জুই অপেক্ষা করছে।
নিজের উপর বিরক্ত। নির্দিষ্ট সময়ের দশ মিনিট আগেই এসেছে ও। দরকার ছিল না কিন্তু টেনশন কাজ করছে ভিতরে প্রবলভাবে। সেই টেনশন নিয়ে বসে আছে ধানমন্ডির জলপদ্ম রেস্টুরেন্টের দোতলার কর্নারের টেবিলে। জীবনে এই প্রথম কারো জন্য অপেক্ষা। তাও, মানুষটি বয়সে ওর চেয়ে বিশ পঁচিশ বছরের বড়। কেনো এসেছে? ঠিক বিশ্লেষণ করতে পারছে না। গোটা ঘটনাই কৌতুক আর কৌতুহলের বিষ ফোড়া মনে হচ্ছে জুইয়ের। ফেসবুকেই পরিচয়। না, জুইয়ের নিজের কোনো আগ্রহ ছিল না। মানুষটি একের পর এক রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে, মামনি আমি তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে চাই। আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই। আমি বয়সে তোমার পিতার মতোই হবো। তুমি আমার রিকোয়েস্ট গ্রহণ করো…
জুইয়ের ফ্রেন্ডসলিস্টে তিন হাজার জন। সবার সঙ্গে কথাও হয় না। কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে ও। মা সুরাইয়া আসগর সব সময়ে চোখে চোখে রাখে জুইকে। কলেজে ফাস্ট ইয়ার পর্যন্ত মা সঙ্গে গিয়ে নামিয়ে দিয়ে আসতো। আবার কলেজ ছুটি হলে নিয়ে আসতো। বন্ধুরা বাসায় আসলে অবশ্য মা কিছু বলে না। বরং চা নাস্তার দারুণ আযোজন করে। কোথাও গেলে সঙ্গে বাবা, নয়তো মা থাকেই। কিন্তু কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেই জুই বেঁকে যায়, আমি কলেজে একা যাবো।
কেনো? অবাক সুরাইয়া।
আমি যথেষ্ট বড় হয়েছে মা। আমার সঙ্গে স্কুল থেকে স্কুর মতো লেগে আছো, এখন আমি কলেজে পড়ি। তাও সেকেন্ড ইয়ারে। আমার বন্ধুরা আড়ালে হাসে।
কিন্তু সময়টা ভালো না মা!
মা গোটা দুনিয়াটাই আজকাল পাল্টে গেছে। কখন কোথায় কি ঘটে বলা যায় না। তুই আর তোর ভাই জিকু, এইতো আমাদের সংসার। গত মাসেই পাশের বাসার হেমেন্দ্র বাবুর ছেলেটাকে উঠিয়ে নিয়ে গেলো না? পাওয়া গেলো, সাতদিন পর লাশ!
মা, পরে তো জানা গেছে হেমেন্দ্র বাবুর নিজের ছোট ভাই কাজটা করিয়েছে, এই ঘটনা তো কোনো সন্ত্রাসী ঘটায় নাই। আমি একা যাবো মা, ড্রাইভার কাকাতো আছেই…
ড্রাইভারতো পর মা।
মা, এইভাবে মানুষকে অবিশ্বাস করলে বেঁচে থাকা যাবে না। কাউকে না কাউকে বিশ্বাস করতে হয়, হবে। তুমি যাই বলো, কলেজে আমি একা যাবো, একা আসবো। ব্যস…। যদি তুমি যাও, আমি কলেজেই যাবো না। জুইয়ের সরাসরি ঘোষণা।
রাতে জুইয়ের ঘোষণা নিয়ে পারিবারিক মিটিং বসে জুইয়ের রুমে। জুইয়ের বাবা আলী আসগরের গারমেন্টস ব্যবসা। আলী আসগর সংসারের পুরো ভার ছেড়ে দিয়েছেন সুরাইয়ার উপর। ব্যবসার জন্য সংসারে সময় দিতে পারেন না। দুই তিন মাসে দুই একবার দেশের বাইরেও যেতে হয়। আর সুরাইয়া শক্ত হাতে সংসার সামলায়। আলী আসগর এদিকে মুক্ত। কিন্তু তিনি জুইকে যেভাবে পাহারায় রাখে সুরাইয়া, সেটা মানতে পারেন না। কিন্তু স্ত্রীর মনের বিষাদ মাতৃত্বকে মনে রেখে চুপ থাকেন। হয়তো উপায়ও নেই। মিটিংয়ে জিকুও সমর্থন করে জুইকে, আপুতো ঠিকই বলেছে। কোনো আপুকে পাহারা দাও? পাহারা দেয় কাকে? চোর ডাকাত বদমাশকে। আর মন্ত্রীদের পাহারা দেয় পুলিশ। তো আপু চোর ডাকাতও না, মন্ত্রীও না। আর আপু এখন বড় হয়েছে, বন্ধুরা নিশ্চয়ই ঠাট্টা করে..
