলবেত্যাকনই সোংসার থেকে দূরে গেল। মন দিলে সারা এলেকার মানুষের কাজে

তা অ্যাকন মনে হয় বৈকি যি কত্তা আর একটি জিনিশ চাইতসেই জিনিশটি হলো খ্যামতা। সংসারের খ্যামতা তো সে পেয়েই ছিলতা নিয়ে কারু কুনো কথা ছিল না। তার সোংসারের বাইরেও খ্যামতা পাবার লেগে সে জেনে হোক না জেনে হোকআমি ঠিক বুঝতে পারিঅ্যানেকদিন থেকে অ্যানেক চেষ্টাই করছিল। যি মানুষ কুনো কথা বলতেই চাইত নাআমি ইস্ত্রী বলে আমারও কুনো আলেদা খাতির ছিল নাসেই মানুষ মন-মেজাজ ভালো থাকলে আমাকেও দু-একটো না বলে পারত না। বাইরের কতো আল্কা লোক কবে থেকে বাড়িতে আসেকি কাজে কত্তা পেরায় পেত্যেকদিন গাঁয়ের বাইরে যায় আবার সাঁঝবেলায় ফিরে আসেবাড়িতে কতো কাগজ-বই আসেদ্যাশের ভেতরে কতো কি হচে তা নিয়ে কন্তু আজকাল কথা দু-একটো বলে। ইসব কথায় ত্যাকন তেমন কিছু মনে হতো না। কিন্তুক একদিন রেতে কত্তা আমাকে যখন বললে সাতটো গাঁ নিয়ে যি ইউনিনসেই ইউনিন নিয়ে সে নিব্বাচন করবেত্যাকন মুখ ফুটে বলেই ফেললম

তোমার বুজিন অ্যাকন খুব খ্যামতার পেয়োজনদ্যাশে কতো রকম হানাহানি হচেতুমিই তো বললোহিঁদু-মোসলমানে হানাহানিবিটিশ তাড়ানোর লেগে হানাহানিসব জায়গায় হানাহানি। গাঁ-ঘরও বাদ যেচে না। এই হানাহানিতে তুমিও ঢুকবেখ্যামতার লেগে?

ক্ষমতার জন্যে কি লোকে ক্ষমতা চায় – আমার কথা শুনে কত্তা রাগলে নাক্ষমতা চায় কিছু কাজ করার জন্যে। ক্ষমতা পেলেই তবে কিছু করা যায় নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়া যায়। আবার দেশের কাজও করা যায়। ক্ষমতা না পেলে কিছুই করা যায় না। নিজেরও নাপরেরও না। শোনো! হানাহানি কিছু হবে নাআর যদি হয় তো হবে। ইউনিয়ন নির্বাচন আমাকে করতে হবে। ক্ষমতা পেলে নিজের জন্যে কিছু করব নাশুধু দেশের কাজই করবএই কথাটি আমাকে বলতে হবে বটে তবে তা সত্যি নয়। দুটিই করতে হবেনিজের জন্যে কিছু করবদেশের মানুষের জন্যেও কিছু করব। তোমাকে বলিযদি একটা নিজের কাজ করিদশটা সমাজের কাজ করব। কথার কথা বলছি নাযা বলছি তাই করব

এই কত্তা লোকটিকে আমি য্যাতোদূর চিনিআমার ছেলেমেয়ের বাপবাড়ির কত্ত বলে লয়অন্য একটো লোক মনে করেই বলছিএই লোকটিকে বিশ্বেস করা যায়। ওর যি কথা সেই কাজ। তা নাইলে কেউ বলতে পারেখ্যামতা পেলে নিজের লেগেও কিছু করবপরের লেগেও করবএমন হিশেব করে কেউ বলতে পারে নিজের একটো করলে দ্যাশের দশটো কাজ করবে?

আমি জানি উ যেদি জানে মরেও যায়তবু তা-ই করবে। উ কি কম কঠিন পাষাণ! সারা তল্লাটের লোককেও উ বোধায় বিশ্বেস করাতে পেরেছিল ই কথা। ইটি হিঁদুদের এলেকাসাত গাঁয়ের মদ্যে মাত্তর একটি ছোট গাঁ মোসলমানদেরআর দুটি গাঁয়ে দু-চার ঘর আছেবাকি সবই হিঁদু। কত্তার বিরুদ্দে নিব্বাচনে দাঁড়িয়েছিল সব বাঘা বাঘা হিঁদু। সব হেরে গেল তার কাছে। কতো কথাই না বললে তার লেগে! উ মোসলমানভিন্ জাতউ হিঁদুদের মাথায় পা দিয়ে শাসন করবে। ই হিঁদুদের এলেকাকতত বামুন-বদ্যি ইখানে বাস করেকতো শিক্ষিত হিঁদু ই তল্লাটে রয়েছেসব বাদ দিয়ে একটো মোসলমানকে ইউনিনের পেসিডেন করতে হবে ক্যানেকতো কথাই না বললে! কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। হিঁদুরাকত্তার শত্রুর হিঁদুদের কথা ঘাড়াইলে না। কত্তাই জিতলে। কত্তা জিতলে যি আনন্দফুত্তি হতে লাগল তাতে ভালোই বোঝলমকত্তা হিঁদু-মোসলমান সক্কলেরই নয়নমণি। তাপরেও মানুষের ভ্যাদ পাওয়া কি কঠিন দ্যাখো! কত্তামার সেই ছেলেদুটিসেই দুটিকে তো কত্তাই নিজের হাতে মানুষ করেছেতারা তার আপন ভাইদের বাড়াকি না করেছে কত্তা তাদের লেগে আর তারাও কত্তাকে দাদা বলতে অজ্ঞানআমাকেও বউদিদি বউদিদি করে এমন সসম্মান করে অথচ কত্তা একদিন ভোটের সোমায় কোন্ গাঁ থেকে অ্যানেক রেতে ফিরে এমন একটো কথা বললে যি আমার মুখের রা-কথা বন্ধ হয়ে গেল

পাশের গাঁয়ের ভদ্দরলোকদের সাথে কথা বলতে বলতে অ্যানেকটো রাত হয়েছে। ফেরার সোমায় সঙ্গে যারা ছিল গাঁয়ের হিঁদু-মোসলমান দু-রকম মানুষই ছিল তারা সব নিজের নিজের বাড়ির দিকে গেলে হিঁদুপাড়া দিয়ে কত্ত একাই আসছিল। আদার তেঁতুলতলাটো পেরুতে যেতেই দেখতে পেলে কে একজনা জুবুথুবু হয়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভয়-ডর বলে কুনোকিছু তো কত্তার কুনোদিন নাই। কে রে ওখানে বলে কত্তা তার কাছে যেতেই দেখতে পেলে কামারপাড়ার মদন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। এখানে তুই কি করছিস রেবলতেই মদন তেমনি কাঁপতে কাঁপতেই কর পায়ের কাছে বসে পড়ল। চাদরের তলা থেকে বেরিয়ে পড়ল এই বড় পাঁটা কাটার এক চকচকে খাঁড়া। মদনএকি রেআমি একথা বলতেই কালিপ্রসাদের নাম করে বললেছোড়দা আমাকে বললে আপনি যখন তেঁতুলতলা দিয়ে বাড়ি যাবেনতখন চোখ বুঝে আপনার ঘাড়ে যেন একটা কোপ বসিয়ে দি

তা কোপ বসাতে পারলি না তোযা বাড়ি যা

কি পাপ আমি করতে যাচ্ছিলামআমার যে নরকেও জায়গা হবে। মদন হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল

যা বাড়ি যাশুধু শুধু কখনো খাঁড়া বার করিস না

কত্তা জিতলে কিন্তুক বাড়িতে কুনো হৈ চৈ হলো না। একবার শুদু সে বাড়িতে মাআর বুনের কাছে এল। মা বলে একবার শুদু দাঁড়াইলেআর কিছু বললে না। গিন্নিও একটো কথাই বললেবাবাআমার সব আশা পুরেছেআর কিছু চাই না

বাড়িতে একটু আঁকজমকএকটু বড়লোকি ঠাট-ঠমক হলো বৈকি। ঘোড়াটো বদলানো হলোযেটো ছিল সেটো বিক্রি করে লতুন ভালো জেতের বড় একটো ঘোড়া কেনা হলো। পালকিটো নতুন করে ছাওয়ানোরঙ করা হলো। গরুর গাড়ির ছইটোকেও আবার রঙ করা হলোনাঙল বোধায় আর একটা বাড়লহাতির মতুন আরও এক জোড়া মোষ এল বাড়িতে। ঘর-দুয়োর সব ল্যাপা-মোছা হলোখামারের ঘাস লতা-পাতা পোষ্কার করা হলো। দলিজ ঘরটোকে সাফ-সুতোর করে নতুন করে সাজানো হলো। খামার থেকে দলিজে ওঠার সিঁড়িটো রাজমিস্ত্রি এনে পাকা করা হলো। দলিজ ঘরের মাটির দেয়ালের পেছন দিকটো যাতে পানির ছাঁটে লষ্ট না হয়সেই লেগে নতুন করে আলকাতরা ল্যাপা হলো। তাপর এল অ্যানেকগুলিন কাঠের চেয়ার আর টেবিল। পাড়াগাঁয়ে উসব ত্যাকন কে দেখেছেসারা গাঁ খুঁজলে একটো-দুটো দবজ শালকাঠের চেয়ার হয়তো মিলতটেবিল আর কোথাকিন্তু আমাদের দলিজটিকে চেয়ার টেবিলে সাজাতেই হলো কত্তাকে। এটি যি অ্যাকন কোট হবে। তাই নানা আসবাব আসছেআপিসের কতোরকম জিনিশপত্তর কতোরকম কাগজখাতা। সবশ্যাষে এল একটি একনলা বন্দুক। এই জিনিশটি য্যাকন এলএকমাত্তর তখুনি দেখলম গিন্নি আপত্তি করলে। কেন। বাবামানুষ মারার এই অস্তরটি আনতে গেলেকত্ত তার জবাবে বললেমানুষ মারার জন্য নয়মানুষের ধন-প্রাণ বাঁচানোর জন্যেই

এটি কেনা হলো মা। এখন থেকে তোমার ছেলের দায়িত্ব শুধু তোমার সংসারটিই নয়বহু সংসারের দায়িত্বই এখন তার। তাছাড়া আরও কি একটো কথা কত্তা বলতে গিয়েও বললে না

যা বললেমএকটু বেশি জাঁকজমকএকটু বড়লোকি হলে আর কি করা যাবেধনে-জনে ফলে-ফসলে ফেটে পড়ছে সোংসার। হবে-ই বা ক্যানেদিনকে তো একবার দোপর হতেই হয়চড়তে চড়তে সুয্যিকে একবার উঠতে হয় আসমানের মাথায়। এ-ই লিয়ম। ই সোংসারের অ্যাকন তা-ই

 

কতো লোকের কতত বিচেরকতো বিধেন

কোট বসত রোববারে। যতোদূর মনে হচে রোববারেই কত্তার আদালত বসত। রোববার ছুটির দিন বটে,গাঁয়ের ইশকুলেও ছুটি হতো ঐদিনে শহর-গঞ্জের মতুনই। কিন্তুক ইশকুলটো বাদ দিলে গাঁয়ে আবার ছুটি কি! সেই লেগে মনে হচে দলিজে কোট বসত রোববার দিন। দলিধরের ভেতরে-বাইরের দুই উসারায়নামোয় খামারে লোকজন গমগম গিসগিস করত। সাত গাঁয়ের লোক ঐদিন তাদের য্যাতে নালিশ-রিয়াদ নিয়ে আসত

বাড়ির বউ-ঝিদের বাইরে আসার লিয়ম ছিল না। পুরুষদের কাজ আলেদামেয়েদের কাজ আলেদা। মেয়েরা দিনে-রেতে বাইরে যাবেপায়খানা-পেশাবের বেগও ধরে রাখতে হবে। কেউ শুদুবে না তো বটেইপুরুষরা বোধায় জানেও না যি মেয়েদের ঐসব দরকার আছে। রাত হলে চোরের মতুন বাড়ির আশপাশেপুকুরঘাটের ধারে বউ-ঝিরা চলে যেত। কারুর ছামনে উ কথা তোলাও শরমের কথা। সারাদিন বাড়িতে থাকোচোখে ঠুলি লাগিয়ে একই জায়গায় হাজার বার পাক মারোগুষ্টির লেগে রাঁধেছেলেমেয়েকে দশবার বুকের দুধ খাওয়াওগভূতভা থাকলে চোখ-কান বুজে বয়ে বেড়াও! মিয়ে-মোকাদিমদের বাড়িতে এই ছিল লিয়ম। তা বলে গরিব সাধারণ আবস্তার মোসলমানদের লেগে ইলিয়ম লয়সিখানে ঘর-বার সমান। পদাপুশিদার বালাই নাই। সে যা-ই হোকউয়ারই মদ্যে ই সোংসারটো একটু আলেদা ছিল আর আমি তো অনেক পুরনো বউ-মানুষআমি নাচদুয়োরের কাছে যেয়ে বাড়ির পুরনো পাঁচিলের ফঁক-ফোকর দিয়ে খামারের দিকে অ্যানেক সোমায় তাকিয়ে থাকতম

আজও দেখছেলমআশপাশের গাঁয়ের ভদ্দরলোকেরা সব এয়েছে ক্ষারে কাচা ধুতিজামা পরে। হিঁদু-মোসলমান বেশির ভাগেরই এই পোশাক। মোসলমানদের কেউ কেউ তহবন পরেও এয়েছে। গরিব মানুষদের ক্ষারও জোটে নাইশস্তা সাজিমাটিতে ধোয়া জামাকাপড় পরে এয়েছে তারা। তবে নালিশ করার লেগে বাদী-ফরিয়াদি যারা এয়েছে তাদের পেরায় সবারই খালি গা। দলিজের ভেতর-উসারায়যেখানে চেয়ার-টেবিল পাতা আছেসেখানে কোট বসেছে। লোকের ভিড়ে কিছুই দেখা যায় না। কোটের আর সব মেম্বাররা সেখানে চেয়ারে বসে আছেবিচের চলছে। কত্ত একদিন বলেছিলইখানে আর বিচের কি হবেখুন-জখম ভায়ানক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ডাকাতি-রাহাজানির বিচের ইখানে হয় না। ওসব আমরা সদরে মহকুমায় পাঠিয়ে দিই। ছোটখাটো নালিশ ফরিয়াদ নিয়ে যাতে লোকে শুধু শুধু শহরে না যায়হয়রানি না হয়টাকাপয়সা খুইয়ে না আসেএখানে শুধু সেইসবই বিচের করি। দু-পাঁচ টাকা জরিমানা করতে আর এক দিনের জেল দিতে পারি আমি একটু মিলিয়ে-মিটিয়ে দেওয়াই আমাদের কাজবুঝেছএলেকায় যাতে শান্তি থাকে

তা নালিশ-ফরিয়াদের কথা শুনলে হাসিও লাগে বটে! কে কাকে কাঠ-পিঁপড়ের গত্তর ওপর ঠেসে ধরেছে,পিপড়ের কামড়ের বিষে বেচারার জ্বর এসে গেয়েছেকে মসিদে হাত দিয়ে মিছে কথা বলে পাওনা টাকা দেয় নাইকোন্ বুড়ি বুঝিন মা-কালীর থানে এক ঘণ্টাএক পায়ে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলে ভাত দেয় না বলে নালিশ করেছেতা মা-কালী বেবস্থা করে নাই বলে কোটে এয়েছে কেস্ করতে। এমনি সব নানা কথা নিয়ে মামলা। মাঠ থেকে ধানের আঁটি চুরিমরাই থেকে এক-আধ মণ ধান বার করে নেওয়াহোক মোটা ছেড়া শাড়িশুকুইতে দেওয়া ছিলসেই শাড়িটো চুরি করাএইসব লিকিনি নালিশ

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলমলতুন ঘোড়াটো নিয়ে এল হাড়িপাড়ার সইস। ঘোড়ার হাঁটা দেখলে বিশ্বেস হয় না ঐ ঘোড়াই অমন টগবগ করে ছোটে। হটর হটর করে ঘোড়ার শুদু হাঁটা দেখলে ঘোড়াকে ঘোড়া বলেই মনে হয় নামনে হয় অন্য কুনো জন্তু। ঘোড়াটোকে হাঁটিয়ে নিয়ে এল সইস। ইখানে আনলে ক্যানেবোধায় সবাইকে একবার দেখাইতে চাইছে। হাঁ করে সব দেখছেও বটে। ঠিক বুঝতে পারছি না এত দূর থেকেতবু মনে হচে চাষাভুষােদের মদ্যে থেকে দু-একজন ঘোড়ার বেশি কাছে এগিয়ে গেলে বাগদিপাড়ার দফাদার তাকে হাতে ধরে সরিয়ে দিচে। দফাদার এমনিতে ত্যানা পরে থাকে আর অ্যাকন তার সরকারি পোশাকের কি বাহার! নীল জামাহাফ প্যান্টসি এমনি মোটা যি ইহজন্মে ছিড়তে পারবে না। সেই জামার ওপরে পেতলের ঝকঝকে তকমা আঁটা। বাউরিদের একজনা জমাদারও আছে। তারও ঐ পোশাক। এমনিতে গরিব মানুষ তারাযেমন গরিবতেমনি বেচারাসাত চড়ে রা কাড়ে নাগায়ে আবার অসুরের মতুন বলঅ্যাকন এই পোশাক পরে তাদেরও যেন গরবে মাটিতে পা পড়ছে না

এই সোমায় বেরাট একটো কাজ হতে যেচে শোনলম। সি কাজটো কত্তা যেদি করতে পারেতাইলে এলেকার লোকে তাকে দু-হাত তুলে দোয়া-আশীৰ্বাদ করবে। সেই কবে থেকে টেরেন চালু হয়েছে। য্যাকন ইচ্ছা লোকে জেলা শহরেমহকুমা শহরে যেতে পারে। দিনে দিনে যেতে পারেআবার ফিরে আসতে পারে। কিন্তুক ই গাঁ থেকে এক কোশ দূরের ইস্টিশনে যাবার কুনো রাস্তা নাই। মাঠজুড়ে শুধু ধানের জমি। ধান আর ধানআর কিছু নাইগাছপালাও পেরায় কিছু নাই। সেইসব জমির আল ধরেকখনো বা শুকনো ড্যাঙার ওপর দিয়ে সাপ-খোপ ভরা কাটা-জঙ্গল মাড়িয়ে তবে ইস্টিশনে যেয়ে টেরেন ধরতে হয়। বর্ষাকালে মানুষের কষ্টের অবধি থাকে না। ত্যাকন আল-রাস্তার কুনো চেন্নও থাকে না। কাদায় পানিতে নাকাল হয়ে কি কষ্টই না হয় মানুষের ইস্টিশনে পেঁৗছুইতে। গরু-মোষের গাড়িও ত্যাকন অচল হয়ে যায়। শোনলমঅ্যাকন লিকিনি ইউনিন বোড় থেকে সড়ক করে দেবে। কাচা সড়কই হচেবটেকুনো একদিন হয়তো পাকা হবে। শুধু ই গাঁ থেকে ইস্টিশনে যাবার লেগেই এই এক কোশ সড়ক হচে নাতা যেদি হয়তাইলে কত্তার দুর্নামের অন্ত থাকবে না। সড়ক হবে মোট পাঁচ কোশ। ইউনিনের সাতটো গাঁকেই ই রাস্তার সুবিধা দিতে হবে। পুবের গাঁগুনোর একটো থেকে ই রাস্তা বেরিয়ে আরও দু-তিনটো গাঁয়ের পাশ দিয়ে আমাদের গাঁয়ের একবারে ভেতরে এসে ঢুকবে। রাস্তা উদিকে চার কোশইদিকে এক কোশ

রাস্তা হবেনা রাস্তা হবেযে শুনছে সেই খুশি! কত্তার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে গেল। ত্যাকনো জানি না ইয়ার মদ্যে আবার এক বেপার আছে। কত্তা বলতেই বোঝলম। কত্তা একদিন বললেরাস্তা তো হবেকিন্তু জমি নষ্ট হবে অনেক। ডাঙা-ডোবা যা রাস্তার মধ্যে পড়বে তা বাদ দাওচাষের জমি কতো নষ্ট হবে তা কি বুঝতে পারছএত জমি কে দেবে?

তাই তো বটেকত্তা য্যাকন এই পাঁচ কোশ সয়রানের লেগে কতো ধানের জমি লাগবেতার হিসেব দিলেত্যাকন আমার মাথা খারাপ হবার জোগাড়। যাদের জমি যাবে সরকার তাদের ক্ষেতি পুষিয়ে টাকাপয়সা কিছু দেবে। কত্তা বললে সরকারের কথা ছাড়ো। সারা দেশের কতো বিরাট বিরাট ব্যাপার নিয়ে সরকারের মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল। সরকারের কথা হলোনিজের নিজের এলেকায় তোমাদের রাজা করে দিয়েছিযা করবে নিজেরা টাকা-পয়সা জোগাড় করেই করবে। তা সরকার একদম কিছু দেবে নাতা নয়। যাদের যাদের জমি নেওয়া হবেতাদের সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে

এই শুরু হলো। রাতদিন লোক আসছে। বড়লোক ছোটলোক মানামানি নাই। কিনাতার জমিটো বাদ দিয়ে রাস্তা এট্টু সরিয়ে করতে হবে। গরিব কুনো চাষি এসে বলছেতার মোটে দু-বিঘে জমিরাস্তাতে চলে যেচে দশ কাঠাতাইলে সে কি করে বাঁচবে। এই জমিটুকু ছাড়া তার আর কিছু নাইঐ জমিটুকুনি থেকে যে ধান সি পায়তাই দিয়ে ভাত-কাপড়ত্যালনুনডালকেরাসিন সব জোগাড় করতে হয়। দশ কাঠা গেলে সে ছেলেমেয়ে নিয়ে উপোস করে মরবে। এইরকম কথা নিয়ে কতো গরিব চাষাভুষাে যি পেত্যেক দিন আসছে তার হিসেব নাই। উদিকে বড়লোক যারা তাদেরও আসার কামাই নাই। তাদেরও ঐ একই আবদারতাদের জমি থেকে রাস্তা সরিয়ে নিতে হবে

এই এদের নিয়েই বিপদ বেশি বুঝলেগরিবদের তাড়িয়ে দিলেই হলো। যাযা দিকিনি এখান থেকেস্টেশনে যাবার রাস্তা হতে হবেসে রাস্তা কি আসমান থেকে আসবেরাস্তা হবেগাট গ্যাট করে হেঁটে বাবুর মতো স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরবিতার জন্য একটু স্বার্থত্যাগ করবি নাযাম্যাপ হয়ে গিয়েছেসে আর কেউ বদলাতে পারবে নাক্ষতিপূরণটা যাতে ঠিক হয় দেখবযা। গরিব চাষিদের ইসব কথা বলে আটকাতে পারা যায়বড় বড় জমিঅলাদের কি বলবেএক কাঠা জমি গেলে গরিবের যতো না গায়ে লাগেএদের লাগে তার দশগুণ। সব রাঘব বোয়াল আবার কি রকম গুণধরজমি বাঁচাবার জন্যে পয়সা খরচ করতেও রাজি। পারলে গভমেন্টকেও ঘুষ দেয়

আমি জানিকত্তা পারত সিধে রাস্তা করতে। আর য্যাতোটো সম্ভব। গরিবের জমি বাঁচাবার লেগেই চেষ্টা করবে। শ্যাষ পয্যন্ত কি হলো জানি না। রাস্তা হতে সোমায় অ্যানেকটোই লাগলচার-পাঁচ বছর পেরায়

রাস্তা কত্তা কিছুতেই সিধে করতে পারবে না। অবশ্যি সি একা তো আর রাস্তা করে নাইআরও সব মেম্বাররা ছিলম্যালা ওপরঅলা ছিল। তবু রাস্তা তো তার এলেকাতেই হচেতার দায়িত্বই বেশি। কত্তা কখনো কখনো বলতমুখটা ত্যাকন একটু খুশিতে ভরাওমুক খুব গরিব মানুষবেচারার মোটে দেড় বিঘে জমিচাষবাসের শেষ দিনে গায়ের লোক ব্যাগারে তার জমিটুকু আবাদ করে দেয়। সেজন্যে সারা মরশুম সে নিজেই ব্যাগার খাটে। তার ঐটুকু জমির তিন কাঠা রাস্তায় চলে যাচ্ছিলকি করবকোনোরকমে জমিটুকু বাঁচিয়ে দিলাম বটেরাস্তা কিন্তু ঐ জায়গাটায় তারাবাকা হয়ে গেল। দু-এক জায়গায় বড়লোকদের চাপেও ওরকম করতে হয়েছে। নাঃযেমন রাস্তা হবে মনে করেছিলামতেমন হবে না

হবে হবেহচে হচে করে রাস্তা হতে বেশ ক-বছর লেগে গেল। তাপর শোনলমজেলার বড় সায়েব আসবে। বিদিশি বিটিশ শাদা সায়েবসেই সায়েব এসে ফিতে কাটবেতাপরে সবার লেগে রাস্তা খুলে দেবে। আমাদের জান ভয়ে কোণে কোণে লুকুইতে লাগল য্যাকন শোনলম সায়েব গাড়ি নিয়ে লতুন রাস্তা দিয়ে সোজা আমাদের বাড়িতেই আসবেতাপর যিখানে ফিতে কাটার বেবস্থা হয়েছে সিখানে যেয়ে যা করবার করবে। সায়েবরা কেমন মানুষকি খায়কি করে কিছুই জানি না। আমরা তো কুন্ ছার,কত্তারাই তার কুনো কথা বুঝতে পারবে না। একটা কথা তাকে বলতেও পারবে না। ইসব কথা কত্তাকে বলতে গেলমতা সে রেগে ধমকে দিলে। এসব তোমাদের ভাবতে হবে না। বাড়ির কোনো খাবার সায়েব খাবে না। যেমন আসবে তেমনি সোজা গিয়ে চেয়ারে বসবেকাগজপত্তরে সই করবে। খামারে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে। পাঁচ মিনিটবড়জোর দশ মিনিটতার বেশি সায়েব এখানে থাকবেই না। আমরা সদর থেকে দার্জিলিং-চাবিলিতি বিস্কুট এইসব এনে রাখবযদি কিছু খায় তখন দেখা যাবে

সায়েব যিদিন আসবে সিদিন সারা গায়ে উচ্ছব। আধাবেলায় আসবে সে। সিদিন গাঁয়েব সব্বাই সকালবেলাতেই গা ধুয়ে যার যেমন ভালো জামাকাপড় আছে তাই পরে ঘরের-মাঠের কাজকম্ম বাদ দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কখন সায়েব আসে। হিঁদুদের সব এয়োতিরা সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে চুল আঁচুড়ে নিজের নিজের বাড়ির দুয়োর গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকলেমোসলমান বাড়ির বউ-ঝিরাও দেউড়ি দুয়োরের আড়ালে-আবডালে দাঁড়িয়ে রইলে সায়েব এলে দেখবে বলে। ঐসব দিকে সায়েবের গাড়ি হয়তো যাবেই না তবু সব দাঁড়িয়ে রইলে আর সারাগাঁয়ের হিঁদু মোসলমান পুরুষমানুষদের পেরায় সবাই আমাদের দলিজের ছামনে খামারবাড়ির মাঠে এসে জমায়েত হলো

ইশকুলেও সিদিন ছুটি দেওয়া হয়েছেল। মাস্টাররা সব ফরশা জামাকাপড় পরে এয়েছে। বোডের মেম্বর,আদালতের কেরানিবাবুরাগাঁয়ের আর ভদ্দরলোকদের কেউ আসার বাকি নাইসবাই হাজির। শুধু আমাদের বউ-ঝিদেরই একটুও বেরুনোর হুকুম নাই। এমনকি বেশি উঁকি-ঝুঁকি মারলেও গিন্নি রাগ করবে

কেউ বললে নাতবু জানতে পারলম সায়েব কখন এল। সব যেন কেমন হয়ে গেলপাখি ডাকতে ভুলে গেলছেলে কঁদতে ভুলে গেলকি জানিবাতাস দিতেও যেন ভুলে গেল। সব চুপচাপ। কিসায়েব এয়েছে! আমি কত্তার ঘরে যেয়ে পরচালির দিকের দরজাটা খুলে দেখি খামার দলিজে লোকে লোকারণ্য। এক পাশে ধুলোয় ঢাকা একটো মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে আছেলাল পাগড়ি পরা কটো সেপাইও রয়েছে ইদিক-ঊদিক আর দলিজে লোকজন সবাই দাঁড়িয়ে আছে। শুধু একজনা একটো চেয়ারে বসে আছে। লাল টকটকে এক সায়েব। সায়েবকে পোষ্কার দেখতে পেচি না বটেকিন্তুক অতগুলো মানুষের মধ্যে ঐ একজনাকেই শুদু চোখে পড়ছে। কি তার গায়ের রঙকি তার পোশাক-আশাক। সায়েব থুতনিতে দু-হাত দিয়ে বসে আছে এইটুকুন শুদু দেখতে পেচি। কি যেন শুনছে। ত্যাকন দেখতে প্যালম খাটো ধুতি আর মোটা কাপড়ের পাঞ্জাবি পরাগলায় উড়নি জড়ানো এক ভদ্দরলোক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কি যেন একটো পড়ছে। লোকটোর চোখে চশমাতবু পড়ার কাগজটো ধরে আছে মুখের ওপর আর কি জোরে জোরে যি পড়ছে সি কি বলবমনে হচে যেন যাত্রা করছে। কথা কিছু কিছু শুনতে পেচি বটে। কিন্তু বুঝতে পারলম না কিছুই। কত্তার কাছে পরে শুনেছেলমবুঝব কিসি তো বাংলা কথা লয়সায়েবদের নিজেদের কথাইঞ্জিরি

তা বেশিক্ষণ হলো না ইসব। একটু বাদেই উঠে পড়ল সায়েবগাড়িতে যেয়ে উঠল। গাড়ি ভো করে খামার থেকে বেরিয়ে গেল আর বললে কি লোকে পেত্যয় যাবে যি এক লহমার মদ্যে অত বড় খামার দলিজ একদম ফাঁকা। যি যেমন করে পারলে দৌডুইলে গাড়ির পেচু পেচু। কত্তাকেও দেখলম নিজের দলবল নিয়ে বেরিয়ে গেল। কত্তা কিন্তুক তেমন সাজগোজ করে নাইবাড়ির বাইরে গেলে যেমন পোশাকে থাকেতেমনিই। পরনের ধুতিটো তার বরাবরই এট্টু দামিউড়ুনি অবশ্য একটো নিয়েছে আজ। এলেকার য্যাতো বড় বড় সব লোক আজ সঙ্গেই আছে। পাশের গাঁয়ের গোঁসাই আছেএমন দিনেও কিন্তুক খালি গায়ে। একটো চাদর শুধু জড়ানোকপালে চন্দনের ফোটাতিলক কাটা। গাঁয়ের ভশ্চাজ্যিপাঠকপালখাননন্দীএরা তো আছেই। মিয়ে-মোকাদিম ইদিকে কমতা-ও দু-তিনজনা এয়েছে আজকের দিনে

রাস্তা চালু হয়ে যাবার পর আমি একদিন আবদার ধরলম রাস্তা দেখতে যাব। কত্তা কিন্তুক এরকম আবদারের মান রাখত। মোষের গাড়ি এলইস্টিশন পয্যন্ত যেয়ে আবার ফিরে আসা হবে। বউদের আর কেউ যেতে চায় না। কত্ত মাকে শুদুলেগিন্নি যাবে কি না। এট্টু হেসে আমার শাশুড়ি বললেরাস্তায় আমার আর দরকার নাই বাবারাস্তা ধরে এখন আর কোথাও যাবার নাই। যে কদিন আছি সব রাস্তা আমার এই বাড়িতে। তোমরা যাও

পুবদিকের গাঁগুনো থেকে রাস্তা এসে গাঁয়ে ঢুকেছে বটে তবে সি রাস্তা কিন্তুক গাঁয়ের ভেতরে এসে মিলেছে গাঁয়েরই মাঝখানের পুরনো রাস্তায়। গাঁয়ের ভেতরে ই রাস্তা তো চেরকালই ব্যবহার হচে। তাই গাঁয়ের ভেতরে আর লতুন সড়কের কুনো কথা নাই। কিন্তুক গাঁ থেকে বেরিয়েই দেখলম লতুন রাস্তা বড্ড আঁকাবাকা। গোড়াতেই অত ব্যাঁকাব্যাঁকা ক্যানে শুদুলে কত্তা বললেধরোমহারাজার দিঘির দক্ষিণ পাড় এই পাওয়া গেলকারুর জমি আর মারা গেল না। রাস্তা এখান থেকেই যদি সোজা করিপ্রথমে এই বড় ভাগাড়টা যাবেতখন গাঁয়ের মরা গরু-মোষ ফেলবে কোথা লোকেতারপর যাবে গরু-মোষ চরার এই বিরাট পগার। তারপর যাবে ছেলে-ছোকরাদের এই পেল্লাই খেলার মাঠ। এতো বড় মাঠ আশেপাশের কোনো গাঁয়ে নাইমহারাজার সম্পত্তিইস্কুলের জন্যে দেওয়াভাগ করলে তিনটে মাঠ হবে খেলার। এই মাঠ কি নষ্ট করা যায়। যাক নারাস্তা একটু ঘুরে! গাঁয়ের লোকের এতো কি আর তাড়া

সত্যিই এতো জায়গা ছেড়ে দেওয়ার লেগে রাস্তা অ্যানেক ঘুর হয়েছেকুটুর কুটুর করে গাড়ি যেচে তো যেচেই। কেউ যেদি হেঁটে ইস্টিশনে যেতে চায়তাইলে আদ্দেক সোমায়ে যেতে পারবে। লোকে কি আর শোনেবর্ষাকালটা বাদ দিয়ে সারা খরানির সোমায়ে ভাগাড়ের ওপর দিয়েপগার দিয়েখেলার মাঠ ধরেই সবাই গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করত। শুদু কি তাইনতুন সয়রানের অ্যানেক জায়গাতেই দেখলম যা-তা ঘুরুনি হয়েচে। ডাইনে ঘুরল তো ক-পা যেয়ে বাঁয়ে ঘুরল। তাপর আবার ডাইনে ঘুরল। কত্তা হেসে বললেএসব বেশিরভাগই হয়েছে গরিবের জমি বাঁচানোর জন্যে

বড়লোকের জমি বাঁচানোর লেগে এরকম ঘুর কি একটোও হয় নাই?

তা কি আর না হয়েছে?

হ্যাঁলোকে অবিশ্যি বলতে পারে রাস্তা ছিল নারাস্তা হয়েছেলোকের চলাচলের সুবিধে হবে। এই পর্যন্ত। এত ঢোল পিটোবার কি আছে তা নিয়েলোকের চাষের জমি নিয়ে আবার সেই জমিরই দু-পাশের মাটি নিয়ে কুলি-মজুর লাগিয়ে রাস্তা তৈরি হয়েছে। উঁচু মাটির সরানদু-পাশে তার লম্বা খালের মতো নালাসেখানে চাষের কাজ কিছু হবে না। ক্ষতি তো মানুষের হয়েছেই। তবু বলা যায়ক্ষতির চাইতে লাভই বেশি হয়েছে। তাই বলে ততো বাহাদুরির কিছু নাই। আমিও তাই বলিবাহাদুরির কিছু নাইকাজটা করার দরকার ছিলআমি না করলে একদিন না একদিন আর কেউ করত। করতে হতোই একদিনকপালগুণে আমার ওপরেই পড়ল দায়িত্ব। এ নিয়ে বুক ফুলিয়ে আমার বলার কিছু নাই। এমন করে কথা কত্তার মুখে কুনোদিন শুনি নাই। সে কথা বলেই যেচে

আমি ভাবি অন্য কথা। একজন মানুষ দুনিয়ায় আর কদিন থাকেকিন্তু মানুষ চিরকাল থাকবে। একজন একজন করে ধরলে কোনো মানুষই বেশি দিন দুনিয়ায় নাই তবু দুনিয়া ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত দুনিয়ায় মানুষ থাকবে। এই যে রাস্তা হলোধরো আমার অছিলাতেই হলোআমার লোভলালসা যা-ই থাকুকহলো তো রাস্তানা কিআমি দুদিন বাদে দুনিয়া ছেড়ে গেলেও এই রাস্তা থাকবে। কতোদিন থাকবেআমি বলছি বহুকাল থাকবেআর নষ্ট হবে না। রাস্তা হয়তো অন্যরকম হবেপাকা হবেকতো গাড়িঘোড়া চলবেআমার তিনপুরুষ চারপুরুষ পরের মানুষেরা এই রাস্তা দিয়েই চলাচল করবে। কারুর মনে থাকবে না আমার নামআমাদের কারুর নাম। তবু রাস্তাটা থাকবে। এই মনে হলে মনে হয় আমিই চিরকাল থাকলাম

কথাগুলি যা সে বললে সোজা কথাতেই বললে। সবকথা বুঝতে না পারলেও কিছু তো বোঝলম। যা বোঝলম তাতে আমার গা কিরকম করতে লাগল। কত্তা কেমন লোকউকে কি আমি চিনি! উ যেদি সব সোমায়ে এমনি করে কথা বলততাইলে আমি হয়তো ওর সাথে ঘর করতে পারতাম নাখুব ভয় হতো। কিন্তুক তা লয়ইরকম কথা সে আর কবার বলেছে?

 

পিথিমির পেজা আর কতো বাড়াব

এবারের সন্তানটি পেটে নিয়ে আমি খুব পেরেশান। কি আর বলব! নিজের ওপরেই নিজের রাগ হয়। কতো মনে হয় আর চাই নাআর বোঝা বইতে পারি নাকিন্তু জম্মের পরে তার শুদু মুখটি দেখা বাকি! কার কারসাজি জানি নাএকবার যেই মুখটির ওপর চোখ পড়লএকদিকে সারা দুনিয়া আর একদিকে ঐ নাড়িছেড়া সন্তান। কিন্তুক য্যাতত দিন জন্ম না হচেপেটের ভারে সমদমখালি মনে হয় আর দরকার নাইআর কতো পেটে ধরতে হবে! নিস্তার কি কুনোদিন মিলবে না?

বাড়ির ছেলেমেয়েদের আর কতো হিশেব দোব! আমার দুটি আর একটি এল বলে। ল-বউছোট বউয়ের একটি একটি খোঁকা হয়েছে। সেজ বউ দুটি খোঁকা রেখে চোখ বুজেছিল তবে বছর দুই আগে তার ছোটটি দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে গেয়েছে। আট-ল বছরের হয়েছিল। একদিন দোপরবেলায় দুবার শুকনো বমি হলোমুখ হয়ে গেল নীলবন্ন। তার মা নাইলতুন মা কেবল ঘরে এয়েছে। সব কাজ বাদ দিয়ে সেই ছেলের সেবা গিন্নি একা করলে। আমার ননদকেও কাছে আসতে দিলে না। শাশুড়ি বুঝলেএই মা-হারানো ছেলেটিকে তাকেই দেখতে হবে। অবশ্যি বেশি সোমায় লাগল নাদু-তিন দিনের মধ্যেই সে চলে গেল। এক-একজনার অমনি কপাল হয়দুনিয়ায় আসেকেউ তাকায় নাদেখে নাআদর-ভালোবাসাও তেমন জোটে না। তাপর হুট করে একদিন চলে যায়। চলে যাওয়াটোও তেমন কেউ খেয়াল করে না। ঐ ছেলেও অমনি কপাল করে এয়েছিল

যাকগোত্যাকন আমি খুব পেরেশানচলাফেরা করতে কষ্ট হয়। ভোগাবে মনে হচে পেটের এই সন্তানটি। এই সোমায় একদিন দোপরবেলায় হিঁদুপাড়ায় লাগল আগুন। এই এলেকায় আগুন লাগাটো যি কি বেপার তা মানুষে চিন্তা করতে পারবে না। শুকনোর সোমায়ঝাড়া পনেরো দিন আসমান থেকে আগুন ঝরছে। দু-একটো বাদে সব বাড়িরই মাটির দেয়াল আর খড়ের চাল। খুব কমএকটি-দুটি বাড়ির চাল টিনের। তা মাটির বাড়ির বাহার কম হয় নাই দ্যাশে এমন মাটি পাওয়া যায় যি তা দিয়ে ঘরের ভেতরের দেয়ালে চুনকামের কাজও হয়। আমাদেরই কটো ঘরের দেয়াল এমনি চুনকাম করা আছে। আর বাড়ির বাইরের দেয়ালগুনোয় মাটির মিহিন কাজ করে আলকাতরা লেপে এমন করা হয় যি শতেক বর্ষাতেও কিছু হয় না। কিন্তুক এত সৌন্দর্য হলে কি হবেচাল যি সব খড়ের! কতো বাহার করে ছাঁচ কাটা! শালকাঠতালগাছের কড়িবাঁশএইসব দিয়ে চালের তলার কাঠামো এমন দবজ করে তৈরি যি বোশেখ জষ্টি আশিন কাত্তিকের ঝড়েও কিছু হবে না। কিন্তুক আগুনের কাছে সব জব্দ। আগুন লাগলেই মনে হয় সারা বাড়ি যেন ঠিক বারুদের গাদা। সিদিন দোপরে কোথা থেকে আগুন ধরল কে জানেকামারশালা থেকেনা মোড়লবাড়ির চুলো থেকেনাকি অন্য কুনো বাড়ি থেকেনাকি আপনাআপনিই লাগল কেউ বলতে পারলে না। উত্তরপাড়ায় লাগল আর লহমার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এগুইতে লাগল দখিন-পুব দিকে। ই তল্লাটে গাঁয়ের রাস্তার দু-পাশে একটার পর একটা বাড়িচালে চালে লাগানো। ঠিক শহরের মতুন। খুব কাছে কাছে বাড়িদু-বাড়ির মাঝে একটোই পাঁচির কিংবা কুনো পাঁচিরই নাই। আগুন যি লাগলধুয়োইলদাউ দাউ করে জ্বলে উঠল তা কি কেউ দেখতে পেলেদোপরবেলার আগুন কেউ দেখতে পায় না। শাদা ধুয়ো হয়তো একটু দেখতে পায় কিন্তুক দিনের আলোর সাথে আগুন এমন মিশে যায় যি কিছু বোঝা যায় না। তাই বলে আগুন লাগলে কাউরির জানতে বাকি থাকে না বরং আগুনের খবরই সবচাইতে তাড়াতাড়ি জানতে পারে লোকে। কি করে জানেজানি না। হু হু করে একটো শব্দ ওঠে। সি শব্দও আবার তেমন শোনা যায় না। তবে হ্যাঁহঠাৎ করে চারদিক থেকে বাতাস ছুটে আসেসি বাতাসের শন শন আওয়াজ পাওয়া যায়। তাপর দাঁড়িয়ে থাকলে গরম বাতাস এসে গায়ে লাগেছাই উড়ে বেড়ায় আর মাটিবাঁশখড়সোংসারের জানের জান সব জিনিশ পোড়ার গন্ধ পাওয়া যায়

আগুন লাগার খবর ঠিকই জানতে পারলম। এগৃনেয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলম আগুন উত্তর থেকে দখিন দিকে যেচেপট পট ধুমধাম আওয়াজ হচে। পেথম যি লোক দেখেছিলসে চেঁচাতে যেয়েও চেঁচাতে পারে নাই। তাকে বোবায় ধরেছিল। আগুন পেথমে যি দেখে সে লিকিনি গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারে না। বুকে বিশমণি পাথর চাপানো আছে মনে হয়। অ্যাকন অবশ্যি অ্যানেক মানুষসারা গাঁয়ের মানুষ আগুন নেভাইতে লেগে গেয়েছে। সবাই চেঁচাইচেহৈ-হুল্লা-চিকার কানে আসছে। কি আচ্চয্যিএত পুড়ছেসব পুড়ে যেচে তবু মানুষের চেঁচানি শুনেই ভয় অ্যানেকটো কম লাগছে। কিন্তুক য্যাকন আগুনটো লেগেছিলযি পেথম দেখেছিল তার দম আটকে গেয়েছিলশব্দ বার করতে পারে নাই। আগুন লাগলে মানুষের যেন কেয়ামতের ভয় লাগে!

সেইদিনই সাঁঝ-লাগার কোলে কোলে বামুনপাড়ায় পোড়া আঁতুড়ঘরের মদ্যে ভশ্চায্যি-গিন্নির একটি খোঁকা হলো আর মাঝরেতের পরে আমারও গভূভের সন্তানটির জরমো হলো। সি-ও একটি খোঁকা। মনে হয় ঐ মাহা লঙ্কাকাণ্ড না হলে ঐদিন ভশ্চায্যি-গিন্নির ছেলে হতো না। আমার ছেলেটিও ঐ রেতে দুনিয়ায় আসত না। পরের দিন সকালেই ভশ্চায্যি এল বাড়িতে

প্রলয় হলো হে প্রলয় হলো। প্রলয়ের মধ্যে পুত্রলাভআমারও হলোতোমারও হলো। আমি ঐ হতভাগার নাম রেখে দিয়েছি ভণ্ডুল’–তাই বলে তুমি ওরকম রেখো না। একটা ভালো সোজাসুজি নাম রেখে দিয়ে ছেলের

সে তো হলোএদিকে গাঁয়ের যে সর্বনাশ হয়ে গেল ভটচাজ!

