রুপি রাজনীতি ও রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য


করোনা মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিশ্বরাজনীতি বদলে গেছে। অনেকেই ক্ষমতার মেরুকরণের লাগাম পশ্চিমের হাত থেকে ছুটে যাওয়ার পক্ষে মতো দিলেও আমার মতে বিশ্বভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। যা একটা নিরাপদ পৃথিবীর জন্য খুবই প্রয়োজন। তবে এই পরিস্থিতিতে নিজের ক্ষমতা জাহির করাবার জন্য বিশ্বমোড়লেরা মিত্রদেশগুলোকে নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগুতে পারেসেই শঙ্কাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। 


এবার ফিরে আসি আজকের আলোচনায়। পরিবর্তীত এ বিশ্বপরিস্থিতিতে ভারত রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের ফলে অর্থনৈতিক রাজনীতিরও পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্বের দেশে দেশে আমেরিকান ডলারের বিপরীতে মুদ্রার দরপতন হচ্ছে, খাদ্য ও জ্বালানী সরবরাহে সংকট দেখা দিচ্ছে। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানী সরবরাহের বড় যোগানদাতা রাশিয়া। 


বাংলাদেশের সাথে রাশিয়ার রপ্তানি বাণিজ্য খুব বড় অঙ্কের না হলেও আমদাদি বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য। রাশিয়ায় আমাদের রপ্তানি পণ্যের বড় বাজার হলো তৈরি পোশাক। বাংলাদেশ গত অর্থ বছরে ৩১.৪ বিলিয়ন ইউএস ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে যার মধ্যে মাত্র ৪.৮ মিলিয়ন ইউএস ডলারের রপ্তানি হয়েছে রাশিয়ায়। বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে গত মাসে রাশিয়ায় তৈরি পোশাক রপ্তানির চালান বাতিল হয়ে গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে দুইলাখ টন গম ও প্রায় তিন লাখ টন পটাশ সার আমদানি করে থাকে। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ফসপেট সারও আমদানি করে থাকে। রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধের পর পশ্চিমাদের খুশি রেখে যা আমদানি করা সহজ হবে না। 


আমন মৌসুমে নেমে যাওয়া বন্যার পলি ও বৃষ্টির পানিতে ধান উৎপাদন করা গেলেও বোর মৌসুমে ব্যাপক ভাবে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয়। ধান উৎপাদনে সরকারের দাবীকৃত স্বনির্ভরতা টিকিয়ে রাখতে হলে রাশিয়া থেকে সার আমদানি করা জরুরী। কারণ একই মূল্যে অন্য কোথাও থেকে এই মুহুর্তে সার আমদানি করা সহজ নয়। সরকারকে মনে রাখতে হবে শ্রীলংকায় রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধ করে জৈব পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে খাদ্য উৎপাদনে কি পরিমাণ ধ্বস নেমেছিল। 


ইতোমধ্যে ভারত রাশিয়ার সাথে রুবলে বাণিজ্য করে যাচ্ছে। ভারতের কয়েকটি ব্যাংকে রুবলে এলসি খুলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ভারতের জন্য রুবলে বাণিজ্য করা সহজ হলেও রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির জন্য সেটা সহজ নয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ভারত চাচ্ছে রুপিকে বাংলাদেশের লিগাল টেন্ডার বা কারেন্সি হিসেবে চাপিয়ে দিতে। এর আগে ২০১৩ সালেও ইউএস ডলারের বিপরীতে দরপতন ঠেকিয়ে রুপিকে শক্তিশালী করতে এশিয়ার প্রতিবেশি দেশগুলোতে রুপিকে লিগাল টেন্ডার হিসেবে চাপিয়ে দিতে তৎপরতা চালিয়েছিল ভারত। তখন বাংলাদেশ সেই চেষ্টার ফাঁদে পা দেয়নি। তবে টাকার ক্রমবর্ধমান দরপতন ও বিশ্বপরিস্থিতিতে ভারত আবার বিষয়টাকে সামনে এনেছে। এক্ষেত্রে অবশ্যই কূটনৈতিক চাপও থেকে থাকবে। 


কিন্তু বাংলাদেশের মনে রাখতে হবে ইউএস ডলারের বিপরীতে বর্তমানে রুপিই শক্তিশালী নয়। ক্রমাগত দরপতন হচ্ছে। তাছাড়া ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতিও প্রবল। ফলে রুপি দিয়ে রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে আরও নাজুক করে তুলবে। কারণ এক্ষেত্রে ভারতীয় ব্যাংক থেকে উচ্চ হারে ঋণ নিতে হবে অথবা ডালার দিয়ে রুপি কিনতে হবে। ফলে ক্রমম্রিয়মান বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ আরও কমে যাবে। তাছাড়া বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে পশ্চিমাদের পাশকাটিয়ে রুপিকে লিগাল টেন্ডার হিসেবে গ্রহণ করা একেবারেই উচিত হবে না। মনে রাখতে হবে পশ্চিমারা আমাদের তৈরি পোশাকের বড় ক্রেতা। কোন ভাবেই সেই বাজার হারানোর ঝুঁকিতে যাওয়া যাবে না। তাছাড়া রুপিকে লিগাল টেন্ডার হিসেবে গ্রহণ করলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব চরম ভাবে বিঘ্নিত হবে। 


উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উচিত পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক আলোচনা চালানো। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে বাংলাদেশ চাইলে রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানী কিনতে পারে। এ সপ্তাহেই রাশিয়া-তুরস্ক-ইরান ঐক্যমত্যে পৌঁছেছে যে কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেন-রাশিয়ার খাদ্যপণ্য রপ্তানি হতে কোন বাঁধা নেই। এই পরিস্থিতিতে সামনের বোর মৌসুমে সারের কতটা প্রয়োজন তা পশ্চিমাদের বুঝাতে হবে। সার না পেলে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারেসে বিষয়টা তুলে ধরতে হবে। আর এখনই সেটার উপযুক্ত সময়। দেরি হয়ে গেলে সামনের বোর মৌসুমে ধানের উৎপাদন ব্যপক ভাবে বিঘ্নিত হতে পারে। যা দেশের স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করবে।  


Post a Comment

0 Comments