কিন্তু জুইয়ের নিরাপত্তা ভাববি না জিকু! সুরাইয়া হাহাকার করে।
হাসে জুই, আমার নিরাপত্ত! আমি কে? আমি জুই। পড়ি মাত্র কলেজে, এখন সেকেন্ড ইয়ারে। আমার নিরাপত্তা কী? আমার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন হলে, কলেজে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীদের কী অবস্থা! কই ওদের তো নিরাপত্ত নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই…
ঠিক আছে, হাত তোলে আলী আসগর- আমি বুঝতে পেরেছি আমাদের মেয়ে মিস তারানা আফরিন জুই এখন বড় হয়েছে, কলেজে পড়ে। কলেজে এখন সঙ্গে মাকে নিয়ে যেতে চায় না। এটাই স্বাভাবিক। সুরাইয়া, ছেড়ে দাও মেয়েকে মেয়ের হাতে।
সুরাইয়া আসগরের কিছু বলার থাকে না। বুঝতে পারেন, জীবনের সকল গ্রন্থি এভাবেই ছুটে যায় হাতের মুঠো থেকে। মুক্তি পায় জুই। পরেরদিনে থেকে জুই একাই যায় গাড়িতে কলেজে। ফেরেও একা। না, কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু বাসার সামনে এসে দেখতে পায়, মা সুরাইয়া তিনতলা থেকে নেমে নীচে অপেক্ষা করছে। জুই জড়িয়ে ধরে মাকে। প্রথম কয়েকদিন সুরাইয়া কলেজ থেকে ফেরার সময় নীচে অপেক্ষা করতেন। এখন আর করেন না। সয়ে গেছে।
ফেসবুকে আহমেদ মামুন প্রথম রিকোয়েস্ট পাঠানোর পর, দেখে জুই। কিন্তু গ্রহণ করে না। কয়েকদিন পর ডিলিট করে আবার রিকোয়েস্ট পাঠায় মামুন। বিরক্ত হয়ে জুই কিন্তু গ্রহণ করে না। সপ্তাহখানেক পর আবার রিকোয়েস্ট পাঠায়।
আপনার সমস্যা কী? ইনবক্সে লেখে জুই, কেনো আমাকে বিরক্ত করছেন বারবার? আপনার কোনো কান্ডজ্ঞান নেই? আপনি কতো বয়স্ক মানুষ… আমাকে রিকোয়েস্ট পাঠান কেনো?
মামনি, আমি খারাপ মানুষ না। আর কোনো উদ্দেশ্য করেও তোমাকে রিকোয়েস্ট পাঠাইনি। তুমি বিশ্বাস কর। খুব ছোটবেলায় আমার মা মারা যায়। অবিকল সেই মুখ তোমার মামনি… সেই জন্যই রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। তোমার খারাপ লাগলে সত্যি আমি দুঃখিত। সরি…
মেসেজ পড়ে জুইয়ের নিজেরই খারাপ লাগে। লেখে, আমি আপনার ব্যপারটা বুঝতে পারিনি আংকেল। আমাকে মার্জনা করবেন। আমি আপনার রিকোয়েস্ট গ্রহণ করলাম। এবং সঙ্গে সঙ্গে আহমেদ মামুনের রিকোয়েস্ট গ্রহণ করে। মামুন কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রশ্ন করে, মামনি তোমার প্রোফাইলে দেখলাম, তোমার বাবার নাম আলী আসগর। উনার বাড়ি কী জামালপুর?