তার আর কি করা যাবে বলোনিয়তি কেউ খণ্ডাতে পারে না। তবে কথা হচ্ছে তুমি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টআমি একজন মেম্বার। তোমার সময়েই এমন আগুন লেগে আদ্দেক গাঁ পুড়ে ছাই হয়ে গেলতোমাকেই এখন লোকের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হবে

ঐ শুরু হলো। সত্যিই আদ্দেক গাঁ পুড়েছিল। ঘরের সব জিনিশ লষ্ট হয়েছিল তো বটেইবেশিরভাগ বাড়ির খড়ের চাল পুড়ে এমন দশা হয়েছিল যি দেখলে চোখের পানি রাখা যেছিল না। খালি পোড়া কালো কালো দেয়ালগুনো দাঁড়িয়ে আছে। আঁদার রেতে সিদিকে গেলে গা ছমছম করে। ঠিক যেন সার সার ভূত দাঁড়িয়ে রয়েছেমুখে রা নাইসি যি কি আবস্তা বলা যেচে না। ছেলেমেয়ে নিয়ে রেতে থাকে কোথাঅ্যানেক ভদ্দরলোক গেরস্থ কি করবেউঠনে বিছেনা পেতে খোলা আসমানের তলায় থাকতে লাগল

আর এইবার দেখলম কত্তাকে। সে দিনকে দিন মানলে নারাতকে রাত মানলে না। আশেপাশের বিশটো গাঁয়ে ছুটে বেড়াতে লাগল। এক দণ্ড বাড়িতে থাকত না

কোনো কথা নয়মানুষকে একটু মাথা গোঁজার ঠাই করে দিতে হবে। তারপর অন্য কথা। গাড়ি গাড়ি নতুন বাঁশ লাগবেকাঠ লাগবেখড় লাগবেদড়িপেরেকগজাল মোট কথা হচ্ছে বাড়ি করতে যা যা লাগে সব জোগাড় করতে হবে। মানুষের জন্যে ভিখিরি সাজতেভিক্ষে করতে দোষ কিনিজের জন্যে তো নয়হীন হবার কিছু নাই

কত্ত হাত জোড় করে গাঁয়ে গাঁয়ে যেয়ে আবস্তাপন্ন চাষি গেরস্তদের কাছে বাঁশ-খড়-কাঠ এইসব যাচেঙ্গা করতে লাগল। চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেলহ্যাঁএকটো মানুষের মতুন মানুষ বটে! হিঁদু-মোসলমান বলে কথা নয়একজন মানুষ। কতো সুনাম তার হতে লাগল। লতুন রাস্তা হবার পরেও তেমন হয় নাই

অসাধ্য কিত্তি করলে মানুষটো! একা করে নাই বটেসবাইকে সাথে নিয়েই করেছিল এই কাজইউনিনের মান্যগণ্য কত্তারা সবাই ছিল। তবু সবাইকে একসাথেই বা করতে পারে কজনাসারা গাঁ যেন ঘুমিয়ে ছিলমিশমার হয়ে ছিলকত্তার ডাকে গা ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠল। কেউ বসে নাইসবাই কাজে লেগে গেয়েছেযাদের কুনো ক্ষেতি হয় নাই আগুনেতারাও সবাই কাজে লাগল। নিজের নিজের কাজটুকু করে আবার ঐ সাজারের কাজে হাত লাগাল। দরকার হলে লতুন করে মাটির দেয়াল করে দিচেবাঁশ কাটছেকাঠ চিড়ছেঘরামিরা এসে চালা তুলছেবাঁশ-কাঠের কাঠামো তৈরি করে দিচেতাপর খড় দিয়ে ছাইয়ে দিয়ে তবে ছুটি। টাকাপয়সা যেখান থেকে যা জোগাড় হয়েছিলকত্ত সেখান থেকে যাকে যা দেবারযাকে না দিলেই নয়তাকে তেমনি করে মজুরি দিচে

সত্যিই অবাক বটে। আষাঢ়-শাওনের বর্ষা-বাদল আসার আগেই আমাদের এই পোড়া গাঁ আবার নতুন হয়ে গেল। আগের চেয়ে লতুন। দূর থেকে দেখা যেতে লাগল সব লতুন ঘরের চাল। খড়ের রঙ তো সোনার মতুন! পুরনো কালো হয়ে যাওয়া চালগুনোর বদলে এই নতুন। ছাওয়ানো চালগুনো দূর থেকে সোনার মতুনই ঝকঝক করতে লাগল

সব কাজ হয়ে গেলে কত্তা একদিন ভঞায্যিকে বললেছেলের ভণ্ডুল নামটি বাদ দিয়ে আর একটি নাম দাও ভটচাজ। ভণ্ডুল কিছুই হয় নাই

তা আর ভঞায্যি করে নাই। ছেলের নাম ভণ্ডুলই রইল। সোনার ছেলেতবু সারা জেবন ভণ্ডুল নামই বয়ে বেড়াইলে

 

কি দিন এলসারা দুনিয়ায় আগুন লাগল

পিথিমিতে এলম কিন্তুক পিথিমির কিছুই দেখলম না। কবে একদিন মায়ের প্যাট থেকে পড়লম,দুনিয়াতে এসে চোখ দুটি মেললমহয়তো দুবার জোরে চিষ্কার করে কেঁদেছেলমঐ পয্যন্তই। তাপর এত কাল পার করলমকিছুই দেখলম না পিথিমির। সারা জেবনে বাড়ি থেকে তিন কোশ চার কোশের বেশি যেতে হয় নাই। কেউ নিয়ে যায় নাই। মাঠ-ঘাটঘরবাড়িআসমান-জমিন ওইটুকুনই যা দেখলম। কবর কেমন হবে জানি না তবে মনে হয়কবরের থেকে একটু বড় এই সোংসার। কবরের জায়গাটো তবু নিজের নিজেরসসাংসারের সবটো নিজের লয়। সংসারে থেকে যা দেখা যায়আসমান-জমিনসি তো কবরের বাড়া! সোংসার করতে করতে জান জ্বলে গেলে এইরকম মনে হয়। গাধার খাটুনি খাটতে খাটতে মনে হয়পিতিদিন রাজ্যের লোকের পিন্ডির বেবস্তা করতে করতে হিমশিম খেয়ে গেলে মনে হয়। শাশুড়ি-ননদের বাঁদিগিরি করতে করতে মনে হয়। তারা নিজেরা বাঁদি-চাকর না ভাবলেও মনে হয়। জা-রা য্যাকন গিদের করে বসে থাকেটিটেমি করেগরজ ঠাওরায়ত্যাকন ইসব মনে হয়। ত্যাকন যেন নিজের ছেলেমেয়ে-সোয়ামি-সংসার সবই বিষ। তা বিষ খেতে খেতে এমন হয়েছে যি অ্যাকন এই বিষেও নেশা লাগে

গাঁ যিদিন পুড়ল সেইদিন রেতে আমার যে আর একটি খোঁকা হয়েছিলসে তো মরেই যেছিল। বাঁচার কুনো আশা ছিল না। বর্ষার মরশুমটো টিকবে কি না তাই খুব সন্দ। সি-বার বর্ষাও হয়েছিল তেমনি। সারা দিন সারা রাত গদগদ করে আকাশ ঢালছে তো। ঢালছেই। তা ঢালুক চাষবাস সবই আসমানের মুখ চেয়ে! বর্ষায় পানি যেদি না হলোধান হয় রোয়াই হবে নানাইলে মাঠের ধান মাঠেই শুকুবে। কিন্তুক সিবার হলো উল্টো। এতই বিষ্টি যি চাষের ফাঁক পাওয়া যেচে নাবীজতলা তলিয়ে যেচেরোয়া ধান ভেসে যেচে। সারা মাঠ পানিতে তম তম করছে। এমন বাদলে কচি ছেলেটোকে বাঁচানো কঠিন হয়েছিল। তা শক্ত জান নিয়ে এয়েছিল ছেলে। বর্ষাকালও শেষ হলোসে-ও বেশ ডাগর-ডোগর হয়ে উঠিল

এই সোমায় কত্তা একদিন বললেবাড়িতে যেসব কাগজ-টাগজ আসে সেসব কি চেয়ে কোনোদিন দ্যাখোনাঅক্ষর-টক্ষর সব ভুল মেরে বসে আছ! কত্তার ব্যাকা কথায় আমিও বাকা কথা বললম। সোংসারের বত্রিশ জনার পিন্ডি রাঁধতে রাঁধতে অক্ষর-ফক্ষর সব চুলোয় গেয়েছে

সত্যিই তোপড়তে একদিন শিখেছেলমকিছুই অ্যাকন আর মনে নাই। কতো দিন কিছু লিখিও নাইকিছু পড়িও নাই। হপ্তায় হপ্তায় বঙ্গবাসী কাগজটো আজও আসেআরও কতো কিসব আসে। কত্তা দেখি আজকাল সবই পড়ে। লোকটোকে অ্যাকন আর চিনতে পারি না। খুব ভদ্দরলোক ভদ্দরলোক লাগে। কুনো সময় খালি-গা হয় না। ধুতির ওপর হাতাঅলা গেঞ্জি পরেনা-হয় একটো কুনো জামা পরে। চোখে চশমা লাগায়। কত্তা দূরে যেচেআমি যেখানকার সেইখানেই আচি। কত্তর দিকে চেয়ে লরম করে বললমসাংসারের কাজে এত বেস্ত থাকিএক লহমার ফুরসৎ পাই না। দুনিয়ার খবর আর কি করে রাখব?

আবার যে সারা দুনিয়ায় যুদ্ধের আগুন লেগেছে। আর কিছু না হোক বঙ্গবাসী কাগজটা একটু কষ্টোমষ্টো করে দেখো

দেখে কি করবসোংসারের কয়েদখানায় সারা জেবনের মেয়াদে কয়েদ খাটচি-কুন্ দ্যাশে যুদ্ভু হচেকে যুঘ্ন করছেকত লোক মরছেকতো লোক খোড়া হচেকতো দ্যাশকতো ঘর-সসাংসার ছারেখারে যেচেতা আর আমি কি জানবআমি য্যাকন চোদ্দ বছরের মেয়েআমার বিয়ের সোমায়ে য্যাকন এমনি সারা দুনিয়া যুদ্ধ হয়েছিলকই কিছুই তো বুঝতে পারি নাই। বেঁধেছিবেড়েছিখেয়েচিছেলেপুলে মানুষ করেছিযুদ্ধ নিয়ে কুনোদিন ভাবি নাই। তা আবার অ্যাকন সারা দুনিয়ায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে বলছতা হলোই বানিজেরা তো কিছু ট্যার পাব না। তার চেয়ে জষ্টি মাসে গাঁয়ে যি আগুন লাগলগোটা হিঁদু-পাড়াটো পুড়ে গেলসি ধাক্কা জানে যেয়ে লেগেছে তোমার এই যুন্ধুর চেয়ে অনেক বেশি

এবার বোধ হয় অত সহজ হবে না। যুদ্ধ আর আগের মতো নাই। কত্তা বললেঢাল-তরোয়াল নিয়ে সামনাসামনি মারামারি-কাটাকাটি হতো সেখানকার যুদ্ধ সেখানেই থাকত। যতো রক্তারক্তি হোকঐ জায়গার বাইরে আর যুদ্ধ নাই। ঢাল-তরোয়াল দিয়ে যুদ্ধ করে আর কত লোক মারা যায়কিন্তু এখন যে যুদ্ধ হবে তা একদম আলাদা। লাখ লাখ লোক যুদ্ধে যাবেযুদ্ধ করবেমরবেও লাখে লাখে অথচ হয়তো শত্রুকে চিনবেও নাদেখবেও না। আবার যারা যুদ্ধে যায়ই তোমার আমার মতো খুব সাধারণ মানুষতাদেরকেও মরতে হবে লাখে লাখে। হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের শহরে মানুষ নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছে তোআঁধার আকাশ থেকে বোমা মেরে বাড়িঘর-দুয়োর দেবে মাটিতে মিশিয়ে। কতো লোক যে মরবে তার কেউ হিসাব করতে পারবে না। লাশই পাবে না। মা পাবে না ছেলের লাশছেলে পাবে না বাপের লাশ। এক-একটা লাশ ছিড়ে-খুঁড়ে কোথা যে পড়বে তা কেউ জানতে পারবে না

কতো দূরে যুদ্ধ হচেআমরা ইয়ার কি বুঝবউ নিয়ে তুমি অত মাথা ঘামাইছ ক্যানেকইসেই আগের যুদ্ধতে তো কিছুই বুঝতে পারা যায় নাই! ঐ বঙ্গবাসী কাগজ আর কি কি সব ছাইভস্ম বাড়িতে আসে,ওইগুননাই য্যাতো লষ্টের মূল

কত্তা একটু হেসে বললেদুনিয়া জুড়ে কতো বড় বড় ব্যাপার হচ্ছেকোন্ এক গাঁয়ের এক কোণে আমরা সব ছা-পোষা মানুষ পড়ে আছি। ঠিকইআমরা আর এসব কি বুঝবতবে আগে সব জানালাদরজা বন্ধ ছিল। এখন একটা-দুটো কাগজ-টাগজ আসেবাইরের দুনিয়ার হাওয়া খানিকটা বোঝা যায়। হাওয়া ভালো মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আগুন যেখানেই লাগুকসারা দুনিয়ায় ছড়াবে। দুনিয়াটা বেওয়ারিশ সম্পত্তি নয় মনে রেখো। এরও মনিব-চাকর আছে। যেমন এইদেশে ব্রিটিশ মনিবআমরা চাকর

দিন যেতে লাগলবছর ঘুরে গেলযুদ্বুর কিছু কিন্তু আমরা বুঝতে পারলম না। সব আগের মতুনসোংসারের চাকা ঘুরছে তো ঘুরছে। বাড়ির লোক কেরমাগত বেড়েই যেচেছেলেপুলেগুলো বড় হচেএকটি-দুটি করে জায়েদের সন্তান হচে। ঠিক আগের মতুনই সকালে সুয্যি উঠছেসাঁঝবেলায় ডুবছে। বঙ্গবাসী কাগজটো এলেকত্তার পড়া হয়ে গেলেগাঁয়ের আর যারা পড়তে নিয়ে যায়তারা ফেরত দিয়ে গেলেএকবার একবার চোখের ছামনে নিয়ে বসে থাকি। বিটিশ আর জারমেনি এই দুটো নাম দেখি বটেআর আর নামও দেখিতবে মনে থাকে না। ঐ দুটি নাম খুব বেশি দেখি বলে মনে থাকে। এক-একটো খবর ভালো করে পড়তে যাইবিদ্যে কমঅ্যানেক কথাই বানান করে করে পড়তে হয়তা-বাদে অতো কষ্ট করে পড়েও কিছু বুঝতে পারি না। বুঝব কি করেউড়োজাহাজ দিয়ে একটো-একটো বড় শহরে বোমা ফেলছেকামান-বন্দুকের গুলি মারছেআহা আহাসব ভেঙে গুঁড়িয়ে যেচেসমুদুরেও আগুন লাগছে। কি ক্ষেতিই না হচেকতো লোকই না মরছে! ইসবের হিশেব যি থাকছে না তা লয় কিন্তু আমার মাথায় ঢুকছে না। একের পরে একটো শূন্য দিলে দশ হয়দুটো দিলে একশো হয় আর তিনটো দিলে হাজার হয়। এই পয্যন্ত জানি আর হাজার হলে কতো হয় তা-ও একটু একটু বুঝতে পারি। কিন্তুক তারপরে য্যাতো শূন্যই দাওতাতে কতো হয় তা আমি কুনোদিনই শিখতে পারব না। আর পারলেই বা কিএক হাজার কতো তা-ই মাথায় ঢোকে নাএক লাখ হলে কতো হয় তা কি কুনোদিন বুঝতে পারব?আর কাগজে য্যাতো হিসেব সব শূন্য দিয়ে। এই লেগে কাগজ পড়তে গেলেই বুকের মদ্যে খালি খাঁ খাঁ করে। হায় হায়তামাম দুনিয়ার সব্বোনাশ হচে!

কখনো কখনো মনে হয়গাঁয়ের ভেতর ঘরের কোণে বসে আছি বলে কিছু বুঝছি না। শহরে হয়তো অনেক কিছুই হচে। কত্তা আগের মতুনই শহরে যায় বরঞ্চ এট্টু বেশিই যায়। ছোট দ্যাওর কোটে চাকরি করে। বিয়ে হয়েছেএকটি ছেলেও হয়েছেতাদের নিয়ে শহরে বাসা করে থাকে। আমার ছোট ভাইটিও আর কলেজে যায় নাই। পড়াতে তার মন ছিল কিন্তুক তার আগে বাপের অভিশাপ কুড়নোর ইচ্ছা হয় নাই। সে-ও একটি বিয়ে করে ছোট একটি চাকরি জুটিয়ে শহরে বাসা ভাড়া করে থাকে। বাপজি মারা গেয়েছে আমার ছোট খোঁকাটি য্যাকন প্যাটে সে-ও তো ক-বছর হয়ে গেল। কিন্তুক একবার চাকরি আর সোংসারে ঢুকে পড়ে সে আর ল্যাখাপড়া করতে চাইলে না। দ্যাওর আর ভাইয়ের বাসা পাশাপাশিবলতে গেলে একই বাড়ি। কত্তা শহরে গেলে এই দুই বাসাতেই যায়। বাড়ির সরু চালমুগ মুশুরি ডালঘি এইসব দিয়ে আসে। শহরের খবর যা পাইতার কাছ থেকেই পাই। কত্তা আজকাল পেরায়ই বলছে,যুদ্ধ লিকিনি পশ্চিমের দ্যাশগুনো থেকে আমাদের ইদিকে এগিয়ে আসছে

তিলিপাড়ার আগুন বামুনপাড়ায় কেমন করে গেল দেখলে তোএইবার বুঝবে

ছোট খোঁকাটি ত্যাকন দ্যাড়-দু বছরের হয়েছেজম্মের পর কি অসুখ করেছিলবাঁচার কথা ছিল না। নেহাত হেয়াত আছে তাই অ্যাকনো দুনিয়া দেখছে। বলতে গেলে অ্যাকন আর রোগ-বালাই কিছু নাই। বেশ মোটাসোটা হয়েছেদু-হাতে দুই রুপোর বালা নিয়ে কাদাপানিতে খেলে বেড়ায়শুদু বুকের ভেতর বিলুইয়ের মতুন ঘরর ঘরর আওয়াজটো আর গেল না

ইয়ারই মদ্যে একদিন কত্তা বাড়ির ভেতরে এসে সেই আগের মতুন মা-বুনকে ডাকলে। গিন্নি এসে পাশে দাঁড়ালে বললেবউদের কাপড় আনা হয়েছেবছরে দু-জোড়া সবারই লাগে। মনে আছেছ-মাস আগে শাড়ি আনা হয়েছিলএখন আর এক জোড়া করে সবারই লাগবে। তুমি সবাইকে যেমন যেমন দিয়ে দাও। কাছে এসে কাপড় দেখে গিন্নি বললেই কি কাপড় বাবাএমন শাড়ি তো কখনো দেখি নাই। এ বাড়ির বউরা তো কুনোদিন এত মোটা শাড়ি পরে না। এ তুমি ফেরত দাওগা

বাজারে আগুন মামিহি তাঁতের শাড়িচিরকাল যা তোমরা পরে এসেছসে আর বাজারে নাই। এ বড় বড় শহরেকলকেতায় এখনো এখানে-ওখানে কিছু থাকতে পারে শহরগঞ্জে কোথাও তাঁতের মিহি শাড়ি আর নাই

সে আবার কি বলছবাবা?

যুদ্ধের ফল এই বোধহয় শুরু হলো। ঘরে ঘরে সব তত বন্ধ। সুতো নাইতাঁতিরা সব পেটে কাপড় বেঁধে বসে আছে। আজ সারাদিন বাজারে ঘুরে ঘুরে বহু কষ্টে এই মিলের শাড়ি কটি জোগাড় করেছি। বাজারে কাপড় মিলছে নামিলছে না মানে মিলছেই নাএ কি কোনোদিন কেউ ভেবেছেএই তত কাপড়তার আবার কি চড়া দাম!

কাপড় দেখে আমাদের তো মাথায় হাত। চটের মতুন মোটামাড় কি দিয়েছেজমিনে হাত দিলে হাত পিছলে যেচেসুতো মিহি না মোটা বোঝাই যেচে না। একরঙা ম্যাড়মেড়ে সবুজ নাইলে খয়েরি পাড় আর কাপড়ের রঙ কি! শুনছি কোরা রঙঘিয়েঘিয়েধোপাবাড়িতে দিলে ধুয়ে শাদা করে দিতে পারবে। ই কাপড় ভিজলে যি কি ভার হবেবোঝাই যেচে। জানি নাই গরম দ্যাশে কেমন করে ই কাপড় পরব। ত্যাকন কি আর জানিই কাপড়ও আর দু-দিন বাদে জুটবে না। বোধায় ছ-মাসও যায় নাইকত্তা এসে খবর বললে বাজারে কাপড় নাই। নাই তো নাইকুনো কাপড়ই নাইবিদ্যাশ থেকে কাপড় আনা হয় বন্ধনাহয় খুব কম। দিশি মিল-কারখানাগুলিনও কাজ করছে না। কুনো সুতো পায় না বলে গাঁয়ে গায়ে তাতিরাও সব তাঁত বন্ধ করে থুতনিতে হেঁটো দিয়ে বসে আছে

উসবই কি যুদ্বুর লেগেকবে যুদ্ধ শুরু হয়েছেতিন বছর পেরিয়ে যেতে চলল। আর এতদিন বাদে পরনের কাপড় অমিল হবে?

কাপড় বেশ কিছুদিন থেকেই অমিলকত্তা বললেমেয়েদের কাপড় তবু এতদিন পাওয়া যাচ্ছিলপুরুষদের জামা জোব্বা ফতুয়ার কাপড় অনেকদিন থেকেই টানাটানি। তা আমাদের এই গরম দেশে গরিব মানুষদের কজনই বা জামা পরেভদ্রলোকদেরও জামা-জুতো অতো না হলেও চলে যায়। কিন্তু মেয়েদের তো একটি শাড়িই সম্বল। যুদ্ধ কিদেশের মানুষ এবার বুঝবে। এখন তো শুধু কাপড় অমিল মনে হচ্ছে মানুষ কি তবে ন্যাংটো থাকবেএকটিমাত্র জিনিশের অভাব হলে কি হয় দ্যাখো! বাঁচতে মানুষের বেশি কিছু লাগে না। তবু দু-একটি যা লাগে তার অভাব হলেই ভয়ানক কাণ্ড! কাপড় নাইএর পর আর একটিই জিনিস যেমন ধরো ভাত নাইতখন কি হবে?

যুদ্বুর কুনোকিছু তো এখনো ই-দ্যাশে হয় নাই। তাইলে হঠাৎ হঠাৎ এক একটো জিনিশ ক্যানে নাই হবে?

গাঁয়ের টিউবওয়েল থেকে পানি পাচ্ছপ্রতিদিনবাড়ির রাখালটা পানি নিয়ে আসছেতাই তোএকদিন সে এসে বললেপানি নাই কলে। তুমি কি জানতেমাটির তলার যে পানি থেকে তুমি পানি পাচ্ছসেই পানি মাটির তলায় থাকবে যদি দূরের একটা নদীতে পানি থাকে। সেই নদীর পানি কবে শুকিয়ে গিয়েছেতুমি জানোও নাকিন্তু একদিন দেখলে টিউবওয়েলে আর পানি নাই। এখনকার যুদ্ধই এইরকমকিসের সাথে কিসের যোগ তুমি-আমি জানতেই পারি না। মাটি পাথর হচ্ছেকেউ জানে নাতারপর দেখবে একদিন তামাম মাঠই পাথর চাষবাস সব শেষ!

ঐ হেঁয়ালি কিছুই বোঝলম নাকিন্তু বেশিদিন গেল না ছ-মাস না যেতেই শোনলমচারিদিকে হাহাকার হচেকাপড় নাইমেয়েদের পরনে কিছুতেই কাপড় জুটছে না। কোথাকার মেয়েরা লিকিন কাপড়-বিহীন ন্যাংটো থাকছে। সে গাঁয়ে মেয়েরা দিনে তো কথাই নাইরেতেও বাপ-ভাইয়ের ছামনে বেরুইতে পারছে না। বেশি কথা আর কি বলবযা কুনোদিন ইসব দ্যাশে হয় নাইএইবার তা-ও হতে লাগল। বরাবর দেখছি রেতে শোবার সোমায় কেউ দুয়োরে খিল দেয় নাবড়জোর ঠেসিয়ে রাখে। আমাদের বাড়ির কথা আলেদা। অন্য সব বাড়িতেই আমকাঠের দরজাত্যাড়াকাএকটো দিক হয়তো ভাঙাহাঁসকল খুলে পড়ছেখিল আছে কি নাইদরজা তো লয়যেন দরজার ছল। ও-তে আবার খিল দেবে কেতার দরকারই বা কি?

এইবার খবর আসতে লাগল খুব কাপড় চুরি হচে। লতুন কাপড় লয়পুরনো কাপড়ই চুরি হচে। সোয়ামি-স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে শুয়ে আছেভাঙা দুয়োরটো ঠেসানোসকালে ঘুম থেকে উঠে দেখছে। বউটির পরনের একটি কাপড় কে নিয়ে গেয়েছে। দুটোর বেশি কাপড় ই দ্যাশে কারই বা থাকেবড়লোকের বাড়ির বউ-ঝিদের দু-একটো তোলা-শাড়িবিয়ের বেনারসি কাপড় ইসব তোরঙ্গে ভোলা থাকে। সিসব লয়ঐ গরিব বউ মানুষটিরই দুটি শাড়ির একটিকিংবা একমাত্র শাড়িটি চোরে নিয়ে গেয়েছে। ভিজে কাপড় অ্যানেক-সোমায় বাইরে এগনেতেই দড়ি কিংবা তারে শুকোতে দেওয়া থাকেএতকাল তা-ই থাকত। অ্যাকন আর তা কেউ করে না। ঘর থেকেই কাপড় চলে যেচে। এত দুঃখের মদ্যে বলতে হাসিও লাগেএকপাড়ার বউয়ের কাপড় ভিনপাড়ার বউয়ের পরনে লিকিন দেখা গেয়েছে। ই বেপারে হিঁদু-মোসলমান বাছাবাছি নাই। কাপড়ের টানাটানি সবারই। কাপড় লাগবে সবারই। বোঝাই যেচেকাপড় যারা চুরি করছে তারা চোর লয় বরঞ্চ আসল চোরই অ্যাকন চুরি করা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তুক তা বললে হবে ক্যানেআমাদের সেবোর মায়ের কাপড় অমুকের বউয়ের পরনে দেখা যেচে যি!

এমনি কথা বলে বাড়ির পুরুষ মরদটো যেচে সেই বাড়িতে। এক রঙের কাপড় হয় নাতোমার বউয়ের শাড়ির মতুন রঙ কি দুনিয়ায় আর একটোও নাইকারুর কাপড়ে কি নাম লিখে দিয়েছে কোম্পানি?

আমাদের সেবোর মায়ের শাড়ির এককোণে পাকা জামের রঙ লেগেছিল। এই দ্যাখো সেই কষ

ক্যানেজামের কষ কি আমাদের বাড়ির গোঁদানির মায়ের শাড়িতে লাগতে পারে না?

এইসব কথা নিয়ে মরদে-মরদেবউয়ে-বউয়ে সি কি তুলকালাম ঝগড়ামারামারি!

এমনি য্যান আবস্তাত্যাকন একদিন শোনলমছায়রাতুনবিবির লাতিনি মেয়েটি এখনো বিয়ে হয় নাইসোমত্ত মেয়ে সেই মেয়ে ন্যাংটো হয়ে ঘরে বসে আছে। ছায়রাতুন বুড়ি ক্যানে বেঁচে আছে কেউ বলতে পারবে নাসোয়ামি-পুত্তুর-ভাই-বেরাদর কেউ নাই তার। সব পুড়িয়ে খেয়েছেশুদু ঐ লাতিনটো আছে। বোধায় ঐ লাতিনটোর লেগেই বেঁচে আছে। তাদের মতুন তাদের ভিটেটোও বেআব্রু। একটোই মাটির কুটুরি। ভিটেঘেরা মাটির দেয়াল এককালে ছিলএখনো তার কিছু কিছু চেহ্নত আছেএই পয্যন্ত। ঘরটোর দেয়ালও জায়গায় জায়গায় ভাঙাদরজার বালাই নাইএকটো ছেড়া চট টাঙানো থাকেচোরে সিটি নেয় নাইভাগ্যিস নেয় নাই। পায়খানা-পেশাব করতে ঐ চটটো পিদে লাতিনি বাইরে আসে। বুড়ি লিকিনি বলেছেনিজের শাড়িটি লাতিনিকে দিয়ে সে ন্যাংটো হয়ে বাড়িতে কাজ করবেন্যাংটো হয়ে গাঁয়ের রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে। সে কি অ্যাকন আর মেয়েমানুষ যি লাজ-শরম থাকবেউসব ধুয়ে-মুছে খেয়ে নিয়েছে সে। সে ন্যাংটোই ঘুরবে। বলেছেদেখি গাঁয়ের লোকে কি করে! সিদিন রাতে খেতে বললে কত্তা এমন করে হাত নাড়লে যি আর একবার বলতে সাওস হলো না। গা-মাথা মোটা একটা কাপড় চাপা দিয়ে শুয়ে থাকলে

 

আবার অ্যানেকদিন বাদে বাপের বাড়ি

তা অ্যানেকদিন বাদেই বটে! আগের মতুন আর আনন্দ হয় না। বাপজি মারা গেয়েছে বছর চারেক হলো! অসুখের খবর লয়আমি একেবারে মরার খবরই পেয়েছেলম। কষ্ট কিছু হয় নাই তার। মুখ দিয়ে রক্ত উঠেছিল। ই রোগের নাম লিকিনি সন্ন্যাস রোগ। ওষুধ-পানি আর করতে হয় নাইডাক্তারও ডাকতে হয় নাই। খানিকক্ষণের মধ্যেই সব শ্যাষ

তা সোংসারের ইতর-বিশেষ আর কি হবেবৈমাত্র ভাইটি বেশ জোয়ান হয়ে উঠেছে। তিন বুনের একটোরও অবশ্যি বিয়ে হয় নাই। জানিউসব আবার কত্তাকেই করতে হবে। বাপজির তেমন বয়েস। হয় নাইআরও অনেকদিন বাঁচার বয়েস ছিল। আত্মীয়-কুটুম সবাই এয়েছিল। খবর পেয়ে আমি তো অ্যালমই। এক দিন থেকে আবার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গ্যালম। সোংসারে অসুবিধা তেমন কিছু নাই। বাপজি ভালোই রেখে-থুয়ে গেয়েছে। ভাই যেদি উড়িয়ে-পুড়িয়ে না দিয়ে এট্টু দেখেশুনে রাখেতাইলে সোংসার ভালোই চলবে

যাই হোকচার বছর আমার বাপের বাড়ি আসা হয় নাই। অ্যাকনকার বড় খোঁকা আর আমার সাথে আসতে চায় না। বড় হয়ে গেয়েছেনিজের পড়া নিয়ে বেস্ত। মেয়ে আর চার বছরের খোঁকাটি নিয়ে আমি ইবার বাপের বাড়ি যেচি। ইবার অন্য রকম ভালো লাগছে। আগে মোষের গাড়ি করে ধু ধু তেপান্তর মাঠের ভেতর দিয়ে যেতম। অ্যাকন লতুন সড়ক হয়েছেসেই সড়ক ধরেই গাড়ি যেচে। সড়ক লতুন বটেতবে কাচা তোবর্ষাকালে একহাঁটু কাদা হয়েছিল। জায়গায় জায়গায় রাস্তা ভেঙে এমন এঁটেল কাদা হয়েছিল যি মোযই কাদায় ডুবে যেত। অ্যাকন এই চোত-বোশেখে সেই কাদা শুকিয়ে একহাঁটু করে ধুলো হয়েছে। কি ধুলোই না উড়ছেনিশ্বেস নিতে পারছি না

বাপের বাড়ি যেতে এক কোশ দ্যাড় কোশ যেয়ে এই সড়ক ছেড়ে আবার আগের মতুন মাঠে মাঠে যেতে হবে। বাদশাহি পাকা সড়ক দিয়ে যাওয়া যায় বটে তবে সি খুব ঘুরপথ। সিদিক দিয়ে কে যাবেমাঠে মাঠে যাওয়াই ভালো। গাঁয়ে যেতে শেষ এক কোশ আবার পাওয়া যায় পুরনো একটো পাকা সড়ক। এই সড়ক ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। আমাদের গাঁয়ের ভেতর দিয়ে গেয়েছেকতো দূর গেয়েছে জানি না। এই সড়কে গাড়ি উঠলেই আমার মনে হয়এই তো চলে এলম বাড়ি! মনে ত্যাকন খুব আনন্দ হয়। বাড়ির বউ আর বাড়ির মেয়ে বলে কথা! তফাত কতো! পাকা সড়কে উঠে আনন্দ ইবারও হছিলযেদিও আগের মতুন লয়। এট্টু বাদে সি খুশিটো-ও মাটি হয়ে গেল য্যান পেছনের গরুর গাড়িটো পাশ দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সোমায় গাড়োয়ান চেঁচিয়ে আমাদের গাড়োয়ানকে বললেমেলিটারি গাড়ি হলে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে মাঠে নেমে যেও কিন্তুকনাইলে তোমার গাড়ি ভেঙেচুরে মেলিটারি গাড়ি বেরিয়ে যাবে। মরলেনা বাঁচলেফিরে চেয়ে দেখবে না। এই বলে নিজের গাড়ি সে তাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল

আমি গাড়োয়ান ছোঁড়াটোকে বললমকি র্যাকিছু বুঝলিসে দাঁত বার করে হেসে বললেশুনেছেলম বটে ইদিকে কোথা মেলিটারি ঘাঁটি করেছে। দিন নাইরাত নাইউয়াদের গাড়ি যেচে আসছে। বলতে বলতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে কি দেখে বললেউই দ্যাখোমেলিটারি গাড়ি আসছে

এই রাস্তায় কুনোদিন তেমন গাড়ি-ঘোড়া দেখি নাই। বাস অবশ্যি চালু হয়েছে হালে। সকালে দোপরে সাঁঝবেলায় এই মাত্তর তিনটে বাস। রাস্তা সারাদিনই সুনসান থাকে। গাড়োয়ান ছোঁড়ার কথা শুনে আমি কি একটো বলতে গেলমআর তখুনি সেই মেলিটারি গাড়িটো এসে পড়ল। ধুলোর মদ্যে ছিল বলে এতক্ষণ দেখতে পাই নাইঅ্যাকন দেখলমএকটো ছোেট গাড়ি। পরে নাম জেনেছেলম এই গাড়িগুলিনকে জিপগাড়ি বলে। খাকিরঙ একটু দূরে গেলেই আর দেখতে পাওয়া যায় না। দেখতে দেখতে গাড়িটো আমাদের গাড়ির কাছে এসেই বাঁশি দিলে। সি বাঁশির আওয়াজ যেন কেমনগা-টো রি রি করে উঠলহাঁড়ি চাচার আওয়াজ যেমন হয় তেমনি। বাঁশি একবার দিলেদুবার দিলেযেন তর সইছে না। ত্যাতোক্ষণে গাড়োয়ান ছোঁড়া ভয়ের চোটে মোষদুটোকে ডাকিয়ে হুড়মুড় করে গাড়ি নিয়ে মাঠের মদ্যে নেমে গেয়েছে। যেমন করে গেল আর একটু হলেই গাড়ি উল্টিয়ে যেত। উদিকে জিপগাড়ি রিরিরিরি করে বাঁশি দিতে দিতে আমাদের পেরিয়ে গেল। এক লহমার মদ্যে দেখলমদুজনা না তিনজনা গোরা সোলজার বসে বসে হি হি করে হাসছে। মেয়েমানুষ দেখছেতা আবার বেপদে পড়া মেয়েমানুষহাসবেই তো। বাঁদরের পোঁদের মতুন লাল মুখগোরো ধপধপে বসে আছে এক একটো যেন পৰ্বত!

গাঁ যেতে এই এক কোশ পথটো আর যেন ফুরুইতে চায় না। ঐ গাড়িগুনো একটার পর একটো আসছেই। সয়রান থেকে আমাদের মোষের গাড়ি মাঠে নামাইতে সোমায় পাওয়াও যেচে না। মোযদুটো ভয় পেয়ে ছুটে নামতে যেয়ে গাড়ি উল্টিয়ে যাওয়ায় মতুন হচে আর রিরি করে বাঁশি বাজাইতে বাজাইতে জিপগাড়ি বেরিয়ে যেচে। একটো পেরুইচে তো আর একটো আসছেকারাল নাই। পেত্যেক গাড়িতে। একজন দুজনা করে সেই হুমদোমুখো গোরা সায়েব বসে আছে। কেউ হাসছেকেউ হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছেকেউ আমাদের বেপদ দেখে ভারি মজা পেয়ে খারাপ অঙ্গভঙ্গি করছে। এইরকম করে কতো গাড়ি যি গেলকতোবার যি মাঠে আমাদের গাড়ি নামাতে হলো তা আর হিশেব নাই। এই এক কোশ রাস্তা মনে হতে লাগল আর কুনোদিন শেষ হবে না। পেছু দিকে দূরে গাড়ি দেখলেই তরাস হতে লাগলএই ছোঁড়াগাড়ি নামা র্যা বলতে বলতে গাড়ি চলে আসছে বাঁশি বাজাইতে বাজাইতে। কাছে এসেও যি জোরে আসছিল তা একটুও কমাইছে না। বোঝাই যেচেআমাদের গাড়ি রাস্তা থেকে সরাইতে না পারলে সব ভেঙেচুরে ওপর দিয়েই চলে যাবেছেলেমেয়ে নিয়ে আমরা মরে থাকলেও ওরা একবার ফিরে তাকাবে না। পরের গাড়িটো হয়তো আমাদের লাশের ওপর দিয়েই চালিয়ে দেবে। অ্যাকন দেখছিশুধু গাড়োয়ানটোই লয়দূরে গাড়ি দেখলেই আমার ছেলেমেয়েদুটিও ভয়ে নীল হয়ে যেচে। একটো পার হচেনিশ্বেস ফেলছিআবার একটো আসছে। সি যি কি বিভীষিকা হয়েছিলকুনোদিন ভুলব না

শ্যাষ পয্যন্ত গাঁয়ে ঢোকার বাগদিপাড়ার ঢালটো এলে জানে যেন পানি এল। মনে করি নাই যি ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি পৌছুইতে পারব। ছোট ভাইটি বাড়িতেই ছিলতাকে ইসব কথা বলতেই বললেতোমরা জানো না বটে। তোমাদের উদিকে এখনো তো ইয়ারা যায় নাইজানবে কি করেইদিকে খুব উপদ্রব হচে। তিন কোশ দূরে সয়রানের পাশেই উােের বেরাট ড্যাঙায় মেলিটারিরা অ্যারোডম করেছে। ছারখার করে দিলে এলেকা। গরু-ছাগল-মুরগি এন্তার খেয়ে ছয়লাপ করে দিচে। এই হুজুগে কতো ব্যাবসাই করছে গাঁয়ের লোকেতা করুক। কিন্তুক শালারা জানে বাঁচতে দেবে বলে তো মনে হচে না। আজ তোমাদের গাড়ি ভেঙেচুরে দেয় নাই ভাগ্য ভালো। পিতিদিন রাস্তায় কতো বেদম যি উয়ারা ঘটাইচেকি বলব! গরু-মোষের গাড়ি একটো-দুটো তো পত্যেকদিন ভাঙছেইকত শেয়াল-কুকুর-ছাগলগরু-মোষ পেত্যেকদিন চাপা পড়ছে। শালাদের জানে দুখ-দরদ বলে কিছু নাইছামনে রাস্তায় কিছু যি দেখলিএট্টু আস্তে চালাতা লয়একটুও কমাবে না। গাড়ি নিয়ে মানুষ সরতে পারলে ভালোনাইলে সোজা এসে মেরে দেবে। তাইলে বলি শোনোসিদিন মারলে একটো গাড়িকেগাড়ি যেয়ে পড়ল রাস্তার পাশে গাবায়। একটো চাকা খুলে গড়িয়ে কুনদিকে চলে গেলযি মুনিষটো চালাইছিল সে-ও ছিটকে কোথা যেয়ে পড়ল। ইদিকে ডাইনের হেলে গরুটোযেটো গাড়ি টানছিলতার একটা পা ভেঙে সি ত্যাকন গাবায় পড়ে আছেতার গলায় লেগেছে গলান্দির দড়ির টুসি। জোয়াল উঠেছে আসমানেকিছুতেই গলান্দির দড়িটো আমি আলগা করতে পারলম নাগরুটোর চোখের দিষ্টি কি রক্ত বেরিয়ে এল গো চোখ দিয়ে! হাতে ছুরিকাটারি কিছু নাইদড়িটো কেটে দিতে পারলম না। গরুটো ছটফট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে শ্যাষে মরে গেল। জ্ঞান হয়ে মুনিষটোর কি কঁদন!

কথা শুনে ছোট বুনটি বললেখালি উ কথা লয়। উয়ারা লিকিনি অ্যাকন গাঁয়ে-ঘরে ঢুকছেযা মনে হচে তা-ই টেনে নিয়ে চলে যেচে। সিদিন তোমাদের বললম নাগা ধোব বলে ঘাটে গেয়েছিগা ধোয়া হয়ে গেয়েছেগামছাটো নিংডুতে নিংডুতে উঠে আসছিএমন সোমায় পেছু দিকে শিস দেবার আওয়াজ শুনে যেই ফিরে তাকিয়েছিদেখি এই একজনা লালমুখো সায়েব পুকুরের ওপারে দাঁড়িয়ে একটো ছবি তোলার কালো বাসো আমার দিকে তাক করে আছে। তাই দেখে আমি ছুটেমুটে বাড়ি এসে মাকে সব বললম। শুনে ভাই বললেকই আমি তো শুনি নাইখবরদার আর ঘাটে যাবি না

তাইলে ইবার কেরমে কেরমে যুদ্বু এসে বাড়ির মদ্যে ঢুকে যেচে। পেলেন তো অনেকদিন থেকেই দেখছি। পাখির মতুন ঝাকে ঝুঁকে আসছেযেচে। পেথম পেথম হাঁ করে আসমানের দিকে তাকিয়ে দেখতম। ত্যাকন আসতও অনেক কম। একটো-দুটো। গুড়গুড় করে আওয়াজ হতোম্যাঘের আওয়াজের মতুনই কিন্তুক ম্যাঘ তো লয়আকাশে ম্যাঘের বংশ নাইমাঘ ডাকার আওয়াজ আসবে কোতা থেকে! তাপর দেখতমআসমানের এক কোণ দিয়ে পাখির মতো উড়ে এল পেলেন। রোদে ঝকঝক করছেতাকিয়ে দেখতে গেলে চোখ ধাঁধিয়ে যেচে। পাখির মতুনই ড্যানা আছে বটে কিন্তুক সি ড্যানা থিরপেথম পেথম দেখে ভারি অবাক লেগেছিল। য্যাতো এগিয়ে আসছেগুড়গুড় আওয়াজ ত্যাতোই বাড়ছে। দেখতে দেখতে মাথার ওপর দিয়ে কোনাকুনি আকাশ পেরিয়ে মিলিয়ে গেল। কখনো একটোকখনো দুটো। দেখতে ওইটুকুনি লাগছে বটেশুনেছিআসলে ছোটখাটো একটো বাড়ির মতুন। কান-ফাটানো আওয়াজ করতে করতে মাথার একদম ওপর দিয়ে যাবার সোমায় দেখেছিসত্যি অত ছোট তো লয়,বেশ বড়

তা এই পেলেনও দেখছি অ্যাকন অ্যানেক আসছে আর য্যাখনত্যাখন আসছে। আজকাল আর খেয়ালও হয় না। একসাথে আট-দশটোও আসছেঅত খেয়াল করবে কেদিনের মধ্যে কতোবার যি আসছে যেচেকতরকম করে আসছেএকটোর পেছনে দুটোপাশাপাশি চারটোছামনে তিনটোপেছনে তিনটোডিগবাজি মারছেনিজের মনে কাজ করছিএকবার একবার তাকিয়ে দেখছিকি দেখছি তা-ও খেয়াল হচে না। অ্যাকন মনে হচেতাই তোযুদ্বুর গাড়িঘোড়ায় দ্যাশ যি ভরে গেল। আজ রাস্তায় য্যাতো গাড়ি দেখেছিমনে হচেতাইলে সারা দ্যাশে না জানি কতো গাড়ি এয়েছে আর তাদের সাথে কতো সায়েবকতো গোরা সেপাই ই দ্যাশে এয়েছে! যুদ্ধ এখন নাই কিন্তুক দ্যাশ ভরে গেয়েছে যুক্ষুর সরঞ্জামে। আমরা গাঁয়েগঞ্জে অত দেখতে পেচি নাশহর-নগর তাইলে নিচ্চয় ভত্তি হয়ে গেয়েছে। হঠাৎ ভয়ে আমার বুক হিম হয়ে গেল। এত সাজ-সরঞ্জামএত আয়োজন তবু যুন্ধুর তো কিছুই নাই অ্যাকন। তাইলে য্যাকন যুদ্ধ দ্যাশে আসবে ত্যাকন কি হবে?

আমার খোঁকা দেখছি উত্তর-দুয়োরি ঘরের উসারায় বসে হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। গুড়গুড় আওয়াজ হচে দখিন-পশ্চিম কোণে। দেখতে দেখতে আট-দশটা পেলেন এগিয়ে এল। কতো ভঙ্গি করছেদুটো এগিয়ে আসছেআবার পিছিয়ে যেচে আর খালি ডিগবাজি দিচেইসব কি খেলাখোঁকা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কি মনে হলোছেলেটোকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলম

সব যেন কেমন কেমন লাগছে। কবছর আসি নাই ঠিকতা বলে কিছুই তো বদলায় নাই। বুন তিনটো বড় হয়ে গেয়েছেতিনজনাই সোন্দরী একজনা যেন রাজরানী হবার লেগেই জন্মাইচেতার রূপ দেখে ভয় লাগে। আর একজনার মাজা মাজা রঙটানা টানা চোখকোমর পয্যন্ত লম্বা চুল আর ছোটটোর দিকে তাকাইলে চোখ বেঁধে যায়পাড়াগাঁয়ে এত রূপকি করে যে কি হবে! আজকাল আবার মেলিটারিরা সব গাঁয়ে ঢুকতে শুরু করেছে

রাতটো ক্যানে যি এতো অসোয়াস্তিতে কাটল জানি না। নতুন মায়ের সাথে পিতিবার কতো কথা হয়,ইবার কথা খালি কেটে কেটে যেচে। বড় হয়েছে বলে কি না জানি নাবুনরাও যেন কি কথা বলবে খুঁজে পেচে না। মনে হলোঅনেকদিন পরে আসা হয়েছে তোতাই এরকম হচেদু-একদিন বাদে আবার সব আগের মতুন হয়ে যাবে। এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিসকালে ঘুম ভেঙে উঠে দেখিবেলা অনেকটাই হয়েছে। অন্য অন্য বার আমি বাড়ি এসে পৌঁছুলেই গাঁয়ের মেয়ে-পুরুষ অনেকেই বাড়িতে দেখা করতে আসেকতো গপ্পো-গুজব করে। ইবার আর তেমন কেউ আসে নাই। তাই আমি ভাবলম,হাত-মুখ ধুয়ে আমি বরঞ্চ একবার পাড়াটো ঘুরে আসি। গাঁয়েরই মেয়ে তো আমি!

এইবার যাবএইবার যাব করছিএমন সোমায় খবর এলমীরপাড়ার ওলি মামুর ভোরবেলা থেকে ভেদবমি অরম্ব হয়েছে। শুনে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। স্বপনেও ভাবি নাইছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি আসব আর এই মহামারী রোগ ই-গাঁয়ে অরম্ব হয়ে যাবে। দু-বছর তিন বছর বাদে বাদে ই রোগদুটি ভালো কথায় বলে কলেরা আর বসন্তলোকে এমনি বলে পেট-নামা নামুনে আর মা-শেতলার দয়াএই রোগটি আসবেইকেউ ঠেকাইতে পারবে না। আর যি বছর আসবে গাঁ-কে গা একদম উজাড় হয়ে যাবে। গেল দু-তিন বছর ক্যানে জানি না ভুলে ছিল আর অ্যাকন অরম্ব হবি তো হ আমার বাপের বাড়ির গাঁয়েই শুরু হয়ে গেল। এই সকালবেলাতেই ওলি মামুর খবর প্যালম। সোমায় তো বেশি নেবে নাহয়তো বৈকালবেলাতেই শুনব ওলি মামু আর নাই। শুনে অবদি নিজের কথা ভাবছি না কিন্তুক ছেলেমেয়ে কারুর যেদি কিছু হয়তাইলে কত্তার কাছে কি জবাব দেবএই জায়গায় কত্তার কাছে কুনো মাপ নাই। কেন তুমি সাথে সাথে ফিরে এলে নাযা হবে আমার চোখের সামনে হবে। আর কুনো কথা সি শুনবে না। মাকে বললমও মাআমার যি খুব খিদিবিদি লাগছে। এই কথা শোনবার পর থেকে আমি যি কিছুতেই থির থাকতে পারছি না। মায়ের বুদ্ধি যি কি ঠান্ডাআমার কথা শুনে বললেমাছেলেমেয়ে নিয়ে তুমি কালই বাড়ি ফিরে যাও। যার ধন তার কাছে যাও। এই কথা আমিও ভাবছি। দিন ভালো হলে আবার আসবে। তোমার ভাইকে বলছিকালই দিয়ে আসুক তোমাদের

চলে যাব শুনে বুনরা কাঁদতে লাগল। সারাবছর তারা বসে থাকে। কখনো বছরের পর বছর এন্তেজার করে থাকে কবে তাদের বুনপো-বুঝি আসবে। তাদের নিয়ে কি কি করবে তারা খুঁজে পায় না। আর ইবারে আজ এসে কাল তাদের যেতে হবে!