প্রশ্ন রেখেই ফেসবুক থেকে বের হয়ে যান মামুন। জুই অবাক। লোকটা পাগল নাকি? আমার বাবার বাড়ি যে জামালপুর, উনি জানলেন কেমন করে? আহমদ মামুনের প্রোফাইলে ঢোকে জুই। মামুনের পরিচিতি, কাধে ব্যাগ, হাতে ডিএসএলআর ক্যামেরা, মাথায় হ্যাড, চোখে সান গ্লাস, পরনে জীনস আর টিশার্ট। দারুণ লাগছে। দৃষ্টি বহুদূরে। ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার। গ্রামের বাড়ি, বরিশাল। দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর শখ। দুনিয়ার বেশ কয়েকটা দেশের ছবি দিয়ে রেখেছে, একের পর এক দৃশ্যগুলো চমৎকার। ছোট ছোট নানা ধরনের মন্তব্য এসেছে অজস্র। ছবিগুলোতে প্রচুর লাইক। ইন্টারেস্টিং চরিত্র মনে হচ্ছে ওর। হঠাৎ হাসি পায় জুইয়ের, লোকটা প্রেম নিবেদন করবে নাতো? এইসব লোকদের নিয়ে বড় বিপদ। ওরা ভীষণ ডেসপ্যারেট হয়।
পরের কয়েকদিন কোনো খবর নেই। জুইও ভুলে যায়। টিউটোরিয়াল পরীক্ষা ছিল গতসপ্তাহে। ভীষণ ব্যস্ত। পরীক্ষা শেষ, একটু রিলাক্স। রাত দশটার দিকে মোবাইলে ফেসবুক অন করে দেখতে পায় মামুনের মেসেজ, মামনি কেমন আছো?
জি ভালো। আপনি?
আমি? আমি সব সময়ে ভালো। তোমার পড়াশুনার খবর কী?
আমি এবার এইচএসসি দেবো।
গুড, পড়াশুনা করবে। গান করো নাকি মামনি?
নাহ, তবে শুনি।
কী গান শুনতে পছন্দ কর?
সব ধরনের, তবে ব্যান্ডের গান বেশী শুনি।
ব্যান্ডের গান আমার ভালো লাগে না। আমি শুনি নজরুল সঙ্গীত। একটা গান আমার খুব প্রিয়. অনুপ জালোটা গাওয়া, খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে বিরাটও শিশু আনমনে…। তুমি শুনেছো কখনো?
নাহ…।
শুনবে, অন্যরকম গান। অবশ্য তোমাদের যে বয়স, তাতে ব্যান্ডই ভালো লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। জুই?
জি বলুন?
প্রোফাইলে তোমার মায়ের নাম লেখোনি দেখলাম। কেনো লেখোনি মামনি? কিন্তু প্রচুর ছবি পেলাম তোমাদের পারিবারিক। দেখেই মনে হয়, সুখী পরিবার।
লিখিনি? নিজে প্রশ্ন করেই নিজের প্রোফাইলে ঢোকে জুই, সত্যিই মায়ের নামটা নেই। বছরতিনেক আগে যখন ফেসবুকের প্রোফাইল খুলেছিল, তখন তো বাবা মা এমন কী ছোট ভাই জিকুর নামও ছিল। অবশ্য বেশ কয়েকবার চেঞ্জও করেছে। সেই চেঞ্জে কতোকিছু হয়েছে, কেবল বাবার নামটা রয়ে গেছে। কিন্তু আজকালতো কেউ প্রোফাইলে বাবা মা নাম দেয় না।
আমার মনে হয় তোমার মায়ের নাম সুরাইয়া আখতার। না?
পুরো শরীরের রক্ত ছলকে ওঠে জুইয়ের, আপনি কিভাবে জানেন?
আহমেদ মামুন উত্তরে জুই ফুলের গুচ্ছ পাঠিয়ে ফেসবুক বন্ধ করে দেয়। ফেসবুক বন্ধ করে দেয়ায় বিস্মিত জুই। কেনো বন্ধ করলো? মায়ের নাম কেমন করে জানলো? এক সঙ্গে পড়তো? সেটা সরাসরি লিখলেই পারে। কেনো রহস্য করছে? মানুষটা কি আমাকে নিয়ে কোন ফাঁদ রচনা করছে? মাকে কী জিজ্ঞেস করবো, তুমি আহমেদ মামুন নামে কাউকে চেনো? মা যদি পাল্টা প্রশ্ন করেন, তুই চিনিস কিভাবে? বেশতো মুশকিলে পড়ে গেলাম, জুই নিজের মধ্যে গেঁথে যায়। ঘুরে ফিরে অনেক রাত পর্যন্ত আহমেদ মামুনের প্রোফাইল দেখে। মানুষটা কোথায় লেখাপড়া করেছে, কোথায় চাকরি করে, কোনো খবর নেই। কেবল দেশ বিদেশের অনেক জায়গার দৃশ্যমায়ার ছবি। মানুষটা রহস্যময়।
পরের দিন থেকে জুই মোবাইলের ফেসবুকে কেবল মামুনকে খোঁজে। পায় না। লোকটা কী? বিরক্ত হয়। রাগ হয় নিজের উপর? কেনো বিশ্রী লোকটার রিকোয়েস্ট এক্সসেপ্ট করলাম? না করলে তো ঝামেলা হতো না। আমাকে মায়ের মতো লাগে! যত্তসব!
তিন দিন পরে, বিকেলে কলেজে থেকে ফেরার পথে ফেসবুকে হাজির আহমেদ মামুন। সঙ্গে সঙ্গে ইনবক্সে লেখে জুই, আপনি একটা খচ্চর। মিচকে শয়তান।
হাহাহাহা, তাই নাকি! কিন্তু কেনো মামনি?
দেখছো লোকটার কাণ্ড! আমি এতো খারাপ শব্দ লিখলাম, লোকটা না রেগে হাসছে। আসলেই আংকেল মানুষটা রহস্যময়। জুই লেখে, আপনি এই তিন দিন কোথায় ছিলেন?
আমি ছবি তুলতে সিলেট চাবাগানে গিয়েছিলাম। তোমার ইনবক্সে ছবি পাঠাচ্ছি, দেখো বাংলাদেশটা কতো সুন্দর!
আপনি আমার মায়ের নাম জানলেন কি করে?
আহমেদ মামুনের সাড়া নেই। বিরক্ত জুই। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে, কিন্তু মামুনের ফেসবুক খোলা, কিন্তু মামুন নেই। হয়তো অন্যকাজে ব্যস্ত! এমন কেনো করছে আংকেল? ভাবনার মধ্যে গাড়ি বাসায় চলে আসে। নিজের রুমে ঢুকে ব্যাগ রেখে আবার মোবাইল নিয়ে বসে, ইনবক্সে অনেকগুলো ছবি পাঠিয়েছে মামুন। বুঝতে পারে জুই, ছবি পাঠানো নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আমার মেসেজ দেখেনি।
তুই রুমে বসে আছিস কেনো? আমি তোর খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছি না জুই? সুরাইয়া ঢোকে রুমে। মুহুর্ত মাত্র, চিন্তা করে জুই, ঘটনাটা কী মাকে জানাবো? না। সিদ্ধান্ত নিয়ে জুই খাট থেকে নেমে মাকে জড়িয়ে ধরে, সরি মা। চলো। মোবাইলটা খাটের উপর রেখে মায়ের সঙ্গে বের হয়ে যায় জুই।
খেয়ে রুমে এসে মোবাইলের ফেসবুক খোলে। মামুন লিখেছে, মামনি মানুষের জীবন বড় নাটকীয়। নাটকের চেয়েও নাটকীয়। তুমি যদি কিছু মনে না কর, আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। মাত্র একবার, এই ঢাকা শহরের যে কোনো জায়গায়, তোমার পছন্দে। শর্ত একটাই, তুমি একা আসবে, আমিও একা আসবো। একটা বুড়ো ছেলে তার তরুণী রূপসী মায়ের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাবে। সকল মানবজাতির পক্ষে আমি কথা দিচ্ছি, আমার দ্বারা তোমার কোনো অনিষ্ট হবে না। তোমার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকলাম- মামুন।
লেখাটা বার বার পড়ছে। জুই বুঝতে পারছে, কোথাও একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। রিরাট রহস্য। কিন্তু কী রহস্য? লোকটা কে? কারো সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করাও যাচ্ছে না। ক্লাসের রাজিবকে খুব বুদ্ধিমান আর বন্ধু মনে হয়, ওকে কী বলা যায়?