বৈকালের মদ্যেই খবর পাওয়া গেলমীরপাড়ায় আরও দু-তিনজনার পেট নেমেছে। রোগটি ওলাউটোইআর কিছু নয়। মুন্সিপাড়াতেও একজনার শুরু হয়েছে। যে ইসব খবর আনতে গেয়েছিল সে আমার এক বুন। কথায় কথায় বলেছেমাহামারীর খবর পেয়ে বড় বুবু ছেলেমেয়ে নিয়ে কালই আবার শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাবে। তাই শুনে সি পাড়ার এক বাঁজা-বউ বলেছেওলাউটোর কথা শুনে পালাইচে তোর বুন! ছেলেপিলে যেন আর লোকের নাই! যোম যেদি একবার চেনেযেখানেই যাওপেচু পেচু যেয়ে ধরবে

ছি ছিএমন কথা কেউ বলে! কথাটো শুনে কি দুঃখ যি হলো! জান আর জানে থাকছে না! দুনিয়ার সব্বারই বুকের ধন ভালো থাকুকছি ছিই কি কথা! আমার ছোট বুনটো ভারি রাগীভারি তেজি। সে বললেএকুনি সে মুন্সিপাড়ায় যাবে ঝগড়া করতে। বহু কষ্টে তাকে সামলালম

তিমি-সাঁঝবেলাতেই খবর পাওয়া গেলওলি মামু আর নাই

 

গিন্নি বিছেনা নিলেআর উঠলে না

বাড়ি ফিরে অ্যালম কিন্তুক এক দিন পরেই ক্যানে অ্যালম সি কথা কাউকেই বলতে চাই নাই। ননদ একবার শুদুইলে বটেমেতর-বউদু-দিন থাকতে গেলেকতদিন যাও নাই বাপের বাড়িতা একদিন বাদেই ফিরে এলে ক্যানেননদ শুদুইলে বটে কিন্তুক গিন্নি লয়। ঐ মানুষ কি সব বুঝতে পারতআমি আর থাকতে না পেরে নিজে থেকেই বলে ফেললম সব কথা শুনে গিন্নি বললেভয় কি মেতরবউআল্লার দুনিয়ায় সব জায়গাই সোমান। তা বেশ করেছছেলেমেয়ে নিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে এয়েছ। কত্তাও শুনে তেমন কিছু বললে নাখানিক চুপ করে থেকে শুদু বললেভয় পেয়ে কি কিছু হয়সাবধান হওয়া দরকার

ঠিক কথা। হিঁদুদের মা-শেতলা লিকিন যোবতী নারীগাঁয়ে তার পুজো হয়। তাইলেও সি কি কথা শোনে! আর মোসলমানদের ওলাবুড়ি নিজের নোংরা কাপড়ের পুঁটুলিটো নিয়ে গুটগুট করে মাঠ-ঘাট পেরিয়ে হেঁটে আসবেঐ কুঁজো বুড়িকে এক লহমার লেগে কেউ থামাইতে পারবে না। আসতে অনেক সোমায় লাগতে পারেমনে হবে বুড়ির পা বুঝি ভেঙে পড়ছেএইবার বুড়ি মাঠের মদ্যে মরা শুকনো কাঁকড়ার খোলের মতুন পড়ে থাকবে। তা লয়সে ঠিক এসে ঢুকবে গাঁয়ে। এবার এমন রোদএমন গরমএক দিনও বিষ্টি হয় নাইআমের বোলগুনো সব শুকিয়ে গেয়েছেবড় বড়। পুকুরের পানি শুকিয়ে খালি কাদাপানি আছে। মারী-মড়ক এলে ওমনিই হয়

একদিন বাদেই ডোমপাড়ায় দু-একজনার নামুনির খবর পাওয়া গেলতাপর দু-দিন কি তিনদিন পেরোয় নাইসারা গায়ে লাউটো ছড়িয়ে পড়ল। অ্যানেক রোগের মতুন ই রোগেরও চিকিচ্ছের কুনো বালাই নাই। তা সোমায় নেবে নাভাবতে দেবে নাশোক করতেও দেবে না। এক বাড়িতে একজনা মরলতার দাফন-কাফন হতে না হতে আর-একজনা মরল। পাশাপাশি বাপ আর ব্যাটার লাশনাইলে মা আর মেয়েনাহয় দু-বুনদু-ভাইএমন আবস্তাদাফন-কাফন করবে কেকবর খুঁড়বে কেহিঁদুদের মড়া হলে পাঁচ কোশ দূরের শ্মশানে পোড়াইতে নিয়ে যাবে কেসোমায় কি করে পাওয়া যাবেভাররেতে ভেদবমি অরম্ব হলোদিনটোও গেল নাসাঁঝের আগেই শ্যাষ। পানির মতুন দাস্ত হচেআর চাল ধোয়া শাদা পানির মতুন বমি হচেএকবার থামাথামি নাই। যাতে ভেদবমি হচেরুগির ত্যাতো লাগছে পিয়াসউঃ সি কি পিয়াসদুনিয়ার পানি এক চুমুকে শ্যাষ করবে। এমনি করে করে দোপরের পর থেকেই নেতিয়ে পড়বেজেরবার হয়ে যাবেহাত-পায়ের আঙুলে খাল লাগবে। চিকিচ্ছে-মিকিচ্ছে বাদ দিয়ে ত্যাকন একটোই কাজমওত আসার আগে পয্যন্ত কি করে রুগিকে এট্টু আরাম দেওয়া যায়। একজনা পাখা করেবাতাস দেয়আর-একজন হাতের পায়ের আঙুল টেনে টেনে সোজা করে। শ্যাষকালে রুগির গাল বসে যায়চোখ কোটরে ঢুকে যায়রুগি চোখে দেখতে পায় নাতারপর সুয্যিও ডোবে রুগিও চোখ বোজে

চার-পাঁচ দিনের মদ্যে বাগদিপাড়ামুচিপাড়াবাউরিপাড়া পেরিয়ে এসে বামুনপাড়াআগুরিপাড়াতিলিপাড়ায় ঢুকে পড়ল ওলাউটো। মোসলমান পাড়াতেও ঢুকলেতবে এট্টু দেরিতে। সি যি কি হতে লাগলউরি বাপরে! পেত্যেকদিন একটো-দুটো-তিনটো করে যেতে লাগল। তাইলে কি কেউ বাঁচবে নাআমি ক্যানে বাপের বাড়ি থেকে ছেলেমেয়ে নিয়ে পালিয়ে অ্যালমবাঁজা-বউটির কথাই সত্যিযোম পেচু পেচুই আসেযাকে চেনে তাকে ধরে-বেঁদেই নিয়ে যায়। এই বেপদে কত্তার মাথা কিন্তুক একইরকম ঠান্ডা। সে বাড়ির ভেতরে এসে বললেমাকেউ যেন না-ফুটনো পানি খায় না। এ রোগ মাছিতে আনেখাবারের ভেতর দিয়ে আসে। খাবারের ভেতর দিয়ে না গেলে কিছুতেই এ রোগ হবে না। না-ফুটনো পানি এক ফোঁটা কেউ খাবে নাবাড়ির বাইরে কেউ কিছু খাবে নাসব খাবার ঢাকা দিয়ে রাখো। বাসি আর ঠান্ডা খাবার সব ফেলে দাও

কত্তা যা যা বললে গিন্নি ঠিক ঠিক তা-ই করলে। বাড়ির কারুর সাধ্যি হলো না যি তার একটি কথা অমান্যি করে। গাঁয়ের ভেতরে পাড়ায় পাড়ায় যেয়ে কত্তা এই কথা সবাইকে বললে বটে কিন্তুক কে শোনে কার কথাআর শোনা কি সোজা কথাকে অত জ্বালট জোগাড় করবে আর পানি ফুটোবেএটুখানিক পানিতে আর কি হবেটিউকলের পানিপোস্কারই তো রয়েছেঐ খেলে আর কি হবে এই মনে করে লোকে পানি খেচে। আ-ঢাকা ঠান্ডা খাবার তো আখছার খেচে। খাবার কি শস্তাফেলে দেবে ক্যানেখেয়ে ফেলছে। কিন্তুক ই বাড়িতে কত্তা এমুনি করলে যি উসব করার কুনো উপয় থাকল না

দশ-পনেরো দিনের মদ্যে গাঁয়ের অনেক লোক মরল। হাড়িপাড়া বাগদিপাড়া মুচিপাড়ায় বেশিভালো হিঁদুপাড়াতেও অনেকে গেল। মোসমলানপাড়া থেকেও চার-পাঁচজনা দুনিয়ার মায়া কাটাইলে। দু-হপ্তা বাদে একদিন খবর পাওয়া গেলহারামজাদি বুড়ি ওলাবিবি কাপড়ের পুঁটুলি নিয়ে ঠিক বুঝকিবেলায় পুব-দখিন কোনাকুনি মাঠ পাড়ি দিয়েছে। বঁটা মারআবার কুন গাঁয়ে ঢুকে গাঁ উজাড় করবে কে জানে! এই কদিন মুসিবতের শেষ ছিল নাকেমন করে দিন যেছিলকেমন করে রাঁদা-খাওয়া হছিলসি আর কি বলব! ছেলেমেয়ে খেলা ভুলে গেয়েছিলখাওয়া ভুলে গেয়েছিলঘুমননা ভুলে গেয়েছিল। আমরা মায়েরা তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকিইয়াদের মদ্যে কেউ কি যাবেতার এ যেন আমি যাইএইরকম বুকবুকুনি করে দিন গেয়েছেরাত গেয়েছে। কুনোদিকে মন ছিল না

বুড়ি মাগি গাঁ ছেড়ে গেলে অ্যাকন মানুষের খেয়াল হবে গাঁয়ের ই কি দশা হয়েছে! পেঁদনের কাপড় মিলছিল না তো অ্যানেকদিন থেকেই। বউ-ঝিরা আর কেউ কারুর বাড়িতে আসে নাবাড়িতেই থাকে। খুব দরকারেও পাড়ার রাস্তায় আসে না। পরনের কাপড়ের এমনি দশা যি আর আর বাড়িতে বেড়াইতে যাবে কিএকবার রাস্তায় বেরুবে কিবাড়ির মদ্যে বাপ-ভাইদের ছামুতে বেরুতেই শরম লাগে। দিনের বেলাতেই কারুর গলা শোনা যায় না আর রাত লাগলে তো কথাই নাই। খেলাধুলোও বন্ধসাঁঝবেলাতেই নিঝুম রাত। কোথাও কুনো সাড়াশব্দ নাই। গাঁ যেন আঁদার কো-কাপকুনো বাড়িতে একটি আলো দেখা যায় না। কেরাসিন একদম গরমিল। মাথা খুঁড়লেও একটি ফোঁটা কেরাসিন পাবার উপয় নাই। গাঁয়ে দুটি মুদির দোকান আছে দুটিই বন্ধ। কি বেচবে তারাদোকানে কিছুই নাই-নুন নাইতেল নাইচাল নাইআস্তে আস্তে সব গরমিল হতে লেগেছে

আমাদের বাড়িতে দুটো হেরিকেন ছিল। একটো-কে ঘিরে ছেলেমেয়েরা সবাই গোল হয়ে বসে শোরগোল করে পড়ত আর একটো কত্তার ঘরে দিয়ে আসা হতো। সেই হেরিকেন দুটো অ্যাকন কেরাসিন বিহনে জ্বালানো হচে না। ভাগ্য ভালোদিঘির ঢালু ঘেসো পাড়টোতে রেড়িগাছ লাগানো হয়েছিলখুব রেডি হয়েছে! সেই রেড়ি ঘানিতে ভাঙিয়ে রেড়ির তেল পাওয়া গেয়েছে অনেক। তাই দিয়ে পিদিম জ্বালানো হচে। একগাদা মাটির ছোট ছোট পিদিম কেনা হয়েছে। আর কেনা হয়েছে চারদিকে চারটো মোটা কাচ লাগানো লণ্ঠন। পিদিম জ্বালিয়ে ঐ লণ্ঠনের মদ্যে রেখে হেরিকেনের কাজ চালানো হচে। রেড়ির তেলে চুবনো ত্যানার পলতেয় পিদিমে আর কতোটুকুন আলো হবেঘরের এক কোণে কুনোমতে মিটমিট করে জ্বলে। লণ্ঠনের ভেতর রাখলে আলো একটু বেশি হয়একটু বাতাসেই নেবে না। ঐ আলোতেই ছেলেমেয়েরা পড়া পড়ছে

এমন করে আর কততকালএকদিন রেতে কত্তাকে বললম

যুদ্ধ কি এইবার একটু একটু বুঝতে পারছ তোপ্রথমে দেখলে মানুষের পরনের কাপড় নাই। এখন দেখছ একটি-একটি করে জিনিশ গরমিল হচ্ছেনুন নাইকেরোসিন নাইচিনি নাই। তার মানে গাঁয়েগঞ্জে যা যা তৈরি হয় নাতৈরি করতে পারা যায় নাতাই তাই নাই। যা কিছু বাইরে থেকে আসততা আর এখন পাওয়া যাবে না। জমিতে চাষ-বাস করে চাল ডাল তেল এইসব পেয়েছি বলে ততো অভাব মালুম হচ্ছে নাসব জিনিস যদি নিজেদের না থাকতযদি কিনে খেতে হতো তখুনি বুঝতে পারা যেত যুদ্ধতে কি হয়

তাইলে শহরের মানুষদের আবস্তা কি?

তাদের তেল নুন চিনি কেরোসিন তো বটেইচাল ডালও কিনে খেতে হয়। শহরের লোকদের খেতে হচ্ছে বিদেশ থেকে আনা মোটা চাল। আমরা গাঁয়ে ভালোই আছি

আমি কত্তাকে সেই বাপের বাড়ি যাওয়ার গঞ্জনার কথা বললম

আমি জানিখবরের কাগজে পড়িমাঝে মাঝে শহরে যাইদেশে এখন আর দেশের লোক নাইবিদেশীতে দেশ ভরে গিয়েছে। গোরা সেপাইতেবিদেশী গাড়িতেউড়োজাহাজেকামান-বন্দুক গোলাবারুদেকোনো জায়গা আর বাদ নাই। শহরগঞ্জের পথঘাটট্রেন-বাস সব জায়গায় ওরা। ওদের যা লাগবে তাই জোগাতে হবে। ফলমূলহাঁস-মুরগি গরু-ছাগল সব ওদের জুগিয়ে দিতে হবে। ট্রেনে বাসে ওদের পয়সা লাগবে না। সব ওদের দিতে হবে। মেয়েমানুষ পর্যন্ত বাদ নাই। না দিলে কেড়ে নেবে। ওরা যা খুশি তা-ই করবেকোনো বিচার-আচার হবে না। যেখানে-সেখানে দেশের মানুষদের ওরা লাথি মারছেডান্ডা মারছেমেরেও ফেলছেকিছুই বিচার নাই। খুব খারাপ দিন আসছে। সারা দুনিয়ায় এই যুদ্ধপশ্চিম দুনিয়ায় এখন থমকে আছেযুদ্ধ এখন পুবের দুনিয়ায়। কিছুই থাকবে নাসব মিশমার হয়ে যাবে। ফসলভরা একটা মাঠে পঙ্গপাল বসলে কি হয় দেখেছচার-পাঁচদিন পরে যখন দলটা চলে যায় তখন মাঠে শুকনো খটখটে শাদা মাটি ছাড়া আর কিছুই থাকে না। একটা ঘাসও আর দেখতে পাওয়া যায় না। এই যুদ্ধ শেষ হলে ঠিক তা-ই হবেএকটা ঘাসের ডগাও পড়ে থাকবে না সব বিরান মরুভূমি হয়ে যাবে

এত ভেবে আর কি করবযা হয় হবে। এবার আকাশের আবস্তাও খারাপ। ই কি খরানি! দু-মাস ধরে একটি ফোটা বিষ্টি নাই। কোথাও কুনো ঘেঁয়া নাই। সারা গাঁ উদোম খোলা পড়ে আছে। বড়-ছোট কুনো গাছে পাতা নাইভয়ে সব যেন কাঠি হয়ে গেয়েছে

একদিন দোপরের খানিক আগে সব্বোনাশ হলো। উঠনে ধান মেলে দেওয়া ছিলগিন্নি সেই ধান নাড়াতে যেয়ে হোঁচট খেয়েনাকি এমনি এমনিপড়ে গেল। আমরা ছুটে তাকে তুলতে গ্যালম। হালকা মানুষবয়েস হয়েছেশরীর শুকিয়ে গেয়েছেতুলতে কষ্ট হলো না আমাদের। কিন্তুক গিন্নিকে হাঁটাতে যেয়ে দেখলম গিন্নি হাঁটতে পারছে না। খুব জোরে আঘাত লেগেছে কিম্বা কোথাও কিছু ভেঙেছে বলেও মনে হলো না। ইদিকে দেখছি গোটা ডান পা আর ডান হাত লাঠির মতুন সোজা হয়ে রয়েছে। গিন্নি কথাও কিছু বলছে না। ত্যাকন ভালো করে তাকিয়ে দেখিমুখের চারদিকটো কেমন বেঁকে রয়েছে। এই দেখে আর কুনো কথা না বলে আমরা ধরাধরি করে গিন্নিকে নিয়ে উত্তর-দুয়োরি ঘরের মেঝেয় বিছেনা পেতে শুইয়ে দেলম

সেই যি শয্যে নিলে গিন্নিআর উঠলে না। ডান দিকটোশরীলের পেরায় আধেকএকবারেই অবশ। হাতও নড়ে নাপা-ও নড়ে না। এত চেষ্টা করে গিন্নি কথা বলতে। তা মুখের বাঁ দিকটো এক-আধটু নড়াচড়া করছে বটে কিন্তুক ডান দিকটো থির। মুখ দিয়ে শব্দ হচে কিন্তুক একটি কথাও বোঝা যেচে না

খবর পেয়ে কত্তা এলঅন্য সব ভাইরা এলছোট দ্যাওরকে খবর দেওয়ার লেগে শহরে লোক গেলগাঁয়ের ডাক্তারটোও তখুন-তখুনি এল। সে বললেআবস্তা খারাপ। ই রোগের নাম সন্ন্যাস রোগ। ই রোগেই বাপজি মরেছিল। মাথার শিরে ছিড়ে যায়মাথার ভেতরে শরীলের সব রক্ত জমা হয়ে দইয়ের মতুন থকথকে হয়ে যায় তারপর দু-একদিনের মদ্যে রুগি মারা যায়। চোখে অন্ধকার দেখলম। তাইলে আর আমাদের গিন্নির হেয়াৎ নাইগিন্নি ব্যাগোরে ই সোংসার একদিনও চলবে নাকেউ চালাতে পারবে না। আমি বউ হয়ে এসে মাকে মাশাশুড়িকে শাশুড়ি একসাথে পেয়েছেলম। একদিনের লেগে ভাবি নাইআমার কুনো দায় আছে। বুঝেছেলম যি শুদু হুকুম শুনলেই হবে। অ্যাকন কে হুকুম দেবেকার হুকুম শুনবএই কাঠির মতুন ফরশা রোগা এতটুকুন মানুষ শুয়ে আছেউ কুন ধাতুতে তৈরি তা কেউ না জানলেও আমি জানি। ঐ শুকনো পাথরে কতো পানিকতো মায়াকতো দয়া-আমি হুহু করে কেঁদে ফেললম। তাই শুনে কত্তা এমন করে আমার দিকে চাইলে যিকাঁদন সাথে সাথে গিলে নিতে হলো। কত্তা বললেকিছু হয় নাইরোদে মাথা ঘুরে গিয়েছেদুর্বল শরীরতাই পড়ে গিয়েছেদু-দিন বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে

বড় খোঁকাকে দেখার লেগে যি ডাক্তার এয়েছিল শহর থেকেসেই ডাক্তার আবার এল। রুগি দেখে ডাক্তার বললেশিরা ছেড়ে নাইতাইলে বাঁচত না। মাথার ভেতর শিরা দিয়ে রক্ত যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেয়েছে বলে রক্ত জমে গেয়েছে। তখন-তখুনি য্যাকন রুগি মারা যায় নাইআর ভয় নাইরুগি এখুনি মারা যাবে না। ওষুধ খেতে হবেরুগিকে খুব যত্নের মদ্যে রাখতে হবেখাবার পথ্য যা যা লিখে দেওয়া হবে ঠিক তাই তাই খাওয়াতে হবে। আশা দিয়ে ডাক্তার বললে অবশ ভাবটা আস্তে আস্তে কেটে যাবেকথা হয়তো দু-চার দিনের মধ্যেই বলতে পারবে। এখুনি হাঁটতে পারবে না। তবে আস্তে আস্তে আবার হাঁটার ক্ষমতা ফিরে আসতেও পারে

ডাক্তারের কাছ থেকে সব বুঝে নিয়ে কত্ত আমাদের বউ-ঝিদের সবাইকে ডাকলেভাশুর হয়েও সব ভাজ-বউদেরও ডাকলেডেকে বললেমায়ের সামনেই বলছিশাশুড়ি তার কথা শুনতে বা বুঝতে পারলে কিনাজানি না একদিষ্টে তাকিয়ে ছিল দেখলমতা কত্তা বললেআমার কাছে দুনিয়া একদিকে আর আমার মা একদিকে কাজ সব ভাগ করে নাওকে কি করবে। পায়খানা-পেশাব থেকে শুরু করে সব কাজই করতে হবে। আমার দিকে চেয়ে এই পেথম সবার ছামনে আমাকে বললেএই কাজটা তুমি নিজের হাতে করবে। তাপর বুনের দিকে চেয়ে বললেমহুদা সবারই কাজ দেখবে। মোট কথারুগির যদি এতটুকু অযত্ন হয়মায়ের কাছ থেকে যদি কিছু জানিতাহলে যে-ই হোকতার কোনো খাতির নাইএ বাড়িতে তার জায়গা হবে না

আমরা সবাই জানিকত্তার কথার একটুকুন ইদিক-উদিক হবে না। গিন্নির সেবা এগুতা-বাদে অন্য কিছু। ঘরের আর আর জিনিস সরিয়ে ফেলা হলো। শুদু সিন্দুকটো থাকলতার ওপর পোঙ্কার বিছেনা আর রুগির যা যা লাগে সব রাখা হলো। মাথার দিকে ওষুধ-পত্তর আর ফলমূল পথ্য এইসব। কত্তা মুটের মাথায় চাপিয়ে মায়ের লেগে কতো জিনিস যি আনলে! ডাবের পাহাড় হলোবাজার ঘুরে ঘুরে বেদানানাশপাতিখেজুরকলাআমলিচু সব কিনেছে সেকিছু বাদ নাই। এত আক্রা-মাগনের দিনে পয়সা পেচে কোথা— একদিন এই কথা শুদুলে কি রাগ কত্তা

তাতে তোমার কি দরকারবাড়িতে কি ধান-চাল কিছুই নাই! এক শো বিঘে জমি আছে কিসের জন্যে?সব বেচে ভিখিরি হবযাও

ওরে বাপরে! আর একটি কথাও বলা নয়। উ মানুষের এমন রূপ কুনোদিন দেখি নাই। তা আমি কিছু বারণ করেছিআমাকে অত কথা বলার দরকার আছেগিন্নির সেবার লেগে আমাকে বলতে হবে ক্যানেঐ মানুষ আমার মায়ের বেশিবাপের বেশিই সোংসারের মুদুনি। মুদুনি ভাঙলে কি আর ঘর থাকেকত্তা যি বুনকেই সব দেখতে বলেছে তার কারণ আছে। আমি জানিগিন্নি গেলে ননদই লতুন গিন্নি হবে। ঐ মায়েরই তো মেয়েভাইদের সোংসারের হাল সে ঠিকই ধরতে পারবে। গিন্নির সেবা-যত্নের খবরদারি করা তারই কাজ বটে! তবে সেবা-শুশুষার সব কাজ আমাদের বউদেরই করতে হবে। বড় বউয়ের ছেলেপুলে হয় নাইকাজকম্ম সবই করে বটে কিন্তু একটু আলগা আলগাকুনো কিছুতেই তেমন আঁট নাইনিজের ওপরেও যত্ন নাইকোথাও তার কুনো বাঁধন পড়ে নাইজেবনটা কুনো গতিকে কেটে গেলেই হবেএমনি করে চলে সে। এইসব চারদিক ভেবে গিন্নির সব দায় আমাকেই নিতে হলো। বাড়ির আরও কাজ আছেসিসব আর দু-বউ করুক। ছোটজনা তো শহরে আছে। আসবে হয়তো কাল-পরশু দু-দিন থেকে আবার চলে যাবে। ছোট দ্যাওরের আপিস কামাই করার উপয় নাই

আমাদের অত সেবা বেরথা গেল না। কদিন বাদেই দেখা গেল গিন্নির জবান আবার ফিরে আসছে। পেথমদিকে একটি কথাও বোঝা যেছিল নাসব কথা জড়িয়ে-মড়িয়ে খালি একটো গোঙানির মতো আওয়াজ শোনা যেছিল। তাপর মুখের ব্যাকাভাব কাটতে লাগলএকটি-দুটি করে কথা পোষ্কার হতে হতে আবার তার কথা আগের মতুন হলো। অসুখ যেন হয় নাইসব আগের মতুন আছে। গিন্নির মনে কুনো ভয়-ভীত্ নাই। আগের মতুনই কি করতে হবেনা হবেবলে। একবারও কই অসুখের কথা বলে নানিজের কষ্টের কথা বলে না। একবার কাকে যেন বললেমওত যখন আসবে তখন আসবেআমি বেস্ত হব কেন। কথাবার্তা য্যান বেশ সড়োগড়ো হলো ত্যাকন ককে একদিন বললেকি জানি বাবামাথাটা কেমন করে ঘুরে উঠলফু দিয়ে পিদিম নিভিয়ে দিলে যেমন হয়তেমনি দপ করে সুয্যিটা নিভে গেল। আর আমি কিছু জানি না

তোমার সব ঠিক আছে তো এখনসব কথা মনে করতে পারো তো?

হ্যাঁসব মনে আছে শুধু এই হাঁটাটা বন্ধ। কেউ ফিরিয়ে না দিলে পাশ ফিরতেও পারছি না। বিছেনাতেই পায়খানা-পেশাব করতে হচ্ছেবাবা! শুধু এই জন্যেই মওত চাইছি। কেন কেউ এই কাজ করবে?

কথা শুনে চোখের পানি রাখতে পারলম নাই কথা কেন বলছে গিন্নি। আমার কঁদন দেখে গিন্নি কত্তার দিকে চেয়ে বললেমহুদাই এই কাজ করত। কিন্তু আমি জানি মহুদাকে এ কাজ করতে দেবে না মেজ বউ। তুমি ভেবো না বাবা

সসাংসারের আর কুনো হ্যার-ফ্যার হলো না। সব আবার ঠিক আগের মতুন চলতে লাগল। শুদু একটো মানুষ দিন-রাত শুয়ে আছেসব দেখছেসব শুনছে। সে সবকিছুতেই আছে কিন্তুক কুনো কিছুতেই থাকতে পারছে না। সুরুজ ওঠার আগে তাকে বিছেনা থেকে উঠে বসিয়ে দিতে হয়পাত্তর কেনা হয়েছেতাতে পায়খানা-পেশাব করিয়ে দিতে হয়মুখ ধুইয়ে দিতে হয়। তাপর সকালের বাঁধা খাবারটো খাইয়ে দিতে হয়। ডান হাতটো তো অবশ। এইরকম করে দিন অরম্ব করে সারাদিনে তাকে কতোবার উঠিয়ে-বসিয়ে দিতে হয়গোসল করাতে হয়ওষুধ খাওয়াতে হয়একটো মানুষের সব কাজ করে দিতে হয়। গিন্নি কিছুই বলে না। দিনের পর দিন যায়। তবে এক-একদিন গিন্নির চোখে কি এট্টু রাগ দেখিবিড়বিড় করে কিছু যেন বলছে বলে মনে হয়। আমি জানিগিন্নি কারু ওপর রাগে নাইরাগ তার নিজের ওপর। বিড়বিড় করে আল্লাকে শক্ত শক্ত কথা বলেশিগগিরি-শিগগিরি মত চায়। একদিন লিকিনি কুন্ বউ পানি খাইয়ে হাতের গেলাশটো এট্টু বেরক্ত হয়ে ঠক করে মেঝের ওপর নামিয়ে রেখেছিল। গিন্নি কত্তাকে সাথে সাথে ডেকে পাঠিয়ে বললেসত্যি বলছি বাবাএকটুও রাগ করে বলি নাইদুনিয়ায় দিন যদি শেষ হয়েই থাকে। শেষ তো হবেই একদিনসব মানুষেরই হবেতা যদি দিন শেষ হয়েই থাকেআর কিছুই করার না থাকেতাহলে দুনিয়ায় থাকা কেনআল্লা কেন তবে নেয় নাএর কোনো মানে পাই না। তোমাকে শুধু একটি কথা বলার জন্যেই ডেকেছিযার মন হয় নাসে যেন কিছুতেই আমার কাজ না করে। সে যেই-ই হোকআমি তাতে এতটুকুনি রাগ করব না

কথা শুনে কত্তা সবই বুঝলেঘর থেকে উঠে বাইরে যেতে যেতে ভারি কঠিন গলায় বললেযার মন হবে নাসে যেন না মায়ের ঘরে যায়। ও ঘরে ঢুকে কেউ এতটুকুন বেচাল করলেতাকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বার করে দেব

দিন যেতে লাগল আগের মতুনই। সেই সকাল থেকে চুলো জ্বলছেসারাদিন যজ্ঞ হচেমুনিষ-মাহিন্দার যেচে-আসছেভালোমন্দ খবর পেচিকিছুই বাদ নাই। চুলো নিভছে সেই অ্যানেক রেতে। সারারাত আঙার থাকছেভোরে আবার সেই আঙার থেকেই চুলো জ্বালানো হচে। চেরকাল যা হবার তা-ই হচে। কিন্তু আমার কাছে সব লাগছে অন্যরকম। সব জায়গায় কথাশুদু এক জায়গায় কথা নাই। উত্তর-দুয়োরি ঘরের দরজা সব সময়েই বন্ধ। রুগি ছাড়াও ঘরে কেউ না কেউ সব সোমায়েই আছে কিন্তুক সব চুপ। গিন্নি থিরকাঠি হয়ে শুয়ে আছে। গায়ের ফরশা রঙ ঘরের আবছা আলোয় যেন আরও ধপ ধপ করে। ঠিক আগের মতুনই শাদা থানের শাড়ি কপালের আধখানা ঢেকে আছে

এই মানুষ কুনোদিন নামাজ কাজা করে নাই। আমাদের কারু ওপর কুনোদিন জোর-জবরদস্তি করে নাই,তবু সেই কতোকাল থেকেবোধায় ই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর থেকেই গিন্নিননদ আর আমি একসাথে পাশাপাশি বসে আসরমাগরেব আর এশার নামাজ পড়তম। সেই নামাজে কি হতো তা তো আমাদের কারুরি জানার উপয় নাই তবে সোংসারের জ্বালার ওপর সি ছিল মলমের মতুন। গিন্নির পাশে বসলেই এই কথাটি মনে হতো। জবান আর জ্ঞানবুদ্ধি আবার ঠিক হয়ে যাবার পরে গিন্নি আবার নামাজ পড়ছে বিছেনায় শুয়ে শুয়েই। এক হাত তুলে দোয়া করা হয় কি নাজায়েজ আছে কি নাতাও একদিন কত্তাকে শুদিয়েছিল। কত্তা বলতে পারে নাইশুদু বলেছিলতুমি যেমন করে পড়বে তা-ই জায়েজ। গিন্নি অ্যাকন থির হয়ে শুয়ে শুয়েই নামাজ পড়েলষ্ট না হলে ওজুও করে না

এমনি করে গিন্নি নিজের বিছেনায় শুয়ে থাকলে। কুনোদিন আর উঠলে না

 

আকাল আর যুদ্দুর দুনিয়ায় কেউ বাঁচবে না

কি ভায়ানক দিন এল! এমন খরানি বাপের জন্মে দেখেছি বলে মনে হয় না। আকাশের দিকে চাইলে চোখ পুড়ে যেচেআসমানের নীল রঙ লাল হয়ে গেয়েছে। এক-একটো দিন যেন পাহাড়ের মতুন বুকে চেপে থাকছেকিছুতেই পেরইতে পারা যেচে না। সাথে আছে আবার যুদ্ধ আর আকাল। গেরস্তর নিত্যদিনের যা যা লাগেতা যি শুদু আক্ৰা তাই লয়পাওয়াই যেচে না। পেঁদনের কাপড়ের কথা আর কি বলবসি তো পাওয়াই যেচে না। কেরাসিন নাই। কয়লার চুলো অ্যানেকদিন থেকেই বাড়িতে আছেখুব ধুমো আর রান্নায় গন্ধ হয় বলে ঘসি আর কাঠের জ্বালটই ই বাড়িতে বেশি চলে। গাছ কেটে কেটে শ্যাষঅ্যাকন গাছই পাওয়া যেচে কম। কয়লাটো এতদিন পাওয়াও যেছিলদামেও শস্তা ছিল বলে কয়লা আনা হছিল এদানিং বেশি। সেই কয়লাও অ্যাকন আর পাওয়া যেচে না। নুন নাইট্যানাকাঠি নাইচিনি নাই। চিনির অভাবে তেমন অসুবিধা হতো নাকারণ ই দিকের লোকে গুড়ই খায় বেশি। কিনতেও পাওয়া যায়গাঁয়ের সালে নিজের নিজের সোংসারের গুড় তৈরি হয়। ইবার কারুর বাড়িতে গুড় নাইআমাদের বাড়িতেও নাইঅ্যাকন শুনছি মুদির দোকানেও নাই। যা এক-আধটু আছে গরিবের তা কিনে খাবার কুনো উপয় নাইএমনি দাম! গাঁয়ের তিনটো মুদির দোকানের দুটো বন্ধকুনো জিনিশ আনতে পারছে নাদোকানে রাখতে পারছে

কুনো জিনিশ দামের চোটে। দোকান খোলা রেখে কি করবেবাইরের জিনিশকাপড়কেরাসিনকয়লানুনচিনি ইসব কোথাও নাই। আর আর সামিগ্রিচালডালখাবার তেলমশলাইসব গেরস্তদের কিছু কিছু থাকলেও গরিব মানুষদের কোথা থেকে থাকবেতাদের কিনেই খেতে হয় ইসব জিনিশ। পয়সা তো কুনোদিনই নাই গাঁয়ের মানুষের হাতেরুপোর টাকা-আধুলি-সিকি গরিবরা চোখেই দেখে না। উসব আসবে কোথা থেকেধান বেচেচাল বেচেটাকা পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তুক বেচার মতুন ধান-চাল কজনার আছে! কুনোরকমে এট্টু ধান-চাল জোগাড় করতে পারলে লোকে তাই নিয়ে দোকানে যায়ঐটি দোকানিকে দিয়ে মাপিয়ে দোকানিকে বিক্রি করে আধ পয়সারসিকি পয়সার জিনিস কেনে। তবে সসাংসার চলে। ইসব অ্যাকন বন্ধ। সব দাঁত টিপে ঘরে বসে আছে। রাঁধা-বাড়াশখ-আল্লাদ সব গেয়েছে। যার খ্যামতা আছেকুনোরকমে দুটো চাল ফুটিয়ে মাড়সুদু খেচেছেলেপুলেকে খাওয়াচ্ছে। কি কষ্টের কথাগরু-মোষের লেগে মাড় রেখে দিয়েছিউ পাড়ার এক বউ সেই মাড় চেয়ে নিয়ে গেল। কিনা মেয়ে তিনটো না খেয়ে আছে! এট্টু মাড় খেয়েও প্যাট ঠান্ডা করার রাস্তা নাই। মাড়টুকুনি না পেলে কেউ কেউ হয়তো তাও পায় নাইসি বাড়িতে ছেলেমেয়ে নিয়ে সবাইকে উপোস করতে হবে। ওমাআমার কি হবেজেবনে যি এমন ভাতের আকাল দেখি নাইশুনি নাই

কার লেগে কি করব! অ্যাকন জষ্টিমাসের মোটে আধেক যেচেসারা বর্ষা পড়ে আছেতা বাদে শেরাবন ভাদরের আলেদা আকাল আছে। ইদিকে ধান ছাড়া ফসল নাইঅঘান মাসে দু-চারটি আউশ হয় বটেসি কিছুই না। সবাই তা পায়ও না! আসল ফসল আমন ধানসেই পোষ মাসে। ঐ-ই একমাত্তর সারা বছরের খোরাক আর ঐ বেচেই আর যা যা লাগে তার বেবস্তা করতে হয়! তাইলে এতগুলিন দিন কেমন করে পেরুবে মানুষআবার শুনছি শহরে চালের দাম দ্বিগুণ হয়েছেকেনে হয়েছে কে জানেসি লিকিনি ফাগুন-চোতেই হয়েছে। গায়ে তেমন বোঝা যেত না বটে। বোঝা যাবেই বা ক্যানেগায়ে চালই নাইতা দাম বাড়ল না কমল জেনে কি হবেখুব ভয় লাগছেখুব ভয় লাগছে

আর হুজুগের শ্যাষ নাই। পেত্যেকদিন লতুন নতুন হুজুগ। যুদ্বুর আবস্তা খুব খারাপ হচে। বিটিশরা অ্যাকন সব জায়গা থেকেই লিকিনি পালাইচে। আমাদের এই বেরাট দ্যাশের লাগোয়া উদের আর একটো দ্যাশ আছে। সি দ্যাশের নাম হচে বরমা। সি দ্যাশ বিটিশদের কাছ থেকে লিকিনি দখল করে নিয়েছে। আর একটা কথা খুব উঠেচেজাপানিরা বোমা ফেলবে ই দ্যাশে। এই কথা নিয়ে গান বাঁধা হচে। মাঠে-ঘাটে ছেলে-ছোকরারা গাইছেসারেগামাপাধানিবোম ফেলেছে জাপানি। সি বোমা অবশ্যি আকননা পড়ে নাই। যি কুনোদিন পড়বে আর পড়লে ই দ্যাশের আর কুনো চিন্ন থাকবে না। জাপানিরা কম লয়ওরাই ঐ বৰ্মা দখল করে নিয়েছেঅ্যাকন ই দ্যাশের দিকে এগিয়ে আসছেই দ্যাশটোও দখল করে নেবে বিটিশদের হাত থেকে। তার এগু বোমা ফেলে সব ছিতিছান-বিতিবান করে দেবে। জাপানিদের নাম আমরা আগে তেমন শুনি নাই। জাপানি কুন দ্যাশকেমন সি দ্যাশের লোকতাদের সব আমাদের মতুন মা-ভাই-বুন-সোংসার আছে তো!

তা হুজুগের আর দোষ কিসারা দ্যাশ আম্রিকার গোরা পল্টনে ভরে গেয়েছে। গাড়িঘোড়া সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে তারা সব জায়গায় হাজির। দ্যাশের সবকিছু তাদের লেগেই। চাল-ডাল-আটা-গরু-ছাগলডিম-মুরগি আগে তাদের যা লাগবে সব দিয়ে তাপর ই দ্যাশের মানুষরা পাবে। এসবের অ্যানেক কিছুই চেরকাল ই দ্যাশের মানুষ নিজেরাই করে আসছে নিজেদের লেগে। কেনাকিনির অত চল ছিল না। অ্যাকন সব দালাল হয়েছেগাঁ-গঞ্জ থেকে গরু-ছাগল-ডিম-মুরগি ইসব কিনে নিয়ে যেচেতাতে গেরস্তরা দুটো পয়সা পেচে ঠিকপয়সার লেগেই সব বেচে দিচে। আগে নিজেরা কিছু খেত মাখতঅ্যাকন কাঁচা পয়সার লেগে সবই বিককিরি করছেনিজেদের লেগে কিছুই রাখছে না। অবশ্যি উসব কিনে খাবার লোক আগে ছিল নাআর অ্যাকন তো নাই-ই। তাছাড়া কেউ কিনতে গেলে পল্টনের লোক এসে হাড়গোড় ভেঙে দেবে। যুদ্ধ ছাড়া অ্যাকন আর কুনো কথা নাই। গোরা পল্টনের গা থেকে লিকিনি কেমন একটা বোটকা গন্ধ পাওয়া যায়বললে না কেউ পেত্যয় যাবে সেই বোটকা গন্ধ অ্যাকন সারা দ্যাশেপল্টন কাছে থাকুক আর না থাকুক। ই গন্ধই অ্যাকন যুদ্বুর গন্ধ। রুগির ঘরে সেই গন্ধভাতের থালায় সেই গন্ধছেলের গায়ে সেই গন্ধ। চামড়া শুকানোর গন্ধ

অ্যানেকদিন থেকে আসমানের উড়োজাহাজের দিকে আর কেউ তাকিয়েও দ্যাখে না। দেখে কি করবে?গোঁ গোঁ আওয়াজ করে আসেকখনো কখনো খুব নিচু দিয়ে আসেকান যেন ফাটিয়ে দেয়কখনো আসে খুব উঁচু দিয়েশব্দও শুনতে পাওয়া যায় না। জাপানিরা বোমা ফেলবে এই হুজুগ ওঠার পর থেকে অ্যাকন আবার লোকে পেরায় সব সোমায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। বোমা ফেললে তো উড়োজাহাজ থেকেই ফেলবে। কি করে বোঝা যাবে কুনটো ফেলবে আর কুনটো ফেলবে না। সব উড়োজাহাজ কি এক রকমনা আলেদা আলেদাআজকাল আসছে অনেক বেশিআর আসছেও অ্যানেকবার করে। মাঝে মাঝে পাঁচটো-সাতটো একসাথে গুড়গুড় শব্দ করতে করতে গাছপালার ঠিক ওপর দিয়ে উড়ে যেচে। আগে ডিগবাজি মেরে মেরে খেলা করত— অ্যাকন সিসব দেখি না। দু-একটো দেখি একা একা আসছেআসমান দিয়ে কোনাকুনি আসছে গুট গুট আওয়াজ করতে করতেঅ্যানেকটো সোেমায় লাগছে আকাশ পেরিয়ে যেতে। সি চলে গেলে সব আওয়াজ বন্ধ। দোপরবেলায় বাড়িতেও কুনো সাড়াশব্দ নাই

আমাদের বড় ভাগ্নেটিমা মরে গেলে কত্তা যাকে ই বাড়িতে এনেছিলসে অ্যাকন খুব রূপের এক যোব। সে শহরে একটো চাকরি পেয়েছে। এই মেলেটারির চাকরি। জাপানি বোমার হুজুগের পরেই এই চাকরি। সে বললেএকটো আপিসে বেবস্থা আছেবোমা ফেলার লেগে উড়োজাহাজ এলে অনেক আগেই লিকিনি জানতে পারা যাবে আর ত্যাকনই একটো হুইসিল না সাইরিন কি বাজিয়ে দেবে। সি অওয়াজ এত জোরে হবে যি সারা শহরের লোক জানতে পারবে আর সবাই সাবধান হয়ে যাবে। কি সাবধানসারা শহরে গত্ত খুঁড়ে রেখে দিয়েছে এক-একটো খালের মতুন। সাইরিন বাজলেই যে যেখানে আছেসেই খালের ভেতরে ঢুকবেছেলেমেয়ে-বউ-বিবি সব নিয়ে সেইখানে বসবে। বোমার উড়োজাহাজ চলে গেলে আবার অন্য রকম সাইরিন বাজলে সবাই উঠে আসবে। আরও একটা বেবস্থার কথা শোনলম। যেখানে-সেখানে বালির বস্তার দেয়াল তৈরি করা হয়েছে। বোমা যেদি পড়েই তাইলে বোমার ভেতরে যিসব ভায়ানক জিনিস আছেতা ঐ গত্তে ঢুকতে পারবে নাবালির দেয়ালও ভাঙতে পারবে না। ভাগ্নেটি এই চাকরি করছেমাঝে মাঝে য্যাকন আসেত্যাকন এইসব কথাই শুনি তার কাছে। বেশ চাকরি করছেমাইনে পেচে। বোমা ই পয্যন্ত পড়ে নাই

 

নোহ নবীর সোমায়ের কেয়ামত কি আবার এল

হেঁশেল ঘরের উসারায় একটো খুঁটিতে হেলান দিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছি। পাঁচ দিন হলো বাদল নেমেছে। মাঠভরা ধান-ইবার লিকিনি খুব ফলন হয়েছে ধানেরবহুকাল এমন কেউ দেখে নাই। সবারই মনে আনন্দ। হবে না ক্যানেঐ এক ধানধান ছাড়া আর তত কিছুই নাই দ্যাশের মানুষের। আর কিছুই নয়শুদু এই আমন ধান। সারা বছরের ঐ একটি ফসল-বর্ষায় রোয় আর পোষ-মাঘে কাটে। খাওয়া-পরা সবকিছুই ঐ ধানে। ই বছর খরানির কালে লোকের খুব ভয় হয়েছিল। আসমানের পানিই শুধু ভরসাসেই পানি যেদি আষাঢ়-শেরাবনে না হয় তাইলে জমি আবাদ হবে নাবীজতলা শুকিয়ে যাবে আর ইয়ার মানে একটোইমরণ। সারা বর্ষা পানির লেগে ত্যাকন হাহাকারসেই কাত্তিক মাস পয্যন্ত। এই হলো খরানির। ভয়আবার পানি বেশি হলেও ভয়! ধান ভেসে যাবে না তোজমি তলিয়ে যাবে না তোকম হলে চাষির মনে দুরদুরুনি শুকিয়ে যাবে না তোজমি শুকিয়ে চরচরিয়ে ফেটে যাবে না তোআর বেশি হলে ভয়ভেসে যাবে না তোএইরকম করে করে চলে

ইবারের খরানির ভাব দেখে লোকে মনে করেছিল পানির অভাবে আবাদই হবে নাগেলবার পানির অভাবে চাষে জুৎ হয় নাইলোকের খুব কষ্ট গেয়েছেইবারও যেদি ধান মরে যায়তাইলে মানুষ আর কিছুতেই বাঁচতে পারবে না। উদিকে যুদ্ধর আগুন তো আছেই। কিন্তুক নাশ্যাষ পয্যন্ত আষাঢ় মাসের দিনকতক যেতেই ভালো বর্ষাই নেমেছিল। মানুষ খুব খুশি। পেটে ভাত নাইপেঁদনে কাপড় নাইওলাউটোয় কত মানুষ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে তবু মানুষ আশায় বুক বেঁধে ইবার খুব ভালো করে চাষ করলে। ঐ দু-মাসে পানি বেশিও হয় নাইকমও হয় নাই। দেখা যেচে ধানও খুব ভালো হয়েছে। আমাদের সেজ আর ল-কত্তা চাষবাস নিয়েই থাকে। আমর তো আর মাঠে যাই নাওরাই এসে বুনের কাছে গপ্পো করেইবারের মতুন ধান বহুকাল হয় নাই। পাঁচ-ছটো মরাই পিতি বছর হয়ইবার মনে হয় সাত-আটটো হবে। আমাদের অতো বড় খামারেও জায়গা হওয়া কঠিনদেখোপাড়ার ছেলেমেয়েরা এসে লুকোচুরি খেলবে। ওরা বলছে আর আমি যেন দেখতে পেচি ধানের মরাইগুলিন!