জুই লেখে, আমি দুদিন পরে জানাবো।
ওকে, আমি অপেক্ষায় থাকলাম মামনি আমার।
কিন্তু জুই পরেরদিনই মেসেজ পাঠায়, আংকেল আমি আগামীকাল দেখা করতে চাই, দুপুরের সময়ে, ধানমন্ডির জলপদ্ম রেস্টুরেন্টে। ঠিক বারোটায়। আমি এক ঘণ্টা থাকবো। চলে আসবো কলেজে, আমাকে নিতে বাসা থেকে গাড়ি আসবে আড়াইটায়। সময়ের ব্যপারে সচেতন থাকবেন।
অনেক ধন্যবাদ মামনি। আমি কাঁটায় কাটায় হাজির হয়ে যাবো। আর আমার মামনির যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেদিকে আমার দৃষ্টি থাকবে, জানায় আহমেদ মামুন।
সেই অপেক্ষা করছে জুই। উত্তেজনায় টগবগ করছে ভেতরে ভেতরে। মোবাইলের ঘড়ির দিকে তাকায় বারোটা বাজতে আর মাত্র তিনমিনিট। জুই তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। দরজা ঠেলে ঢোকে আহমেদ মামুন। মামুনকে দেখে একটা টেনশন কমলো, মানুষটা এসেছে, কথা রেখেছে। কিন্তু বলবে কী?
দৃঢ় পায়ে, বলিষ্ঠ ঢংয়ে মামুন এসে টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। চোখের সানগ্লাস খুলে নিয়ে, কাধের ব্যাগটা রাখে টেবিলের উপর। মুখে প্রশান্তির হাসি নিয়ে বসে মুখোমুখি, কেমন আছো মামনি?
মুখ তুলে তাকায়, ভালো। আপনি?
আমি চমৎকার। চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে, মামনি কী খাবে? তুমি তোমার ইচ্ছেমতো অর্ডার দাও। ইশারায় ওয়েটারকে ডাকে।
ঠিক দুপুরের সময়ে আমি কিছু খাই না আংকেল। পরে…
ঠিক আছে, আমি আবার ডাকবো। ওয়েটার চলে যায়।
আংকেল, আমার কাছে খুব বেশী সময় নেই। আপনি কী বলবেন, বলুন।
মামনি, তোমার মায়ের নাভীর ডানপাশে একটা কালো জড়ুল আছে। জড়ুল ঘিরে কালো কালো চুল… আমি ঠিক বলছি?
মামুন দেখে, ওর দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে জুই। জুইকে সহ্য করার সময় দেয়ার জন্য মামুন ব্যাগ খোলে। ব্যাগের ভেতর থেকে ছোট্ট এরকটা সাদা খাম বের করে টেবিলের উপর রাখে। তাকায় জুইয়ের দিকে, চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নেয়।
আপনি আসলে কে? অন্যদিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে জুই।
আমি আসলে কে জানবার আগে তোমাকে একটা গল্প শোনাই। গল্প ঠিক না, ঘটনা। জানো জুই, মানুষের জীবনের প্রতিটি বিন্দুতে গল্প লুকিয়ে থাকে। গল্প আবার ঘটনাও। গল্প হচ্ছে, গল্পকারের লেখা গল্প। ঘটনা কিন্তু গল্প না, ঘটনা ঘটনাই। যা ঘটে, সেটাই ঘটনা। আমি তোমাকে সেই ঘটনাই শোনাবো। সেই ঘটনা শোনানোর আগে তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি ফেসবুকে তিন চার বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আমাকে পাওয়ার জন্য, মানে কী? তীক্ষ্ণ প্রশ্ন জুইয়ের।
হাসে মামুন, দুঃখিত। আমার বলা উচিত ছিল তোমাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য আমার চেষ্টার পরিধি। তুমি এই যুগের মেয়ে, নিশ্চয়ই তুমি ফেসবুকে আছো। আমি নানা নামে, ভিন্ন ভিন্নভাবে তোমাকে খুঁছছিলাম ফেসবুকে। অনেক মেয়ের সঙ্গে আমি চ্যাট করেছি, কিন্তু তোমাকে পাইনি। তুমি বোথহয় ফেসবুকে কম থাকো?
মাথা নাড়ায় জুই, হ্যাঁ। প্রয়োজনের বেশী আমার থাকতে ইচ্ছে করে না। মা’ও বারণ করেন। বলেন, ফেসবুকে অযথা সময় দেয়ার মানে নেই।
তুমি লাকি, চমৎকার মা পেয়েছো। তো খুঁজতে খুঁজতে গত মাসেই তোমাকে পেয়ে গেলাম। আমি তোমার ফেসবুকে প্রবেশ করে তোমার বাবা মা ভাইয়ের সঙ্গে ছবি দেখে, বুকের উপর থেকে বিরামহীন তৃষ্ণার ভার নেমে গেলো। আমি নিশ্চিত হলাম, আমি আমার মামিনকে পেয়েছি।
কি বলছেন আপনি, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। দেখুন আংকেল, আমি আমার সঙ্গে কোনো চালাকি বা প্রতারনার চেষ্টা করবেন না। আপনি জানেন না, আমার আব্বু কতো পাওয়ারফুল মানুষ, কড়া চোখে তাকায় জুই, আমি শুধু এসেছি একটা বিষয়ে জানতে, আমার মাকে আপনি চেনেন কিভাবে?
হাতের সানগ্লাস নাড়াতে নাড়াতে তাকায় মামুন, জুই আমি এতোসব জানি কী করে, নিশ্চয়ই তোমার মনে কঠিন প্রশ্ন জেগেছে। আমি তোমার সকল প্রশ্নের উত্তর দেবো জুই, আগে আমার ঘটনাটা তোমাকে শোনাই। আমার গ্রামের বাড়ি বরিশালের পিরোজপুরে, উজানগাঁও গ্রামে। আমরা দুই ভাই, একবোন। বোন বড়, বিয়ে হয়ে গেছে দুবাই প্রবাসী এহসান আলীর সঙ্গে। দুলাভাইয়ের হাত ধরে আমার বড় ভাই জুয়েল চলে যায় দুবাই। জুয়েল ভাই ওখানে একটা গোল্ডের দোকানে সেলসম্যানের চাকরি নেয়। এসব বলছি প্রায় পঁচিশ ত্রিশ বছর আগের ঘটনা। সেই সময়ে সবকিছু সহজ ছিল। বছর তিনেক চাকরি করার পর জুয়েল ভাই নিজেই একটা শাকসবজির দোকান দেয়। বাংলাদেশ থেকে শাকসবজি নিয়ে বিক্রি করতো। ওদেশে চাকরিরত বাঙালিরা ভাইয়ের দোকানের ক্রেতা। দুবাইয়ের লোকজনও কিনতো। বেশ ভালই চলছিল সবকিছু। আমি জগন্নাথ কলেজে পড়ছি আর শখের ফটোগ্রাফি করছি। এই পড়ার সময়ে দেখা হয় এক মেয়ের সঙ্গে, যাকে প্রথম দেখায়ই আমি ভালোবাসি। নাম সুরাইয়া আখতার। পড়ে জগন্নাথে, বাবা সচিবালয়ে মাঝারিমানের চাকরি করে। আজিমপুরের স্টাফ কোয়াটারে থাকে। সত্যি বলতে কী, আমার প্রতি সুরাইয়ার কোনো আগ্রহ ছিল না। ও ভয়ানক সুন্দরী। অনেক ছেলে সুরাইয়াকে পছন্দ করে। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। একদিন আজিমপুরে ওদের বাসায় গিয়ে, সরাসরি প্রস্তাব দিলাম। আমি সেই সময়েই স্টাইলিশ ছিলাম। বাবা মারা গেছেন। মোটামুটি ভালো সম্পত্তির মালিক আমি। ভাইয়াও মাঝে মাঝে টাকা পাঠায়। সুজুকি বাইক চালাই। পুরোনো ঢাকায় তিনরুমের বাসা নিয়ে থাকি। দুই রুমে থাকে সাত আটজন, আমার রুমে আমি একা। দুই একটা পত্রিকায় ফ্রিল্যান্স ফটোসাংবাদিক হিসেবে কাজও করছি। সুরাইয়ার বাবা আমজাদ বললো, আমার মেয়ের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করা চলবে না। বিয়ে করতে চাইলে গার্ডিয়ান নিয়ে এসো। জুয়েল ভাই আর দুলাভাই আমার গার্ডিয়ান। সব জানালাম ওদের। একমাস পর দুবাই থেকে এসে আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করলো। ইতিমধ্যে আমার জিওগ্রাফিতে মার্স্টাস শেষ করে একটা জাতীয় দৈনিকে ঢুকেছি। ভালো বেতন। দিন চলছে হাওয়ায় হাওয়ায়। বিয়ের এক বছরের মধ্যে আমার স্ত্রী সুরাইয়ার পেটে সন্তান এলো। আমার জগৎ আলোয় আলোয় ভরে ঊঠলো। একই সঙ্গে একটা ভয়াল দুর্ঘটনাও ঘটলো, দুবাইয়ে রোড এক্সিডেন্টে জুয়েল ভাই মারা গেলেন। জুয়েল ভাইয়ের তিনটা বাচ্চা। বড়টা মেয়ে, লাবনী পড়ে মাত্র ফাইভে। বাকী দুটোর অবস্থাতো আরও সঙ্গীন। আমি পড়লাম উভয় সংকটে। অনেক ভেবে, সুরাইয়ার সঙ্গে পরামর্শ করে চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। কারণ, দুবাইয়ের জুয়েল ভাইয়ের দোকানটা চালালে অনেক বেশী আয় করতে পারবো আর ভাইয়ের পরিবারের প্রতি আমি দায়ও পালন করতে পারবো। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি জুই, ততদিনে সুরাইয়ার কোল জুড়ে আমার মেয়ে মৌরি, জুই, পদ্ম, নীলা, টিপটপ, আদুরী, কংকাবতী…
মানে?