ভাদর মাসে খুব বিষ্টি হয়মাঠে পানি লাগেও বটেহয়ও খুব। তাই সিদিন মাঝরেতে ঝমঝমিয়ে ম্যাঘ নামলে ভেবেছেলম বোধায় কদিনের মেয়াদি বাদল নামল। তার বেশি আর কিছু ভাবি নাই। পাঁচদিন আগেসবাই ত্যাকন ঘুমিয়েঘরবাড়ি সব আঁধার কো-কাপ। অতো রেতে মানুষ আলো জ্বালবেই বা ক্যানেতার ওপর কেরাসিন নাইসরষের ত্যাল নাইরেড়ির ত্যাল নাই অ্যানেকের। পিদিম জালাবেই বা কোথা থেকেআবার আমাদের ঘরে অবশ্যি একটো আলো জ্বলত মিটমিট করেকত্তা ঘর একদম আঁদার করতে দিত না। তা এমন দিন পড়েছে যি সি আলোও বন্ধসবাই ঘুমিয়েছেআমিও মনে হয় মরণঘুমই ঘুমিয়েছেলম। ম্যাঘ লম্পানিতে আর গুডুম গুডুম ম্যাঘের ডাকে ঘুমটো ভাঙলখুব ঘন ঘন বিজলি চমকাইছেল আর জানেলা দিয়ে ঘরবাড়ি গাছ পুকুর মাঠ সারা দিনদুনিয়া একবার একবার দেখতে পেচি আবার চোখ বুজছি কিন্তুক থাকতে পারছি না চোখ বুজে। ম্যাঘের ডাকে কানে তালা ধরে যেচে

কত্তার ঘুম খুব পাতলা। আমি জানিতার ঘুম ভেঙে গেয়েছে কিন্তুক সি কুনো কথা বললে না। বলবে না জানা কথা! বিজলি লল্‌পাইছে আর ঘরের ভেতরে ছেলেমেয়ের বিছেনা আবছা দেখতে পেচিআরামে ঘুমুইছে তারা। বড় ছেলে শহরে পড়েমেয়েটোও ননদের সাথে থাকেই ঘরে শুদু আমার দুই খোঁকা। এর মদ্যে আরো একটি খোঁকা হয়েছে কিছুদিন আগে। উ কথা আর বলি নাইকি আর বলবয্যাতোদিন খ্যামতা আছে পেটে ধরবযিদিন বন্ধ হবেসিদিন হবে। তাই বলে কি যারা এয়েছে দুনিয়ায়মায়ের কাছে তাদের অনাদর হবেতা লয়। ঐ যে দুই ভাই নিচ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। সব একবার দেখে নিয়ে আমি আবার চোখ বোজম আর ঠিক তখুনি দড়বড়িয়ে পানি নামল। শুকনো মাটি য্যাতক্ষণ না ভেজেফট ফট করে মাটিতে বিষ্টি পড়ার আওয়াজ হয়। বড় বড় ফোটায় অ্যাকন তেমনি বিষ্টি হচে। চোখ বুজেই আছি কিন্তুক বিজলি চমকাইলেই চোখে আলো দেখতে পেচিচোখ বুজে কুনো কাজ হচে না। আর বাজ পড়ার আওয়াজ তো আছেই

একটু বাদে বুঝতে পারলম মাটি আর শুকনো নাইবিষ্টির চোটে মাটি আর ফটাস ফটাস করে উঠছে নাপটপট ঝমঝম করে ঘোননা আওয়াজ শুরু হয়েছে। তা ভালোবিষ্টি হলে তো মাঠের ধানের ক্ষেতি নাই বরং ভালো। জমি কানায় কানায় ভরে থাকুক কি ভেসেই যাক তাতে কুনো ক্ষেতি নাই। ইসৰ কথা ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে গ্যালম

ঘুম য্যাকন ভাঙলভোরের আলো ত্যাকন খালি ফুটেছেপুবদিক বোধায় ফরশা হয়েছেবিছেনায় শুয়ে শুয়েই শুনতে প্যালম একটানা বিষ্টি হয়ে যেচে। অ্যাকন আর ম্যাঘ ডাকাডাকি নাইলপানি নাইবাতাসের সোঁ সোঁ অওয়াজ কিম্বা ঝাপটানি কিছুই নাই। খালি অঝোর বিষ্টির ঝমঝম অওয়াজ। একবার উঠে উঁকি মেরে দেখলমসারা আসমান আমানির মতুন ম্যাঘে ঢাকাকোথাও একটু কম-বেশি নাইম্যাঘ বলে মনেও হচে নামনে হচে আসমানের বুঝিন ঐ রঙ। ঘন কালো ম্যাঘে খুব বিষ্টি হয়মনে হয়ঐ ম্যাঘে বিষ্টি তো হবেই কিন্তুক এমন ঘোলা ম্যাঘের গোলা দিয়ে লেপা আকাশ থেকে এত বিষ্টি কি করে হচেতা অবশ্যি লতুন কিছু লয়চেরকালই দেখে আসছিআষাঢ়-শেরাবনে ত্যাতো লয়ভাদর মাসে আকাশ এমনি ভাব ধরলে খুব পানি ঢালে। কুনো কুনো বার ভাদর মাসে বাদল হয়মাঠ-ঘাট ভেসে যায়তেমন বাদল দু-তিন দিন কি তার বেশিও থাকে। ইবারেও বোধায় তাই। রাতদোপরে নেমেছে। কম বেশি নাইবাতাসের ঝাপটানিতে বিষ্টি ছেড়া-খোঁড়া হচে না। নিশ্চয় এত বিষ্টিতে মাঠকে মাঠ ভেসে যেচে। আর খানিকক্ষণ এইরকম চললে ধানগাছ সব পানিতে তলিয়ে যাবেসারা মাঠ হয়ে যাবে শাদা সমুদুর। তাতেই বা আর ভয় কিকুনো কুনো বছর এমন হয়। ধান সব তলিয়ে যায়ডগাটুকুনও দেখা যায় না মনে হয় সব ধান পচে যাবে। তা কিন্তুক হয় না। বাদলা কেটে ভাদর মাসের রোদ উঠলে দু-দিনেই পানি হড়হড় করে নেমে যায়। গরম ভাপ হয়ে পানি শুকিয়ে যায়যেমনকার ধান তেমনি আবার জেগে ওঠে। উ নিয়ে ভাবার কিছু নাই

আর শুয়ে থাকা যায় নাউঠেই যখন পড়লম কাজকম্ম দেখি গা। য্যাতো বাদল-বর্ষাই হোকদিন তো বসে থাকবে না। একটু বাদেই ছেলেপিলেরা সব উঠে খেতে চাইবেজা-রা উঠে কাঠ-কয়লা দিয়ে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে নিজের নিজের কাজে মন দেবেবাড়ির পুরুষরা বাইরে বেরিয়ে যাবেবিষ্টি-বাদলা মানবে না। মুনিষ-মাহিন্দাররা বাড়ির এটো-ওটো কাজ করবেহাঁস-মুরগিতে বাড়ি ঘিনঘিন করবেদিন এমনি করে শুরু হবেএমনি করেই শ্যাষ হবে। ইয়ার অন্যাথা নাই। আমি হেঁশেলের পাশে রাঁধা-বাড়ার চালাটোয় যেয়ে চুলো ধরাইতে গ্যালম। এই সোমায়টোয় জ্বালটের খুব অভাবঅত শুকনো কাঠ কোথাডালপালা কাঠিখোঁচা. আর খ্যাড় দিয়েই কাজ চালাতে হয়। গরু-মোষের খাবারে টান পড়েখ্যাড় পোড়াইলে মুনিষ-মাহিন্দাররা আবার রাগ করে। আবার কয়লাও গরমিলএইসব কথা ভাবতে ভাবতে চুলোর কাছে যেয়ে দেখি ডালপালা সব ভিজেচুলোয় রেতের আগুন শুদু যি নিভে গেয়েছে তা লয়চুলোর ভেতরে পানি জমে গেয়েছে। কি করে জ্বালাই চুলো?

তা দিন পড়ে থাকে নাই। আগুন ঠিকই জোগাড় হলোযাহোক রাঁধা-বাড়া হলোদিনের কাজে সবই হলো। ভাবনা করার কিছু হয় নাই। কিন্তু তার পরে বিষ্টি যি একবারের তরে থামল না

আজ পাঁচ দিন বাদল নেমেছেএকবার থামাথামি নাই। হয় বটে বিষ্টিতাই বলে অতদ্যাওরদের কাছে খবর পেয়েছি যি মাঠ ডুবে গেয়েছে পরশুদিনই। অত পানি কি মাঠ রাখতে পারেসব ভরাঅত পানি নেমে যাবে কোথাসারা মাঠে ধান আর দেখাই যেচে নাসব ডুবে গেয়েছে। আগে আগে হলে বলতম দু-দিন বাদে পানি নেমে গেলেই মাঠ আবার সবুজ হবে। তাই বলে টানা ছ-দিন যেদি ধান পানির তলায় থাকে তাইলে কি সেই ধান বাঁচবেআজ পাঁচ দিন তো হয়েই গেল

ইদিকে দিন গুজরান তো অসোম্ভাব হয়ে যেচে। কাল পয্যন্ত কুনোরকমে বাঁধাবাড়া হয়েছে। যেমন করে তোক ছেলেপুলেবাড়ির পুরুষমানুষমুনিষ-মাহিন্দারদের মুখে ডাল-ভাত জোটানো গেয়েছে। আজ কি হবেগিন্নি আঁদার ঘরে নিথর শুয়ে আছেননদ হয়তো আমারই মতুন তার পাশে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। কাকে কি শুদুবকোথা কি আছে আমিই সব জানি! হেঁশেলে বড় পয়ায় চাল আছেডালও আছে য্যাথেষ্টটিনে মুড়িও আছে। চুলোটো যেদি জ্বালাতে পারি তাইলে চালে-ডালে এক পাতিল খেচুড়ি বেঁধে দিলে বাড়ির সবাই খেতে পারবে। কিন্তুক চুলো জ্বালাইতে কি পারবএক ফোটা কেরাসিন নাইকয়লাও নাই। কটো ভিজে ঘসি আর বাবলাগাছের ডালপালা পড়ে আছে। গুণে গুণে দ্যাখলম ট্যানাকাঠির বাসোয় মোটে তিনটো কাঠি পড়ে আছে। ডালপালা গুছিয়ে নিয়ে তৈরি হয়ে বসে একটো কাঠি বারুদের গায়ে টানলম। কিছুই হলো না। বারুদ ভিজে জবজব করচে। বাসোর গায়ে আর একবার কাঠিটো জোরে টানতেই খশ করে কাঠির মাথার বারুদটো খসে গেল। কি হবেকি করে আগুন জ্বালাবকে এট্টু আগুন দেবেপরের কাঠিটো খুব জোরে টানতে গ্যালমযাঃকাঠিটোই ভেঙে দু-টুকরো হয়ে গেল। আর মোটে একটি কাঠি আছে। এটিও যেদি না জ্বলে!

কোথাও আগুন নাইসারা গাঁ ভিজে চবচবকুনো বাড়িতে আগুন নাইকারুরি চুলো জ্বলছে না। কারু ঘরে খাবার নাই। ভয়ে আমার হাত-পা প্যাটের ভেতর সেঁদিয়ে যেচে। এই যেএই শ্যাষ কাঠিটোর বারুদও খসে গেল। ত্যাকন আমার কাঁদন এল। কোথা আমি আগুন পাইমুনিষদের কাছে চকমকি পাথর আছেহয়তো তারা কষ্ট করে আগুন জ্বালাইতে পারবে। কিন্তুক অ্যাকন তারা কোথা?

কতক্ষণ থেকে গালে হাত দিয়ে বসে আছি। কি যে ভাবছি আর কি যে দেখছি কে জানেপানি হওয়া বটেঅ্যাকন মনে হচে এত বিষ্টি জেবনে দেখি নাই। পাঁচ দিন পাঁচ রাত-থির বিষ্টি হয়ে যেচে! আসমানের সেই এক আমানির মতুন রঙকম-বেশি নাই। একবার যেন কতো দূরেঅ্যানেক দূরে,গুড়গুড় করে আওয়াজ উঠল। বিষ্টি আর একটু ঘন হলো। বাড়ির পুব-উত্তর দিকের মাটির পাঁচিরের খ্যাড়ের ছাউনি পচে গলে গেয়েছেএইবার মাটিই গলছে। দু-তিন হাত পাঁচির এর মদ্যেই গলে গেয়েছে। পাঁচিরের ওপর দিয়ে দেখতে পেচি খিড়কির পুকুরটো ভেসে চারদিক দিয়ে পানি উপচিয়ে পড়ছে। এইবার বাড়িতেও পানি ঢুকবে। ঐদিকে সবকটো পুকুর একটো পুকুর হয়ে গেয়েছে। পুকুরগুনোর সাথে মাঠ এক লাগোটা হয়ে গেয়েছে। সব একদম শাদা। বসে বসে দেখছিবাড়িরই চারপাশের পাঁচির অ্যাকন গলে গলে পড়ছেবাড়ি ইবার বে-আব্রু হয়ে পড়বে। তাপর হয়তো মাটির ঘরগুনো দুদ্দাড় করে পড়ে যাবে। ভয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল

বিষ্টি এইবার আরও ঘন হয়ে এল। এখন চোখের দিষ্টি বেশি দূর যেচে না। পাঁচ হাত দূরের জিনিশটো যি কি তা ঠিক বোঝা যেচে না। বাড়িতে কতো জিনিশই তো ইদিক-উদিক ছড়ানো থাকেখেয়ালও হয় না। অ্যাকন বসে বসে ভাবছি ওটো কি জিনিশওটো একটো ঝুড়িঐটো কিএকটা কালো ভাঙা হাঁড়িআতাগাছের তলায় ওটো কি তেঁতুলগাছের শক্ত গুঁড়িটোএই করতে করতে যেখানে কিছুই নাইসেখানেও অ্যানেক জিনিশ দেখতে প্যালম। সি সবই যেন পানি দিয়ে তৈরি। তৈরি হয়েই আবার ভেঙে বেচে। একবার যেন মনে হলো খিড়কি-পুকুরের কোণের বাড়ি থেকে পানি দিয়ে তৈরি একটো মেয়ে বেরিয়ে এল। পানির ভেতর দিয়ে ছপ ছপ করে হাঁটছে। আমাদের বাড়ির দিকেই এগিয়ে আসছে। কিন্তুক সে বাড়ির ভেতরে ঢুকল কিনা বুঝতে পারলম না। খালি ঝমঝম করে পানি হচেসেই আওয়াজই শুনতে প্যালম। একটু বাদে ফের দ্যাখলম কে যেন হেঁশেল থেকে বেরিয়ে যেচে। নাইবার আর বেভ্রম লয়। অবশ্যি এত পানি হচে যি মনে হচে আমার চারদিকে শাদা চাদর টাঙানোতার আড়ালে সব ঢাকা পড়েছে। তবু ঠিক দেখলম একটো মানুষ হেঁশেল থেকে বেরিয়ে এসে এগনেয় নামার আগে উসারার খুঁটির কাছে এসে দাঁড়াইলে। তাপর যেমন সে পা বাড়িয়েছে এনেয় নামবে বলেআমি অমনি ঐ মাহা বিষ্টির মদ্যে ভিজে শুটিয়ে যেয়ে তাকে ধরলম

হ্যাঁখিড়কির কোণের বাড়ির আলিই বটে। বিয়ে হয় নাইএক বুড়ি দাদি ছাড়া এই দুনিয়ায় আর কেউ নাই তার। ভেজা জবজবে মোটা একটো চট বুক থেকে পা পয্যন্ত ডান হাত দিয়ে ধরে আছে। খেতে পায় নাতবু এত বড় বড় দুটো বুক ক্যানে যি তারকি কাজে লাগবে আল্লা জানে! অমন করে চটটো হাত দিয়ে ধরে আছে। মেয়েমানুষের শরম বাঁচাইতে কিন্তুক তবু ঢাকা পড়ে নাই ঐ পব্বতের মতুন বুক। বাঁ হাতে মাটির শানকি-ভরা বাসি ভাততার আদ্দেক গলা। এক শানকি ভাত। হেঁশেলে ভাতের হাঁড়িতে গত রেতের পানি দেওয়া ভাত যা ছিল তা বোধায় সবটাই নিয়েছে শানকি ভরে

আমরা দুজনা মুখোমুখি তাকিয়ে থাকলম। উঃমেয়ের দু-চোখের জমিন কি শাদা! ধলিবগের পালকের মতুন ধবধবে শাদা। বোঝাই যেচে চট দিয়ে শুদু শরীলের ছামনেটাই ঢেকেছে সেঘাড়-পিঠপাছা-কোমর উদোম। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলম। একটি কথা বলতে পারলম না। দুনিয়ায় অ্যাকন খালি সকাল হয়েছে। সারাদিন বাকিঅ্যানেক বাকিঅ্যানেক বাকি। বুকের ধুকপুকুনি কিছুতেই থামে না। কতক্ষণ বাদে আলি ফিসফিস করে বললেতিনদিন তিনরাত কিছুই খাই নাইদাদি ঘরেই আছেবোধায় আজ মরতে পারে। আমি শুদু কোনোরকমে বললমদাঁড়া। এই কথা বলে হেঁশেলে ঢুকে কি এক ভায়ানক রাগে একটো মাটির হাঁড়িতে থাবা থাবা চাল তুলে একদম ভত্তি করে উসারায় বেরিয়ে অ্যালম

শানকি হাঁড়ির মুখে ঢাকা দে। চালটো ভেজাস না। যা

কুনো কথা না বলে আলি পানিতে নামল। অ্যাকন আর চট দিয়ে কি হবেমেয়েমানুষের গোটাটোই অ্যাকন উদোম! তা কি হবেযে খুশি দেখুক। সে নেমে গেলে আমি পেছন থেকে বললমতোদের চুলোয় আগুন আছেথাকলে আমাদের একটু দিস। ক্যানে যে ইকথা বললম কে জানে। বলতে মন হলো তা-ই বললম

তার পরদিন থেকে হাওয়া বইতে লাগল। এই কদিন একনাগাড়ে খালি বিষ্টি হয়েছে। একফোটা বাতাস ছিল না। আজ সকাল থেকে হাওয়া অরম্ব হলো। সকালবেলায় ভাবছি আজও যেদি অমনি করে করে বিষ্টি হয়তাইলে দুনিয়া আর থাকবে না। ঘর-দুয়োর সব গলে মুছে যাবে। মিছে ভাবছি নাগতকাল বৈকালবেলায় মল্লিকদের একটো ঘর আমার চোখের ছামনেই ভেঙে পড়ল। আমাদের এই বাড়ি থেকে ঐ ঘরটো দেখা যেত নাবাড়ির পাঁচিরের আড়াল হতো। সকালবেলায় সেই সীমেনা-পাঁচির ভেঙে পড়েছে বলে মল্লিকদের গোটা বাড়ি দেখতে পাওয়া যেছিল। পড়ন্তবেলায় ঐ বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছিএমন সোমায় উদের বড়ো ঘরটোর একটো দেয়াল হুড়মুড়িয়ে ভেঙে মাটিসই হয়ে গেল। সাথে সাথে সারা বাড়িটো এমন আনকা লাগল যেন আগে কুনোদিন বাড়িটোই দেখি নাই। ভাঙা ঘরের ভেতর থেকে একঘর আঁদার আর একটা খারাপ গন্দময়লা ভাপ এসে আমার নাকে লাগল আর মানুষ হঠাৎ ন্যাংটো হয়ে গেলে যেমন লাগে ঘরটোকেও তেমনি একদম ন্যাংটো মনে হলো। ঘরের ভেতর যা যা আছে সব দেখতে পাওয়া যেচে যি! যা মানুষ দেখায় নালুকিয়ে রাখেসি-সব দেখা যেচে! ভাঙা ফুটো পচা সব জিনিস। জানে ধরে উসব জিনিস ফেলে দিতে পারে নাই

সকালে যি হাওয়া বইতে শুরু হয়েছিলতার জোর কেরমে কেরূমে বাড়ছে দেখছি। কুদিকের হাওয়া কিছুই বোঝলম না। শুদু দেখলমঅমন সোজা-চাদর ঝুলননা বিষ্টি একদিকে হেলে রয়েছে। তাপর হঠাৎ এমন একটো বিষ্টির ছাঁট এসে আমার চোখে-মুখে লাগল যি আমি কাত হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লমপরনের কাপড় সাথে সাথে ভিজে চুবচুবে হয়ে গেল। ই আবার কেমন বাতাস ভাবছি আর ত্যাকুনি আর একটো ঝাপট এসে লাগল। আগেরটোর চাইতে জোর বেশি এটোর

এই অরম্ব হয়ে গেল! হাওয়া মাতালের মতুন করতে লাগলকুনো ঠিক-ঠিকানা নাইএকবার ইদিক থেকে তো আর একবার উদিক থেকে। তাপর দেখিউত্তর-দখিন-পুব-পচ্চিম হাওয়ার গতিক কিছুই ঠিক নাই। আর সি কি জোর আর শোঁ শোঁ আওয়াজ! গদগদিয়ে আজ টানা ছ-দিন ধরে যি বিষ্টি হচেসেই বিষ্টি অ্যাকন ছিড়ে ছিড়ে যেচেগায়ে এসে সুইয়ের মতুন বিধছে। কখনো দেখছি এলোমেলো হাওয়ার চোটে ধুমোর মতুন উড়ে যেচে। গত কদিন ধরে গাঁয়ের সব মাটির বাড়ি খালি বিষ্টিতে ভিজেছেএইবার এই হাওয়ায় আর একটোও খাড়া থাকতে পারবে নাসব মাটিতে মিশে যাবে। মল্লিকদের ন্যাংটো বাড়িটো কাল একবার দেখেছিএইবার গোটা গাঁ-টো ন্যাংটো হবে। খোলা আসমানের তলায় থাকবে সারা গাঁয়ের মানুষছেলে-বুড়ো মেয়ে-পুরুষ সব। ত্যাকন মওত আসতে দেরি হলেই রাগ লাগবে!

আমি একা বসে আছিআশেপাশে কেউ নাইছেলেপুলেদের চ্যাঁ-ভ্যাঁ নাই। বাড়িতে কেউ এখনো ওঠেই নাই। কদিন থেকে শুদু আমিই রাত থাকতে বিছেনা ছেড়ে উঠছি আর একা একা এখানে এসে বসে থাকছিমনে হচে দুনিয়া শ্যাষ হবে। ত্যাকন মনে হতে লাগল আমার ই দুনিয়ায় আর কেউ নাইএইবার দম বন্ধ হয়ে মরে যাব

এই কদিন কেউ সুয্যির মুখ দেখতে পায় নাইসকাল-দোপরবৈকাল কখন আসছে কখন যেচে কারুর বোঝার উপয় নাই। ছেলেপুলের মুখ শুকনোকেউ একটি কথা বলছে নাযা জুটছে তা-ই খেচেকুনো হুজ্জোতি নাই। বড়রা আর কি করবেবুকের সাথে হেঁটো লাগিয়ে সব ঢিপ ঢিপ বসে আসমানের দিকে চেয়ে আছে

দোপরের দিকে মনে হলো বিষ্টিটো কমে আসছে আর বাতাসটো বাড়ছে। বাতাসের য্যাতো জোর বাড়ছে তাতে সি মাথাপাগলের মতুন করছে। বিষ্টিকে তাড়িয়ে একবার ইদিকে নিয়ে যেচেএকবার উদিকে নিয়ে যেচে। এই করতে করতে শ্যাষে বিষ্টিটো একদম থামলঅ্যাকন খালি বাতাস। হোক বাতাসবিষ্টিটো তো থামল! এই ছ-দিন ছ-রাত বোধায় একবারও থামে নাই। গাঁয়ের সব পুকুর ডোবানামো জায়গা পানিতে ভরারাস্তায় একহাঁটু করে পানি। আর একদিন অমনি বিষ্টি হলে এই শুকনো দ্যাশের লোক তো সব ডুবেই মরে যেত। যাক বাবা বিষ্টিটো তত থামল। বাতাস আর কতোক্ষণ থাকবেসাঁঝ আসতে না আসতেই ওর জোর চলে যাবে। ননদ বললেনোহ আলাইহি সাল্লামের সোমায় একবার পেরায় কেয়ামত হয়েছিলজাহাজে যারা জায়গা পেয়েছিল শুদু তারাই বেঁচেছিলইবারের যা বেপার তাতে এই পৃথিবীর জাহাজে কেউ বাঁচবে না গো! দ্যাওররা বললেবিশেষ যি দ্যাওর চাষবাস নিয়ে থাকেআসমান-জমিনের খবর রাখেসে বললেএমন অসময়ে এত পানি কুনোদিন দেখি নাই। এদিকে সব মাটির বাড়িদুদ্দাড় পড়ছেবৈকালের মধ্যে গাঁয়ের আদ্দেক বাড়ি পড়ে যাবে। এ তল্লাটের সব গাঁয়েই এরকম হবে। তা নিয়ে আমি ভাবছি না। ভাবছিধান তো সব তলিয়ে গিয়েছে। ফুলনো ধানশীষ খালি আসতে লেগেছেএই অবস্থায় ধান চার-পাঁচ দিন পানির তলায়! ও কি আর আছেপচে-হেজে নষ্ট হয়ে গিয়েছে সব ধান। নতুন করে আর রোয়ারও কুনো কথা নাই। কি ভায়ানক মাগন যে লাগবে তাই ভাবছি

বাতাসের জোর বাড়তেই লাগল। সাঁঝ লাগতে লাগতে শোনলম গাঁয়ের আরও অনেক বাড়ি পড়ে গেয়েছে। লোকের দুর্দশার শ্যাব। নাইঅ্যানেক বাড়িতে রাঁধা-খাওয়া বন্ধ। চাল-চুলোকাঠ-খ্যাড়,আটা-চাল কিছুই নাই! আমাদের বাড়ির লোক সব বাড়িতেই রয়েছে। কত্তাও বাড়িতেতা সে তো আর বাড়ির ভেতরে আসবে নাপরচালিতে লোহার চেয়ারে ঠেসান দিয়ে চুপ করে বসে আছে। তার কোট-কাছারি নাইভোটে হেরে গেয়েছেহিঁদুপাড়ার গিরে দায়ের কাছে। কত্তার ঘাড়ের কোঁকড়ানো চুল অ্যাকন চাছা। কথা খুব কম বলে

সাঁঝবেলায় আবার বাড়িতে কেউ নাই। সব নিজের নিজের জায়গায়। আমি আর ননদ বসে আছি। কুনোমতে একটো পিদিম জ্বালিয়ে গিন্নির ঘরে দিয়ে এয়েছি। বিছেনায় গিন্নি মরার মতুন পড়ে আছে। শ্বাস বইছেনাবন্ধ হয়ে গেয়েছে বুঝতে পারা যায় না। কথা বলতে পারলেও গিন্নি আজকাল কথা একদম বলে না। আমরা ঘরের ভিজে উসারায় বসে বসে সাঁঝ নামতে দেখছি। চারপাশের সব গাছের মাথা যেন ছিড়ে পড়ছে। বাড়ির মিশমিশে কালো লম্বা তালগাছদুটো এমন করে দুলছে যেন আকাশপেমান দুই লম্বা ভূত মাথা ঝাকিয়ে। নাচছে। পুকুরপাড়ের তেঁতুলগাছের ডালপালার আঁদারের ভেতর থেকে কালো কি একটা ঝাঁক উড়ে আসছে দেখলম। কালো ফুটি ফুটি এক ঝাক পোকা। কাছে আসতে দেখিওমা পোকা নয়এক ঝক বাদুড়। এত বাদুড় একসাথে কুনোদিন দেখি নাই। আমার গা ছমছম করে উঠল

সেই রেতে দুই ছেলে নিয়ে আঁদার ঘরে শুয়ে আছি। কত্তার এতদিনের অব্যেস আলো থাকতে হবেতবু আলো জ্বালাতে পারি নাই ঘরে। আঁদার ঘরে দুই ছেলের নিশ্বেসের আওয়াজ পাওয়া যেচে। বড়টো কাছে নাইমেয়েটো বড় হয়েছেসে ছোটবেলা থেকেই আমার কাছে থাকে নাথাকে ননদের কাছে

মাটিতে বিছেনা পেতে একটু দূরে চাদর দিয়ে গা-মাথা ঢেকে কত্তা শুয়ে আছে ঠিক মরা মানুষের মতুন। আমি জানি একটি কথা বলবে নাঐ মানুষ ঠিক যেন পাথরের মুত্তি। শুয়ে শুয়ে শুদু বাতাসের আওয়াজ শুনতে লাগলম। হু হু করে একটানা বয়ে যাওয়া বাতাস তো লয়সি তো অ্যানেক শুনেছিই বাতাস যেন মদ খেয়ে এয়েছেআসছে যেন আর একটা দুনিয়া থেকে। সিখানে আটকানো ছিলঅ্যাকন ছাড়া পেয়ে খালি আসছেআসছেআসার রাস্তার কুনো ঠিক-ঠিকানা নাইমাঠ-ঘাট ভেঙে আসছেই। কতোরকম শব্দ যি হচে তার শ্যাষ নাইবড় গাছের ডাল ভাঙার শব্দটিনের চালের কাঁ-কে করে কাঁদনের আওয়াজসব আছে। শুদু কুনো জ্যান্ত পেরানির আওয়াজ নাই

য্যাতো রাত গড়িয়ে ভোরের দিকে যেচেআওয়াজ-ও যেন ত্যাতোই বাড়ছে। তবে কি এইবার ঝড় অরম্ব হবেএমন লাগছে ক্যানেএকবার কি উঠে বাইরে যেয়ে আকাশটো দেখবচোখে ঘুম তো এক ফোটাও নাই। বাইরে যাব বলে বিছেনা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিঠিক যেন পাথরের মুক্তির মতুন কত্তা কথা কয়ে উঠলবাইরে যেয়ো না। এই কথাকটি বলে পাথর যেমন পাথর ছিল তেমনিই পাথর হয়ে গেল। চুপ করে আবার শুয়ে পড়লম

ভোরবেলা থেকে শুনতে প্যালম আর-এক রকম আওয়াজ। সি বাতাসের আওয়াজ লয়ম্যাঘ ডাকার আওয়াজও লয়। কেমন এক হড়াম হড়াম দুরদুর হড়হড় আওয়াজ। অনেকক্ষণ ধরে এইরকম শুনছি আর ভাবছি ই কি ভূঁইকম্পের আওয়াজনা আর কিছুকাছে লয়অ্যানেক দূর থেকে আসছেএকবার মনে হচে মাটির তলা থেকেএকবার মনে হচে আসমান থেকে। বাতাসই বোধায় তাকে ইদিক-ঊদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যেচে। খানিকক্ষণ ধরে শুনতে শুনতে আমার মাথাটোও যেন বিগড়ে গেলকার ঘরকার বাড়িকে ছেলেকে মেয়ে কিছুই বুঝতে পারছি না। এমন সোমায় পাথরের মুত্তি আর একবার কথা বলে উঠলজোলের মাঠ থেকে পানি নেমে যাচ্ছে

আঁদার আঁদার ঘরে চাদর-ঢাকা মানুষটো থির হয়ে শুয়ে আছে। মোটা চাদরের তলা থেকে কথা বলে উঠল এমন করে যি আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। তা হবেপানি নেমে যাবার আওয়াজই বটে। আমার মনে হতে লাগলকুন্ দুনিয়া থেকে দানোরা এসে পানির রাজত্বে দাপিয়ে বেড়াইছেহটর হটর করে হাঁটছেঢাক বাজানোর মতুন বুক চাপড়াইছে। আওয়াজ শুনি আর কেঁপে কেঁপে উঠি। ইদিকের এইসব তেপান্তরের মাঠ আর সেই সব মাঠভরা পানি। পানির সমুদুরকুনোদিকে কূলকিনারা নাই। আসমানের সব পানি দুনিয়ায় ঢালা হয়ে গেয়েছেঅ্যাকন এত পানি নেমে কোথা যাবেকোথা জায়গা হবেবাতাসও বাড়ছেপানিকে সি-ও থির থাকতে দেবে নামাঠ থেকে চেঁছেপুছে ঠেলে নদীতে ফেলবে

সাত দিন বাদেআজ সকালে দেখলম সারা আকাশ ধোয়া তকতক করছে। মনে হচে কোথাও একটুকুনি ধুলো-বালি নাই। সাত দিনের কালো ময়লা আকাশ অ্যাকন নামোয় এসে দুনিয়াটোকেই কালো ময়লা চিটচিটে করে দিয়েছে। অ্যাকন এই দুনিয়া সাফ হবে কি করেকোথাও একটুও শুকনো জায়গা নাইসারা গায়ে একহাঁটু করে কাদাঘরদুয়োরের মাটি ভেজাঘরের মেঝে ভিজে স্যাতসেঁতে। ঠান্ডায়জোর হাওয়ায় কাপুনি লেগে যেচে

সকাল থেকে কাজকম্মে আছিযখুনি একটু হাত খালি হয়একটু একা হইতখুনি শুনতে পাই হড় হড়হুড় হুড় আওয়াজ। পানি নামছেইনামছেই। আঁদার ভোররেতে য্যাতো ভয় লেগেছিলঅ্যাকন আর ওরকম লাগছে না। খালি মনে হচেএই আওয়াজ আর সইতে পারছি না। পানির ভারে দুনিয়া হাঁসফাস করছেনিশ্বেস নিতে পারছে না। মনে হচে আমিও নিখেস নিতে পারছি না। কবে আবার দুনিয়ার ভালো শ্বাস হবেথির হবে পিথিমিঅ্যাকন কোথাও কুনো পাখি দেখছি নাকবে আবার পাখ-পাখালি ফিরে আসবেএই ভায়ানক হাওয়াটো থামবেঅমন করে হাওয়া মাথাপাগলের মতুন করবে না?

বিষ্টিটো থেমেছে বটেরোদও উঠেছে কিন্তুক হাওয়ার জোর থামল না। সব পানি না সরিয়ে সে থামবে না। গাঁয়ের পুবদিকের ঢালু দিয়ে পানি নেমে যেচে। ইদিকের মাঠ-ঘাট সব পুব-উত্তরে কাত। সিদিকে সব বড় বড় নদী আছে। বাতাস পানিকে তাড়িয়ে সিদিকেই নিয়ে যেচে

তিন দিন পরেদশ দিনের মাথায় এই কেয়ামত শ্যাষ হলো। বিষ্টি গেলহাওয়া গেলআসমান আবার নীলবন্ন হলোসোনাবন্ন রোদ হলোসব হলো! সেজ দ্যাওরল-দাওর যারা চাষবাস নিয়ে থাকেতারা দুজনে একদিন বাড়ি এসে কপাল চাপড়ে বললেমাঠে কিছু নাইকিছু নাইএকটি দানা মিলবে না কারুর

 

দুনিয়ায় আর থাকা লয়গিন্নি দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল

ল-দ্যাওর সব কথা বেশ ভালো করে বলতে পারে। দশ দিনের বাদলঝড়-হাওয়া থেমে গেলে মাঠ দেখে এসে সে বলেছিলসারামাঠে একটি দানা ফলবে নাএকটি ধানের শীষও টিকবে না। তার কথাই সত্যি হলো। আজ ননদকে সাক্ষী রেখে সে বললেমাঠের সব পানি নেমে গেলে মাঠ দেখে বলেছেলম না যিইবার আর মাঠে আমন ধানের কোনো গন্ধ নাইএক কাঠা ধানও কেউ পাবে নাবলি নাইজমির কাছে গেলেই আমরা বুঝতে পারিতাতে নিশেস আছেনা নাই! জমির অসুখ-বিসুখ আছেনিশ্বেসের কম-বেশি আছেমরতে মরতে মরে পাথর হয়ে যাওয়া আছেজমি যে না চেনেসে কি তা বুঝতে পারবেতখুনি বুঝেছেলম আমরামাঠকে মাঠ একদম কালা ঠান্ডা। কালো কাদা বার করা জমি। তার ওপরে সরু সরু বগরোঁয়ার মতুন সব ধানের চারা যা আছেদু-দিন বাদেই শুকিয়ে যাবে

পর পর দুই সন তাইলে ফসল মারা গেল। গতবার হয়েছিল খরানি আর ইবার ঝড়-বাদল। অ্যাকন দুনিয়ার দিকে তাকাইলে তা কি বোঝবার বাগ আছেকোথা বাদলকোথা সেই অঝোর পানিকোথা সেই ইবলিশি হাওয়া আর কোথাই বা সেই পাষাণের মতুন আসমান। অ্যাকন ধান পাকার সোমায়সোনা-মাখানো ধান। আসমান ভরা রোদ হবেজানভরা ঠান্ডা হি হি বাতাস হবেতা সবই হয়েছেসবই হবেশুদু মাঠে একদানা ধান নাই। ছিল যুদ্ধতাতেই লোক মরতে শুরু করেছিলগাঁয়ের আদ্দেকের বেশি মানুষ অ্যাকন ন্যাংটো থাকছেদিনের বেলায় বেরুইতে পারছে না। যারা বেরুইচেভাগ্যিস তাদের শরম নাইবুড়ো-বুড়িরোগে-শোকে মরা মানুষ তাদের ইজ্জত থাকলনা থাকল নাকে সি কথা ভাবছেকিছুই নাইকিছুই নাই! যুছুতেই এই! এবার যোগ হলো আকাল। দু-বছর ধরে জমানো ধান খেয়ে খেয়ে অ্যাকন আমাদের বাকি আছে পুরনো ধানের আর মাত্তর একটি মরাই। এতে আর ক-দিন চলবে?

কত্তা কতোদিন আর বাড়ির ভেতরে আসে না। কোট-কাচারিআমলা-ফয়লা অ্যাকন আর কেউ নাই,পেয়াদা-দফাদাররাও নাই। পালকিটো পড়ে আছেরং চটে গেয়েছে। কাঠ ভেঙে ভেঙে পড়ছেঘোড়া একটো আছে বটে এখনো ঘোড়ায় চেপে কত্তা কতোদিন কোথাও যায় না!

সেই কত্তা হঠাৎ একদিন আগের মতুন হৈ হৈ করে কথা বলতে বলতে বুনের নাম ধরে ডেকে বাড়িতে এসে ঢুকল। বাড়ির মাহিন্দারটোর মাথায় বেরাট একঝুরি ভত্তি ফল। সোজা উত্তর-দুয়োরি যে ঘরে গিন্নি শুয়ে আছেসেই ঘরে ঢুকে মাহিন্দার ছোঁড়াটোকে। ঝুরি নামাইতে বললে। শীতকালের দিনসব ফলমূল অ্যাকন পাওয়া যায় সত্যি! তাই বলে এতরকম ক্যানেসব পচে লষ্ট হবে। আপেল নাশপাতি বেদানা কমলা আঙুর কিসমিস খেজুর ইসব তো আছেইআরও কতরকম আছে আমরা তার নাম জানি না। গিন্নির মাথার কাছে বসে তার একটি শুকনো হাত তুলে নিয়ে কত্ত বললেমাঅনেকদিন আসি নাই তোমার কাছেএকবার আমার কথা শোনো। গিন্নি চোখ মুজে ছিলতেমনি মুজেই থাকল। শুনতে পেলে কিনাঘুমিয়ে আছে কিনা বুঝতে পারা গেল না। এই কিছুদিন আগে পয্যন্তও গিন্নির জেগে থাকাঘুমিয়ে থাকা আলেদা আলেদা ছিল। জেগে আছেনা ঘুমিয়ে আছেপষ্ট বুঝতে পারা যেত। জেগে থাকত য্যাকনটক টক করে চেয়ে থাকতঘুমুইলে সমানে ঘুমুইত। এই কদিন হলো সব সোমায় চোখ মুজে থাকছে যেন চেয়ে থাকবার খ্যামতা নাইচোখের পাতা বুজে বুজে যেচে। কত্তা আরও কবার মা মা করে ডাকলে কিন্তুক গিন্নি চোখের পাতা মেলতে পারলে না। জাগা আর ঘুমুনো তার কাছে একাকার হয়ে গেয়েছে

সারা ঘরে রুগির গন্ধ। সি গন্ধ এমনিই যি ঘরে ঢুকলেই বমি আসে। পেশাব-পায়খানা এখনো আমিই পরিষ্কার করি আর কাউকে করতে দিই না। কিন্তুক য্যাতেই করি গন্ধ হবেই। আজ ছ-মাসেরও বেশি হলো গিন্নি শুয়ে আছে ঘরের মুদুনির দিকে চেয়ে চেয়ে। কোমরে পিঠে দগদগে ঘা হয়ে গেয়েছে। এত ধুইয়ে দি,ওযুধ দিঘা দিন দিন বেড়েই যেচে। গিনি মাঝে মাঝে তাকায় আমার দিকে কি যি আছে সেই চাউনিতেকেউ বলতে পারবে না। একবার একবার মনে হয় বৈকি আর কত দিন! মনে হয়আর নিজেই শরমে মরে যাই। কত্তা আবার ডাকলেমাশোনো। বহু কষ্টে গিন্নি চোখ মেললেমনে হলো এইবার বোধায় কাকে সেই কথাটো বলবেযি কথা আমাকে অ্যানেকদিন বলেছে। সি কথাটি এইদুনিয়ায় বেঁচে থাকার লিয়ম আছেতার বেশি বাঁচতে নাই। আগের দুনিয়া আছেপরের দুনিয়াও আছে। সব দুনিয়া সবার জন্যে লয়। ভাবলমএইকথাই বোধায় বলবে কত্তাকে। কিন্তুক গিন্নির ঠোঁটদুটি টিপে আটকানোশুদু চোখদুটি মেলে কত্তার দিকে চেয়ে আছে। কত্তা আবার বললেশোনোবাজারে যতো ফলমূল পাওয়া যায়একটা একটা করে সব এনেছি। আর তো কিছু খেতে পারো না তুমি! তবু তোমার জন্যে নয়এনেছি আমার জন্যেআর হয়তো কোনোদিন সুযোগ পাবো না। মাশুধু আমার মুখের দিকে চেয়েআমার সামনে একটু কিছু খাও। এই বলে কত্তা গিন্নির শুনো হাতটি আর একটু নিজের দিকে টানতে গেল। ত্যাকন দেখলমহাতটো কেমন সরতে লাগলসরতে সরতে কত্তার হাত থেকে খসে পড়ে তার কোলে এসে পড়লতাপর কোল থেকে আস্তে করে মেঝেতে পড়ল। গিন্নির চোখদুটি ত্যাকননা তেমনি করে চেয়ে আছে

একটু বাদেই কত্তা বুঝলে তার মা আর নাই

 

সোংসার তাসের ঘরতুমি রাখতে চাইলেই বা কি

দুটি বছর পেরুল। এই দুটি বছর যি কেমন করে গেল সি শুদু আমিই জানি এমন কথা বলতে পারব না। দুনিয়া জাহানে যারা আজও বেঁচে আছেনা খেয়ে শুকিয়ে মরে নাইরোগে ভুগে মরে নাইরাস্তায় হুরে পড়ে মরে নাইকুনো পেকারে শুদু বেঁচে আছেতারাই তা হাড়ে হাড়ে জানে। একটি একটি করে দিন আর যেন কাটে নাইরোজ-কেয়ামতের লেগে অপিক্ষেও এর চাইতে ভালো

গায়ে লোক অ্যাকন অ্যানেক পাতলা। মরার ছিল যারাঅ্যানেক খুনখুনে বুড়োএমনিতেই দু-দিন বাদে যারা মরবেতাপর যারা রোগে ভুগছিলওষুধ-পানি তো দূরের কথাএকমুঠো খুদও জোটে নাইতারা আর দেরি করে নাই। বিছেনায় সেই যি শুয়েছেআর ওঠে নাই। কাউকে কিছু বলে নাইওষুধ চায় নাই,ভাত চায় নাইএকবার কাছে বসবার লেগে বউ-ছেলে-মেয়ে কাউকে ডাকে নাইবোধায় জাকামদানির সোমায়েও এতটুকুন শব্দ করে নাই। হিঁদু হলেমনে হয়ভাই বন্ধু ছেলের কাঁধে চেপে পাঁচ কোশ দূরে ভাগীরথী নদীর পাড়ে শ্মশানে যেয়ে পোড়বার আশাও করে নাই। কি জানিমোসলমান মওতা কবরের আশা করেছিলনা করে নাই। তবে তা একরকম করে হয়ে গেয়েছিল। কবর দেবার লেগে বেশি দূরে তো যেতে হতো না! মাঠের ধারেপুকুরের পাড়েনাইলে কুনো একটা খানায় গাড় খুঁড়ে মড়া রেখে এলেই হতো। এমনি করে বুড়ো-ধুরোজনম-রুগিঢোক-পিয়াসিউদুরি যারা ছিল তারা পেথমেই গেল। তাপরে মরতে লাগল সব রোগা-ভাংরোগুলিনআজ হোককাল হোক যারা মরতই। এদের মরা হয়ে গেলে বাল-বাচ্চাদের মড়ক এল। দুধের বাচ্চাদুধ ছাড়া আর কিছু খায় নাখেতে শেখে নাইতা মায়ের বুক এমন শুকনোর শুকননা যি চোঁ চোঁ করে টেনেও এক ফোঁটা দুধ বার করতে পারত না বুকের দুধের বাছা দুনিয়ার আসে তো দয়া করেরহমতের মতুন। বয়ে গেয়েছে তার বাঁচতে। এয়েছেলমথাকতে দিলি না,চললমবোধায় এই মনে করেই সব ঝটপট বিদেয় হতো। তবে এরা মরলে কুনো হ্যাঙ্গাম-ফৈজত নাই। মাঠের ধারে এই পুকুর ঐ পুকুরের পাড়ে গাড় খুঁড়ে মাটি চাপা দিয়ে এলেই হতো। হিঁদু-মোসলমান সবাই তা-ই করত

সেই যে পরপর দু-বছর একটি দানা ফলল নাযুদ্বুও পেলয়-আকার নিলেকলকাতা বন্দোয়ান আর কুন কুন্ শহরে জাপানিরা বোমা ফেললেসেই সোমায় ধানচাল একদম গরমিল হয়েছিলপয়সা তো দূরের কথা সোনার অলংকারগয়না দিয়েও একমুঠো চাল পাবার উপয় ছিল না। শহরেও পাওয়া যেছিল নাআবার দামেও আগুন লেগেছিল ধান-চালের বাজারে। কত্তাও ত্যাকন বলেছিল চালের এত দাম সি-ও লিকিনি বাপের জম্মে দেখে নাই। তবে গাঁয়ের কথা আলেদাগাঁয়ের লোকে তো আর চাল কিনে খেত না। তাদের কাছে চালের দাম বাড়লেই কিকমলেই বা কিতারা পরপর দু-সন ধান পায় নাই একটো। তাদের তো ঠারো দাঁড়িয়ে মরতে হবেশুয়ে-বসে আয়েস করে মরার ভাগ্যও তাদের নাই

ত্যান দেখেছেলমমানুষরা সব এক জায়গায় বসে নাকেউ কারুর সাথে কথা বলে নাদুটো গল্পগাছাও করে না। কিসের লেগে দিনরাত কুকুরের মতুন হাঁ হাঁ করে ঘুরে বেড়াইছে। এমনিতে কথা নাইকিন্তুক আবার কথা মানেই মারামারি। উপোসি মানুষ মারামারিই বা করে কেমন করেখানিক বাদেই হাঁফিয়ে যেয়ে একজনা আর একজনার দিকে এমন করে তাকিয়ে থাকে যেন পারলে কাঁচা চিবিয়ে খায়। আমাদের বাড়ির খামারে দেখেছি একগাদা লোক পাঁচিলের ছোয়ায় বসে আছে কিন্তুক কেউ একটি কথা বলছে না। গাঁয়ের রাস্তায় রাস্তায় হন হন করে হেঁটে চষে বেড়াইছে মানুষকুনো কাজ নাই। শুদু আনাগোনা-ত্যানাতাঁত বোনাবুনি করছে। কি করবেকোথা যাবে কিছুই যি ঠিক নাই। আদুরে আদুরে ছেলে সব দল বেঁধে মাঠের দিকে চলে যেচেসারা দিনে আর বাড়ি আসে না। এসে কি করবেবাড়িতে চুলো জ্বলে নাইহাঁড়ি চড়ে নাইতাইলে বাড়ি এসে কি করবেঘাটে মাঠের পুকুরে যেদি দুটো বনকুল কি শেয়ার্কুল পায়গাছে একটো কয়েতবেল পায় কিম্বা শালুকপদ্মর উঁটা ঘাটা খাঝার মতুন কিছু পায় তা-ই চিবিয়ে পেটে দেবে। গাঁয়ের ইস্কুল খোলাও নাইবন্ধও হয় নাই। যার মন হয় যায়যার মন হয় নাযায় না। মাস্টাররাও কেউ আসেকেউ আসে না

নাইনাইকিছুই নাই। হেলেঞ্চা শাককলমি শাকশুষুনি শাক যা সব যেখানে সেখানে পাওয়া যেতযে খুশি নিয়ে যেত। অ্যাকন সিসব সারা গা খুঁজে কোথাও পাবার উপয় নাই! আচ্চয্যির কথাগাধাপুইনিখইলুটি শাক যি শাকযা কেউ খেত নাগরু-ছাগলেও নাসেই শাকও গরমিল। যার সজনে কি একটো ডুমুর গাছ আছেসে অ্যাকন একটো শজনের পাতাএকটো ডুমুরও কাউকে দেয় না

আকালের মদ্যে মানুষ কি মানুষ ছিলপুরুষরা নাইলে প্যাটে কাপড় বেঁধে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াইতবউ-ঝি-শাশুড়ি যারা তারা নাইলে ঘরের ভেতর মুখ বুজে বসে থাকতজোয়ান জোয়ান বিটিছেলেগুলিন কি করেতারা সব লোকের বাড়ি বাড়ি দাদুরে বেড়াইতে লাগল। আমি মেয়েমানুষতবু তাদের দিকে তাকাইতে পারতম না। ময়লা চেকট ত্যানাকানি পরে আছে। তার ভেতর দিয়ে সব দেখা যেচেকিছুই ঢাকা পড়ে নাই। তা ঢাকা পড়বেই বা কিনা খেয়ে খেয়ে দ্যাহে কিছু নাইঢাকা দিলেও যা,না দিলেও তাই। সবার আবার ত্যানাকানিও জোটে নাই। কেউ এক টুকরো পচা চট জড়িয়েছে কোমরে। আর এক টুকরো জড়িয়েছে বুকে! কাকে শরম করবেকি করে শরম করবেএ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়াইছে ভূতের মতুনগাছপালার আড়ালে আড়ালে। জট পাকিয়ে আছে চুলডাইনির মতন সেই চুল চুলকোতে চুলকোতে ছিড়ে ফেলছে। খারাপ কিছু তারা করে নাই। তবে খিদের জ্বালা এমমি জ্বালা লোকে করতে চাইলে কি তাদের নিয়ে খারাপ কাজ করতে পারত নাতা তেমন কিছু হয় নাই। গাঁয়ে ঘরে সবাই আকালে মরছেফুত্তি করার মানুষ কোথা?