আমার মেয়েকে আমি প্রতিদিন নতুন নতুন নামে ডাকতাম। একতাল পুতুলের মতো মেয়ে, কী ডাগর চোখ, কী সমৃণ তুলতুলে ওর শরীর। আমি রুমে ঢুকলেই মেয়ে মৌরি বা জুই বা কাটুস আমার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। ওকে কোলে নিলে খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ে। আমার ছোট বাসায় এক বছরের মেয়ে আসমানের চাঁদ হয়ে জ্বলতে থাকলো। এই মেয়েকে রেখে সংসারের বড় স্বার্থে দুবাই চলে গেলাম। জুয়েল ভাই যখন বেঁচে ছিলেন, আমি বছরে দু’একবার দুবাই যেতাম। তো আমি অনেকটাই জানি। দুলাভাইতো ছিলোই। দুবাই যাবার মাত্র পনেরো দিনের মাথায় চলে এলাম ঢাকায়। মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। রাতে ঘুমুতে পারি না। তিন দিন থেকে আবার চলে গেলাম। আবার এলাম বিশ দিনের মাথায়..এভাবে আমার আসা যাওয়া চলতে থাকলো। কিন্তু বছর খানেক হওয়ার পর আমি এক মাস দেড়মাস পর পর আসতাম। শেষবার আমি দুবাই থেকে আমি দুই মাস পর। কিন্তু এসে আমি আমার মেয়েকে পাই না। আমার স্ত্রীকে পাই না। বাসা তালা দেয়া। বাড়িঅলাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, আপনারা তো ঝিকাতলায় বাসা নিয়েছেন। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমি বুঝতে পারছিলাম, কোথাও একটা ঝামেলা তৈরী হয়েছে। আমি দ্রুত গেলাম আমার শ্বশুড়ের বাসায়। আমার শ্বশুড়ের চাকরি শেষ। রিটায়ার্ড করেছেন। বয়স হয়েছে। হাঁটাচলা করতে পারেন না। কথাও বলতে পারেন না। স্ট্রোক হয়ে ডান পাশ অবশ। মেয়ে সুরাইয়া আর একমাত্র ছেলে তানভীর হোসেন। থাকে মোহাম্মাপুরের ভাড়া বাসায়। বাসায় যাওয়ার পর তানভীর জানায়, সুরাইয়ার সঙ্গে আমাদের কোনো সর্ম্পক নেই। কোনো যোগযোগ নেই। কারণ, সে তোমাকে তালাক দিয়ে অন্য একটা ছেলেকে বিয়ে করেছে। আমি অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি, শোনেনি। আব্বা ওরই কারণে স্ট্রোক করেছে।
আমি মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমার মেয়েটা?
ওদের সঙ্গে আছে।
আমি কুকুরের মতো ঝিকাতলার অলিগলি খুঁজতে থাকলাম দিনরাত। কিন্তু কোথাও আমি সুরাইয়াকে পাইনি। সুরাইয়াকে পেলে আমি পায়ে ধরে মিনতি করে আমার কন্যাকে ভিক্ষা চাইতাম। কেউ যখন হারিয়ে যায় ইচ্ছে করে, তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না মামনি। দুবাই ভুলে পাগলের মতো খুঁজলাম, কিন্তু শূন্য। আমার চারপাশে শুন্য। আমার চারপাশে নিরবিছিন্ন হাহাকার। দুলাভাই দেশে এসে আমাকে বোঝালেন। বললেন, কোথায় যাবে তোর মেয়ে? একদিন না একদিন খুঁজে পাবি। কিন্তু দুবাইয়ের দোকান চলে গেলে তোর জীবনের সব চলে যাবে।
আমি দুবাই যাবো না। দুবাই যাবার কারণে আমি মেয়েকে হারিয়েছি।
তোর বড় ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের কী হবে? ওরা কী খাবে?