গাঁ থেকে কুনো মেয়ে যায় নাই। কটো পরিবারতা দশ ঘর হবেগাঁ থেকে চলে গেয়েছে। ঐ দশটো বাড়ি বাগদিপাড়ার দু-ঘরহাঁড়ি-ডোমপাড়ার তিন ঘর আর হিঁদু-মোসলমানপাড়ার চার-পাঁচ ঘর শ্যাষ পয্যন্ত গাঁয়ে আর থাকতে পারলে না। কারুর সাধ্যি হলো না যি তাদের বলেযেয়ো না। রাত আঁদার থাকতে থাকতে কাউকে কিছু না বলে ওরা গা ছেড়ে চলে গেল। শহরে গেলে লিকিনি কাজ পাবেকাজ খুঁজে নেবে। আমরা ভাবতমআকাল পেরুইলে গাঁয়ে ফিরবে বোধায়। কেউ ফেরে নাই। ঘর-বাড়ির চাল গলে-পচে ভেঙে পড়েছেন্যাংটো দেয়ালগুলিন অ্যাকনও আছে

একদিন সাঁঝরেতেত্যাখনো ভালো করে আঁদার নামে নাইকি মনে করে বাড়ির বাইরে এসে খামারে দাঁড়িয়েছেলম। খামারের পচ্চিমদিকের দুই বাড়ির ছামনের গলি দিয়ে তামিল পুকুরের পাড় আর মাঠ দেখা যেচে। দেখি কিপুকুরের ঢাল ধরে কারা সব মাঠে এসে নামল। ঐ তিমি-সাঁঝের আঁদারে সব ছেয়া হেঁয়া মানুষ তাদের গায়ে জামাকাপড় আছে কি নাইএতদূর থেকে বুঝতে পারলম না। বোধায় নাইথাকলেও ছেড়া ত্যানাকানির বেশি কিছু নাইরেতে বেরিয়েছে য্যাকন। যেচে কোথা ওরাই গাঁয়ের মানুষ যি লয়সি তোবোঝাই যেচে। তাইলে কি আশেপাশের এলেকা থেকে এসে ওরা এই গাঁয়ের ঝোপ-জঙ্গলে এসে লুকিয়ে ছিলহায়রেতের আঁদারও যে মানুষের এত দরকারতা কি কুনোদিন ভেবেছি! মানুষগুলিন দূরে চলে যেচেতা দেখতে পেচি। মেয়ে-মরদ বালবাচ্চা সব আছে ঐ দলে। সব ভূতের মতুনসব ছেয়া ঘেঁয়া। ভাত নাইকাপড় নাইজেবনটো এসে ঢুকেছে প্যাটের চুলোয়। সিখান তুষের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছেকিছুই চোখে দেখতে পেচে না। ইজ্জত-শরম তো দূরের কথাসন্তানটোকেও দেখতে পেচে না। ভিটেমাটি ছেড়ে সব বেরিয়ে পড়েছে। ই গাঁয়ে এসে যি বাড়ি বাড়ি ভিখ মাঙবে তারও উপয় নাই। আধ-উদম মেয়ে-পুরুষ সবযেদি কেউ চিনে ফেলে। দূরে যেয়ে যা খুশি তাই করবেকে আর চিনবে?

আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রয়লম। আঁদারে মিলিয়ে যেতে লাগল দলটোআঁদারেই গোটা দলটো জড়া-পুটুলি পাকিয়ে একটা বড় হেঁয়া হয়ে গেল। তা-বাদে আর তাদের দেখতে প্যালম না

দুই চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে বসলম। ওরেঅ্যাকন কাকে ডাকিকার সাথে দুটো কথা বলিবাড়ি খাঁ-খাঁ করছেএত লোক বাড়িতে কিন্তুক অ্যাকন কেউ নাইএকটি ছেলেমেয়েও দেখতে পেচি না। নিজেরগুনো বড় হয়েছে। তারা মায়ের কাছে অতো আসে না। তাইলে এইবার কি আমাদেরও নিজের নিজের প্যাটের ভেতরে সেঁদোনর সোমায় হলোশ্যাষ যি মরাইটো ছিলতার আর আধখানা বাকি আছে। এইমাত্তর খামারে তা দেখে অ্যালম। তা ভালো। এখনো আমরা দোকান করতে যাইগামছার কোণে দুটো চাল বাঁধা থাকে। ঐ চাল দোকানদারকে বেচে ত্যাল-নুন ট্যানাকাঠি মশলাপাতি কিনিদু-বেলা চুলো জ্বলেভাতের চাল ফোটে। তবে সি আর কদিন কে জানে! আমার বুক ফেটে যেতে লাগল। উসারার খুঁটিতে ঠেসান দিয়ে একা বসে থাকলম। গিন্নির ঘর ফাঁকাসি ঘরে কো-কাপ আঁদার। এই তো কদিন হলো চলে গেয়েছেমওতার ঘরে আলো জ্বালানোর নিয়ম। কিন্তুক আলো জ্বালাব কোথা থেকে?

যুদ্ধ নিয়ে অ্যাকন আর কেউ ভাবে না। যা হবে হোক। দিনে রেতে কতোবার কতো উড়োজাহাজ আসছে-যেচেকেউ তাকিয়েও দেখে না। বোধায় বোমা ফেললেও কেউ গা করবে না। বোমাতে আর কতোজনা মরবেআর মরলে সাথে সাথে মরবে। ভুখের জ্বালায় এমন করে ধুকে ধুকে তো মরতে হবে না! বউ-মেয়ে-পুতের মরণও দেখতে হবে না

গাঁয়ে অ্যাকন কন্টোলের দোকান হয়েছে। কটো বাঁধাবাঁধি জিনিশ সিখানে পাওয়া যায়। শাড়ি এলে শাড়ি পাওয়া যায়। সবুজ বা নীল পাড়ওয়ালা মোটামিলের শাড়ি। আজকাল তা-ই পরছি। আর পাওয়া যায় মোটা মার্কিন কাপড়। ছেলেদের জামা তৈরির লেগে পাওয়া যায় লংক্লথ বলে আর একরকম কাপড়। মিলের শাড়ি এমন মোটা যিভেজালে ভারি চব্বর হয়ে যায়। তোলে কার সাধ্যি। এমন মোটা কাপড় কুনোদিন পরি নাই। ননদ পরত মিহি ধূতি। অ্যাকন সবাই ঐ মোটা মিলের শাড়ি পরছি। পাওয়া যে যেচেসেই কত! ই কাপড়ও কন্টোলের দোকানে সব সোমায় আসে না। য্যাতো দরকার ত্যাত কুনোদিনই মেলে না। সবাই যেদি কিনতে পারততাইলে কন্টোলের দোকানে য্যাতোই শাড়ি আসুক সবাই পেত না। বাজারের দিষ্টে দাম বেশ কমই বটে। তা য্যাততই কম হোকদাম দিয়ে শাড়ি কেনার লোক আর কজনাকন্টোলের দোকানে জিনিশ পেতে গেলে রেশন কাট করতে হতো। তাতেই সব জিনিশের নাম লেখা থাকত। কাপড় ছাড়া পাওয়া যেত চিনিট্যানাকাটিকেরাসিন এসব। আরও অনেক জিনিসের নাম লেখা থাকত। ঐ নাম পয্যন্তই সারা বেশিরভাগ জিনিশই থাকত নাযা বা থাকত তা কখন পাওয়া যাবেকতোটো পাওয়া যাবেতা বলবার জো ছিল না

বাড়িতে কন্টোলের শাড়ি এল। শাশুড়ি নাই। তাই ননদ জা-দের সবাইকে ডাকলেনিজের হাতে এক-এক জনের হাতে কাপড় তুলে দিলে। কিন্তু পেত্যেকে দেখলম কাপড়-হাতে মুখ নামিয়ে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলে। কাপড় কি পছন্দ হয় নাইননদ কিছুই বুঝতে পারে না। এতকাল ইসব কাজ গিন্নি নিজে করততা সে চলে গেয়েছে দুনিয়া ছেড়ে। অ্যাকন ননদের ওপরেই সব দায় পড়েছে। সে বুঝতেই পারছে না,কাপড়-হাতে সব মুখ বেজার করে দাঁড়িয়ে আছে কেনে। ননদ এই কথা দু-একবার শুদুইতেই আসল কথাটো বেরিয়ে এল। কাপড় পছন্দ হয় নাই। সবই তো এক কাপড়শুদু পাড়ের রঙ আলাদাতাইলে পছন্দ না হওয়ার কি আছেআমরা পাঁচ বউ সিখানে হাজির। ছোট দ্যাওরের সোংসার শহরেতা সে-ও পরিবার অ্যাকন গাঁয়ে রেখে গেয়েছে শহরের আবস্থা দেখে। তাই আমরা পাঁচ বউ-ই হাজির। মনের কথাটি কেউ ভেঙে বললে না বটে কিন্তুক কথায় কথায় বুঝতে পারা গেলনিজের কাপড়টোই কারুর পছন্দ লয়অন্য জনার হাতে যি কাপড়টো সেইটো পছন্দ। কি আচ্চয্যির কথাননদ বলেই ফেললেএকই কাপড়তফাত কিছুই নাইশুদু পাড়ের রঙের তফাত। এরই জন্যে নিজের কাপড়টি পছন্দ নয়আরেকজনারটি পছন্দনাএ ভালো কথা নয়ভালো কথা নয়

আমি তো কিছুই করি নাইমায়ের আমল থেকে এই নিয়ম চলে আসছে। মেতর-ভাই শুধু মায়ের ইচ্ছার দাম দিয়েছিল। দু-বছরও হয় নাইমা দুনিয়া ছেড়ে গেয়েছেএর মধ্যেই সব নিয়ম পাল্টে যাবেতা যাকগোএই নিয়ে আমি অশান্তি করতে পারব না। শাড়ি সব এই রইলযার যেমন মন হয়তুলে নাও

সিদিন এর বেশি আর কিছু হলো না। যার হাতে যি শাড়ি ছিলসে সিটিই নিলে কুনো কথা না বলেকিন্তুক হাসিমুখে লয়। যেমন বেজার মুখে ছিলতেমনি বেজার মুখেই নিজের নিজের কাপড় নিয়ে গেল। কি মনে করে রেতে এই কথা কত্তাকে বলতে গ্যালম। রাগ করে বলি নাইআমার ভালো লাগছিল না বলেই বলতে গ্যালম। তা এমন করে সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেউঃসি যি কি চাউনি আমার জানের ভেতরটা পয্যন্ত দেখে নিলেআমি কথাটো আধখানা বলেই থেমে গ্যালম। এই পেথম কত্তা আমাকে যেন দেখলেআমিও তেমনি দেখতে প্যালম কত্তাকে। কত্তার সেই চাউনির ভেতরে রাগ ছিল না। মনে হছিল কষ্টে আর দুঃখে সে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়বে

তাইলে সব্বোনাশ কি এমনি করেই শুরু হয়চুলের মতন সরু একটো চিড় কোথা যেন ছিলচোখে দেখতেই পাওয়া যেত না। পেথম দিন দেখে মনে হলোকইআগে কুনোদিন দেখি নাই তোপরের দিন দেখছিওমাতার পাশে আর একটো চিড়তাপর দেখতে দেখতে অ্যানেক অ্যানেক চিড় সব জায়গায় কখন হলোকি হলোকেমন করে হলো ভালো করে কিছু বোঝার আগেই একদিন বড় বড় ফাটল ধরে জিনিশটো চৌচির হয়ে ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সোংসারেও কি তাই হতে যেচেহঠাৎ খেয়াল করলমআমাদের বড় সোংসার অ্যাকন কত বড় হয়ে গেয়েছে! এ তো একটো সোংসার লয়পাঁচটা সোংসারএ তো ডালপালা বাড়া নয়ই বটগাছের মতুন। আলেদা আলেদা ঝুরি নেমে আলেদা আলেদা বটগাছ হয়েছে আর মূল গুঁড়িটো

অ্যাকন আর মুটেই নাইফোপরা হয়ে কবে শ্যাষ হয়ে গেয়েছে। গিন্নি ছিল মূল গুঁড়িসে থাকতে থাকতেই যার যার ঝুরি নামছিল। অ্যাকন আর সি গুঁড়িই নাইমূল গাছটো থাকবে কি করে?

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটো ভায়ানক কথা মাথায় এল। আমিও কি তাইলে এত দিন তলায় তলায় ঝুরি নামিয়েছিসবাইকে বাদ দিয়ে আমার নিজের সোংসারের একটো আলেদা বটগাছের ঝুরি কি পুঁতিছিএকবার ভেবে দেখি তো! নিজের মন নিজের কাছে বিচের করলে দোষ কিছুই নাই। নিজের য্যাতো খারাপই বেরুক কে আর তা জানতে পারছেসেই লেগে খুব চেষ্টা করলম জা-দের কথা না ভেবে নিজের মনের উলুক-শুলুক খুঁজে দেখতে। বড় খোঁকা মারা গেয়েছে তেরো-চোদ্দ বছর। সে আজ বেঁচে থাকলে মনের আবস্তা কি হতো জানি নাহয়তো জা-দের চেয়েও দশকাঠি সরেস স্বাস্থপর হতোম। কিন্তুক সে নাইসে চলে যাবার পর আর আমার জেবনে জেবন নাইকোথাও খুঁটি পুঁতি নাইকোথাও ঝুরি নামাই নাই। আমারএই কথা কেউ জানে নাকত্তাও জানে না। ছেলেমেয়ে আজ যারা আছেবড় হয়ে গেয়েছেতারাও কেউ জানে না। আমার ঝুরি মাটিতে নাইবাতাসে আলগ ঝুলছে

তাই বলে আমার কপাল দিয়ে সবাইকে বিচের করতে যাব ক্যানেদুষবই বা ক্যানেসিদিন আর কিছু হয় নাইঝগড়াঝাটি নাকথা-কাটাকাটি নাননদের দিকে চোখ তুলে কেউ একটো কথাও বলে নাই। তবু ক্যানে আমার মনে হলোএই শুরুসোংসারের ভাঙনের এই হলো গোড়াপত্তনসুখের দিনে কিছু হয় নাইসবাই হেসেছেখেলেছেসবাই সবাইকে দেখেছেদুখে দুখিসুখে সুখী হয়েছে আর অ্যাকন য্যাকন কাল খারাপ পড়েছেঅভাব দেখা দিতে। শুরু করেছেসবকিছুই ভাগে কম পড়ছেঅমনি কোথা থেকে বিষের মতুন গল গল করে হিংসে বেরিয়ে আসতে অরম্ব হয়ে গেয়েছে

অভাব যি অমনি করে আস্তে আস্তে হাঁ করেকুনোদিন জানতম। ধানের শেষ মরাইটো খালি ছোট হছিল। অত বড় পেল্লায় মরাইমনে হতোঅত ধান খেয়ে কে ফুরুইতে পারবেসেই মরাই হঠাৎ একদিন দেখলম কেমন এতটুকুনি হয়ে গেয়েছে। তারপর দেখলম ল-দাওর একদিন মুখটো হাঁড়ি করে মরাই ভেঙে সব ধান বার করে ফেললে। পোষ-মাঘ ত্যাকননা অনেক দেরি। দ্যাওরকে শুধুইতে সে মুখ কালো করে বললেএই ধানকটির চাল ফুরুলেই বাড়ির খোরাকি ধান আর কোথাও নাই। তার কথাটো নিয়ে ত্যাকন তেমন ভাবি নাই। ওমাওর কথার মানে হচে এই বাড়িতে উপোস অরম্ব হবে আর দু-তিন মাসে বাদেসিদিন কি সত্যিই আসবেকত্তা কিছু করবে নাএই সোংসার তো তার। সেই-ই তিলে তিলে গড়েছেসেই অ্যাকন এই খেলাপাতি ভেঙে দেবেতার পক্ষে সবই সম্ভাবদিতেও পারে। সিদিন রেতে একবারের লেগে দেখে ফেলেছেলম তার ভায়ানক দুঃখ আর কষ্টের মুখ! তবু কি শক্ত সেই মুখযেন লোহা পুড়ে গনগন করছে। ঐ মুখটিকে আমি খুব ভয় করি

এই গরমকালেও কোথা থেকে আসছে এই হাঁড়কাপুনি ঠান্ডা বাতাসসব একদম কালিয়ে জমে যেচে। আগে আগে সোংসারে সব জিনিশ খালি বেড়ে যেত। সব কিছুতেই ছিল বরকতকিছুতেই কুনো কিছু শ্যাষ হতো না। অ্যানেক জিনিশই ফেলে দিতে হতো। কতবার গুড় আলু পেঁয়াজ পচে গেলনষ্ট হয়ে গেলসব ফেলে দিতে হলো। কখনো কখনো ভাবতে হতে এত ফলে ক্যানেসব ল্যাজোবরা হয়ে থাকে। হাতের কাজ আর শেষ হতে চায় না। এইবার দেখছি সবকিছুতে ভাটার টান। সেই যি দু-বছর আগে ফাঁপা সমুদুরের মতুন। পানি উথাল-পাথাল হাওয়ায় দু-দিনে হুড় হুড় করে নেমে গেলঠিক তেমনি এক হাড়কাপুনি হাওয়ায় বাড়ির সব জিনিশ যেন উধাও হয়ে যেতে লাগল! এই ছিলআর নাই। ভরা ছিল সকালেবৈকালে খালি। একটু বেলা হলে গাই দুইয়ে দুধ আনা হয় বাড়িতে। অতো দুধ কোথা রাখবকি করবআগে এই ভাবনা হতো। কতদিন দুধ নষ্ট হয়েছে। বলে গিন্নির ধমকানি খেয়েছি। অ্যাকন দেখিসেই দুধ এক বলকা করে রেখে দিলে ঠান্ডা হওয়ারও সময় হয় না। জা-রা সব তক্কে তক্কে থাকছে। ঘটি-বাটি-গেলাসে সবাই নিজের নিজের ছেলেমেয়ের দুধ ঢেলে নিয়ে নিজের নিজের ঘরে চলে যেচে। ননদ যি ছেলেপিলেদের ডেকে ডেকে দুধ খাওয়াতঅ্যাকন আর তার কুনো উপয় নাই। আগে দুধ ফুরুইত নাঅ্যাকন সবার কুলুইচে না। ননদ দুধ দিতে যেয়ে দেখছে দু-একজনকে বাদ দিতে হচে। যারা বড় হয়েছেতারাই কেউ কেউ হয়তো বাদ পড়ছে। জা-রা বাছাবাছির কুনো ধার ধারছে নাযে যেমন পারছে দুধ ঢেলে নিয়ে চলে যেচে। কত্তা বরাবরই রেতের বেলা এট্টু দুধ খায়। আমি তো আর কত্তার দুধ ঢেলে আনার লেগে বাটি নিয়ে জায়েদের সাথে দাঁড়াইতে পারি না। শরমে মাথা হেঁট হয়ে যেতে লাগল। আমার রকম দেখে ননদ-ই বা আর কি বলবেচুপ করেই থাকছে। এক-একদিন দুধের কমবেশি নিয়ে জায়েদের মধ্যে লেগে যেচে তুলকালাম কাণ্ড। চিকার চেঁচামেচি শুনে কত্তা একদিন বাড়িতে ঢুকেছিল। আগে তাকে দেখলে জা-রা ভয়ে শরমে পাথর হয়ে যেত। সিদিন কেউ গেরাহ্যি করলে না। একটু দাঁড়িয়ে থেকে কত্ত আস্তে আস্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল

ভরা গোয়াল কবে খালি হলো কেউ জানে না। মাহিন্দার দুটো বিদায় হয়েছে। পাড়ার এক ছোঁড়া মাঠে গরু চরাতে নিয়ে যায়। গাইগুলিন কি দড়ি ছিড়ে ছিড়ে গোয়াল থেকে লাপাত্তা হয়েছেকোথা গেল ঐসব বড় বড় দুধেল গাইক-বছর আগে মড়কে মরেছিল তিনটোগেমার বিষ খেয়ে ধড়ফড় করে মরল সিন্দিটো। অনেক কটো বকনের বাছুর হলো না। মোষও অ্যাকন আদ্দেক। পেয়ালা রঙের একটো বুড়ি ঘুড়ী আছে অ্যাকনো। কত্তা ঘোড়ায় চাপা ছেড়েছে অ্যানেকদিন। কেউ কিনতে আসে না বলেই ঘুড়ীটো অ্যাকনো বাড়িতে রয়েছে

যুদ্ধ তো ছিলইতাতে তেমন কিছু হয় নাই। কিন্তু মাত্র দু-বছরের আকালে দুনিয়া অন্যরকম হয়ে গেল। ভাত-কাপড়ের টান বড় টান। আর একজনার কি হছে তা নিয়ে কে মাথা ঘামাবেযার পরনে কাপড় নাইসে দেখছে সেই-ই ন্যাংটোআর কেউ ন্যাংটো তা কি সে দেখতে পায়ছেলে ভুখে কঁদছে তা চোখে দেখতে হয় আর মনে আন্দাজ করতে হয় কিন্তু নিজের প্যাটে আগুন জ্বললে দেখতেও হয় নাআন্দাজ করতেও হয় না। সি আগুনের কি কুনো তুলনা আছেসি আগুন জ্বললে পেটের সন্তানকেও দেখতে পাওয়া যায় না

ছেলেপুলেরা বাড়িতে অ্যাকন য্যাকন-ত্যাকন যা খুশি তা-ই খেতে পায় না। বাঁধা তিনবার খাবার। অ্যাকনো ননদই তাদের খেতে দেয়। পেরায়ই দুখে-রাগে তাকে চোখের পানি ফেলতে হয়। যি ছেলেটো বেশি খায় কিংবা কুনো বিশেষ জিনিশ খেতে পছন্দ করেতার দিকে তাকানোর জো নাইননদকে নিক্তিতে মেপে চলতে হয়। একটু ইদিক-ঊদিক হলেকি শরমের কথামুখফেঁড় কুনো ছেলেই হয়তো বলবেউ বেশি পেচে। একজনার খাবার আর একজনার থালা থেকে তুলে নিতেও দেখছে ননদ। ছেলেরা কেউ দুর্দান্তকেউ শান্তকেউ হিংসুটেকেউ সাত চড়ে রা করে না। খাবার সোমায়ে ঘরে হুড়োহুড়ি মারামারি। সব চাইতে খারাবি হচেসময়ে সময়ে তাদের মা-রাও ঘরে হাজির থাকছে। কিছু বলছে না বটেএকদিষ্টে নিজের নিজের ছেলেমেয়ের থালার দিকে চেয়ে আছে। ননদ কাঁদবে না তো কি করবেপোঞ্চার বোঝা যেচেআজ বলছে না কিন্তুক কালকেই কুনো বউ বলবেতার ছেলেকে কম দেওয়া হচে। ননদ এক দিষ্টিতে দেখছে না সবাইকেদুই-দুই করছে। কে জানেহয়তো নিজেরাই নিজের নিজের ছেলেমেয়েকে খাবার খসিয়ে দেবে আর তা করতে গিয়ে নিজেরাই হুড়োহুড়ি করে মরবে। ত্যাকন হয়তো তাদের সোয়ামিরাও এসে হেঁশেলে ঢুকবেনিজের নিজের ইস্ত্রীর হয়ে লড়াই করবে। ত্যাকন ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি হতে আর বাকি কি থাকবেবউদের হয়ে ঝগড়া করতে করতেই হয়তো দ্যাওর তার ভাবির গায়ে হাত দেবে কিংবা ভাসুর মারবে ভাদ্দর-বউকে। পোস্কার দেখতে পেচি ইসব হবেহবে। এর মদ্যেই ছেলেমেয়েরা হাঁড়ি থেকে নিজেরা খাবার তুলে খেতে শিখে ফেলেছে। সারাদিন সবাই নিজের নিজের খাবারের ধান্দায় থাকে। কোথা থেকে একটো মাছ পেলে সেটি পুড়িয়ে খায়নাইলে তার মা-ই তাকে আলো করে বেঁধে দেয়। ননদই কি সত্যি সবাইকে এক দিষ্টিতে দেখতে পারছেসেই যি ভাগ্নেদুটিকে কত্তা ই সোংসারে এনেছিল মানুষ করার লেগেতাদের একজন তো বড়। হয়ে শহরে চাকরি করছেআর একজন ই বাড়িতে অ্যাকননা আছে। ননদের চোখের মণি এই ছেলেটি। তাকে এট্টু অন্য রকম করে না দেখে কি ননদ পারেসকলের ছামনে হয়তো ভালো একটু কিছু ননদ তাকে দিয়ে ফেলেকিম্বা লুকিয়ে-চুরিয়ে কুনো খাবার দেয়। হয়তো নিজের খাবার থেকেই দেয়। তা এমন শিক্ষে হয়েছে। ছেলেমেয়েদের তাদের বাপ-মায়ের কাছ থেকেতারা চেঁচিয়ে উঠবেফুপু ওকে দিলেআমাকে দিলে না। একদিন চূড়ান্ত হলোয্যাকন বউদের একজন ছেলেপুলেদের খাবার সোমায় হেঁশেল থেকে উঠে গেল আর একটু বাদে সোয়ামিকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল। তাপর সেই দ্যাওর সকলের ছামনেছেলেমেয়ে-বউ-ঝি সকলের ছামনেনিজের বুনকে যা লয়তা-ই বলে রপমান করলে। এমন করলে ই সোংসারে থাকা হবে না তা-ও বললে

সোংসারের ভেতরটো এইবার তাকিয়ে দেখতে প্যালম আর সোংসারের মধ্যে মানুষ কিতা-ও দেখলম। কুকুর-বেড়ালের ছেড়াছিড়ি দেখে রাগ করি কিন্তুক মানুষ কুকুর-বেড়ালের চাইতে কিসে ভালোমূলে টান পড়লে সবাই সমান। সেই মূল হচে প্যাট। এই আমি সার বোঝলম। মূল ঠিক থাকলে সব ঠিকতাই বলছেলম প্যাটের খোরাকি নাই তো কিছুই নাইতুমি নাইআমি নাইকেউ নাই। এই দ্যাশে সেই মূলের নাম হচে ধান। ঐ ধান থেকেই খাবারঐ ধান থেকেই কাপড়ঐ ধান থেকেই সব। ঐ জিনিশের অভাবেই সব ছত্রখান হয়ে গেল। ঘর ভেঙে গেলঘরের চাল হুমড়ি খেয়ে পড়লমাটির দেয়াল মাটিতে মিশলগরু মোষ ছাগল মুরগি সব উধাও হলোচাকর মাহিন্দার পালিয়ে গেল। ভরাভত্তি পানি সব নেমে গেলপাঁক আর কাদা বেরিয়ে পড়ল

একদিন ঠিক ভরাদোপরে দু-ভাই নিজের নিজের ইস্ত্রীর কথা শুনে মারামারি করে দুজনই জখম হলো। সি এমনি জখম যি দুজনার কেউ আর দাঁড়াইতে-বসতে পারলে না। একজনার লাগল কোমরেকোমর ভাঙল কি না কে জানে আর একজনার মাথায় পড়ল লাঠির বাড়ি। দর দর করে রক্ত ঝরতে লাগল। এইটি ল-দ্যাওরআমার ভাইয়ের অধিকছেলের মতুন ফেনা মেশানো টকটকে লাল তাজা রক্ত মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে যেচে। সে দু-পা ছড়িয়ে দু-হাতে ভর দিয়ে বসে আছে। মুখে কি খারাপ খারাপ কথা! মাঝে মাঝে হুঁ হুঁ করে কোঁকাইছে

সবাই ছামনে এসে জড়ো হলো। ছোট দাওর নাই তবে তার বউ-ছেলেমেয়ে সব ওখানে। ভাসুরও এল। কিন্তুক কত্তা এল না। হয়তো বাড়িতে নাইথাকলেও আসবে নাজানা কথা। সবাই এসে দাঁড়িয়ে থাকলেকারুর মুখে একটো কথা নাই। শুধু হাহাকার করে কেঁদে উঠল ননদ। যে ছোটভাই এত রপমান করেছিলসেই ছোট ভাইয়ের ব্যাকন রক্ত ঝরলত্যাকন তার লেগেই মাথা ঠুকতে লাগল। ননদভাইয়ের হাতে ভাইয়ের রক্তসোংসার আর থাকবে নাথাকবে না

পড়ে থাকলে দু-ভাই। উঠে দাঁড়িয়ে যি নিজের নিজের ঘরে যাবে সি সাধ্যিও নাই। ঐ উসারাতেই পাশাপাশি দু-ভাইয়ের বিছেনা করে দিলে তাদের বুন। দুর থেকে মনে হতে লাগল তারা দুজনা গলাগলি করে শুয়ে আছে। যি কদিন তারা উঠতে পারবে নাযেমন করে হোক একটু সাবু-বার্লি জোগাড় করে তাই বেঁধে খাওয়াবে ঐ বুন। জা-দের কিছুই করার সাধ্যি নাইতারা শুদু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে। ডাক্তার-বদ্যির কুনো কথা নাই। অ্যাকন অসুখে-বিসুখে জ্বরজারিতে ছেলেমেয়েগুনোই দিনের পর দিন বিছেনায় পড়ে থাকছেসাবু-বার্লিও জুটছে নাতা এইসব বুড়ো দামড়া জোয়ান মরদুরা মারামারি করে পড়ে আছেকে দেখবে তাদের?

আমি দুজনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেজ দ্যাওরটো একটু আখচোটা রকমভালো করে কারুর সাথে আলাপ করতে পারে নাকাজকম্ম গোঁয়ারগোবিন্দের মতুন কিন্তুক মানুষটি সে খারাপ লয়। আর ল-দ্যাওরকে নিয়ে তো কুনো কথা নাই! রাজপুত্তুরের মতুন চেহারা। অবশ্য আর আগের চেহারা নাইতবু সে এখনো সোন্দর। বিয়ে হয়ে আমি য্যাকন ই সোংসারে আসিঐ দ্যাওর ভাইয়ের মতুনছেলের মতুন কাছে কাছে থাকতযা ফরমাশ করতম তাই শুনত। আমার বড় খোঁকাটি হয়েছিল তার জানের জান। দাদির দেওয়া জমির বদলে ইখানে য্যাকন জমি কেনা হলোসেই জমির ধান নিয়ে কত্তাকে বলে আলেদা একটো মরাই বাঁধলে। আমাকে এসে বললেতোমার ধান আলাদা করে রাখা হলো

আমার আবার ধান কিসবই সোংসারের এই কথা তাকে বলেছেলম আমি। কতদিন আগের কথা! ওর কি মনে আছে সি কথাউসব কথা কারুর মনে থাকে না। মাটি থেকে ওঠা ভাপের মতুন কোথা উড়ে যায়

দুজনাই আবার উঠে দাঁড়াইলে বটে কিন্তুক দুই ভাই লয়ঠিক যেন একে আরেকের দুশমন। কুনোই কারণ নাইতবু ওদের দুই বউ-ও একে আরেকজনার দুশমন। আর এ কথা কে পেত্যয় যাবে যি দু-ভাইয়ের ছেলেমেয়েরাও হলো ঠিক তাই

খামার অ্যাকন ফাঁকা! শ্যাষ মরাইটোর শ্যাষ কটি ধানও বার করে নেওয়া হয়েছেখামারবাড়ি খাঁ-খাঁ করছে। আর কদিন চলবেযিদিন তা বন্ধ হবেসিদিন থেকে কি হবেকি বেবস্থা হবে এতগুলিন পেরানিরকত্তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। কি কঠিন সেই মুখযেন পাথরের। তাকে একটো কথা বলতে সাহসও হয় নাইচ্ছাও হয় না

আমার এত কথাকার কাছে বলিকেউ নাই। গিন্নি য্যাতোদিন ছিলতার কাছে যেয়ে চুপ করে দাঁড়াইলেই হতোকুনো কথার দরকারই হতো না। আপনা-আপনিই মন শান্ত হতো। ননদের কাছে তো সিটি হবার উপয় নাইতারই বরং কত কথা বলার লেগে বুক ফেটে যেচে। আর আছে ঐ কত্তা। কিন্তুক উ মানুয অ্যাকন মানুষই লয়পাষাণ। তাকে আমার চিকার করে শুদুতে মন যায়দু-বছরের। মদ্যে সব এমন ছারেখারে গেল ক্যানেকেমন দেখেছেলম ই সংসারআর অ্যাকন কেমন দেখছিঅমন সোংসার তো সেই-ই দিয়েছিলঅ্যাকন সব দেখে চুপ করে আছে কেনজানিযেদি তাকে এই কথা শুধুই তার কুনো জবাব সে দেবে নাবড় জোর সব কথার এক কথা বলবেসারা দুনিয়া ছারেখারে গিয়েছেতোমার আমার সংসারও ঐ এক পথে যাচ্ছে। তবে কি লোকটো একবারে হেরে গেল?

পরপর দুবার মারা গেলেও মাঠে কিন্তুক ইবার ধান আছে। ই বাড়ির ঘেরাটোপ থেকে দেখতে পাই না,মনে ইচ্ছা হয় একবার যাইদেখে আসি আর কত দূরবাড়িতে বসে মনে হয়এখনো অনেক দূর। এখনো অনেক দিন বাকি

উত্তর-দুয়ারি ঘরের আঁদার কোণে মাটির বেরাট এক পয়ায়। ভাতের চাল থাকে। ওখান থেকেই পেত্যেক দিন খরচ হয়। উত্তরপাড়ায় দুই বেধবা বুন আছে। তাদের কাছে লোকে ধান ভঁচা দেয়। সেই ধান তারা সিজোয়শুকোয়তাপর টিকিতে পাড় দিয়ে। চাল বানায়। এই তাদের পেশাএই করেই তারা খায়। আমাদের ধানও ওদেরই কাছে ভঁচা দেওয়া থাকে। ধান যায় ওদের কাছেতাপর চাল আসে। সি চাল খরচ হয়ে গেলে আবার আসে। এই চেরকাল চলছে। পয়ায় চাল শেষ হতে না হতে আবার য়া চালে ভরা হয়। এই পেথম দেখছি পয়া আধেক খালি হয়ে গেয়েছে। ভেতরটো আঁদারউকি দিয়েও বোঝা যেচে না চাল আর কতোটো আছে। দিনের বেলা লম্ফ জ্বালিয়ে পয়াল ভেতরটা দেখলম। একদম তলায় সেরদশেক চাল কুনো পেরকারে থাকতে পারে। লম্ফর আলোয় পুরনো চাল কটো দেখে আমার যি কেমন মনে হতে লাগল কি বলবমনে হচে সাত রাজার ধন এই চাল। চালের রঙ কি অত সোন্দর হয়?

কিন্তু বাড়িতে আর চাল এল না। ল-দ্যাওরের ওপর ছিল সব দেখার দায়িত্ব। তা সে চুপ করে থাকে। ননদ পেত্যেক দিন তাকে বলছেচাল কিন্তুক শ্যাষআর দিন দুয়েক পরে বাড়িতে চুলো জ্বলবে না। কদিন চুপ করে থেকে থেকে একদিন সে বললেভঁচা দেওয়া ধানের আর কুনো চাল পাওনা নাই। ননদ এই কথা শুনে বললেতাইলে কি হবেছেলেপুলে না খেয়ে মরবেযিখান থেকে হোক ধান জোগাড় করতে হবে নাসে ত্যাকন কাঠ-কাঠ গলায় জবাব দিলেআমি কোথা থেকে ধান জোগাড় করবচুরি করবনা ডাকাতি করববাড়িতে ভাত না হলে শুধু কি আমার ছেলেমেয়ে উপোস করবেসবাই করবে। আমি কিছু জানি না

ধানের কথাচালের কথাসংসারের কথা ভাশুরকে বলা বেথা। তার নিজের কুনো ছেলেপুলে নাইঅমন সোজা মানুষের কিছু করার খ্যামতাও নাই। সেজ দ্যাওরকে তো এসব কথা বলার আরও কুনো মানে নাই। সে এমন গোঁয়ারগোবিন্দ যি এসব শুনলে হয়তো আবার কার সাথে মারামারি-ফ্যাসাদ লাগিয়ে দেবে। আর থাকল ছোট দ্যাওর। তারও কুনো ভরসা নাই। এমন দিন পড়েছে যি সে অ্যাকন চাকরির কটো টাকা বাঁচাবার লেগে শহরে একা থাকে। বউ আর পাঁচটা বাচ্চা সে গাঁয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে

কাউকে কিছু বলার নাই। ননদ কাকে কিছুই বলবে না। কত্তা যেদি নিজে থেকে কিছু না করেতাইলে শত বললেও কারুর কথায় কিছু করবে না। তাকে বলার কিছু নাইতার অজানা কি আছেইদিকে জা দের দেখে মনে হচে তারা যেন কিছুই জানে না। কুনো কাজকৰ্ম্ম নাইমনে কুনো দুচ্চিন্তা নাইঘর-দুয়োরে ঝটপাট নাইকোথাও কুনো ছিরিছাঁদ নাই। তারা সবাই সারা বাড়ি ছিরফুটি করে বেড়াইছে আর কথায় কথায় কুঁদুল অর করছে। মনে হচেসোংসারের এই আবস্তা দেখে তারা ব্যাজায় খুশি। এমনি চললে আর কিছুদিন বাদে তাদের নিজের নিজের সোংসার হবে

পেত্যেক দিন রাঁধার সোমায় ননদের সাথে আমি য্যাতম ভাতের চাল আনতে। ঘরের কোণের ঐ বেরাট পয়ার ভেতরে আঁদার দিন-দিন ঘোনো হচে। তার হাতের চাল তোলার টিনের কটোটো খরাৎ খরাৎ করে পয়ার গায়ে লাগেঅ্যানেকটো ঝুঁকেও ননদ পয়ার তলার চাল কটোর নাগাল পায় না। শ্যাষকালে সে মাথা ঢুকিয়ে দিলে পয়ার ভেতরের আঁদারের মদ্যে। স্যারদুয়েক চাল বার করে ঘরের বাইরে এসে দোপরের রোদে এগনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কেঁদে বললেআর একটি দানাও নাই। বাছারা আজ রেতে আর কেউ খেতে পাবে না

কথাটা শুনেই মনে হলো দিনের আলো কেমন মিইয়ে এলশন শন করে ঠান্ডা হাওয়া বইতে লাগলআর বুকের ভেতরটা খামচে খামচে উঠতে শুরু হলো

দোপর বেলায় ছেলেরা সব খেতে বসেছে। খাবার তেমন কিছু নাই। পাতলা ডাল আর ভাত। আগের দিনের মতুনই সব মারামারি হুড়োহুড়ি করছে। খালি বড়গুনোর মন ভার। তারা বোধায় কিছু জানতে পেরেছে। অন্য দিন ননদ রাগারাগি-বকাবকি কতো কি করে। আজ সে একদম চুপ। তাকিয়ে দেখলম,চোখ দিয়ে তার টস-টস করে পানি পড়ছে। ফোলা ফোলা টকটকে লাল মুখ বারে বারে একদিকে পাশ করে পানি মুচছে

বৈকাল গেলসারা বাড়িতে কারুর দেখা নাই। দেখলম সুয্যি উঠলদেখলম সাঁঝ নামলদেখলম আঁদার ঘোনো হলো। আর একটু বাদে ঝিঁঝি পোকা ডাকতে লাগল। অন্যদিন জোনাকি দেখতে পাই না। বাড়িতে লম্ফ-হেরিকেন জ্বলেজোনাকি পোকা কে খেয়াল করেআজ বাড়িতে কোথাও আলো নাইবাড়িময় আঁদারে জোনাকি ঘুরে বেড়াইছে

চুলো জ্বলে নাই। ভাত হয় নাই। কেমন করে ছেলেমেয়েগুলিন। বুঝে গেল আজ বাড়িতে রাঁধাবাড়া হয় নাই। রেতে তারা কেউ খেতে পাবে না। তাইলে কি বাপ-মা-ই তাদের শিখিয়ে দিয়েছে যি আজ আর হেঁশেলে খেতে যাস নাআমার কিছুতেই বিশ্বেস হচে না!

সময় যেতে লাগল তবু কেউ কাছে এল না। ননদকেও দেখতে প্যালম না। শ্যাষে বসে থেকে থেকে রাত পেরায় নিশুতি হলে আমি ঐ আঁদারের মদ্যেই গা-মাথা ঢেকে চোরের মতুন পা টিপে টিপে শোবার ঘরে যেয়ে ঢোকলম। ঘর আঁদারই বটেতবে কত্তার একটা বিদেশী লম্ফ ছিলসেটায় একবার ত্যাল দিয়ে খুব কম করে জ্বালাইলে তিন-চার মাস জ্বলত। বহুদিন বাদে সেটিকে ঝেড়ে-ঝুড়ে বার করা হয়েছিলদেখলমআঁদার ঘরে খালি একটো নীল ফোটা। বোঝলম কত্তা সেইখানেই বসে আছে। আন্দাজে সিদিকে খানিকটো যেয়ে আর যেতে পারলম না। উবুড় হয়ে পড়ে আমি মাটিতে মাথা ঠুকতে লাগলম। ঠান্ডা শক্ত মেঝেবারকতক ঠুকতেই বুঝতে পারলাম কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে। কেমন নেশার মতুন হলোহাত দিয়ে রক্ত মুছি আর তেমনি করেই মাথা ঠুকি। মুখে খালি আমার একটো কথা : বাড়ির ছেলেমেয়েরা আজ না খেয়ে ঘুমুইতে গেয়েছে। ভোখ প্যাটে সারারাত তারা ছটফট করবে। তুমি কিসের কত্তাআঁদার ঘরে বসে আছকারা দুনিয়ায় এনেছে তাদেরবলোবলতে হবে তোমাকে। এইসব কথা বলতে বলতেই দেখিঘরের আঁদার অ্যানেকটো কমে এয়েছেআমার খোঁকাদুটি বিছেনায় উঠে বসেছে আর পাথরের মতুন বসে আছে কত্তা

নীল আলোর ফোঁটাটো টুপ করে নিভে গেল। বোধায় ত্যালের শেষ ফোটাটোও ফুরিয়ে গেয়েছে। আর বেশিক্ষণ গেল নাকত্তা আমার দিকে মুখ না ফিরিয়ে আস্তে আস্তে বললেআর মাথা ঠুকো না। আমি আজকের এই দিনটির অপেক্ষাতেই বসে ছিলাম। দেখছিলামকেউ আসে কি না। ভাই আর ভাই আছে কি না। বউদের আমি গেরাহ্যি করি না। দেখছিলাম ভাইদের কেউ বলে কি না যে চিরকাল তুমিই সব করে এসেছএখন এই সংকটে তোমাকেই হাল ধরতে হবে। নাকেউ এল না। তা যাই হোকছেলেপুলে একদিন না-ই খাকশুকিয়ে মরতে তাদের আমি দোব না। কাল আমি যাব। সন্ধের আগেই এক গাড়ি ধান যেখান থেকে পারি আনব। তবে ঐ ধান শেষ হবার আগে সবারই সংসার আমি পৃথক করে দেব এই আমার প্রতিজ্ঞা। যাওআর মাথা খুঁড়ো না

আমি আর বিছেনায় গ্যালম না। সেইখানেই আঁচল বিছিয়ে শুয়ে পড়লম। বিছেনার চেয়ে মাটি ভালো

 

ভাই ভাইঠাঁই ঠাঁইসবাই পেথগন্ন হলো

সত্যিইকত্তা পরের দিনই গেল আর সাঁঝলাগার আগেই গরুর গাড়িতে এক গাড়ি ধান নিয়ে ফিরে এল। এ এমন মানুষ যি জানেঘরে এখুনি খাবার নাইশুদু ধান নিয়ে গেলেই হবে নাধান তো আর খাওয়া যায় নাচালের দরকার সেই লেগে ধানের সাথে এক বস্তা চালও আনলে

সাঁঝবেলায় গাড়ি য্যাখন বাড়ির ছামনে এসে দাঁড়াইলেআমার ননদ ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল আর বারে বারে বলতে লাগলবাছারা সব না খেয়ে আছে গোএই কথা কাকে বলিমানুষ নাইএই সাংসারে মানুষ নাই! অ্যাকনো এই ভাইকেই হাতে ধরে খাওয়াইতে হবে সবাইকে

ভাইকে জড়িয়ে ধরে এত কথা সে বলতে লাগলে বটেভাই কিন্তুক চুপ। আমি দেখলম কত্তা বুনকে একটো সান্ত্বনা দিলে নাপাথরের মতুন দাঁড়িয়ে থাকলে। তাই দেখে আমার নতুন করে ভয় লাগতে লাগল। বাড়ির ভেতরে যেয়ে দেখিভাইয়েরা সব যেমনকার তেমনি ঘোরাফেরা করছেকারুর কুনো তাপ-উত্তাপ নাইযেন কিছুই হয় নাই। ছেলেপুলেরা যি দু-দিন খায় নাইতার সব দায় যেন একা কত্তার। বোধায় সবারই একটি হিশেবমাঠ জুড়ে ইবার খুব ধানকুনো পেরকারে তিন-চার মাস কাটাইতে পারলেই আর ভাবনা নাই। ত্যাকন আর অভাব হবে না

ধান সব সাথে সাথে গাঁয়ের সেই বেধবা বুনদের বাড়িতে ভাঁচা দেওয়া হলো। কাঠ-কুটো জ্বালটও কিছু জোগাড় করে দেওয়া হলো তাদের। আর ভাবনা নাইকদিন বাদেই আগন মাস পয্যন্ত খাবার মতুন চাল থাকবে বাড়িতে। রেতে কত্তা বললেঅনেক হীন হয়ে এই ধান আনতে হয়েছে আমাকে। কাছের কোনো গাঁয়ে যাই নাই। আমিচেনা মানুষের কাছেই গিয়েছিলামতবে দূরের এক গাঁয়ে

দিলে ধান?

দিলে বৈ কি। আমি জানি চাইলেই দেবে। এমনি এমনি তো নোবমাঘ মাসের মধ্যে দেড়গুণ ধান ফেরত দিয়ে শোধ দোব

এই ধানে ই কমাস আমাদের খুব চলে যাবেখুব খুশি হয়ে আমি বললমমাঠেলিকিন এবার ধান খুবখামারে মরাইয়ের জায়গা হবে না

তা হবেসে হলে তো ভালোই

কত্তার কথা শুনে আমি তার মুখের দিকে তাকাই। আসলে ভয় ভয় করছিল বলেই খুশি হবার ভাব দেখাইছেলম। কত্তা কি তার সেই পিতিজ্ঞা ভোলে নাই। নাভোলে নাইকত্তার মুখ দেখেই বোঝলম যে ভোলে নাই। ই সোংসার সে আর এক-ভাতে রাখবে না। শাশুড়ি নাইকত্তাকে জোরের সাথে কথা বলার অ্যাকন আর কেউ নাই। এক উপায়সব কটি ভাই যেদি তাদের বুনকে সাথে নিয়ে কত্তার কাছে এসে তাকে ধরে। কিন্তুক তাতেও দেরি হয়ে যেচেউ মানুষের এমনি জেদ যি য্যাতো দিন যায় জেদ তার ত্যাতো বাড়ে আর ভেতরে যি রস-কষ আছেসব শুকিয়ে যায়। তবে ইসব কথা ভেবে লাভ কিকেউ তো এল না তার কাছে। আমি বেশ বুঝতে পারছিমাঠের ধানের দিকে চেয়ে সবাই নিজের নিজের হিশেব করছে। আমি যেমন ভাবছিতেমন হিশেব সবাই না-ও করতে পারে কিন্তুক সোংসারে অ্যাকন শান্তি আর নাই। সবারই ভেতরে একটো রাগ তুষের আগুনের মতুন ধিকি ধিকি জ্বলছে আর জায়ে জায়ে যি আখেজ দেখছি তাতে রেষারেষিরকুনো ঢাকাচাপা নাইসব সোমায় পেকাশ পেয়ে যেচে। দেখেশুনে ননদ আর কি করবেমুখ শুকিয়ে ঘুরে বেড়াইছে। শুদু একটি ভয় তার জানটোকে কুরে কুরে খেচে। বড় ভাগ্নেটি অ্যাকন আর ইখানে থাকে নাশহরে চাকরি করে। সে ঘরের ছেলে ঘরেই ফিরে গেয়েছে বলা যায়। ছোটটি অ্যাকনো ইখানে আছেকিন্তুক ডামাডোলে সোংসার ভাঙলে সে কি আর ইখানে থাকবেনা তার বাপ চাচা তাকে ইখানে থাকতে দেবেত্যাকন বাঁচবে কি করে ননদ?

কত্তা আজকাল শহরে কমই যেছে। কথা খুব কম বলছে। সারাদিন বাড়িতেই থাকেগাঁয়েও কারুর বাড়ি পেরায় যায় না। কত্তামার বাড়ি যাওয়াও কমতে কমতে আকন পেরায় বন্ধই হয়ে গেয়েছে। গাঁয়ের সেই আবস্তা তো আর নাই। মহামারী যুদ্ধ আর আকাল এসে সব লয়ছয় করে দিয়েছে। ঘরে ঘরে মানুষ উপোস করেছেঅ্যাকননা করছে। রোগেশোকে-তাপেনা খেয়ে কতো চেনা লোক যি দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে গেয়েছেতার সুমার নাই। কত্তামাযি কিনা রাজার ভাগ্নিতাদের না খেয়ে হয়তো থাকতে হয় নাইতবে যুছু আর আকালের হাওয়া সি সংসারেও যেয়ে লেগেছে। ইসব নিজের চোখে দেখতে হবে বলে কত্তা যি কোথাও যায় নাতা আমি জানি। খামারের দিকে পরচালিতে একটো লোহার চেয়ারে সারাদিন সে বসে থাকেকথা বলতে গেলেই কেমন খেকিয়ে ওঠে। সকাল দোপর রেতে দুটি খেয়ে আবার ঐ পরচালির চেয়ারে

ভেতরে-বাইরে লক্ষ্মী ছেড়েছে। তিন-তিনবার গরু-মোষের কি একটো রোগ এলঝেটিয়ে গোয়াল খালি হয়ে গেল। চোখের ছামনে বড় বড় হেলে গরুদুধেল তিনটো গাইদু-জোড়া হাতির মতুন বড় বড় মোষ দেখতে দেখতে ছটফট করে মরে গেল। এমন দিন ত্যাকন এয়েছিল যি মনে হয়েছিল গরু-ছাগলহাঁস-মুরগিমানুষজন কিছুই থাকবে না। অ্যাকন দেখছি কিছু কিছু টিকলে বটেতবে সব যেন কেমন আড়া-আড়া ছাড়া-ছাড়া। শনি ঢুকেছে গেরস্থালিতেসবাই যেন ডোকলাসবাই যেন হাঘরে

বাড়ির ভেতরে জায়েরা কিসের লেগে যি ইসব করছে কে জানে! এই টানছেএই ছিড়ছেমাটির ভাতের হাঁড়ি এমন করে চুলো থেকে নামাইছেতাতে যি ভাঙছে না এই বড় ভাগ্যি। ঝন ঝন করে কাঁসার থালা ফেলছেপেতলের ডেকচিপানির ঘড়া দুম করে নামাইছে মেঝের ওপরকাঁসার গেলাস ঠন ঠন করে গড়িয়ে পড়ছে উসারা থেকে এগনেয়। শাড়ি শায়াটো এমন করে টান দিচে যি কাপড় শুকনোর তারে লেগে ফাঁস করে ছিড়ে যেচে। কিন্তুক এত যে গামুস-গুমুস করছেমুখে কুনো কথা নাই। বাড়ির ভেতরে বোদ-বাদারি ময়লা আবজ্জনাঘরে ঝটপাট নাইলেপামোছা নাইসব জায়গায় চিমসে গন্ধ। ননদ-ও হাল ছেড়ে দিয়েছেকে কখন আসছেকখন

যেচেসি হিশেব সে আর রাখতে পারছে না

বাইরে গোয়াল তিনটো পেরায় খালি। দলিজ ঘর খাঁ খাঁ করছে। কবে থেকে মানুষের আসা-যাওয়া নাই,খামার জুড়ে একহাঁটু ঘাস আর কন্টিকারির জঙ্গল। এইসব ছামনে নিয়ে কত্তা বসে থাকেসে-ও যেন সব্বোনাশটোর লেগে অপিক্ষে করছে

ইদিকে সারা গাঁয়ের মানুষ মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। য্যাতো দূরেই হোক পোষ মাসতাকে তো শ্যাষ পয্যন্ত আসতেই হবে। ধান পাকছেসোনার মতো রঙ ধরছে ধানেকঁচা সোনার রঙ এট্টু এট্টু করে ধানের গায়ে লাগছে। সারা মাঠ ভরাদু-বছর বাদে কি ধানই না এবার হয়েছে! ঘরে বসে ভাবনা করতে করতেই গরম ভাত মনে মনে খাওয়া হয়ে যেচে। সেই আসবেতাইলে এতকাল কোথা ছিল পোষ মাস!

অন্য অন্য বার কতো কথা বলে দ্যাওর-রা। ইবার সব মুখে কুলুপ এঁটে মাঠের কাজে নেমেছে। একটি কথা বলে না কেউ। ধান কাটা শুরু হয়ে গেয়েছেআঁটি বাঁধাটিপ দেওয়ার কাজও চলছে। তাপর একদিন শুরু হয়ে গেল ধান বওয়ার কাজ। দুটো মোষের গাড়ি ভোর থেকে সারাদিন ধান আনছে। মুনিষরা সারাদিন ধান পিটোইছে। আমি একবার একবার যেয়ে দেখিধান গাদা হচেপিটনোর পাটার গায়ে ঠিক গাদা করা সোনার নোলক। ঐ থেকেই ধোঁয়া ওঠা কুঁদফুলের মতুন শাদা ভাত হবে। সেই ভাত থালায় থালায় ভরে ছেলেপুলেদের সামনে ধরে দেবে ননদ। ভাবনা এই পয্যন্ত যেই এল অমনি বুকের ভেতরটো কে যেন খামচে ধরলে। ছেলেপুলে কোথা পাবসব তো আলো আলেদা ঘরে নিজের নিজের মায়ের হাতে খাবে

তবে এইটিআমি জানি কত্তা যেদি নিজে থেকে কিছু না বলেকারুর সাধ্যি নাই যি তাকে যেয়ে বলবেআর দেরি করা ক্যানেসোংসার পেথক করে দাও। নাসি সাধ্যি কারুর হবে না। অ্যাকন আবার কত্তাকে দেখে মনে হচেসে বোধায় এইবারের মতুন নিজের পিতিজ্ঞে ভুলে গেল! আল্লাতাই যেন হয়। কিন্তুক তাই কি হবেহঠাৎ একদিন রেতেকিছুই যেন হয় নাইএমনি করে কত্তা বললেধার করে আনা ধানের চালে সংসার কতদিন চললবলতে পারবে?

তা পেরায় চারমাস

ঠিক করে বলতে হবে। এখনো চাল যা আছেতাতে কতোদিন চলবে?

কাল বুবুর সাথে যেয়ে দেখেছেলমদশ-পনেরো দিন যেতে পারে আরও। মাঠের লতুন ধান ভঁচা দেওয়া হয়েছে বুবু বললে। এমন হিশেব করে দেওয়া হয়েছে যি মজুত চাল শেষ হবার আগেই যেন বাড়ির নতুন চাল আসে

শেষ হবার দু-একদিন আগে আমাকে বোলো

ইকথা শুনে কত্তা আবার কি করবেএকবার ভাবলম বটে কথাটো নিয়েআবার ভুলেও গ্যালম। ই কথা কি কারুর মনে থাকেকদিন বাদে যেই বলেছি বাড়ির পুরনো চালে আর দিন দুয়েক চলতে পারেঅমনি কত্তা একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল

তোমাকে বলেছিলাম না ঠিক করে জানাবে। দিনকতকদু-দিনতিনদিন আবার কি কথা। যাওদেখে এসে আমাকে জানাও ঠিক কদিন যাবে

কি করবদেখে এসে বললম আবারকাল আর পরশু এই দুদিন যাবে। ভঁচা-বাড়ি থেকে কালকে নতুন চাল দিয়ে যাবে বলেছে

কি আচ্চয্যিঠিক পরের দিনই সাঁঝবেলায় কত্তা উত্তর-দুয়য়ারি ঘরের উসারায় সব ভাইদের ডাকলে। ঘোট দাওর যি শহরে থাকেতাকেও একদিনের মদ্যে খবর দিয়ে ডেকে আনলে

সাঁঝবেলায় সারা বাড়ি থমথমে। একটো হেরিকেন জ্বালিয়ে তার চারপাশে ভাইরা সব বসেছে শেতলপাটির ওপর। কত্ত সব শ্যাষে বুনকেও ডেকে নিলে। তাপর আস্তে আস্তে কথা বলতে শুরু করলে। সি কথা শোনা যায় কি যায় নাকান পাতলে তবে শোনা যায়। কিন্তুক পেত্যেকটি কথা পোষ্কারএকবারও থামছে নাএকটানা বলে যেছে। ভাইরা ঘাড় নামিয়ে শুনছে। জায়েরা দেখলম নিজের নিজের ঘরের দরজার ছামনে দাঁড়িয়ে কথা শোনার চেষ্টা করছেনোখ দিয়ে মাটি খুঁড়ছেআঙুলে কাপড়ের আঁচল জড়াইছে। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে কত্তার কথা শুনছি। মানুষ কি এমন করে কথা বলতে পারে! গলার আওয়াজে উঁচু-নিচু নাইকথা হাতড়ানো নাই। এক জেবনের সব বলছে কত্তা। এমন করে বলছে যি মনে হচে কথা শ্যাষ হলে আর একটি কথা যোগও করতে হবে নাবাদও দিতে হবে না। বাপের মিত্যুর কথা থেকে বলতে শুরু করেছে। মা কেমন করে ছেলেপুলেগুলিনকে আগুলে রেখেছেকেমন করে খাওয়া জুটেছেমা সারাদিনের পরে ঝিকিমিকি সাঁঝবেলায় দোপরের ভাত খেতে বসেছেকেমন করে রাত গেলকেমন করে দিন গেলমাস গেলবছর হয়ে গেল

এইসব কথা বলতে যেয়ে কত্তা মুটেই নিজের কথা সাতকাহন করে বললে না। শুদু ভালোদিনমদিনের কথা বললেদুবারের যুদূর কথা বললেএকবার বড় খোঁকার মিত্যুর কথা বললে। কিন্তু তাতে তার গলা কাপল না। মায়ের মিত্যুর কথাও বললে অমনি করে। আকাল মহামারীর কথাও বললে। রাত বাড়ছেসোমায় গড়িয়ে যেছে কিন্তুক মাঝখানে তাকে থামিয়ে কারুর একটি কথা বলবার জো নাই। ভাইরা বসে আছে আর আমরা বউরা সেই যি দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি

সব কথা বলা হয়ে যাবার পরে কত্তা ঐ একইরকম গলায় খুব কঠিন কঠিন কথা বলতে লাগল। রাগ করে লয় বটেতবে সি বড় কঠিন কথা। তার আসল কথাটো হচেবেপদ মসিবতের সাগর পেরিয়ে আসা হয়েছেঅ্যাকন সবারই নিজের নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আলেদা সোংসার চালানোর ক্ষমতাও হয়েছে। নিজের সোংসার ছেলেপুলে নিজেই চালাইতে চায় সবাইআর মোট একজনা চালাইলে কিংবা সবাই মিলে ঠেলাঠেলি করে চালিয়ে দিলে ভালো লাগে না। কত্তা খুব ভালোমুখে বললেএক-এক জন এক-এক ভাবে চলতে চায়এক-এক পথে ছেলেপুলে মানুষ করতে চায়একান্নবর্তী পরিবারে তা সম্ভব হয় না। সেইজন্যে যুক্তি পরামর্শ করে আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। সবাই যেটা মনে মনে চাইছেসেটাই করার জন্যে আজ আমি সবাইকে ডেকেছি

আমরা তো কেউ সংসার ভাঙতে চাই নাই

তুই নিজের কথা বল্। আর কেউ কি চেয়েছে না চেয়েছে সে সেই-ই বলবে

আমি সংসার পৃথক করতে চাই নাই

আমি দেখলমসত্যি যে সসাংসার ভাঙতে চায় নাইআমার ভাশুরসে এইকথা বললে নাবললে আর একজনা। আমি জানি ছোট দ্যাওর-ও মন থেকে আলেদা হতে চায় নাইকিন্তুক সিকথা তার বলার সাওস নাইএকদিষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে ছোটবউ

এই কথাটি আমি যেন আর একবার কারুর মুখ থেকে না শুনি। মিছে কথা আমি ঘেন্না করি। কে কি ভাবে সেকথা আমি তার নিজের চাইতেও ভালো জানি

কত্তা আরও কি কি কথা বলতে যেছিলএই সোমায়আমার ভাশুর একেবারে কচি শিশুর মতুন হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। সেই কান্না শুনে কাকে চুপ করতে হলো। ভাশুর ত্যাকন দু-হাতে কপাল চাপড়াইতে চাপড়াইতে মাথার চুল টেনে ছিড়ছে আর মুখে খালি এক কথাহায় হায়। ই কি হলোহায় হায় ই কি হলো। ঘাড় পেরায় মাটিতে ঠেকিয়ে ভাইরা। সবাই চুপ করে থাকলে। কত্তাও দেখলম ঘাড় নামিয়ে রয়েছে

খানিক বাদে ভাশুর থামলে কত্তা আবার ঠিক আগের মতুন গলায় বললেযুদ্ধ চলছে সারা দুনিয়ায়এখনো শেষ হয় নাই যুদ্ধসেই যুদ্ধ একরকম করে পার হয়ে এইছি। দুর্ভিক্ষ আকাল মারী কিছুই ভেদ করতে পারে নাই এই সংসারের। কতো সংসার ছারখার হয়ে গেলকতো মানুষ দুনিয়া ছেড়ে গেলআমাদের কিছু হয় নাই। আর কিছু নয়বাড়ির ছোটরা যেদিন না খেয়ে উপোস করে দিন কাটালেআমার মাথায় বাজ পড়ল নাতাদের বাপ-চাচাদের মাথাতেও বাজ পড়ল না। পড়া উচিত ছিলসংসার ভাঙার জন্যে যে বাপ-চাচারা ছেলেমেয়েদের উপোস করিয়ে অপেক্ষা করতে পারে তাদের মরাই ভালো। সেইদিনই আমি ঠিক করেছিসকলের মনোবাঞ্ছা আমি পূরণ করব। মানুষ না হয়ে স্ত্রৈণ হয়েছে যে পুরুষমানুষ তার আর এক সংসারে থাকার কোনো দরকার নাই

কত্তা এই ততদিলে নিদেন হেঁকে। সে চুপ করলে দেখলম বাকি সবাই মাথা হাট করে চুপ করে থাকলে। গলা নামোয় নিয়ে যেয়ে ঐ যি কথা কটি সে বললেকেউ আর তার কুনো উত্তর করতে পারলে না

ত্যাকন কত্তাই আবার সহজ গলায় বললেমন খারাপ করার কি দরকারযা হবার তাই হচ্ছে। ঝগড়া-ফ্যাসাদ আমরা কেউ করছি না। আর এক দিক থেকে বলিনিজের মতন করেনিজের হাতে সংসার করতে ইচ্ছে সবারই করেসব সময় ঘাড়ে একটি কর্তার ভূত থাকা কি ভালোসংসার বেশি বড় হয়ে গেলে গোলমাল বিশৃঙ্খলা হয়। তাতে ছেলেমেয়েদেরও ওপর অবিচার হয়

কত্তার এই কথার পরে বাতাস যেন অ্যানেকটো হাল্কা হয়ে এল। সবাই সহজ সুরে কথা বলতে লাগল। সোংসার ভালো করে চালাবার লেগে যেমন করে কথা বলেসোংসার পেথ করার লেগে অ্যাকন তেমনি করেই সবাই জমি-সোম্পত্তি নিয়ে কথা বলতে লাগল। সবকিছুর ভালোটা কত্তার ভাগে দেবার লেগে ভাইদের সি কি ঝুলোঝুলি! একমাত্তর ভাশুর শুদু চুপ করে থাকলে

বাড়িতে যে যেমন থাকেছেলেমেয়ে নিয়ে যে যে-ঘরে থাকেআগের সেই বেবস্কাই বাহাল রইল। রাঁধা-বাড়ার লেগে যি চালাটো ছিল সিটি বেশ বড়ই। সি-টি আর অ্যাকন ভাগ হলো না শুদু পেয়োজন মতুন আরও কটো চুলো তৈরি করে নেওয়ার কথা বলা হলো। জমি-সোম্পত্তি ল-দ্যাওরের ঠোঁটস্থসে-ই মুখে মুখে কোথা কি আছে বলতে লাগল। গরু মোষ ছাগল কুনো হিশেবই তার জানা বাকি নাই। সে বলতে লাগল আর মুখে মুখেই সব ভাগ হতে লাগল। কতক সরেস জমি কত্তাকে দেবার লেগে কে যেন পেস্তাব দিলেকত্তা আবার একবার ধমকিয়ে উঠল কিন্তুক আমার দাদির দেওয়া জমিটো যা এতদিন এজমালিতে খাওয়া হছিলসেই জমিটো য্যাকন আবার আমাদের ভাগে দেবার কথা হলোত্যাকন কত্ত বেশি আপত্তি করতে পারলে না। জমি তো তার লয়সে আপত্তি করবে কি করেজমি আমার। মনে পড়তে লাগলএকদিন এই জমির ধান আলাদা করে। মরাই বেঁধে রেখে ল-দ্যাওর বলেছিলএ মরাই তোমারই রইল। আমি তাতে রাজি হই নাই। আজ আমাকে রাজি হতে হচে। একবার মনে করলমযাইঐ পুরুষমানুষদের যেয়ে বলিই জমি আমার বটেতবে ই আমি একা নোব নাসবার ভেতরে ভাগ হোক ই জমি। ভাবলম বটেতবে সি যি কি অসোম্ভাব তাও সাথে সাথে বুঝতে পারলম। সোয়ামির কথা ছাড়া জমি ক্যানে একটি পয়সাও কাউকে দেবার আমার এক্তিয়ার নাই! ল-দ্যাওরের দিকে চেয়ে দেখলম। তার কিছুই মনে নাইসে হেসে হেসে ই জমি যি আমারকেনার পর থেকেই আমার সেই কথাটোই বারে বারে বলছে

সব বিলি-বেবস্থা য্যাকন হয়ে গেলকত্তা বললেদলিল সব আমার কাছেযার যেমন জমি ভাগে পড়েছে সেইরকম সব দলিল আমি পরে সবাইকে বুঝিয়ে দোব। নিজের নিজের দলিল নিজের কাছেই রাখতে হবে

কথাবার্তা শ্যাষ করে সবাই উঠতে যেছেএমন সোমায় আমার ননদ ভাইদের কাছে বসে পা ছড়িয়ে মড়াকান্না কাদতে শুরু করলে। সি এমনি কাঁদন যি তাতে একটি কথা নাইতা শুদুই কাদাশুনলে পাষাণও ফেটে যায়। অ্যানেকক্ষণ কেঁদে সে এইবার ফেঁপাইতে ফেঁপাইতে বললেআমার জমি আমাকে দিয়ে তোমরা আমার সব কেড়ে নিলে। জমি নিয়ে আমি কি করবআমার কবরের লেগেও তো উ জমি লাগবে না। উসব না করে আমাকে বরঞ্চ তোমরা মেরে ফেলল। এই কথা বলে আবার চুল ছিড়তে লাগল ননদ

কত্তা শুদু বললেকঁদিস নাতুই একা মানুষতোর আবার ভাবনা কিএখন তোর একার একটি বাড়ি নয়সব ভাইয়ের বাড়িই তোর বাড়ি

এই পেথম মনে হলো কত্তা মন-রাখা কথা বললে

ভাগ-জোগের কথা শ্যাষ হতে হতে সিদিন রাতদোপর পেরিয়ে গেয়েছিল। মাঝে একবার থেমে রাতদোপরের পরে সবাই রেতের খাবার খেয়ে নিলে। সবকিছু গরম করে আমরা বউ-ঝিরা পুরুষদের খাওয়ালম। সব ভাই মিলে মনে হয় এই পেথম আর শ্যাষবারের মতুন একসাথে বসে খেলে। পেথমবার বলছি এইজন্যে যি আমি অন্তত ই সোংসারে আসার পর থেকে পাঁচ ভাইকে একসাথে খেতে দেখি নাই। কত্তা বরাবর নিজের ঘরে আলেদা একা খায়। ভাশুরের সাথে কুনো কুনো ভাইকে কিম্বা ল আর ছোট দ্যাওরকে একসাথে কখনো কখনো খেতে দেখেছি বলে মনে পড়ে কিন্তুক পাঁচজনাকে একসাথে কখনো দেখি নাই। আর শ্যাষবারের লেগে বলছিঅনুমান যিআর কি কুনোদিন তাদের একসাথে খেতে দেখতে পাবসোংসার ভাঙার। লেগে জড়ো হয়েছে বলে বাধ্য হয়ে তারা আজ একসাথে বসে খেচেসোংসার জোড়া দেবার লেগে নয়

ঐ রেতেই যেমন যেমন কথা হলো সেইভাবেই সব ভাগ হলোঝগড়াঝাটি হলো নাপাড়াপড়শিগাঁয়ের লোকদের ডাকতে হলো না। তবে সব ঠিকঠাক হতেআলেদা আলেদা হাঁড়ি হতে দিনকতক সময় গেল। বুকে পাষাণ বেঁধে চুপচাপ নিজের কাজ করতে লাগলম। বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝবার জো নাইকিছুই বদলাইল নাযে যেমন ছিল তেমনি থাকলেশুদু ছেলেপুলেগুলি নিজের নিজের মায়ের কাছে খেতে লাগল

আমি জানি কি সব্বোনাশ ই সোংসারের হয়েছে। মুখে কারুর একটি বাকি নাই। সবাই ঘুরে বেড়াইছে ঠিক যেন মড়াধড়ে জান তাইমুখে হাসি নাই। ছেলেমেয়ের মুখে জ্যোতি নাইরা-কথা নাই। কি চেল্লাচিল্লিহাঁকাহাঁকিমারামারি ছিল ই সোংসারের ছেলেমেয়েদের মদ্যে অ্যাকনতার কিছু নাই। ননদকে আজ কদিন থেকে দেখতে পাওয়াই যেচে না। নিজের ঘরটিতেযে ঘরে বড় খোঁকা মরেছিলগিন্নি মরেছিলসেই ঘরে আঁদারের মদ্যে দিনরাত বসে আছে। তার বুনপোআমাদের ছোট ভাগ্নেটি আজ কদিন হলো নিজের বাড়িতে গেয়েছেআর বোধায় ফিরবে না। বড় হয়েছেহয় স্কুলপাশ দিয়ে শহরে পড়তে যাবেনয় নিজের বাড়িতে বাপ-চাচার কাছে ফিরে যাবে। কথা অ্যাকনো হয় নাইতবে ননদ ঠিক বুঝে গেয়েছে যি পাখি আর বেশি দিন থাকবে না। আমার ছেলেটি কবে থেকে শহরে পড়ছে কলেজেবাড়ি পেরায় আসেই না। মেয়েটো-ও শহরের মেয়ে-স্কুলে ভত্তি হয়েছেথাকে তার মামুর কাছেআমার সেই মায়ের প্যাটের ভাইটির কাছে। তবে খুকি ঘন ঘন বাড়িতে আসে। বাইরের ঘরটিতে আগের মতুনই আমি ছোট ছেলেদুটিকে নিয়ে থাকি। ওখানে একবার ঢুকে গেলে বাড়ির আর কুনোকিছু আমাকে দেখতে হয় না। কত্তা ঠিক আগের মতুন পরচালিতে লোহার চেয়ারে পিঠ লাগিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। কি ভাবে সেই জানে

খামারে একটার পর একটা মরাই বাঁধা হতে লাগল। একদিন দু-দিন পরে পরে মুখে গামছা জড়িয়ে মুনিষরা সব মরাইয়ে ধান তোলে। কেমন রাবণের মতুন মুখ ফুলিয়ে গোমড়ামুখে কাজের দেখাশোনা করে ল-দ্যাওর। এক-একটো মরাই যিদিন শ্যাষ হয়সিদিন যার মরাই সে মুনিষদের চিতুই পিঠে না হয় ধুকি খাওয়ায়। আগের মতুন আট-নটো মরাই দেখে খুশিতে ডগোমগো হয় না কেউ। খামার ভরে মরাই তেমনিই আছে বটেকিন্তুক কুনো ভাইয়ের একটিকুনো ভাইয়ের দেড়টি মরাইতা দেখে একা একা আর কতো খুশি হবে?

 

এত খুনএত লউমানুষ মানুষের কাছে আসছে খুন করার লেগে

একদিন দোপরবেলায় চুলো থেকে উজ্জ্বলন্ত ভাতের হাঁড়িটি খালি নামিয়েছিএমন সোমায় খবর প্যালম রায়েদের বড় ছেলে সত্য কলকেতায় হিঁদু-মোসলমানের হিড়িকে কাটা পড়েছে। পেথম ই কথার কুনো মানে বুঝতে পারলম না। কাটা পড়েছে আবার কিবাসে চাপা পড়েটেরেনে কাটা পড়েকলকেতায় মানুষ কাটা পড়েছে মানে কিমানুষ কি কদু-কুমড়ো যি বঁটির ছামনে ধরলম আর ঘাস করে কেটে ফেললম। সবাইকে আমি শুদুইহ্যাগো হিঁদু-মোসলমানের দাঙ্গা আবার ক্যানে শুরু হলো। ই কথার জবাব আর কে দেবেসবাই তো আমারই মতুনকথা শুনে হাঁ হয়ে আছে। ঐ রায়েরাএককালে য্যাতো বড়লোকই থাকআজ তারা ভিখিরি। ছোটরায় দাদঅয়লা পেট বার করেগলায় কালো-কিটকিটে পৈতে ঝুলিয়ে খালিগায়ে কাপড়ের একটো ঝোলা নিয়ে পেত্যেকদিন ভিক্ষে করতে বের হয়। তা তার মনে খুব দয়া যি সি ই গাঁয়ে ভিস্থ করে না। যেদি করততাইলে ই গাঁয়ের ভদ্দরলোকদের মুখে জুতো পড়ত। সে ভিস্থ করে ভিন গাঁয়ে। কঠিন গরমের দিনেতেতে পুড়ে কিম্বা ঝড়-বাদলে কাক ভেজা হয়ে ভিক্ষার চাল কটা এনে বামুন-গিন্নির হাতে দেয় তবে চুলো ধরেদুটো ভাত ছেলেমেয়েদের মুখে ওঠে। ধিঙ্গি ধিঙ্গি মেয়েদের বিয়ে হয় নাইদুটি ছেলে ইস্কুলে যায় আবার যায়ও না। শুদু বড় ছেলেটিই কলকেতায় যেয়ে কার বাড়িতে রাঁদুনি হয়েছেনা মুদির দোকানে মাল ওজন করেসে দু-চার টাকা সংসারে পাঠায় তবে এতগুলিন মানুষ বেঁচে আছে। সেই সত্য আবার কলকেতায় কি করলেকার ক্ষেতি করলে যি খচাৎ করে তার মাথাটো কেটে ফেলতে হলো! তার না হয় কল্লা গেলএইবারে যি তার বাড়ির এতগুলিন মানুষ না খেয়ে মরে যাবে! ছোটরায়ের সাধ্যি নাই যি এতগুলিন পেরানিকে সে পেরানে বাঁচায়। ছেলেটোকে আমি চেনতমআমার অ্যাকনকার বড় খোঁকার বয়েসিদু-একবার তাকে দেখেছি বড় খোঁকার সাথে। সে এমনি ভালো মানুষ যি একটো পিপড়ে মারারও ক্ষমতা নাই তার। আমাকে কেটে ফেললেও বিশ্বেস করতে পারব না যি সে কাউকে মারতে গেয়েছে। সত্যর মায়েররায়েদের ছোট গিন্নির মুখটো আমার মনে পড়তে লাগল। দু-একবার দেখেছি। ফরশা টুকটুকে বউমানুষটি ময়লা চেকট ছোঁড়া শাড়ি পরে থাকে। মাজা সোনার মতুন তার খোলা গা বেরিয়ে পড়ে। সেই মানুষের কপালে এমন পুত্রশোক লেখা ছিল! হায় হায়!

সবাই বলতে লাগল নেড়ে মোসলমানরা তাকে মেরেছে। তাই হবেহিঁদু-মোসলমানে হিড়িক মানেই হচে হিঁদুকে মোসলমান মারবেমোসলমানে হিঁদু মারবে। আর কিছু দেখাদেখি নাইপাঁচজনা হিঁদু কলকেতার রাস্তায় একটো মোসলমানকে একা বাগে পেলে তো পিটিয়ে কিম্বা ছোরা ঢুকিয়ে মেরে ফেললে আবার পাঁচজনা মোসলমান একটো হিঁদু দেখতে পেলে কি চিনুক না চিনুককিছু করুক না করুকতাকে তরোয়াল নাইলে টাংগিনাইলে যা দিয়েই তোক মেরে ফেললে

বাঃ ভালো! এইবার এই গাঁয়ের হিঁদুরা বলছে সত্যকে মেরেছে মোসলমানরা। তাইলে বিশ্বভাবনের মোসলমানরা বিশ্বভভাবনের হিঁদুদের শত্রুর। তাই যেদি হয়তাইলে ই গাঁয়ের মতুন যেখানে য্যাতো হিঁদু-মোসলমানের গাঁ আছেসব জায়গাতেই কি দাঙ্গা শুরু হবেকি অস্থির যি লাগতে লাগল আমার! কত্তা কি এই নিয়ে আমাকে দুটো কথা বলবে না?

আমাদের এই বেরাট গাঁয়ে মাত্তর বিশ ঘর মোসলমান। ছানাপোনা নিয়ে একশোটো লোক হবে কিনা সন্দ। হিঁদু খুব কম করেও পাঁচশো ঘর। আশেপাশের গাঁগুলিনও মোটামুটি হিঁদু-গাঁ। এই কথা কুনোদিন মনে হয় নাই। ক্যানে মনে হবেমানুষ আপনমনে বাস করছে। নিজের নিজের পেরানছেলেমেয়ে সোংসার নিয়ে হাবু-সোঁটা খেতে হচে সবাইকে। হিঁদু-মোসলমান আবার কিকুনোদিন মনে করি নাই যি ই নিয়ে আবার ভানা করতে হবে। মনে তো অ্যাকনো করতে চাই না। কিন্তু খালি যি মনের ভেতর আগা লিছেযেদি ই গাঁয়ে দাঙ্গা লাগে তাইলে এই কটি মোসলমান তো এক লাপটেই মারা পড়বে। সাথে সাথে মনে হলোমনে পাপ ঢুকেছে তাই এই কথা মনে হচে। ভাবো দিকিনি কত্তা কাটতে যাবে কত্তামাকে! নাপিত বউয়ের স্বামীনাইলে হলা বাগদির বাপ খুন করতে আসবে আমার ছেলেদুটিকে

গত বছর থেকে খালি শুনছিমোসলমানদের আলেদা একটো দ্যাশের লেগে আন্দোলন হচেবিটিশদের সাথে খুব দেন-দরবার চলছে। কত্তা খালি তাড়া দিত আর নতিজা করত বলে গত কবছর বঙ্গবাসী’ কাগজটো এট্টু এট্টু পড়তে চেষ্টা করতম। ত্যাকন থেকেই জেনে আসছিমোসলমানদের লেগে একটো আলেদা দ্যাশ করার বন্দোবস্ত হচে। কত্তা আর আগের মতুন পেরায় পেত্যেকদিন শহরে যায় নাপেসিডেন্টগিরি যাবার পর থেকে বাড়িতেই থাকে বেশির ভাগ দিন। তাপরে এমন যি আকাল গেলবুকে হেঁটো ঠেকিয়ে জড়িয়ে-মড়িয়ে কুনো পেরকারে সেই পুলসেরাত পার হতে হয়েছেশহরগঞ্জে যেতে ভয়ই লাগত মানুষের। তা ত্যাকন কত্ত বাড়িতে বসে বসে আর কি করবেকাগজ-মাগজ পড়ত আর মন-মর্জি ভালো থাকলে দ্যাশ দুনিয়া নিয়ে আমাকে কখনো কখনো দু-চার কথা বলত। যে করে থোক আকালটো মোটামুটি মানুষ সামলাইলেদুবার ফসল যাওয়ার পরেতিতিয় বছর খুব ধান হলো। গবরমেন্টের সাধ্যি হলো নাচোরা-কারবারিদেরও লিকিন খ্যামতা হলো না যি আকালটো আর কিছুদিন চালিয়ে যায়। ইদিকে যুদ্ধর ত্যাজও মরতে মরতে গত বছর বর্ষাাকালের গোড়ায় সারা পিথিমির যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে। কিন্তুক সেলমানদের লেগে আলেদা একটো দ্যাশের কথা ক-বছর থেকেই শুনে আসছি। ই নিয়ে কতো কথা থাকে কাগজেকত্তাও অ্যানেক কথা বলে এই নিয়ে। সব কি আর বুঝতে পারিকাগজে অ্যানেক মজার মজার নাম পড়িআবার সিসব নাম ভুলেও যাই। কিন্তুক কতকগুলিন আর ভুলতে পারি না। এক সময় খালি পড়তম শ্যামা-হক এই নাম। বুঝতে পারতম না ই একটো লোকের নামনা দুটি লোকের নাম। কত্তাকে শুদুইলে বললেনাতোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না। দুটি মানুষের নাম তাও বুঝতে পারলে নাশ্যামাপ্রসাদ মুখুজ্জে আর শেরে বাংলা ফজলুল হক। মন্ত্রীদের একটি সভা আছেতাদের পরামর্শে আর ব্রিটিশদের চোখ-রাঙানি সয়ে এই দুজনেই এখন দেশ চালাচ্ছে

কবে বলেছিল কত্তা এই কথা। তাপর কাগজেও পড়েছেলমকত্তা-ও বললে ঐ সভা ভেঙে গেয়েছে। উদের ক্ষমতা শ্যাষ। অ্যাকন খাঁটি মোসলমানদের শাসন চলবে। সে-ও ক-বছর হয়ে গেল। তার পর থেকেই শুনছি মোসলমানদের আলেদা একটো দ্যাশের লেগে খুব আন্দোলন চলছেসি লিকিনি না করে ছাড়বে না। আর পড়তে লাগলমশুনতেও লাগলম কটি নামজিন্নানেহেরুগান্ধিপ্যাটেল। এমন নাম তো জেবনে শুনি নাইকিছুতেই মনে থাকত না যেদি হাটে মাঠে ঘরে বাইরে সব সোমায় এই নামগুলিন না শুনতে পাওয়া যেত। আরও পড়লম নাজিমুদ্দীনলেয়াকত আলীসোরাবর্দীআবুল হাশিমের নাম। আবুল হাশিমের নাম খুব দেখতে প্যাতম। ঐ নামটি ভুলি নাই। একে তো মোসলমানদের নেতাতাপর তার দ্যাশের বাড়ি আমার বাপের বাড়ির খুব কাছেদু-তিনকোশের মদ্যেই

সি যাকগোকথা তা লয়। দাঙ্গার কথাটো বলতে যেয়েই এত কথা। মোসলমানদের আলেদা দ্যাশ পাকিস্তানের কথা হতে হতে এমনি শোরগোল হতে লাগল সি আর কান পাতা যায় না। শ্যাষের দিকে খালি বলেলড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। লড়কে তো লেঙ্গেকিন্তুক নিয়ে করেঙ্গেটা কিকোথা পাকিস্তান হবে জানিসতু যাবি সেখানে?

কত্তাও দেখি মাঝে মাঝে খুব রাগ করছে। মোসলমানদের আলেদা দ্যাশের কথা তো সেই আকালের সোমায় থেকেই শুনে আসছি। ত্যাকন এক কান দিয়ে ঢুকত আর এক কান দিয়ে বেরুইত। বলে,মানুষের প্যাটে-পিঠে সেঁটে গেয়েছেপরনে ত্যানা নাইলতাপাতাশামুকগুগুলি খেয়েও লোকে বাঁচতে পারছে নাশেয়াল-কুকুরের জেবন হয়েছে মানুষের আর তারই মধ্যে আবার মোসলমানদের আলেদা অ্যাকটো দ্যাশের কথা! কে তাতে কান দেবেকিন্তুক কান দেবার লোক আছে বইকি! যাদের নিজেদের ভাবনা-চিন্তা নাইখাওয়া-পরার চিন্তা নাইতারা তো গরিব মানুষের লেগে ঘরে বসে মাহা মাহা চিন্তা করতেই পারে

যাই হোক সিসব কথায় ত্যাকন লোক কান দেয় নাই। কিন্তুক কথাটো গেল নাজিটিবিটি করে ধরে থাকল। আকাল গেলযুদ্ধ গেলপাকিস্তানের কথা আবার ফিরে এল। আগে আগে কত্তা বলতপাকিস্তানের বাতিকটা বোধ হয় গেল। লোক দেখানো হোকযাই হোকব্রিটিশ চেষ্টা করছে হিঁদুদের গান্ধিনেহেরুপ্যাটেল আর মুসলমানদের নেতা জিন্নার সাথে বসে একটা পথ বার করতেযাতে দেশটাকে আর ভাগ করতে না হয়। আবার কদিন বাদে হয়তো এসে বললেনাঃ হলো নাএকটা দক্ষযজ্ঞ মনে হচ্ছে হবেইএবার জিন্না রাজি না। কদিন পরে ফের বললেএবার নেহেরু রাজি হলো না। এই করতে করতে একদিন মাহা বিরক্ত হয়ে এসে বললেএই জিন্না লোকটা একটা দিন জেল খাটলে নাএকটা দিন উপোস করলে না গান্ধির মতোমুসলমানের কিছুই নাই তারজামাকাপড় আগে পরত সাহেবদের মতেএখন মুসলমানদের নেতা হয়েছেশেরওয়ানি পরেমাথায় পরে তার নিজের কায়দার টুপি

অত রাগ করছ ক্যানেআমি এট্টু অবাক হয়ে শুদুই

রাগ হবে নাসারা দেশের মানুষ কি চায়না চায়তার খবর তে হবে নাকাগজ-কলম নিয়ে শুধু ঘরে বসে আঁক কষলেই হবে

আমাকে এট্টু বুঝিয়ে বলো দিকিনি। আঁক ক্যা আবার কি?

কোথা ভারতের স্বাধীনতা তার কোনো খবর নাই। আঙুলটা পর্যন্ত কোনোদিন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তোলে নাই আর যখুনি এই দেশের স্বাধীনতা দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাবার অবস্থা ব্রিটিশেরদিশেহারা অবস্থাতখুনি সে বলছে মুসলমানদের আলাদা দেশ দিতে হবে। আবার প্যাটেল-ম্যাটেল কটা হিঁদু নেতা আছে যারা হিঁদু-মুসলমান। দুই দুই না করে কোনো কথা ভাবতেও পারে না

কত্তা কথাগুলো এমন করে বলছিল যেন নিজের সাথে নিজে কথা বলছে। সেই লেগে আমি একটু চেঁচিয়ে বললমআহাঘরে বসে কাগজ-কলমের কথা কি বলছিলে সেই কথাটি পোঞ্চার করে বলো

কাগজ কলমকত্তা হাসলেযাদের জন্যে এইসব কথাতাদের কাছে না এসে ঘরে বসে চিঠি চালাচালি করাখবরের কাগজে একগাদা কথা ছাপানোএইসব করেই বাজিমাত করার কথা বলছিলাম রাগ করে। স্বাধীনতার জন্যে একটা আন্দোলন হচ্ছেআবার সেই আন্দোলনের পেটের ভেতর মুসলমানদের জন্যে একটা আলাদা দেশের আন্দোলনও হচ্ছে। ডালে-চালে মিশে যাচ্ছে না?

আমি আজ শুনব। মোসলমানদের আলেদা দ্যাশ ঠিক কি কথা?

আচ্ছাঠিক আছে শোনো। আমি নিজেও যে খুব বুঝি তা নয়। কোনো কিছুর সঙ্গে এখন আর আমি নাই। খবরের কাগজ-টাগজ পড়ে যা বুঝি তাই বলছি

আগে বললমোসলমানদের দ্যাশ যি বলছসেই দ্যাশ হলে সব মোসলমান সিখানে বাস করবেকেউ তার বাইরে থাকবে না?

আর দূরতাই কখনো হয় নাকিসারা দুনিয়ায় মুসলমানদের কত দেশ আছে জানোকতো পোশাককতো ভাষাকতো জাততার কোনো অন্ত আছে নাকি! একটিমাত্র দেশে তাদের সবারই থাকার কোনো জায়গা নাই। আমাদের এই ভারতেই কতো দেশ! কতো কিসিমের মুসলমান এই বিরাট দেশে আছে কেউ জানেওভাবে এক দেশে সব মুসলমানকে রাখার কথা হয় নাই। এই বাঙালি হিঁদু-মোসলমানের মধ্যেই কতো মুসলমান আছেসবাইকে একটা আলাদা দেশে রাখতে পারবে কেউ?

তবেআলেদা দ্যাশের কথা ক্যানেআমাদের এই দ্যাশের মোসলমানকেই যেদি একটা দ্যাশের মদ্যে রাখতে না পারে তাইলে উকথা হচে ক্যানে?

আমার এই কথায় কত্তা যেন একটু থমকে গেল। কিন্তুক উ কি থামবার মানুষবললেপ্রথমে কথা হয়েছিলসারা দেশে যেখানে যেখানে মুসলমান অন্য জাতের চেয়ে বেশি বাস করেসেই সব জায়গা নিয়ে বেশ কটা আলাদা দেশ হবে। তারপর সেকথা উড়ে গেলব্রিটিশরা বললে দেশ ভাগ কোরো নাবরঞ্চ তিনটে খণ্ড করে এক দেশের মধ্যেই সবাই থাকো। সে কথাটিও আবার নেহেরু প্যাটেল হিঁদু নেতাদের পছন্দ হলো না। এখন জিন্না খেপেছেকোনো কথা নয়পাকিস্তান বলে একটি আলাদা মুসলমানদের দেশ চাই

এতক্ষণ ধরে কত্তা যেসব কথা বলছিলমনে হছিল তা অন্য কুনো ভাবের কথা তার একটি বন্ন বুঝতে পারছেলম না। খুব চেষ্টা করলম। বুঝতে কিন্তুক কি বুঝবদুনিয়ার কি কিছু জানিকোথা কোথা মোসলমান থাকেএই দ্যাশেই বা কোথা কোথা তারা থাকেকি খায়কি মাখেকি পরেকেমন করে কথা বলেকি ভাষায় কথা বলেকি তাদের স্বভাব-চরিত্তির ইসব কিছুই জানি না। বোঝলম ই নিয়ে কথা বলা আমার ঠিক হবে নাতবে এই কথাটো খুব মনে হছিল যি ইসব কথার সাথে হিঁদু-মোসলমান সোংসারি মানুষের কুনো সম্পক্ক নাই। আর নাই য্যাকনত্যাকন আমি মাথা ঘামাইতে যাই ক্যানে! তবে খালি মনে হতে লাগল মোসলমানের দ্যাশ হবে অথচ সব মোসলমান সিখানে থাকবে নাএমনও হতে পারে যি আমি থাকব কিন্তুক আমার সোয়ামি ছেলেমেয়ে থাকবে না। তাই যেদি হয় তাইলে ই কাজ করতে যেয়ে হিঁদু-মোসলমান সম্পক্ককে বিষ বিষ করতে হবে ক্যানে?