আমি আমার ভেতরে সহ্যের টুকরো হতে থাকলাম। বুঝতে পারলাম, আমাকে বিষ পান করতে হবে অমৃত ভেবে। চলে গেলাম দুবাই। যখনই ঢাকা আসি, আমার একটাই কাজ ঢাকা শহরের কিন্ডারগার্ডেন স্কুলের সামনে ঘোরা। ইতিমধ্যে পাঁচ ছয় বছর হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই সুরাইয়া মেয়েকে কোনো স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। কিন্তু ব্যর্থ হলাম। কোথাও পেলাম না মেয়েকে আমার। ইতিমধ্যে মেঘে মেঘে অনেক বেলা গড়িয়েছে। জুয়েল ভাইয়ের ছেলে এসএস সি পরীক্ষা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওকে দুবাই নিয়ে বাপের ব্যবসা বুঝিয়ে দিয়ে আমি বেড়িয়ে পরলাম। আমার কোনো পিছুটান নেই। ফটোগ্রাফিতে মেতে উঠলাম। ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফি সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত হলাম। আর যেখানেই যাই ফেসুবুকে আমার মেয়েটাকে খুঁজে বেড়াই…।
এতোক্ষণ নিজের মতো করে সম্মোহনের ঢংয়ে বলে গেছে আহমেদ মামুন কিন্ত আবেগ আর ধরে রাখতে পারলো না, গলা ভারী হয়ে আসে। এবং চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। জুই পাথর বনে গেছে…। কী করবে ভেবে কূল কিনারা পায় না। এতোদিনের সাজানো গোছানো জীবনটা একেবারেই পাল্টে গেলো? সামনে বসা কান্নাকাতর এই মানুষটি আমার বাবা! এতোদিন যাকে বাবা জেনেছি, সেই মানুষটি ফানুস! আমার মা….। জুই বসে আছে, চোখে কোনো জল নেই। মনের ভেতরের মন জ্বলছে দাউ দাউ…। কেনো এমন হলো? হ্যাঁ বাবা…। বাবা? হ্যাঁ বাবাইতো! শুরুতেই বলেছে, জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয়। সত্যি, আমি এখন কী করবো? কার কাছে যাবো? আমি কী মরে যাবো? আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে কেনো?
জুই, মামনি আমার! এই খামটা একটু দেখবে? হাতে ধরা সাদা খামটা বাড়িয়ে ধরে। জুই নিঃশব্দ পাখির ডানায় খামটা হাতে নেয়। খোলে, খামের ভেতর থেকে বের হয় টুকরো টুকরো বড় বড় নানা ধরনের ছবি। এক মাস থেকে এক বছরের নানা মাত্রিকতার ছবি, প্রত্যেকটা ছবিতে জুই। কোনো ছবিতে মায়ের কোলে, কোনো ছবিতে বাবার কাঁধে। বেশ কয়েকটা ছবি আছে, মা বাবার সঙ্গে জুই।
এই ছবিগুলোই আমার সারা জীবনের সম্পদ মামনি।
বুক ঠেলে কান্না উথলে উঠলে জুইয়ের, কিন্তু প্রাণপন চেষ্টায় নিজেকে সামলাচ্ছে। ছবিগুলো টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিল। মামুন ছবিগুলো ধীরে ধীরে খামে ভরে। তাকায় না জুইয়ের দিকে। জুই তাকিয়ে আছে পিতার মুখের উপর মমতা আদর আর বেদনার বিনয়ের দৃষ্টিতে। এই মানুষটি আমার বাবা! আমার বাবাটা কতো সুন্দর, হ্যান্ডস্যাম। আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে না? আদর করবে না?
তাহলে আমি যাই! দাঁড়ায় আহমেদ মামুন। কাঁধে তুলে নেয় ব্যাগ। মাথায় রাখে হ্যাড। খামটা রাখে প্যান্টের বাম পকেটে। তুমি ভালো থেকো মামনি…। গলাটা কেঁপে ওঠে মামুনের, তোমার হাতে সময় নেই। কলেজে গাড়ি আসবে আড়াইটায়। এখন বাজে দুটো। যাও…। সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে মামুন। প্রায় দরজার কাছে যায়।
বাবা! পাখির গতিতে ছুটে আসে জুই। ঝাঁপিয়ে পরে মামুনের বুকে, আমি তোমার সঙ্গে যাবো। আমি তোমার সঙ্গে যাবো…।
0 Comments