কত্তার সাথে এই নিয়ে আর কুনোদিন কথা বলতে চাই নাই। কিন্তুক মনে হয় তারও বুকের ভেতরে ঝড় বইছিল। অ্যাকন তো আর বুঝতে কিছু বাকি নাই। মাঘ-ফাগুনে কত্তা একদিন বললেএকটো নিৰ্বাচন হবে। কঠিন নিব্বাচনএমন নিব্বাচন লিকিনি আর কুনোদিন হয় নাই। এই নিব্বাচনে ঠিক হবে মুসলমানরা তাদের আলেদা দ্যাশ পাকিস্তান চায় কি চায় না

কত্তার সেই কথার পরেউঃএই অজ পাড়াগাঁয়েও যি কি জগঝম্প বাজতে লাগল! বাড়িতে থাকিতাও কান ঝালাপালা হয়ে যায়। কদিন এগু যুদ্ধ শ্যাষ হয়েছেঅ্যাকন শুরু হলো আর এক মহাযুদ্ধ। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানলড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান রব করছে মোসলমানরা। পাকিস্তান চাইদের দলে দাঁড়াইলে আবুল হাশিমআর বোধায় পাকিস্তান চাই-না-র দলে দাঁড়াইলে সে-ও একজনা মোসলমান। তার নামটো মনে ছিলঅ্যাকন ভুলে যেচিমনে হচে তার নাম ছিল ছাত্তার

আমরা আর ভোট দিতে যাই নাই। কত্তাকে শুদুইলে সে কিছুতেই রা কাড়লে না। ভাবে মনে হলো আবুল হাশিম পাকিস্তান-অয়লাকেই ভোট দিয়েছে

এর পরে আর ছটো মাসও কাটল না। হিঁদু-মোসলমানে লেগে গেল হিড়িক। কে যি লাগাইলেক্যানে যি লাগাইলে সিকথা বলতে পারব না। কোথা কুন্ পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছি দুনিয়ার কুন্ এক কোণেচাদ-সুরুজ যিখানে চুপে-চুপে ওঠেচুপে চুপে ডোবেচুপে-চুপে ধান হয়গম হয়ফল-পাকুড় হয়চুপেচুপেই আমাদের সন্তান হয়বাড়েমরে। আমরা কার কি করেছি যি সেই গাঁয়ের এক মায়ের অন্ধের নড়ি পুতকে কেটে দুখাণ্ডা করে দেবে?

আমার খুব মনে হতে লাগল একবার রায়দের ছোট গিন্নির কাছে যাই। আমার বড় খোঁকা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল রোগে ভুগে। ছোট গিন্নির নাড়িছেড়া ধনটির দুনিয়া থেকে যাবার সোমায় হয় নাইকে তাকে মারলেকুন অপরাধে মারলেসে-ও জানলে নাতার মা-বাপও জানলে না। টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকল ছেলে। পচে গলে লষ্ট হয়ে গেয়েছে সেই লাশনা কুকুর-শেয়ালে খেয়েছেনাকি কাক-শকুনে খেয়েছেতা-ও জানতে পারলে না মা-বাপ। আহাএকবার যাই সত্য-র মায়ের কাছে। তার গায়ে-পিঠে হাত দিতে পারব না জানিহিঁদুরা আমাদের ছোঁয় না। ছোট গিন্নি তো আবার বামুনের মেয়েযিখানে যেয়ে বসব দাঁড়াব সিখানে আবার পানি ঢেলে ধোবে। তা হোকএকবার যাই। কত্তাকে শুদুব কিনা ভাবলম। এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পরে কুনোদিন গাঁয়ের রাস্তায় বেরুই নাই পায়ে হেঁটে। যেখানেই যাইগেয়েছি গরু-মোষের গাড়িতেটপ্পরের দু-মুখে শাড়ি বেঁধে। তবে গাঁয়ের মোসলমান পাড়ায়। বড় ননদের বাড়িতে দু-একবার যাই মাঝে মাঝেহেঁটেই যাই। পাড়ার ভেতর দিয়ে ই বাড়ি উ বাড়ির পাশ কাটিয়েএর এনে ওর এগ্‌নের ওপর দিয়ে চলে যাই। দিনে রাস্তায় কুনোদিন বেরুই নাই। করে বউ হয়ে ঢুকেছি এই বাড়িতেমাথার চুল পাতলা হয়ে গেছেপাকছে-ও দু-একটিইয়া চ্যাওড়া সিঁথি অ্যাকনতবু বউমানুষের শরম গেল না আমার। মনে করলমকত্তাকে আর শুদুব না। ক্যানে বেরিয়েছেলম শুনলে রাগ করবে না আমি জানি

বৈকাল বেলায় গা-মাথা ঢেকে কুনোরকমে টুক করে রাস্তাটো পেরিয়ে পুকুরের পাড়ের কলাবাগানের আড়াল আড়াল গ্যালম রায়বাড়ি। পুকুরের দখিন কোণেই বাড়ি। বাইরে এসে গায়ে বাতাস লাগলে মনে হলো কুন জগতের বাতাসচাপাপড়া ঘাস যেন নতুন জান পেলে। রায়বাড়ির সিং-দরজা নাইকবে বিক্রি হয়ে গেয়েছেসেখানে দুদিকের মাটির পাঁচির হাঁ হয়ে আছে। সেটো পেরিয়ে এনেয় যেয়ে দাঁড়াইতেই দেখলম সীমেনার পাঁচির কবে ভেঙে পড়ে গেয়েছে। চারিদিক খাঁ খাঁএককোণে একটি মাত্র ঘরআর এগনের এক কোণে রান্নাঘর। ঘরের ছামনে যি একটুকু উসারা আছেসেইখানে একটি ছেড়া ছপ পেতে শুয়ে আছে রায়গিন্নি। দুদিকে গিট-মারা ময়লা একটো বালিশ মাথার তলা থেকে বেরিয়ে এয়েছে আর উঁচু উসারার বাড়ি থেকে রায়গিন্নির এলোচুল এনে পয্যন্ত ঝুলে আছে। খানিক আগে হয়তো পানি ঢেলেছে মাথায়ভালো করে মোছা হয় নাইচুল গড়িয়ে টপ টপ করে ত্যাকনো পানি পড়ছেদু-চারটি পাকা চুল দেখা যেচে। ছোট গিন্নির চোখ বোজাজেগে না ঘুমিয়ে ঠিক বুঝতে পারলম না। বাড়িতে কাক-পক্ষী নাইএকদম ফাঁকা। মেয়েদুটি নাইছেলেটি-ও নাই আর ছোটরায় লিশ্চয় ভিক্ষেয় বেরিয়েছে। এত বড় পুত্রশোকেও তার উপয় নাইপোড়া প্যাট তো মানবে নাভিক্ষার চালেই সেই প্যাটের গত্ত ভরাইতে হবে

কি করব বুঝতে পারছি না। চলে আসব না কি ভাবছিএমন সোমায় রায়গিন্নি চোখ মেলে আমাকে দেখলে। চোখের পাতা তার তখুনি আবার বন্ধ হয়ে যেছিলচেয়ে তাকানোর খ্যামতা নাই। কিন্তুক তবু কি কষ্ট করে যি সি চোখের পাতাদুটি খুলে রাখলেতা আমি বুঝতে পারলম

কে?

গলার আওয়াজ শুনে গা শিউরে উঠল। ই কি মানুষেরা গলাআমি নিজের পরিচয় দেলম। মাথায় পানি ঢালতে যেয়ে ছোট গিন্নির লালপাড় ঘেঁড়া শাদা শাড়িটিও ভিজে গেয়েছে। মুশুরির বিউলির মতুন গায়ের রঙ তার অ্যাকনো আছেভেজা শাড়ির ভেতর দিয়ে সেই রঙ যেন ফুটে বেরুইছে। আমি পরিচয় দিলে অতি কষ্টে উঠে বসতে বসতে ছোট গিন্নি উসারার দিকে দেখিয়ে আমাকে বসতে বললেবোসো দিদি।

একটু অবাকই হয়ে আমি আস্তে আস্তে ছোট গিন্নির কাছ থেকে একটু দূরে উসারার ওপর মাটিতেই বসতে গ্যালমগিন্নি ইশারায় আর। এট্টু কাছে যেতে বললে

আমার এমন সাধ্যি নাই যে আসনটা এনে তোমাকে বসতে দিহারামজাদি দুটি এখন কোন্ চুলোয় গেছে!

তাড়াতাড়ি করে মাটিতে বসে পড়ে আমি বললমনা নাআমি এই মাটিতেই বসিতুমি বেস্ত হোয়ো না। আমাকে তুমি চিনতে পারো নাইআমি

নানাচিনতে পেরেছি। দু-তিনবারের বেশি তোমাকে দেখি নাই বটেতবে একবার তোমাকে দেখলে কেউ ভুলতে পারেপিতিমে দেখা আর তোমাকে দেখা যে এক কথা। আমার কি সৌভাগ্য যে তুমি এ বাড়িতে এসেছ

আমি যি মা খপ করে মুখ দিয়ে কথাটো বেরিয়ে গেল আর কি যি হলো জানি নাচোখদুটি আমার পানিতে ভেসে গেল। সেই ঝাপসা চোখেই আবছা দেখতে প্যালম রায়গিন্নি একদিষ্টে আমার দিকে ঠিক যেন শাদা পাথরের চোখে চেয়ে রয়েছে। আমার চাউনি পোঞ্চার ইলে দেখলম রায়গিন্নির চোখের পাতা পড়ছে নাথির তাকিয়ে আছে। আমার দিকে। তাপরঅ্যানেকক্ষণ পরআস্তে আস্তে তার ডাগর চোখদুটি পানিতে ভরে এলটইটম্বুর হয়ে এল আর গলা দিয়ে শুকনো বাস বার করতে করতে সে বললেদিদি বড় কষ্টবড় কষ্ট দিদি! সি এমন করে বলাসি এমন করে বলা! আর বলতে বলতেই রায়গিন্নি মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে বুক ফাটিয়ে কেঁদে উঠলকোথা রেকোথা রেকোথা গেলিরেকোথা মরে পড়ে থাকলি রে বাবা!

আমার এমন ইচ্ছে হলো যেন সব ভুলে এই মানুষটিকে বুকে জড়িয়ে ধরি। মনে হলো সে-ও যেন হাত বাড়িয়ে আছে। এত ইচ্ছেতবু যেতে কি পারলমতখনি মনে হলোযেতে যি পারছি নাতার কারণ তো আমি মোসলমান আর রায়গিন্নি হিঁদু! আর য্যাত লড়ালড়িখুনোখুনি হচে সব তো শুদু হিঁদু-মোসলমান বলে। এক হিঁদু মায়ের পুতকে মারছে একজনা মোসলমান আবার এক মোসলমান মায়ের পুতকে মারছে। একজন হিঁদু। আঃ হায়রে! মানুষ লিকিন বুদ্ধিমান পেরানি

আমি যেখানকার সিখানেই বসে থাকলমএকফোঁটা নড়তে পারলম না আর রায়গিন্নি মেঝেতে মুখ গুঁজে অমনি করে গুঙিয়ে গুঙিয়ে এমন কাঁদন কাঁদতে লাগল যেন ধরণী ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। মনে মনে ভাবছি আমি এখানে কিছুই করতে পারব নামায়ের। এমন শোকে আল্লাই সান্ত্বনা দিতে পারবে নাআমি তো কুন ছাড়তাইলে আমি অ্যালম ক্যানে?

এইসময় সিং-দরজার হাঁ-মুখ দিয়ে রায়গিন্নির হারামজাদি দুটি বাড়ি ঢুকল। সি যি কি সোন্দর মেয়েদুটি! পাতলা পাতলা ঠোঁটটানা টানা চোখযেন পটে আঁকা। প্যাট ভরে খেতে পায় নারুখু চুল উড়ে বেড়াইছে। কতোদিন ত্যাল পড়ে নাই তাতেতবু কি রূপকি রূপ। হাতে পায়ে চুলে ধুলোর পরত পড়েছেতারই ফাঁকে ফাঁকে ধপধপে গায়ের রঙ যেন ফেটে বেরুইছে। তারা মাথা নামিয়ে মায়ের দু-পাশে হেঁটো মুড়ে বসল। সি মুখদুটিতে যি কি আছে আমি বলতে পারব না। একবার একবার বুনদুটি আমার দিকে তাকাইছেআবার মুখ নামিয়ে নিছে। আস্তে আস্তে তারা মায়ের ছড়ানো চুলগুলি গুছিয়ে তার উবুড় পিঠে রাখলেতাপর দুপাশ থেকে রায়গিন্নির মুখটি ধরে খুব নামো গলায় বললেওঠোওপাড়ার জেঠি বসে আছেউঠে কথা বলো। এই বলে তারা মাকে উঠে বসাইলে

চেয়ে দেখলম ছোট রায় ভিক্ষের ঝুলিটি কাঁধে নিয়ে বাড়ি ঢুকছে। ভিক্ষে অ্যানেক পেয়েছেঝুলিটি বেঁধে বস্তার মতুন করে কাঁধে বয়ে নিয়ে আসছে। খালি-গাসারা প্যাটে দাদচুলকিয়ে চুলকিয়ে যেন। খড়ি উঠেছে। ময়লা পৈতেটি দেখে মনে হচে বামুন বটে! এনে পেরিয়ে উসারায় উঠে একবার আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে মাটি দেখতে দেখতে সে ঘরে যেয়ে ঢুকল

কি করবএইবার আমি আবার উঠব উঠব করছিরায়গিন্নি ধরা গলায় বললেকি করে কি হলো দিদিকিছুই বলতে পারব না। ছেলে মরল মরলতার দেহটি-ও পেলাম না। শেষ কাজও করতে পারলাম না। আমাদের হিঁদুদের মধ্যে গঙ্গা না পেলে কারু মুক্তি নাই। যতো পুণ্যিই থাকুকপাপ তো কিছু সব মানুষেরই থাকে। সেই পাপ কিছুতেই ক্ষয় হবে না মা গঙ্গা কোলে না নিলে। তার দাহ হলো নাছেরাদ্দ-ও এখনো হয় নাই। তোমাদের মতোই তো দিদিগোর না দিলে তোমাদের কারু কি গতি হয়?

খবরটো কেমন করে পেয়েছিলে ছোট গিন্নি?

সিদগাঁ আমার বাপের বাড়ি। আমার ছোট ভাই কলকাতায় কাজ করে। সেই তো সত্যকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে এক বড়লোকের বাড়িতে রান্নাবাড়ার ঠাকুরের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। দুজনাই একসাথে এক মেসে থাকে। আলাদা আলাদা জায়গায় কাজ করলেও দুজনে মেসে ফেরে একসাথে। সেদিনও তেমনি ফিরছিল তারা। রাস্তা ফঁকা। দাঙ্গা নাকি কদিন আগে শুরু হয়েছিলএরা ওদের মারছিলওরা এদের মারছিল। এক দিকে হিঁদু-পাড়া আগুনে পুড়ছেআর একদিকে তোমাদের মোসলমান-পাড়া পুড়ছে। ভাই বলছিলসামনা-সামনি দাঙ্গাতে-ও মানুষ মরছিল

সত্য তো সামনা-সামনি দাঙ্গাতে মরে নাই

না দিদিহিঁদুপাড়ায় একজন মোসলমানকে বাগে পেলে মারছে আবার মোসলমানপাড়ায় একজন হিঁদুকে বাগে পেলে মারছেচিনুক আর নাই চিনুক। হিঁদু না মোসলমান বুঝতে পারলেই হলো। সেদিন রাস্তা ছিল ফাঁকাকিরীটী

কিরীটী তোমার ভাই?

হ্যাগো দিদিঐ একটিই ভাই আমার। তা কিরীটী বললেহঠাৎ চারজন তোমাদের জেতের লোক পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তাদের ঘিরে ধরল। চারজনের হাতেই ছুরি ছিল। এসেই কোনো কথা নয়সত্য-র তো খালি গাপৈতে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল বামুনসত্য-র পেটে বুকে চারজনেই ছুরি ঢুকিয়ে দিল। কিরীটী-ও বাঁচত নাসত্য-র দিকেই ওদের সবার নজর ছিল বলে সে লাফ দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এসে একটা বড় নিমগাছের আড়ালে লুকিয়েছিল। সেখান থেকেই সে সব দেখলে। সত্য দুবার মা মা বলে ডেকেছিলআর কোনো কথা বলতে পারে নাই। পেটে বুকে পিঠে ছুরি মারতে মারতে ছেলেটিকে আমার আঁঝরা করে দিয়ে আর একটুও দাঁড়ায় নাই। তারা। কিরীটী বললেআমাকে তুমি জুতো মারো দিদিআমি কাছে গিয়ে সত্যকে আর একবার দেখে আসতে পারি নাই গোপেরান নিয়ে সেই যে দৌড়েছি,মেসে এসে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়ে তবে থেমেছি

আমি রায়গিন্নির মুখের দিকে চেয়ে থাকলম। তার চোখে অ্যাকন আর পানি নাইচোখদুটি যেন ধকধক করে জ্বলছে। আমার মনে হতে লাগলআমার বোধায় আসা ঠিক হয় নাইআমার বোধায় অ্যাকন চলে যাওয়াই ঠিক। রায়গিন্নি কাকে ঘিন্ করবে বুঝতে পারছে নাবোধায় আমাকেই তার ঘিন্ লাগছে। কি দোষ দেব রায়গিন্নিরঐ। মা তার ছেলের লাশটো-ও দেখতে পায় নাই। রাস্তায় সেইখানেই লাশ পড়েছিল নামুদ্দোফরাস টানতে টানতে নিয়ে যেয়ে মড়া-ফেলার গাড়িতে তুলেছিল কিছুই জানে না সে। কিন্তুক কারা তাকে মেরেছে তা জানতে পেরেছে সে। আমি য্যাতোই আসি একজন মা-কে সান্ত্বনা দিতেসে আমাকে ভালো চোখে দেখতে পারবে ক্যানেআমি আর বসে থাকতে পারলম নাবাড়ি যাবার লেগে উসারা থেকে এনেয় এসে নামলম। সাথে সাথে রায়গিন্নির মেয়েদুটিএকটির নাম লক্ষ্মীআর একটির নাম সরস্বতী রায়গিন্নির হারামজাদি দুটি উঠে দাঁড়াইলে। ত্যাকন রায়গিন্নি সব ভুলে চেঁচিয়ে উঠলদিদি তুমি যাচ্ছআমি আর কি বলব দিদি! আর যেন কারু কোল এমনি করে খালি না হয়। ভগবানকে বোলো আমি যেন কাউকে শাপ-শাপান্ত না করিও মামাগো

ঘোট গিন্নি আবার মাটিতে পড়ে কাতরাইতে লাগল। আমি গা-মাথা ঢেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অ্যালম

এই শুরু হলো। কতো কথা যি চারদিক থেকে আসতে লাগলকতো কাইনিকতো ঘটনা। সারা গাঁসারা এলেকা সরগরম। আকালেও এইরকম হয়েছিল বটেতবে সি যেন উল্টো। জাড়কালের রেতে মাঠ যেমন ঠান্ডাশক্ত কঠিন আর শব্দ নাইযেন কতোদিনের বাসি মড়া পড়ে আছে মড়া যেন গলতে পচতে গন্ধ বার করতেও ভয় পেছেআকাল ছিল তেমনি। সারা সারা এলেকা একদম মরে গেয়েছিল। কিন্তুক অ্যাকন যেন গাঁয়ের পর গাঁ উঠে বসেছেমোসলমানরা মাথায় ফ্যাটা বেঁধেছেহিঁদুরা কপালে সিঁদুর লেপেছেরাগে সবারই চোখ টকটকে লাল। বাঁশের ঝাড়ে ঢুকে বাঁশ। কেটে লাঠি বানাইছেকামারশালে যেয়ে টাঙি সড়কি এই সব বানিয়ে নিছে

আমার ল-দ্যাওরের খুব ফুত্তি। কার কাছ থেকে কি শুনে লাফাইতে লাফাইতে বাড়ি ঢুকে বলছেআর হবে নাহিঁদুদের সাথে আর কিছুতেই থাকা হবে নাপাকিস্তান হাশিল করতেই হবে। তার কথা শুনে মনে হছেতাই বোধায় হয় ঠিকপাকিস্তান হাশিল না করলে আর উপয় নেই। ই গাঁয়ের হিঁদুরা তো বটেইআশেপাশের গাঁয়ের সব হিঁদুরা লিকিন তৈরি হচেএকটি মোসলমানও তারা আর রাখবে না। তা ঠিকএত হিঁদু ই দিগরে আছে একবার যেদি ঢেউয়ের মতুন আসেএকজন মোসলমানও জানে বাঁচতে পারবে না। তোড়ে ভেসে যাবে। তা এই আবস্তায় সে এত লাফইছে ক্যানেদ্যাওরকে জিগ্গাসা করতেই সে এমন নোম্বা নোম্বা বাত দিলে যি বুঝতে পারলম সে ঘোরে আছেতার মাথা কাজ করছে না

তৌহিদের খ্যামতা জানোতৌহিদি শক্তির সামনে হিঁদু মালাউন দাঁড়াইতে পারবে না। এক মোসলমান,সত্তরজনা কাফের!

আবার কিসব বলতে বলতে সে ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। হিঁদুদের তো অত দেখতে পাই নাতারা অত চেঁচায়ও না। কতো কথা যি কানে আসে! কুকুর-বেড়াল কান বন্ধ করতেও পারেখুলতেও পারে। তাদের কান নড়েচড়ে। মানুষের কান বন্ধ করার উপয় নেইতার কান খোলাই থাকে। তাই শুনতে না চাইলেও শুনতে পাইগাঁয়ের হিঁদুদের লিকিন গতি-মতি ভালো লয়তারা ভিন্ ভিন্ গাঁয়েরহিঁদুদের সাথে ষড় করছে

তাইলে কি সব মিছে হয়ে গেল। নতুন বউ হয়ে আসার পরে কত্তামা যি আমার লেগে এক-গা গয়না গড়িয়ে রেখেছিলসামনে বসিয়ে একটি একটি করে গয়না দিয়ে আমাকে সাজিয়েছিলসি কি মিছেকত্তা লিকিন তার বড় ছেলেতার ছোট ছোট ছেলেদের যি ভাইয়ের অধিক যত্ন দিয়ে মানুষ করলেসি-ও কি মিছেভচ্চায্যি বড় খোঁকা মরলে কত্তার গলা জড়িয়ে ধরে তাকে বুকে টেনে ঠায় কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেসি-ও কি হিঁদু-মোসলমানের লোক-দেখানো আদিখ্যেতাআর ইদিকে যি আপন ভাইরা এক কথায় পেথগন্ন হয়ে গেলসি বুঝি কিছু লয়দাইবউ নাপিতবউ কতোদিন আর ইদিগপানে আসে না সি কি শুদু হিঁদু-মোসলমানে দাঙ্গা হচে বলেআমার বড় খোঁকাটির লেগে এই কমাস আগেও যি সি আমার কাছে কেঁদে গেলতা-ও কি তোক দেখানো ছিলসে ছোট জেতের হিঁদুবড় জেতের হিঁদুদের কাছে লোক-দেখানোর কাঁদন কাঁদার লেগে তার কি দায় ঠেকেছেহাথাকে বটে হিঁদুদের মদ্যে দু-চার জনা হিঁদু যারা মোসলমানদের জান থেকে ঘিন্ করেপারলে দুনিয়ার সব মোসলমানকে কেটে ফেলে। তেমনি মোসলমানদের ভেতরেও তো আছে তেমন মোসলমান যারা হিঁদুদের ঘিন্ করেতাদের কাফের মালাউন বলে গাল দেয়পারলে সব হিঁদুকে মাটিলাগ করে দেয়। এমন দু-চারজনা হিঁদু মাথাসরো যোবক ই গাঁয়ে আছেসি কথা কত্তাও জানেআমিও জানি। তেমনি মোসলমান পাড়ায় আছে কটো মাথাড্যাকরা ছোঁড়ারাতদিন হিঁদু মারবে বলে লাফাইছে। এমন তো সব জায়গায় সব সোমায়েই আছে। তাই বলে দাঙ্গা করতে হবে ক্যানেরায়গিন্নির হাতের নড়ি ছেলেটিকে রাগ নাই ঝাল নাই শুদু পৈতে দেখে বামুন বলে চেনা গেল বলে মেরে ফেলতে হবে। ক্যানে?

বিষ কেরমে কেরমে কি আমার ভেতরেও ঢুকতে লাগলএতদিন যা জেনেছেলমযেমন করে চলেছেলমসব কি বদলে যেছেআস্তে আস্তে আমারও মনে হচে দিন আর রেতের মতুন হিঁদু-মোসলমানও দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেয়েছে। কে দিন আর কে রাত অ্যাকনো জানি না। সব গোলমাল হয়ে যেছে। কত্তার যি এত জ্ঞানসেই কত্তাও অ্যাকন চুপ! একার সোংসারে সারাদিন খেটে মরিকুনো কুনো দিন সকালেকুনোদিন সাঁঝবেলায় গুমুড়ে গুমুড়ে কাঁদন আসেচুপে চুপে কঁদিশব্দ করে কাদি। কেউ কি শুনতে পায়শুতে এলে কত্তার সাথে দেখা হয়সে-ও চুপমরিয়া হয়ে একদিন শুদুইইসব কি হচেতুমি এমন চুপ ক্যানে?

আমার কিছু করার নাইএখন আর আমার কিছু করার নাই

বাঃতোমার কিছু করার নাইতাইলে কে করবেএতকাল ই সোংসারের লেগেই এলেকার লেগে তুমিই তো সব করে এয়েছ?

আমার সময় চলে গিয়েছে। আমাকে ছেড়ে সময় চলে যাচ্ছেআমি দেখতে পাচ্ছি। এ এমন আগুন লেগেছেআমি তো আমিহিঁদু-মুসলমানের কোনো নেতাই এখন আর এই আগুন সামলাতে পারবে না। খেলা করতে গিয়েছিল আগুন নিয়ে। এখন সেই আগুনে দেশ পুড়ে ছারখার হচ্ছে এ তাদের দেখতেই হবে। যতসব জোচ্চোর বদমাশ!

কত্তা কাকে গাল দিচেক্যানে এত হেঁয়ালি করছে তা আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকল না

হেঁয়ালি না করে আমাকে বলে দিকিনি দ্যাশ ভাগ হবে কি হবে?

আগে সব পুড়ে ছাই হোকতারপরে পোড়া দ্যাশ ভাগও হবেস্বাধীনও হবে

বোঝলম কত্তা এর চেয়ে পোঞ্চর করে আর কিছু বলবে না। তারপর বেশিদিন যায় নাইএকদিন সাঁঝরেতে আমাদের গাঁয়েই হ্যাঙ্গামা লাগল হিঁদু-মোসলমানদের মদ্যে। কারণ সামান্য। শ্যাভেদের একগাদা আউশ ধান পিটনোর লেগে খামারে রাখা ছিলবোধায় জায়গা হয় নাইখানিক আঁটি রাস্তায় গাদিয়ে রেখেছিল। হাজরাদের মোষের গাড়ি রাস্তার সেই ধানের গাদা মাড়িয়ে চলে গেয়েছে। সাঁঝরেতে দেখতে পায় নাই হতে পারে আবার ইচ্ছে করেও হতে পারে। শ্যাভেদের কত্তা দলিজে বসে লোকজন নিয়ে তামুক খেছিল। সে গজ্জন করে উঠলধানের গাদা মাড়িয়ে গেলি যি?

অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পাই নাই

জোসনা রেতে আবার আঁদার কিদেখতে পাস্ নাই মানে?

দেখতে পাই নাইপাই নাইকি করবে কি তুমিযা করেছিবেশ করেছি

বাসআর যায় কোথা। শ্যাখের বড় ছেলে তাগড়া জোয়ানসে কুদি মেরে ছুটে যেয়ে হাজরার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল। এক ঝটকায় তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাজরা বললেথাকল এই আমার গাড়ি। সবাইকে খবর দিয়ে আসছি আবার। বাপের ব্যাটা হলে গাড়ি তখন আটকে রাখিস

আসলে ইসব কিছুই লয়। হিঁদু-মোসলমান দু-পক্ষই ভেতরে ভেতরে তৈরি হছিল। আগুন এতদিন ধোঁয়াইছিলআজ এট্টু ফুই পেতেই দপ করে জ্বলে উঠল। খানিকক্ষণের মদ্যেই সারা গায়ের হিঁদু-মোসলমান মুখোমুখি এসে দাঁড়াইলে। আমার দ্যাওর-রা সব ছুটে বেরিয়ে গেল। লাঠি কাটারি গাঁইতি শাবল যে যেমন পেলে হাতে নিয়ে ছুটলে। ছি ছি ছি! সবাই কি সব ভুললেএক মাঠএক ঘাটএক রাস্তাএক খরানিএক বর্ষাএক ধানহায়হায়দু-দলের মাত্তর কটো লোকের লেগে সব বরবাদ হয়ে গেল! সি যি কি চেল্লানিকি হাঁকাড়ি কানে আসতে লাগল কি বলব! জোস্না রাত খান খান হয়ে যেতে লাগল। নোংরা কথায় বাতাস ভরে উঠল। সি-সব কথা শুনে আমার গা পাক দিতে লাগল। কত্তা ঠায় পরচালিতে বসে। মানুষের সামান্য বেপদে যে কুনোদিন ঘরে বসে থাকে নাইআজ এই মাহা বেপদেও সে থির বসে থাকছে কি করেসি কথাটি তাকে বলতে গ্যালম

আমি খবর পেয়েছিশুধু আমাকে মারার জন্যেই আজকের এই ব্যাপার। আমাকে পেলেই মেরে ফেলবে,তারপর সব মিটিয়ে ওরা চলে যাবে। হিঁদুদের বিশেষ কাউকে মারার কোনো কথা আমাদের মুসলমানদের মধ্যে আছে কিনা জানি না

কথা শুনে গা শিউরে উঠল। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে অ্যালম। এই কি সব হিঁদুদের মনের কথা?লয়তা কিছুতেই নয়ই শুদু দু-চারজনা মাথা মাথা মানুষ আর কটো বজ্জাত হিংসুক ছেলেছোকরাদের মতলব। আমার এই কথাই ঠিক। দু-পক্ষেরই কজনা মানুষের গলা কানে আসতে লাগল। তারা শুদু শুদুইতে লাগলকাকে মারবে আর ক্যানে মারবে। আর মানুষ মারলে কার কি লাভ হবে। * শ্যাষ পয্যন্ত হলো না কিছু। সারারাত চেঁচাইতে চেঁচাইতে ঘ্রান্ত হয়ে ভোরবেলায় সবাই নিজের নিজের বাড়ি চলে গেল

ই গাঁয়ে কিছু হলো না বটেতাই বলে সারা এলেকায় কি কিছুই ঘটে নাইদাঙ্গা লাগানোর এমন সুযোগ কি কেউ ছাড়েচেরকাল দেখে আসছি দুনিয়ায় একটো-দুটো মানুষই সব লষ্টের মূল। রাখাল যেমন করে গরু ডাকিয়ে নিয়ে যায় তেমনি করে এই একটো-দুটো মানুষই ঘরো ভালোমানুষদের ডাকিয়ে নিয়ে যেয়ে গাড়ায় ফেলে। শহরগঞ্জেই এমন খারাপ মানুষ বেশি বোধায়। দাঙ্গাহাঙ্গামা সব সোমায় শহরেই শুরু হয় এই লেগে। গাঁয়ের মানুষ শহরে গেলে সব ভুলে যায়তার পাড়াপড়শি থাকে নাভাইবন্ধু থাকে না। সে কাউকে চেনে না। পাশের বাড়িতে যে থাকে তাকেও লয়। ছোট দ্যাওরের শহরের বাসায় দু-একবার গেয়েছি বটে কিন্তু কিছুতেই জান টেকে নাই

হিঁদু-মোসলমানের হিড়ি যেদি পাড়াগাঁয়েই চলে এলতাইলে টাউন শহর কি বাদ থাকবেঠিকএকদিন খবর এলমউকুমা টাউনের ইসুফ মিয়েকে তার নিজের বাড়ির ভিতরে যেয়ে মেরে এয়েছে হিঁদুরা। খুব নাম করা মোকাদিম এই ইসুফ মিয়ে। তার চামড়ার ব্যাবসা। মোসলমানদের মদ্যে তো বটেইহিঁদুদের মদ্যেও এমন আবস্তাপন্ন মানুষ বেশি নাই। নিজেদের গাঁয়ের বাড়িতে সে থাকে না। ব্যাবসার লেগে শহরে একটো বেরাট রাজবাড়ির মতুন বাড়ি বানিয়েছিল। সিদিন সে বসে ছিল বাইরের ঘরে। একাই ছিল। এই সোমায় পাঁচ-সাতজনার একটি দল সিং-দরজা পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকল। তাদের হাতে টাঙিখাঁড়ারামদাএই সব। অ্যাইঅ্যাইকেকেকি চাইবাড়ির চাকরবাকররা এইসব বলতে বলতেই তারা বাইরের ঘরের পাকা বারেন্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। শোনলমইসুফ মিয়ে চোখ তুলে তাকিয়েই দলটোকে দেখতে পেয়েছিল। সাবধান হবার কুনো সোমায় পায় নাই। সে উঠে দাঁড়িয়ে তোমরা কারাকি চাইশুদু এই কথাটি বলতে পেরেছিলতখুনি তার ঘাড়ে পড়ল পেথম খাঁড়ার কোপ

তাপর জান-পরান দিয়ে ইসুফ মিয়ে এক ঘর থেকে আর এক ঘরে ছুটে পালাইছেগায়ে মাথায় পড়ছে দুদ্দাড় করে লাঠির বাড়ি। ঝুঁঝিয়ে রক্ত ঝরছে সব্বাঙ্গ দিয়ে আর গোটা দলটো আসছে তার পেছু পেছু। ই ঘর উ ঘরকতো ঘর ই বাড়ির তার হিশেব নাই। ইসুফ মিয়ে একবার পালঙ্কের আড়ালে লুকুইছেএকবার আলমারির পেছনে দাঁড়াইছেনাইরক্ষা নাইটাঙ্গি খাড়া লাঠি সব এক সাথে চলল। শ্যাষে রান্নাঘরে ঢুকে আর কুনোদিকে সে যেতে পারলে নাহুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল। দেখতে দেখতে খাঁড়া টাঙি রামদায়ের কোপে ইসুফ মিয়ের শরীল সাত টুকরো হয়ে চারিদিকে ছিটিয়ে পড়ল

আমি নিজে তো যাই নাইনিজের চোখে দেখিও নাইকিন্তুক এই বেবরণ শুনেই আমি যেন সব ঘটনা চোখের ছামনে দেখতে প্যালম। তারপর থেকে খালি ওয়াক দিতে লাগল প্যান্টের ভেতর। কিছু খেতে গেলেই বমি আসছে। কিন্তুক কিছুতেই বমি হচে না। রেতে ঘুমুইতে যেয়ে চোখ বন্ধ করলেই যেন দেখতে পেচি ইসুফ মিয়েকে একদল লোক একসাথে কোপাইছে

সত্য আর ইসুফ মিয়ের মিত্যুর বেত্তান্ত শোনবার পর ভেবেছেলম আর হয়তো এমন খবর কুনোদিন শুনতে হবে না। তাই কি কখনো হয়আমি শুনছি নাজানছি না বলে কি দাঙ্গা বন্ধ হবেশুনতে চাই নাই তবু কদিন বাদেই শুনতে প্যাম পাশের গাঁয়ের মোসলমানদের একটি ছেলে জেলার বড় শহরে স্কুলে পড়ত। আমার খোঁকার বয়েসি। মনে হচে যেন দেখেছি ছেলেটিকেখোঁকার সাথে একবার দুবার এয়েছে ই বাড়িতে। সে মোকাদিম বাড়ির ছেলে না হোক আবস্তাপন্ন গেরস্থ ঘরের ছেলে বটে। শহরে তাদের নিজেদের ছোট বাড়িতে সেই সোমায়ে সে একাই ছিলআর কেউ ছিল না বাড়িতে। একদিন দোপর বেলায় আজরাইল এল তার জান কবচ করতে। কোথাও পালাইতে পারলে না। ছুটে যেয়ে বাড়ির খাটা পাইখানায় লুকিয়েছিল। সেইখানেই খাঁড়া বগী ছোরা ছুরি কিরিচ নিয়ে একদল হিঁদু যেয়ে তাকে কেটে কুচি কুচি করলে। আহাজড়াপুটুলি পাকিয়ে পায়খানা-ভরা পাতনাতেই সে মুখ গুজে মরে পড়ে থাকল

এই দুটি ভায়ানক খবরের পরে আমার দ্যাওর আর গাঁয়ের সব মোসলমানরা বলতে লাগলমোসলমান সব মেরে শ্যাষ করবে হিঁদুরাদ্যাশে একটি মোসলমানকে আর তারা বাঁচিয়ে রাখবে না। বিশেষ করে দ্যাওর-রা এক-একদিন এক-একটি গুজব নিয়ে আসতে লাগল। কুনোদিন এসে বলছেসাত গাঁয়ের হিঁদু এক হয়েছেমা কালীর পুজো দিয়ে কপালে সিঁদুর লেপে খাড়া হাতে করে তারা সব সাঁঝরেতে ই গায়ে এসে হামলা করবে মোসলমানদের ওপর। কুনোদিন বলছেঅত সোজা হবে নামোসলমানকে যারা চেনে নাইতারা চেনে নাই। পাশের মোসলমান গাঁয়ের সব মোসলমান আজ সেজে আসছে। আগে এই গাঁয়ের হিঁদুকটোকে সাফ করবেতবে অন্য কথা

এইবার আমি কি করবহিঁদু আর মোসলমানকে আলেদা না করে কি করবকিন্তুক য্যাতত আলেদা করতে যেচি ত্যাতত যেন পাঁকে ডুবে যেচি! খালি মনে হচে দুজনা মোসলমানের এমন মরণের কথা শুনেই কি ভাবছি হিঁদু জাতটোই এমনিতাইলে কি দুজনা হিঁদুর মোসলমানের হাতে এমুন মরণের কথা শুনলে ভাবতে হবে মোসলমান জাতও ঐ রকমতাইলে সত্য-র যি মাকে দেখে এয়েছি সে আর ইসুফ মিয়ের মা যদি অ্যাকনো বেঁচে থাকেসেই থুথুড়ি বুড়ি মা-টো কি আলেদা?

খবর সোমানে আসত লাগল। হাজার হাজার মোসলমান যেমন মরছে হাজার হাজার হিঁদুও লিকিন তেমনি মরছে। কারা কমকারা বেশি ভেবে লাভ নাই। বাড়ির কাজকর্ম ছেড়ে বাইরের ঘরের জানেলা দিয়ে পাড়ার রাস্তার দিকে চেয়ে থাকি। ছেলেমেয়েরা কাছে আসে নাকোথা কোথা ঘুরে বেড়ায়। মেয়েটি থাকে ননদের কাছে। একা বসে আকাশ-পাতাল ভাবছি। সব ঠিক আছেপাখি ডাকছেবাতাস বইছে,আসমান ভেঙে মানুষের মাথার ওপর পড়ছে নারাস্তা পথ। ঘাট যেখানকার যেমন তেমনি আছে এর মধ্যে খালি মানুষ মানুষকে মারছে! কলকেতার রাস্তায় ডেরেন দিয়ে কলকল করে মানুষের রক্ত বয়ে যেছে। মোসলমানের রক্তহিঁদুর রক্ত। আলেদা কিছুই লয়একই রক্ত। ঐ ডেরেনে হিঁদু-মোসলমান এক। ” কত্তাকে বলতে সে বললেপড়তে কি ভুলে গিয়েছপড়ে দ্যাখো নাকাগজ আসা তো এখনো বন্ধ হয় নাই! পড়লেই বুঝতে পারবেসব কিছু খালি তোমার এই পাড়াগাঁয়েই হচ্ছে না। সারা দেশে আগুন জ্বলছে। কলকাতায় হিঁদু বেশিমুসলমান কমকাজেই সেখানে মুসলমান মারা পড়েছে বেশি। মোটকথা এখন আর স্বাধীনতা টাধিনতার কথা নাইস্বাধীনতা দাও আর না দাওদেশ ভাগ করে দাও

তাপর একদিন কত্তা বললেগান্ধি নোয়াখালি গিয়েছে। সেখানে মুসলমান বেশিখুব হিঁদু মারা যাচ্ছে। বিহারে মুসলমান মরছে বেশি। গান্ধি কলকাতাকে একরকম করে থামিয়েছেনোয়াখালি বিহারকেও হয়তো এখন থামাতে পারবেকিন্তুক ইংরেজরা যা চেয়েছিল তাই হলো। হিঁদু-মুসলমান দুই জাতকে চিরদিনের মতো একে-অপরের শত্রু করে দিলে। পাকিস্তানের নাম করে জিন্না ইংরেজদের কাজটিকেই করে দিলে আর ক্ষমতার লোভে পড়ে নেহেরু-রাও তাই করলে। প্যাটেলশ্যামা মুখুজ্জে মুসলমানদের আলাদা করে দিতে চেয়েছিলতাই হলো। গান্ধি এখন একঘরে। দরজায় দরজায় তাকে কেঁদে মরতে হবে

কত্তার সব কথা ভালো বুঝতে পারলম না। শুধু এই বোঝলমবেপদ মুটেই শ্যাষ হয় নাইমাহা বেপদ নেমে আসছেসব লন্ডভন্ড হবে। এই দাঙ্গাই হবে অছিলা। মানুষ যি আবার সব ভুলে যাবেআবার হিঁদু-মোসলমান একসাথে বসবাস করবেসুখে-দুখে দিন। কাটাবেএর কাজ উ করবেওর কাজ ই করবেসবই হবে কিন্তুক তার এ সব ওলটপালট হয়ে যাবে

দাঙ্গা আস্তে আস্তে কমে আসতে লাগল। ঠিক যেন যুদ্ধ আকাল মাহামারীর মতুন। এই আমাদের জেবনেই ওগুনো সব এলআবার চলেও গেল। উসব তত মানুষের সোংসারে সব সোমায়ে ঘটে নাআসে আবার চলে যায়। ই দাঙ্গাও বোধায় তাই। দাঙ্গা তো জেবনের লিয়ম নয়শান্তিই জেবনের লিয়ম। মনে হলোসারা দ্যাশের মানুষের ভারি জ্বর হয়েছিলজ্বরে গা পুড়ে যেছিলচোখ হয়েছিল করমচার মতুন লালপিয়াসে বুকের ছাতি ফেটে যেছিল আর মাথা গোলমাল হয়ে শুদু ভুল বকছিল। সেই জ্বর এইবার ছাড়ছে

এইরকম সোমায়েকে আর খবর দেবেকত্তাই একদিন খবর দিলেযাওদেশ তোমার স্বাধীন হয়েছে

তাইআমাকে এট্টু বুঝিয়ে বললআমি ব্যাগোতা করে ফেলল

হ্যাঁইন্ডিয়া স্বাধীন হলোদুশো বছর বাদে ব্রিটিশ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু যাবার সময় দেশটাকে কেটে দুভাগ করে দিয়ে গেল। দুভাগ কেনতিন ভাগ! যেখানে যেখানে হিঁদু বেশি সেইসব জায়গা নিয়ে হিঁদুস্থানআর যেখানে যেখানে মোসলমান বেশি সেসব জায়গা নিয়ে পাকিস্তান। বাঙালি মুসলমানদের জন্যে পুব-পাকিস্তান। আর একটি ভাগ

সব হিঁদু সব মোসলমান এই দুই দ্যাশে চলে যাবে?

তাই কি হয় নাকিযেখানে হিঁদু বেশি সেখানে কিছু কিছু মুসলমান থাকবে আবার যেখানে মুসলমান বেশিসেখানে হিঁদুও কিছু থাকবে

আলেদা করবে বলে এমন করলে ক্যানে?

দাঁড়াও দাঁড়াওআরও একরকম ভাগ হয়েছে বললাম নাআমাদের এই বাংলা ভাগ হয়েছে আর পাঞ্জাব বলে আর একটি দেশও ভাগ হয়েছে। বাংলায় মুসলমান বেশিহিঁদু কম। তুমি বোধহয় জানো নাবাংলা-বলা লোক ধরলে মুসলমানই বেশি। সেই হিশেবে গোটা বাংলাকেই পাকিস্তানে ঢোকাতে হয়। হিঁদু নেতারা কি তাই হতে দেবেবাংলাও এখন দুভাগ হয়েছেযেদিকে হিঁদু বেশি সেই বাংলা হিঁদুস্থানে আর যেদিকে মুসলমান বেশি সেই বাংলা পাকিস্তানে ঢুকেছে

বাঃই আবার কিরকম কথাইখানকার সব মোসলমান পাকিস্তানে চলে যাবেআর পাকিস্তানের সব হিঁদু হিঁদুস্থানে চলে আসবে?

নাআসবে না। গোঁজামিলই চলতে থাকবে। তুমি যদি মুসলমানের হিশেব করোতাহলে তোমাকে এই দেশ ছেড়ে দিতে হবেএ দেশ আর তোমার নয়তোমাকে যেতে পুব-পাকিস্তান। পুব-পাকিস্তানের হিঁদুদেরও চলে আসতে হবে এখানে। হয়তো তোমার এই বাড়িতে আসবে কোনো হিঁদু গেরস্থ

কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল

নাক তো চাও নাইকাজেই নাক পাও নাই তবে নরুন একটা পেয়েছঐ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকো

এই বলে কত্তা বেরিয়ে গেল

 

আর কেউ নাইএইবার আমি একা

বাড়িতে আমি একা রয়েছি। আর কেউ নাইআর কেউ থাকবে না। আজ দোপরের খানিক বাদে চেরকালের লেগে কাটান-ছিটেন করে। সব চলে গেল! ত্যাখন বাড়িভরা মানুষ ছিল। মনে হয় কেউ কেউ মজা দেখতে ই বাড়িতে ঢুকেছিলঅ্যানেকের দাড়ি-গোঁফের তলায় এট্টু এট্টু হাসি আমি দেখতে পেয়েছি

কদিন ধরে জ্বর আসছে। ঘুষঘুষে জ্বর আর খুসখুসে কাশি। দোপরের পর থেকে মাথা টিপটিপ করে,সাঁঝবেলার মদ্যেই জ্বরটো চলে আসে। গা টিসটিস করেজাড়-জাড় লাগেরেতে অ্যানেকদিন খাই না। কাউকে কিছুই বলি নাই। আজ জ্বর এয়েছিল সকাল থেকে। মেয়ে এসে বলেছিলমাতোমার মুখটা এত শুকনো লাগছে কেনবললমকই না তো। শুনে মেয়ে কাছে এল। ছেলেমেয়েরা কুনোদিন আমার গা-লাগোটা লয়। ওরা কেউ-ই তো শিশুকালে আমার হাতে খায় নাইঘুমোয় নাই। সেই লেগে ওরাও তেমন গায়ে-লাগা লয়আমারও ছেলেমেয়েদের গায়ে মাথায় হাত দিতে কেমন লাগে। আজই দেখছিমেয়ে একদম কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেমাএখনো একবার ভেবে দ্যাখো। কাগজ-পত্র সব তৈরি হয়ে আছেতুমি হ্যাঁ বলো। মাতুমি যা করছতা কি কেউ কোনোদিন করেনা করতে পারে। কে কবে শুনেছে স্বামী ছেলেমেয়ে সবাই দেশান্তরী হচ্ছে আর শুধু মা তাদের সাথে যাচ্ছে নাসব ছেড়ে একা পড়ে থাকছেআমাকে বলতে পারো কেন এমন করছ?

মেয়ে জড়িয়ে আছেতবু ভেতরে ভেতরে আমি শক্ত হয়ে গ্যালম। একে তো ত্যাকন এট্টু জ্বর এয়েছেআমি কথা বলতে পারছি নাচোয়াল আটকে আটকে যেছে। আমি বললমই নিয়ে আর কথা বোলো নামা!

মাতোমার গায়ে কি জ্বর?

না নাউ কিছু লয়

আজ দশ বছর ধরে এই লতুন বাড়িতে আছি। সোংসার পেথক। হবার পর থেকেই ইখানে। এক সোংসারে থাকার সোমায় কত্তা যি একটো ভিটে কিনেছিল মাটির একটি ঘরসুন্ধুসেই ঘরটি ভেঙে এই ভিটের ওপর একটি দোতলা কোঠাবাড়ি করা হয়েছিল। ভাইদের সোংসার আলো হয়ে যাবার কিছুদিন পরে লতুন বাড়ি তৈরি হয়ে গেলে আমরা এখানে চলে এয়েছেলম। ত্যাকন থেকেই ফাঁকা বাড়িতে থাকার ওব্যেশ হয়ে গেল। ছত্রিশ জনার হৈ চৈচাঁ ঊ্যা-তে রাতদিন সরগরম সোংসার ছেড়ে এই বাড়িতে এসে পেথম পেথম আমার দম বন্ধ হয়ে আসত। করার কিছু ছিল না। সসাংসার অ্যাকন ছোটবলতে গেলে কত্ত আর আমি আর ছোট দুটি ছেলে। একটি গাঁয়ের স্কুলে পড়ে আর একটি খুব ছোট। বড় খোঁকা বাড়িতেই ত্যাকন থাকত। পাকিস্তান হবার পরে সে কলেজের পড়া ছেড়ে দিয়ে একটি চাকরি খুঁজতে লাগল। তাকে দেখতেই প্যাতম নান-মাস ছ-মাসে একবার বাড়িতে আসত। শোনলমএখানে চাকরির বাজার খারাপসে চাকরি খুঁজতে পাকিস্তানে যাবে। তাপর সত্যি সত্যিই শোনলম সে পাকিস্তানে চলে গেয়েছে আর ঢাকায় একটি চাকরিও পেয়েছে। খুশির খবরই বটেআমার পেথম পেথম তেমন কিছু মনে হয় নাই। কলকাতায় যাওয়া আর ঢাকায় যাওয়া ত্যাকন একইরকম লাগত। খোঁকা ঘন ঘন বাড়ি না এলেও বছরে একবার তো আসত। শোনলমশুদু দূর এটু। বেশিকলকাতা আর ঢাকায় তফাত কিছু নাইযাতায়াতে সোমায় এট্টু বেশি লাগে এই যা

এই যেদি হবেপাকিস্তান হওয়া-না-হওয়াতে যেদি কুনো তফাত-ই না হবে তাইলে এমন রক্তগঙ্গা ক্যানে করলে সবাইএত মানুষ মরলএত মায়ের কোল খালি হলোএত সোংসার জ্বলে-পুড়ে ছারেখারে গেলইসব কি এমনি এমনি! আর অ্যাকন যি হিঁদু-মোসলমানে চোখে চোখে তাকাইতে পারছে নাএকই গাঁয়ে বাস করছেমাঠে-ঘাটে সব জায়গায় একসাথে হচেতবু সব সোমায়ে মনে মনে সন্দ হচে এই বুঝিন গলা কাটবেএই বুঝিন বাড়িতে আগুন দেবে। ছি ছিচেরকালের লেগে এমন ক্ষেতি করে সারা দ্যাশের মানুষেরআর কি করে তারা একে আরেকের পড়শি হয়ে বাস করবে?

এইসব কথা নিয়ে আমি মনে মনে তোলপাড় করতম বটেকিন্তুক বাইরে থেকে কিছুই বোঝবার বাগ ছিল না। সবই আগের মতুন। নাপিতবউ আগের মতুনই বাড়িতে আসছেহাড়িবউকে আজকাল আর আসতে হচে না বটেবাড়িতে নতুন মানুষ অনেকদিন থেকেই আর নাই। আসবে কিসের লেগেতবু শুদু কথা বলার লেগেই কখনোসখনো আসে। মজাক করে কথা বলেছেলেমেয়েরা থাকলে তারা দাইমা বলে ডাকে। সবই আগের মতুন। একদিন ল-দ্যাওরকে ডেকে বললমখুব তো লড়কে লেঙ্গে করে পাকিস্তান করলে। সি দ্যাশটি কিরকমকোথা সি দ্যাশ তা কি জানোতা এত কষ্ট করেমারামারি করে যি দ্যাশটি করলেঅ্যাকন সি দ্যাশে যাবে না?

খেপেছ?

ক্যানেখেপেছ ক্যানেএত লাফাইছিলেঅ্যাকন কি হলো?

আরে কি মুশকিলপাকিস্তান যাব কেননিজের দেশ ছেড়ে?

তাইলে কার লেগে দ্যাশটি করতে গেয়েছিলেকার লেগে অত দরদ ছিল গো তোমাদের?

ঠাট্টা করতে করতেই ইসব কথা বলছেলম বটেকিন্তুক বলতে বলতেই কেমন চড় চড় করে রাগ চড়তে লাগল আমার। দ্যাওর বোধায় বুঝতে পারলে সি কথাটিসে আর রা-কথা না করে সিখান থেকে চলে গেল। সে চলে গেলেও আমার বুকের ভেতরটা রি রি করতে লাগল। আসলে বড় খোঁকার ঢাকার চাকরি আমার ভালো লাগে নাই। কিন্তুক কাকেই বা কি বলবসে তার বাপকেও চাকরির কথা কিছু শুদোয় নাই। চাকরি পেয়ে পেথম বার য্যাকন বাড়ি এলআমিই তাকে জিগগাসা করলমসবাই ইখানেতুমি পাকিস্তানে চাকরি নিলে ক্যানে?

চাকরি একটা দরকার ছিল মাপেলামই যখননোব না কেন?

তাই বলে ভিন্ দ্যাশে চাকরি করবে?

ভিন্ দেশ আবার কি?

ভিন্ দ্যাশ লয়ভিন্ দ্যাশই যেদি না হবেতাইলে উ দ্যাশের লেগে অত লড়াই করতে হবে ক্যানেসহজে তো হয় নাই

ও তুমি কিছু বোঝে না। সে অনেক ব্যাপার

তা ঠিকআমি সত্যিই বাবা কিছু বুঝি না! কিন্তুক ইটুকু তো দেখতেই প্যালমকতো মায়ের বুক খালি হলোকতো সোংসারে আগুন লাগল। অ্যাকন সব থেমে গেয়েছেঅ্যাকন বলছ উ কিছু লয়। তাইলে কি বাবা সারা দ্যাশের মানুষকে নিয়ে তামাশা করেছে সবাই?

এমন হয় মানতুন একটা দেশ করতে গেলে অমন হয়

তাইলে ইসব কিছুই লয় বলছ ক্যানেআমরা সবাই য্যাখন ই দ্যাশেই আছিতুমি সেই ভিন্ দ্যাশে চাকরি নিলে ক্যানে?

তুমি কিছু ভেবো না তো মা। নামেই দুটো দেশকাজে এখনো একই আছে। তুমি ধরে নাও আমি এট্টু দূরে চাকরি করছি। কলকাতা থেকে বাড়ি আসতে যতো সময় লাগততার চেয়ে না হয় একটু বেশিই লাগবে

খোঁকার সাথে এইসব কথা হয়েছিল সেই কতোদিন আগে! সাত-আট বছর আগে। খোঁকা ত্যাকন কিছুই বোঝে নাইআমিও কিছু বুঝি নাই। মনে হয়েছিলহোকগো পাকিস্তানএই তো বেশ চলছে দুই দ্যাশ। তেমন কিছু তো এই গাঁয়ে-ঘরে বুঝতে পারছি না। হলে হোকগো পাকিস্তান। কিন্তু বেশিদিন গেল নাদু-তিন বছরের ভেতরেই শুনতে প্যালমআবার ভায়ানক মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়েছে। বাড়ি বাড়ি লুট হচেসোনা-দানা ধনসম্পত্তি কেড়ে নিয়ে মানুষকে ভিটে-মাটি ছাড়া করছে। শহরেগঞ্জেটেরেনেইস্টিমারে মানুষ মেরে মেরে গাদা করছে আর হাজারে হাজারে মানুষ ই দ্যাশ থেকে উ দ্যাশে যেছেউ দ্যাশ থেকে ই দ্যাশে আসছে। ই দ্যাশ থেকে কজনা যেছে জানি নাউ দ্যাশ থেকে লিকিন বেসুমার মানুষ সব্বস্ব হারিয়ে ইখানে এসে হাজির হচে। কলকেতায় ইস্টিশানে ইস্টিশানে লিকিনি মানুষের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নাই। আকালের সোমায় য্যাতত লোক গেয়েছিল কলকাতায়আকন তার চেয়ে অ্যানেক বেশি মানুষ সিখানে গিজগিজ করছে। এইসব শুনে এতদিনে মালুম হতে লাগল যি দুটি আলেদা দ্যাশ হয়েছে বটে! আরও ভালো করে চালুম হলোযিদিন শোনলম খোঁকা ইবারের ঈদে বাড়ি আসতে পারছে না। বকরিদে আসতে না পারলেও এতদিন ফি ঈদে সে বাড়ি আসছিলবিয়ে হয়ে বউ নিয়ে যাবার পরেও সবাইকে নিয়ে আসছিল। ইবার আর আসতে পারবে না। পাপোট না কি চালু হয়েছেসেই বই সরকার না দিলে কেউ উ দ্যাশ থেকে ই দ্যাশে কিম্বা ই দ্যাশ থেকে উ দ্যাশে যেতে আসতে পারবে না

কপাল এমনি বটে! একমাত্তর মেয়ের বিয়ে হলো ইখানে। কিন্তুক বিয়ের কদিন বাদেই শোনা গেল,জামাই বড় চাকরি পেয়েছে পাকিস্তানে। বিয়ে য্যাকন হয়েছিলত্যাকননা ঐ পাস্‌পোট না কি বলে হয় নাই। তারাও যেছিল আসছিলইবার আর তারাও আসতে পারছে না

এইসব ঘটার পরে আর কোথা কি হয়েছে জানি নাআমার সংসার বড্ড ফাঁকা হয়ে পড়ল। খালি ছেলেদুটি। একজনার স্কুলের পড়া শ্যাষ হলো-হলোআর একজনা খালি স্কুলে ঢুকেছে। দ্যাশ আলেদা হোক আমি চাই নাই অথচ আমারই ছেলেমেয়ে বিদ্যাশে চলে গেল আর আলেদা দ্যাশের লেগে যারা লাফাইছিল তারা যেমনকার। তেমনিই রইল। বিনা কারণে শুদু হিঁদু-মোসলমানের মাঝখানে একটা ছোঁয়া পড়ে গেল। সেই ছেয়া আর কুনোদিন গেল না। কুনোদিন যাবে কিনা তা জানি না

আমার যে মেজ খোঁকা গাঁয়ের স্কুলে পড়ছিলসে একদিন স্কুলপাশ দিলে। কাগজ হাতে করে যিদিন কত্তা বাড়ি ঢুকে আমাকে দেখাইলে খোঁকা ভালো করে পাশ দিয়েছেসেইদিনই বৈকাল বেলায় শহরে ছোট দ্যাওরের কাছে তারে খবর এল আমাদের একটি লাতিন হয়েছে। একই দিনে দুটি ভালো খবর। ছেলে বড় স্কুলের পাশ দিয়েছে সি খবর ভালো বৈকিকিন্তুক আমাদের লাতিন হয়েছেআমাদের একমাত্তর মেয়ের একটি মেয়ে হয়েছেই খবরের কি তুলনা আছেসাত রাজার ধন মানিক হাতে পেলেও ই খবরের কাছে সি কিছুই লয়। সারা দুনিয়ায় ঢোল পিটিয়ে ই খবর জানাইলেও যি আশ মেটে না আর সেই খবর কিনা তারে জানতে পারলে দাওর আর সে খবর নিয়ে নিজে আসতেও পারলে নাএকটো লোক জোগাড় করে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিলে। কেউ কোথাও নাইকেউ এল না ই বাড়িনথ নেড়ে নেড়েহাসতে হাসতে দাইবউ সোনার মাকড়ি চাইলে নাগাঁয়ের লোক ভেঙে পড়ল না। বাড়ির পেথম লাতিন! হায় রে হায়বাপের সোংসারভাইয়ের সংসারকত্তার সোংসার সব ভেঙে খান খান। এখন আমি ভালো খবর নিয়ে কি করব?

সাঁঝবেলায় একটি হেরিকেন জ্বালিয়ে দখিন উসারায় বসে আছি। কত্ত-ও আছে। ছেলেদুটিই বাইরে। এখনো ফেরে নাই। মেজ খোঁকার আজ সাত খুন মাপকত্তার হিশেবে ছেলে য্যাখন স্কুলপাশ দিয়েছে ত্যাখন বড় হয়ে গেয়েছেআর তাকে বকাবকি করা যাবে না। সে আজকে পাশ করার খুশিতে গাঁয়ে ঘুরে বেড়াইছে

হঠাৎ আমি ক্যানে যি কঁদতে শুরু করলম জানি না। দুই দুটো এমন খুশির খবরে কেউ কুনোদিন কাদে?কিন্তুক বুকের তলা থেকে গুমুড়ে গুমুড়ে ক্যানে এমন কাঁদন আসতে লাগল কে বলবেআমার কেউ নাইই দুনিয়ায় কেউ নাইএত থাকলেও আমার কিছু নাই। পশ্চিম আসমানের দিকে তাকিয়ে মনে হল সি আসমানও ধু ধু করছেচাঁদ নাইতারা নাই। কাঁদন শুনে কত্তা চুপ করে বসে থাকলেএকটি কথা বললে না। আমাকে কত্তা আজকাল আর কিছু বলে না! কি জানিপুরুষমানুষ বলে সে কি আমার মতুন কেঁদে হালকা হতে পারে না?

কদিন বাদে পাকিস্তান থেকে মেয়ের চিঠিতে তার খুঁকি হবার খবরএল। সি চিঠিও কাঁদনের চিঠিমেয়ের পেথম সন্তান তো বাপের বাড়িতেই খালাস হয়তা তার ভাগ্যে নাইতার মেয়ে হয়েছে হাসপাতালে। মেয়ে কালো হয়েছেকালোর ছটায় ভোবন ভাসছে। অনেক কথা লিখেছেতার পরে লিখেছে একটি সাংঘাতিক কথা। লিখেছেমেজ খোঁকা আর তো গাঁয়ে থেকে পড়তে পারবে নাতাকে ছাড়তেই হবেসে নাইলে খুঁকির কাছেই যেয়ে পড়ুক। জামাই তো কলেজের মাস্টারখুব সুবিধে হবেবুনকেও তাইলে আর একা থাকতে হয় নালতুন খুঁকিও তাইলে মামু পায়

নাআটকাইতে পারলম না! দুই দ্যাশ আলেদা হবার আমি কিছুই বুঝি নাইকিছুই বুঝি নাই! ঘর বাড়ি সোমাজ সোংসার সব ভাঙতে ভাঙতে সাত টুকরো হবেঘটি-বাটি ভাঙবেবাসো প্যাটরা ভাঙবে। অ্যাকটো গোটা মানুষও আর গোটা থাকবে নাআমিও থাকব নাকত্তাও থাকবে না। কত্তা এইবার দুটো হবে

ঠিক তাই হলো। কত্তা আমাকে বেশি কথা বললে না। মেজ খোঁকাও বেশি কিছু বললে না। সে অ্যাকন অ্যাকটো গোটা মানুষ। এই তার স্বাস্থ্যএই জোয়ান। যেন অন্য মানুষ। আমারই কোলে এতটুকুন ছিলআমারই বুকের দুধ খেয়ে বড় হয়েছেকিছুতেই বিশ্বেস হয় না। অচেনা লাগছেকথা বলতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। বুঝতে পারছিএখন আর আমার কাছে কিছু থাকার সোমায় লয়আমার কাছ থেকে সব চলে যাবারই সোমায়

কথা আর কত বলবদশদিনের মদ্যে সব বেবস্থা করে মেজ খোঁকা পাকিস্তানে তার বুনের কাছে চলে গেল। পুরনো দিনের সব কথা য্যাকন বলতেই বসেছিত্যাকন আর কপাল চাপড়ে কি হবেএইখানেই বলে রাখি সব শ্যাষের আঘাতটো দিলে বড় খোঁকা। জেনে লয়ইচ্ছে করে লয়দিলে দুনিয়ার লিয়মে। দিন চেরকাল কারুর হাতে বাঁধা থাকে নাজেবনের কিছুদিনের লেগে কিছুদিন তাবে থাকেতাপর হাতছাড়া হয়ে যায়। আমার দিনও এইবার হাতছাড়া হতে লেগেছেদিন আর অ্যাকন আমার লয়। বড় খোঁকা জানাইলেসোংসারে সে কুনোদিন কিছু করতে পারে নাইকুনো কাজেই লাগতে পারে নাইএখন আর তার কিছু করারও নাইতাকে পাঁচে-পেরকারে বাস করতে হচে আর এক দ্যাশে। কুনোদিন আর ফিরতে পারবে না। আর কিছু না পারুকঅ্যাকন সে নিজের ছোট ভাইটিকে মানুষ করার দায়িত্ব নিতে চায়। তাকে যেন তার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়সে-ই তার ল্যাখাপড়ার দায় নেবে

পানি কুনোদিন ওপরদিকে গড়ায় না। দাঙ্গাহাঙ্গামায় কই ই দ্যাশের অ্যাকটো মোসলমানকে পাকিস্তানে যেতে দেখলম না। গেয়েছে কিনা আমি কি করে জানবই এলেকায় তো দেখলম না। কিন্তুক বড়লোক আবস্তাপন্ন মোসলমানদের লেগে ভালো ঢল নেমেছে পাকিস্তানের দিকেঅ্যানেক মোসলমানই সিদিকে গড়িয়ে যেচে। আমার ছোট খোঁকাটিও একদিন গড়গড়িয়ে চলে গেল। ভালো হলো কি মন্দ হলোসিকথা আমি বলতে পারব নাশুদু জানলম আমার সব খালি হলোসাথে আর কাউকে পাব না। এই খালি সসাংসারে একা বসে থাকব। কথাটো কি ভুল হলো আমারকত্তা তো আছে এখনো! তবে খুব ভুল বোধায় লয়। কত্তা কি আছে আমারভেতরে ভেতরে তা মনে হয় না!

পুরনো বাড়ি আমাদের এই নতুন বাড়ি থেকে এট্টু দূরে। সি বাড়ি অ্যাকন আর একটি বাড়ি লয়ভেঙে ভেঙে অ্যানেক বাড়ি হয়েছে। সবার খুব খোঁজ খবর নিতে পারি নাতেমন কেউ আসে নাই বাড়িতেআমিও যেতে পারি না। আছে সবাই আপন আপন ঘর-সংসার নিয়ে। শুদু বেধবা ননদটি থাকে একদম একা। ভাগ্নেদুটির কেউ অ্যাকন আর থাকে না তার কাছে। বড়টি চাকরি করে শহরেছোটটি স্কুলপাশ দেবার পরে নিজেদের বাড়িতে চলে গেয়েছে। ননদ তার বরাদ্দ ঘরটিতে একা থাকে। চল্লিশজনার সোংসারে যে ছিল মাহারানীবারো-চোদ্দটি ছেলেমেয়ে মায়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসা পেয়েছে যার কাছেআকন আর কেউ তার কাছে যায় না। সারাদিনে একটি শিশু তার কাছে খাবার চায় নাতাকে জড়িয়ে ধরে তার শাদা কাপড় ময়লা করে দেয় নাকুনো ভাই তাকে ডেকে একটি কথা জিগাসা করে না। খুব খারাপ একটি রোগে ধরেছিল তাকে। ঘন ঘন পেশাব হতোখুব খেতে মন হতোদিন দিন রোগা হয়ে যেছিল

আমি বোধায় সাত-আটদিন খবর নিতে পারি নাই। সিদিন সকালবেলায় শোনলমল-বউ দেখেছিল ননদের ঘরের দরজা ঠেসানো রয়েছে যেমন পেত্যেকদিন থাকে। বউদের মদ্যে ল-বউ এট্টু খোঁজ-খবর করতদিনে দু-একবার যেত ননদের ঘরে। ইদিকে সকাল গড়িয়ে দোপর হয়ে যেছে। গিন্নি ঘরের বার হচে না। ত্যাকন উকি মেরে দেখেকাত হয়ে গিন্নি পড়ে আছেমরে একেবারে কাঠ। বোধায় মরার আগে পানি খেতে গেয়েছিলকাঁসার গেলাসের পানি সারা ঘরে গড়িয়ে পড়েছেখালি গেলাসটো বালিশের কাছে পড়ে আছে। কখন জান। গেয়েছে কে জানেআধশোয়া মড়া ঐ আবস্তাতেই শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেয়েছেমুখের ওপর দিয়ে কালো পিঁপড়ে চলে বেড়াইছে। ল-বউ বললে ঠিক শোবার সোমায়ে সে গিন্নির ডাক শুনতে পেয়েছিলতার নাম ধরেই ডাকছিলতা উ রকম করে সব সোমায়ই ডাকতসে আর গা করে নাইহায় হায় গোমরার আগে মুখে এট্টু পানি পয্যন্ত পড়ল নাএই কথা বলে ল-বউ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল

আর কতো বলব! কথার তো শ্যাষ নাইতার চেয়ে বরঞ্চ অ্যাকন যি কথাটি বলতে বসেছি সেই কথা বলি। এই কথাটির পরে আমার আর কুনো কথা নাই। এই শ্যাষ কথাটি বলার লেগেই তো এত কথা বললম। সব মানুষেরই একটি করে শ্যাষ কথা থাকেসেই কথাটির লেগেই তো সারাজেন

ছেলেমেয়েদের পাকিস্তান যাওয়া ত্যাকন সাত-আট বছর হয়ে গেয়েছে। মেজ খোঁকার ল্যাখাপড়া পেরায় শ্যাষসে লিকিন কুনো অ্যাকটো চাকরিতে ঢুকবে ঢুকবে করছে। ছোট খোঁকাও স্কুলে ভালোই ল্যাখাপড়া করছে। আমি ত্যাততদিনে বুঝে গেয়েছি ওরা কেউ-ই আর ই দ্যাশে ফিরবে না। এই সোমায় একদিন সাঁঝবেলায় কত্তা আমাকে বেশ তোয়াজ করে তার পাশে বসাইলে

বড় খোঁকার একটি চিঠি এসেছেকত্তা বললে। চিঠি তো মাঝে মাঝেই আসেদরকার মনে করলে কত্তা পড়তে দেয়নাহলে দেয় নাশুধু বলে চিঠি এয়েছেসবাই ভালো আছে। আজ দেখছিকত্তার। হাতেই চিঠিটো ধরা। বললমতা সবাই ভালো আছে?

আছে। বড় খোঁকা একটি কথা লিখেছে

কি কথাখারাপ কুনো-কথা?

নানাতা নয়

কুনো কিছু নিয়েই তো কত্তা কুনোদিন এমন করে না। আজ এমন লুকোচুরি ক্যানে করছেআবার আমি বললমতবে?

বড় খোঁকা লিখেছেসবাই এখন পুব-পাকিস্তানে। হিঁদুদের দেশমুসলমানদের দেশ এসব কথা এখন আর নাই। হিঁদুস্থান পাকিস্তান সবাই মেনে নিয়েছে। কথা তা নয়ছেলেমেয়ে নাতিনাতিন সবাই যখন আর এক দেশে থিতু হয়েই গিয়েছেতখন আমরা বাপ-মা এখানে একা পড়ে আছি কেন। জমি-সম্পত্তি ঘর-বাড়ির ব্যবস্থা করে আমরাও তাহলে ওদের কাছে চলে যাই

মাথায় আমার বাজ পড়ল। এমন কথা কুনোদিন শুনব বলে মনে করি নাই। ই কথার মানে কি একবার ভাবতে গ্যালম। পিথিমি ঘুরে উঠল আমার চারপাশেতাড়াতাড়ি মেঝে আঁকড়ে ধরলম। কোথা যাবআমি কোথা যাবমরে গেলে কোথা যাব তা জানিকবরে যাবআমাদের এই নতুন বাড়ি থেকে দিঘির উঁচু পাড়ের কবরস্থান দেখতে পাওয়া যায়মরে গেলে ঐখানে যাব কিন্তুক ই দ্যাশ ছেড়ে কোথা যা আমি কিছুতেই ভাবতে পারলম না। আমার খালি মনে হতে লাগলক্যানে যাব কেউ আমাকে বুঝিয়ে দিক। বুঝিয়ে দিলেই আমি যাবযেখানে যেতে বলবে সেখানে যাব। ওটো মোসলমানদের দ্যাশ আর এটো হিঁদুদের দ্যাশ ই কথা বলে আর কেউ আমার কাছে পার পাবে না। উ যি মিছে কথাউ যি শয়তানদের কাজ তা অ্যাকন মনে মনে সবাই জানছে। যাদের জান গেয়েছে তারা আল্লার কাছে ফরিয়াদ করে জানতে চাইবেযারা ভিটেমাটি দ্যাশছাড়া হয়েছে তারাও আল্লার কাছে এই ফরিয়াদ করার লেগে রপিক্ষে করছে। আমি এই কথাটিই কত্তাকে বললমবড় খোঁকা যা ভালো বুঝেছে বলেছেতুমি চেরকাল আমাকে সবকথা বুঝিয়ে বলেছতুমি অ্যাকন আমাকে বুঝিয়ে দাওক্যানে যাবে?

বোঝার কি আছেছেলেমেয়ে নাতিপুতি সব যেখানে আছেসুখে-স্বচ্ছন্দে আছেঘরবাড়ি করেছেসেখানে তাদের কাছে আমরা যাব না?

নাযাব না। ছেলেমেয়েরা করেছে তাদের নিজেদের জেবনের লেগেতাদের ছেলেমেয়েদের লেগে। আমরা সিখানে যেয়ে কিছুতেই জোড় মিলব না। সি ফাটল তুমি ভরাইতে পারবে?

আহাআমাদের জীবন তো শেষ। আর আমাদের করার কিছুই নাই

শ্যাষ তো ভালো কথা। শ্যাষ ইখানেই হবে। শ্যাষ হবার লেগে বিদ্যাশে যেতে হবে ক্যানে?

এমন করে মুখে মুখে তক্ক আমি কুনোদিন কত্তার সাথে করি নাই। কিন্তু আল্লা জানে আমি তক্ক করি নাইকত্তার মুখে মুখ করি নাই। আমার বিশ্ব-বোম্ভান্ডাে ভেঙে যেচে যি। আমি যি শতেক চেষ্টাতেও কত্তার কথা মেনে নিতে পারছি নাজানের ভেতর থেকে যি কথাগুলিন আসতে লাগলআমি সেই কথাগুলিন বলতে লাগলাম আর এককথা দুকথা হতে হতে আসল কত্তা বেরিয়ে এল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে বললেচিরকাল আমি যা করব বলে ঠিক করিতাই করি। কারুর কথা আমি শুনব নাআমি সব বেচেকিনে পাকিস্তান চলে যাব

সি তুমি যেতে পারো তবে চেরকাল তুমি যা ঠিক কর তাই হয় না। তুমি অ্যানেক কিছু ঠিক কর নাই,কিন্তুক তাই হয়েছে। তুমি পাকিস্তান হওয়াও ঠিক কর নাইতোমার সোংসার ভাঙাও ঠিক কর নাই। কিন্তুক উসবই হয়েছে। পিথিমিতে যত জোর তোমার নিজের পরিবারের ওপর। আর একটি মানুষও তুমি পাও নাই জোর খাটাবার লেগে। তা ইবার আমি বলছিবড় খোঁকা য্যাতেই বলুকআর তুমি য্যাতো জোরই খাটাওআমি যাব না

রাগে জ্বলে ওঠার আগে কত্তা আর একবার নরম হলোতোমার একটিমাত্র মেয়েসেই মেয়েটির মুখ মনে করোতার কোলে যে খুকিটি এসেছেতোমার বড় খোঁকার যে ছেলে হয়েছেতোমার নিজের নাতিপুতিতাদের মুখ মনে করোছেলেগুলির মুখ ভাবো

এই পৃথিবীতে আর কি আছে তোমার?

চেরকাল তাদেরই মুখ মনে করেছিচেরকাল তাদেরই মুখ মনে করব। মন করলে এইবার তারা একবার আমার মুখের দিকে দেখুক। তাদের মুখ মনে করতে আমাকে তাদের কাছে যেতে হবে ক্যানেআমার বড় খোঁকার মুখ আজ কতকাল দেখি নাইআর দেখব-ও কুনোদিন। তা সি মুখটি কি কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পেরেছে?

কথা শুনে আর একবার কত্তা নরমসুরে বললেনিজের নাতি-নাতনির কাছে যাবে না এমন আজগুবি কথা কেন বলছ তুমিসেখানে গেলে আবার তোমার সব হবে। নিশ্চিন্তে বাকি জীবনটা কেটে যাবে

ঐ লোভ আমাকে তুমি আর দেখিয়ো না। চারাগাছ এক জায়গা থেকে আর জায়গায় লাগাইলে হয়,এক দ্যাশ থেকে আর দ্যাশে লাগাইলেও বোধায় হয়কিন্তুক গাছ বুড়িয়ে গেলে আর কিছুতেই ভিন্ মাটিতে বাঁচে না

কত্তা অবাক হয়ে বললেতুমি আবার এত কথা কবে শিখলে?

রাগ আমারও হলোবললমএতকাল যা শিখিয়েছ তাই শিখেছিযা বলিয়েছ তাই বলেছিঅ্যাকন একটি-দুটি কথা আমি বোধায় নিজে নিজে শিখেছি

এই কথার পরে পাকা একটি বছর গেল। কেমন করে যি গেল সি একমাত্তর আমি জানি। একটির পর একটি বড় খোঁকার চিঠি আসেখুঁকির চিঠিও আসে দু-একটি। চিঠি এলে কত্তা কখনো আমার সাথে কথা বলেকখনো বলে না। কথা বলবে কিদু-এক কথা হতে না হতে তকরার শুরু হয়ে যায়কত্তা ত্যাকন মুখে যা আসেতাই বলে। একবার খুব সোন্দর একটি কথা বললেশুনে ভারি আমোদ প্যালম। কত্তা বললেতোমাকে আমি পরিত্যাগ করব। একবার বললেদেখিতুমি কি করে এখানে থাকো। সব বেচেকিনে চুকিয়ে তবে যাব

মুখে মুখে ঐ মানুষের সঙ্গে আমি কথা বলব সি আমার সাধ্যি কিআমি একবারও মনে করি নাই যি আমার কথা দিয়ে কত্তার কথা কাটব। আমার শুদু মনে হছিলকত্তা যাই বলুক আর যাই করুকআমার কথাটি আমাকে বলতেই হবে আর সেই কথার মতুন কাজ আমাকে করতেই হবে

শ্যাষ পয্যন্ত কত্তা একদিন বললেআর এই নিয়ে একটি কথা আমি তোমাকে বলব না। তোমার মতের আর কোনো দরকার নাই। জমি-জমা বদলের কথাবার্তা হয়ে গিয়েছে। একটি বাড়ির ব্যবস্থাও হয়েছে। বাকি আছে আমাদের এই বাড়িটির বিলি-ব্যবস্থা। থাকো তুমি তোমার গোঁ নিয়ে। যাবার দিনে ঠিকই যাবে তুমি

কথা শুনে খুব নজর করে আমি আমার সারা জেবনের মানুষটির মুখের দিকে চেয়ে থাকলমকেমন ধুলোর আড়ালে আঁদার আঁদার লাগল। মুখটো। বুঝতে পারলমকত্তা মিছে কথা বলছে নাআমাকে হুমকিও দিছে না। কিছুদিন থেকে খুব শহরে আনাগোনা করছিল। পাকিস্তান থেকে আসা একটি হিঁদু পরিবারের সাথে বদলের কথা হচে। ধুতি-পরা কেমন একধারা একটি লোক আজকাল পেরায়ই বাড়িতে আসছে

এইবার আমার সাথে কত্তার কথার শ্যাষ দিনটির কথা বলি। সাঁঝের খানিক পরে কিছুই যেন হয় নাই এমনি ভাব করে হেরিকেনের আলোটো এট্টু বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেব্যবস্থা সব হয়ে গেল। এই রোববারের পরের রোববারে যাওয়া। বড় খোঁকা আসতে পারছে নাওদিকের সব ব্যবস্থা তাকেই করতে হবে তো। খুকি আসছে তার মেয়েকে নিয়ে। মেজ খোঁকা আসছে তার সঙ্গে। এক্ষুনি সবার আসার দরকারই বা কি। আসা-যাওয়া তো বন্ধ হচ্ছে না। এখন এই বাড়িটা

সেইখানেই বসে পড়ে আলো-আঁধারিতে কত্তার মুখের দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে আমি বললমকেমন করে বললম আমি জানি নাবললমএই বাড়িটিতে আমি থাকব

কে যেন থাবড়া মেরে কত্তার মুখ বন্ধ করে দিলে। জেবনে এই পেথম আমি আমার সোয়ামিকে এমনি করে মারলমআলো-আঁদারির চেয়েও আঁদার হয়ে এল কত্তার মুখ। খুবখুব কষ্ট সিখানে। তবে সে আর কততক্ষণতখুনি পুরুষ গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলযেখানে খুশি চলে যাওযেখানে খুশি থাকো গাএই বাড়ির বদলি-দলিল হয়ে গিয়েছে

ও কথা শুনেও আমি আমার কথা থেকে সরলম নাএই বাড়িতেই আমি থাকব। আমাকে হাতে ধরে বাড়ির বার করে দিলে তবে আমি যাব

 

আর কুনো কথা হলো না। আর তো কথার কিছু নাই। আমিও আর কুনো কথা বলব না। কতো লোক এলকতো কথা চললকতো বুদ্ধি-পরামর্শ দিতে লাগল। ভাইরা সব দলবেঁধে এলঝগড়াঝাটিকাদাকাটা কিছুই বাদ থাকল না। ছোট ভাইটি মাটিতে মাথা কুটতে লাগল। জায়েরা এসে সব আমার গলা জড়িয়ে কেঁদে গেলরাজ্যের জিনিশ বাঁধাছাঁদা হতে লাগলকিছু জিনিশ ফেলা গেল। কিছু জিনিশ দান-খয়রাত হলো। মোট কথা দশদিন ধরে বাড়িতে ম-হা-জ্ঞ হতে লাগল। মুখ বুজেঠোঁট টিপে আমি সব কাজে থাকলম। তাপর খুকি আসার ঠিক আগের দিন সকালে কত্তা এসে আমার সামনে দাঁড়াইলে। জেবনে এই কত্তা কারুর কাছে মাথা নামো করে নাই। আজ দেখলম আমার ছামনে মাথাটো হ্যাট করে দাঁড়াইলে। শরমে আমি মরে গ্যালম

তুমি যাবে ধরে নিয়ে ব্যবস্থা করা আছে। কি করছ একবার ভেবে দেখবে নাএমন কাজ কি কেউ কুনোদিন করেছেযে শুনবে সেই ছি ছি করবেআমাদের সকলের মুখে চুনকালি পড়বে

বাড়িটো বিক্কিরি হলোনা বদল হলো?

কোনোটাই এখনো হয় নাই

ক্যানে?

কত্তা আমার মুখের দিকে একদিষ্টে তাকিয়ে থাকলেতাপর আস্তে আস্তে বললেবলতে যেয়ে তার চোখমুখ কুঁচকে গেলযদি কিছুতেই না যাওবাড়িটি এইরকমই থাকবে আর তোমার দাদির দেওয়া জমিটাও বদল হবে না

 

অন্যদিন জ্বরটা আসে দোপর থেকেআজ এয়েছে সকাল থেকেই। বাড়িতে সারা গাঁয়ের মানুষ। হাজার বছরেও যি এমন ঘটনা ঘটে নাই। যা হতে লাগল সি আর বলার লয়। বুড়ো বুড়ো মানুষ সব কেউ কত্তার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদেকেউ গা ছাড়তে বারণ করেকেউ। শাপ দেয়। যার যেমন মনে হচে করছে। ভেতরে ভেতরে ঘুষঘুষে জ্বর নিয়ে আমি আর নিজের দ্যাহটিকে টানতে পারছি না। একবার দেখলমকত্তামার ছেলেরাও এয়েছে। কত্তামা কবে গত হয়েছে। তার ছেলেদেরও দেখলম একটি-দুটি চুল পেকেছে। যা হয় তোক আমি একদিকে সরে গ্যালম

হেঁশেলে যেয়ে বসে আছিতখুনি মেয়েকে নিয়ে খুঁকি আমার কাছে এয়েছিল। তার সাথে কি কথা হলো তা তো খানিক আগেই বললম। খুব কঁদছে দেখে তাকে আমি আবার বললমমাতোমরা যা মনে করছ তা কিন্তু ঠিক নয়। আমি জেদ করে যেচি না মনে কোরো না। তুমি আমার জানের টুকরোবড় সাদনা করে তোমাকে পেয়েছি মাতোমার এই কন্যে আমার সাত-রাজার ধন মানিক। বলতে বলতে এইবার আমার চোখ দিয়ে দরদরিয়ে পানি গড়াইতে লাগল। সি পানি মোছলম নাসেই পানির সাগরের ভেতর দিয়ে মেয়ে-নাতিনের আবছেয়া মুখ দেখতে দেখতেই বললমসব ঠিক আছে মাতোমাদের সাথে যেচি না বলে মনে কোরো না তোমাদের আমি চেরকালের লেগে জান থেকে বিদায় দেলম। আমি জানবছেলেমেয়ে সব-সোমায় কাছে থাকে নাতাদের আলেদা জেবনআলেদা সোংসারএকসাথে থাকবে ক্যানেআগেও যেমন যেতে-আসতেঅ্যাকননা তেমনি আসবে-যাবে। এতগুলিন কথা বলে আমি চোখ মুছে তাদের দিকে তাকালম। দেখিখুঁকির চোখেও অ্যাকন আর পানি নাই। আমি তাদের দুজনাকে ধরে চুমো খেলে খুঁকি মেয়েকে কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে গেল

দুপুর গড়িয়ে বেলা আর একটু পড়ে এলে রওনা হয়ে যাবার সোমায় হলো। ত্যাখন ভেতরে ভেতরে বোধায় ভাবলমমেজ খোঁকা কি একবার আসবে নানা এলে সি ভালো! তবে একবার কি সে আসবে নাএই ভেবে চোখ তুলতেই দেখিসামনে মেজ খোঁকা। সে কিন্তুক হাসছে। সোজা আমার কাছে এসে বললে,, আমি সব জানি। তোমাকে নিয়ে সবাই পিড়াপিড়ি করছে। আমারও করা উচিত ছিলকরি নাই। এখনো আমি তোমাকে একটুও জোর করব না। শুধু ঠিক করে বলো তো মাতুমি এই কাজটি করলে কেনঅত জোরই বা কিসের তোমারএই কথাটা জানতে আমার খুব মন হচ্ছে

সত্যি বলছি বাবাআমি ক্যানে তোমাদের সাথে দেশান্তরী হব এই কথাটি কেউ আমাকে বুঝাইতে পারে নাই। পেথম কথা হচেতোমাদের যি একটো আলেদা দ্যাশ হয়েছে তা আমি মানতে পারি না। একই দ্যাশএকইরকম মানুষএকইরকম কথাশুদু ধম্মে আলেদা সেই লেগে একটি দ্যাশ একটানা যেতে যেতে একটো জায়গা থেকে আলেদা আর একটো দ্যাশ হয়ে গেলই কি কুনোদিন হয়এক লাগোয়া মাটিইদিকে একটি আমগাছ একটি তালগাছউদিকেও তেমনি একটি আমগাছএকটি তালগাছ! তারা দুটো আলেদা দ্যাশের হয়ে গেলকই ঐখানটোয় আসমান তো দুরকম লয়। শুদু ধম্মাের কথা বোলো না বাবাতাইলে পিথিমির কুনো দ্যাশেই মানুষ বাস করতে পারবে না

মেজ খোঁকা আমার কথাগুলিন যেন গিলছিল। আমার বলা হয়ে গেলে সে শুধু বললেমা তোমার কথা ঠিকতবে আরও কথা আছে

তা থাকুকগোতা নিয়ে আমার দরকার নাই। আমি এই বুঝি যি ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে আজকালকার দিনে আর কাছে থাকতে পারে না। কাছে রাখতে গেলেই তারা আর বড় হতে পারবে না। দিনকাল বদলাইছেতাদের ছেড়ে দিতেই হবে। তাদের জেবন আলেদা হবেসোংসার আলো হবে। তার লেগে আমি ক্যানে,আমার বাড়িআমার দ্যাশ ছাড়বআমি জানব তোমরা সবাই দূরে গেয়েছ। বিদ্যাশ বলে যেদি না মানিতাইলে তোমরা যতো দূরে গেয়েছ তার চেয়ে অ্যানেক অনেক বেশি দূর তো ই দ্যাশেই যেতে পারতে। বছরে একবার দুবার মা-কে দেখতে এসোতাইলেই হবে

ইচ্ছা করেই কত্তার কথা আর তোললম না। মেজ খোঁকা কিন্তুক হাসিমুখেই বিদায় নিলে। আমি তার পেছু পেছু এসে দেখলমমালবোঝাই তিনটো গরুর গাড়ি রওনা হয়ে গেয়েছে। নাতনিকে নিয়ে খুঁকি আর একটি গাড়িতে উঠতে যেচে। একবার আমার দিকে তাকাইলে। কত্তাও গাড়ির দিকে যেছিলকি মনে করে হঠাৎ ফিরে এসে আমার কাছে দাঁড়াইলেলহমার লেগে তাকাইলে আমার মুখের দিকেতাপর আবার গাড়ির কাছে ফিরে গেল। কত্ত কবে ফিরবেএক মাস পরেদু-মাসএকবছরদু-বছর?তিনবছরফিরবে না কুনোদিন?

এই দোতলা মাটির বাড়ি খুব বড়। একতলায় চারটো ঘরদোতলায় চারটো ঘর। কটো আর ব্যাভার করতে পারিদু-একটো বাদে বাকি সব ঘরই পড়ে থাকে। দোতলার একটি ঘরে অ্যাকনো জানেলা বসানো হয় নাই। শুদু এই জানেলা ক্যানেঅ্যানেক জানেলাই অ্যাকনো লাগানো হয় নাই। ভেতরের দিকে অ্যানেক দরজাও নাই। সব দেয়াল ল্যাপা হয় নাইকাদার ওপরে মিস্ত্রির আঙুলের দাগ দেখা যায়। কত্তা বলেমানুষ বাড়ি তৈরি শুরু করতে পারেবাড়ি কুনোদিন শ্যাষ করতে পারা যায় না। তাই বটে! যাই হোকদোতলার ঐ ফাঁকা জানেলাটির কাছে যেয়ে বসলে ইস্টিশানের সয়রানের অ্যানেকটো দেখা যায়। সেইখানে যেয়ে বসে বসে দেখলমপাড়ার ভেতর দিয়ে যাবার সোমায় গাড়িচারটো চোখের আড়ালে চলে গেয়েছিলঅ্যাকন আবার তাদের দেখতে পাওয়া যেছেদিঘির উঁচু পাড়ে উঠে আবার গরানে নেমেছে। গাড়ি আর গরুগুলিকে শুদু দেখতে পেছিআর কাউকে লয়। পেছনের ঐ গাড়িতে আছে আমারই প্যান্টের ভেতরে-বাড়া নাড়িছেড়া আমার দুটি সন্তান আর তাদের বাপ যি তাদের জনমো দিয়েছিল আমারই ভেতরে। ওরা অ্যাকন চলে যেছে। যে যায় নাই সে আছে ঐ দিঘিটোরই ঢালু পাড়ে কবরের ভেতরে ঘুমিয়ে। সে কুনোদিন যাবে না। একদিন আমি তার পাশেই যেয়ে চেরকালের লেগে ঘুমুবো

গাড়িচারটো যা-ও বা এতক্ষণ দেখা যেছিলচোখের পানিতে অ্যাকন আর কিছুই দেখতে পেচি না। কি ঢল যি নামল পানির আর কিছুই দেখতে পেচি না। ঘরদুয়োর বিশ্বসোংসার উঠছে নামছে। বুকের ভেতর কতো বাতাসকতো আগুনকত আলোকতো ছোঁয়া ফুলে ফুলে গলার কাছে আসছে আবার নেমে যেচে। অ্যাকন যদি এমনি করে মরণ হয়বেশ হয়

তাই কি কুনোদিন হয়কখন গাড়িচারটো মিলিয়ে গেয়েছে। আলো কমছেহেঁয়া বাড়ছে। দেখতে দেখতে সব আলো নামতে নামতে সরতে সরতে কোথা চলে গেল আর হেঁয়া পড়তে লাগল। সারা বাড়িতে অ্যাকন হেঁয়াঘরে ঘরে হেঁয়াঘরের বাইরে এনেয় হেঁয়াডুমুর গাছে ছেয়াপেয়ারা গাছে ঘেঁয়া। বাড়িতে আমি একদম একাঅ্যানেক আওয়াজ হতে লাগল সারা বাড়িতে। পশ্চিম দিকের আসমানটো দেখতে পেচিএকটি তারা দেখতে পেচিকতোদিন বাদে মায়ের মুখটো দেখতে পেচিকুন এক জগতের গাছপালা মাঠঘাট দেখতে পেচি আর কানে আসছে কতো রকমের আওয়াজ। পেয়ারা গাছে বাদুড় এসে বসল ডালপালা নাড়িয়েকি কিচ্ শব্দ করে একটো ইঁদুর ছুটে গেলমাথার ওপর দিয়ে দু-একটো চামচিকে উড়ছে তো তার কুনো শব্দ নাইঝমঝম করে একবার ঝি ঝি পোকা ডাকছে। আবার সব চুপ

আমি কি ঠিক করলমআমি কি ঠিক বোঝলমসোয়ামির কথা শোনলম নাছেলের কথা শোনলম নামেয়ের কথা শোনলম না। ই সবই কি বিত্তি-বাইরে হয়ে গেল নামানুষ কিছুর লেগে কিছু ছাড়ে,কিছু একটা পাবার লেগে কিছু একটা ছেড়ে দেয়। আমি কিসের লেগে কি ছাড়লমঅনেক ভাবলম। শ্যাষে একটি কথা মনে হলোআমি আমাকে পাবার লেগেই এত কিছু ছেড়েছি। আমি জেদ করি নাইকারুর কথার অবাধ্য হই নাই। আমি সবকিছু শুদু নিজে বুঝে নিতে চেয়েছি। আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যানে আলেদা একটো দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে যিখানে শুদু মোসলমানরা থাকবে কিন্তু হিঁদু কেরেস্তানও আবার থাকতে পারবে। তাইলে আলেদা কিসেরআমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়। আমাকে আরও বোঝাইতে পারলে না যি ছেলেমেয়ে আর জায়গায় গেয়েছে বলে আমাকেও সিখানে যেতে হবে। আমার সোয়ামি গেলে আমি আর কি করবআমি আর আমার সোয়ামি তো একটি মানুষ লয়আলেদা মানুষ। খুবই আপন মানুষজানের মানুষকিন্তুক আলেদা মানুষ

সকাল হোকআলো ফুটুকতখন পুবদিকে মুখ করে বসব। সুরুজের আলোর দিকে চেয়ে আবার উঠে দাঁড়াব আমি

আমি একা। তা হোকসবাইকে বুকে টানতেও পারব আমি

একা

 

Post a Comment

0 Comments