কবিতা এক অজানা পথের নাম- দীর্ঘপথ ধরে হাটতে হয় কখন কবিতা কি রুপে ধরা দিবে তা কেইবা বলতে পারেন। তবুও এই অজানা পথ ধরে হাটার নামই বুঝি কবিতা। শেষ কোথায় আমাদের কারও জানা নাই। আমরা যেমন কোথায় বা কতদূরে গিয়ে থামতে হবে জানি না তেমনি কোনটা কবিতা কিংবা কবিতা নয় তাও নির্দিষ্ট করে বলতে পারি না। জীবনের কুয়াশাচ্ছন্নতা কিংবা ধোঁয়াটেময়তায় জীবন নিয়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। নিজের কাছেও মনে হয় জীবন কি এমন হওয়ার কথা ছিল। কিংবা কোন পথেই বা চলছে জীবন। জীবনের নানা আবিরে সাজিয়ে চলে জীবন। এই জীবনের পথ ধরে উঠে আসে একজন কবির ব্যক্তিজীবন কিংবা সাংসারিক জীবনের নানা টানাপড়েন। একজন কবি সারারাত জেগে রোপে যান তার কবিতার বীজ। ঢুলু ঢুলু চোখে কম্পিউটারের বিবোর্ডে আঙ্গুল রেখে খটখট আওয়াজে লিখিত হয় আধুনিক কবিতা। কবির ধ্যান-জ্ঞানই এই পরম সাধনার ধন। একটি সমাজের চালচিত্র কিংবা ইতিহাস উঠে আসে কবিতায়। কবিতায় ধরা দেয় সমসাময়িক অবস্থান। চুপচাপ বসে কবি বুঝি সেই কবিতার আশায় ঝিম ধরে বসে থাকেন। জীবনে হয়তো বা দুই ধরনের কবি ও কবিতা লিখিত হয়। এক ধরনের কবিতা পঠন বা পাঠনের সহায়তায় লিখিত হয় এবং অন্যটি বাস্তবতার উপলব্ধিত জ্ঞান দ্বারা লিখিত হয়। যেমন ত্রিশের কবিদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু কিংবা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ইউরোপিও সাহিত্য কিংবা দর্শনকে আত্মস্থ করে কবিতা লিখেছিলেন। জীবনমুখি কবিতার জন্য লাগে বাস্তবতা। আর বাস্তবতা বা নিজের জীবনের অর্জিত জ্ঞানই তো জন্ম দেয় জীবনমুখি কবিতা।
আশির দশকের কবিতা লেখাটা ধরনটা একটু অন্যদিকে রুপ নেয়—এই সময়টাকে বলা হয় সত্তরের সম্প্রসারিত রুপ। কবিরা নানা প্রকরণ নিয়ে এই সময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার করেছেন বলেও অনেকে তাদের অভিহিত ব্যক্ত করেছেন। তবে আবার অনেকে বলার চেষ্টাও করেছেন যে এসময় কবিতা তাদের প্রকোষ্ট থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছে। নিজেরা নিজেদের কবিতাকে করে তুলেছেন নানা আঙ্গিকতায়—যা এক একজন এই মাধ্যমকে বেচে নিয়ে ছুঁটে চলেছেন টাট্টুর পিছু পিছু—এসময়ের কবিদের মধ্যে প্রেম ভালোবাসা যেমন জাগ্রত হয়েছে তেমনই আধ্যাত্মিকতাও মাথা চারা দিয়ে উঠেছে যা আমরা পরবর্তীকালেও তাদের মধ্যে সমানতালে জাগ্রত থাকতে দেখেছি। কবি মজিদ মাহমুদ (১৯৬৬) মধ্য আশির এক মেধাবি কবির নাম। তার প্রথম প্রকাশ কিশোর কবিতা দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীতে অর্থাৎ ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হচ্ছে মাহফুজামঙ্গল। যা বাংলাদেশের কাব্যধারাকেই এক অন্যমাত্রা দান করেছে। তিনি তার এই কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে আমাদের জানান দিলেন পাঠকদের আবিষ্ট করে রাখার কৌশল। এই কাব্যগ্রন্থ এখনও পাঠকদের মন্ত্রের মত টানে। সুদীর্ঘ ৩৩ বছরের ব্যবধানে অর্থ্যাৎ প্রথম পূর্ণাঙ্গ কবিতার বই প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে এবং শেষ কবিতার বই প্রকাশিত হয় ২০২২ সালে নাম শ্রী শ্রী সন্ন্যাসীতলা। ঠিক একই ভাবধারা কিংবা সুফিজমের পথ ধরে কবি তাকে মেলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। যিনি তার কবিতায় বলেন—শরীর থেকে পাখিগুলো উড়ে যাক... শরীরের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সেই প্রাণ ভোমরা যে চোখের নিমেশেই হারিয়ে যায়। এই অসাড় শরীরের তখন কি আর মূল্যই থাকে। কবি এই কবিতায় যেন অতি সহজ সরল-ভাষায় অধিক কথা বোঝাতে চেয়েছেন। মৃত্যুচেতনা বা আধ্যাত্মিকচেতনা এই ৫৭ বছর বয়সে এসে কবির মধ্যে প্রকট রুপে ধরা দিয়েছে। যে কারণে কবি সাঁইরুপি সেই আলামপনার কথা বারবার বলার চেস্টা করেছেন। তবু আমরা এই মৃত্যুর কথা জেনেও প্রতিনিয়ত নিজের সাথে নিজে মিথ্যার ছলাকলায় মাতি-এই দুনিয়া-দারীর। আসলে বাস্তবিক অর্থে কিইবা মূল্য আছে। সবকিছু একদিন শিমুলের তুলার মত বাতাসে উড়বে-শোন ক্ষমতালোভী ধনিক মহাজন/ফুঁৎকারে দেখ উড়ছে তোমার ধন। (কিয়ামত)
একদিন যত ধনদৌলতের মালিকই থাকি না কেনো সব ধ্বংস হবে। সেদিন এই সম্পত্তি কোন কাজেই লাগবে না। তাদেরকেই কবি সাবধানতার বাণী শুনিয়েছেন। এই ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনা কবিকে যেন আরো বেশি গতিশীল করে তুলেছে- অনেকে এসব কথা অনেকভাবে বলেছেন কিন্তু কবিতায় এভাবে বলেছেন বলে আমার জানা নাই। অন্য কোন প্রসঙ্গও কবি আনতে পারতেন কিন্তু আনলেন আমাদের নিত্যদিনের ক্ষমতার বাহাদুরী বা যা নিয়ে আমরা নিজেদের মহারাজা-ধিরাজ মনে করে থাকি সে সব নিয়েই কবি সবাইকে সচেতন করে তুলেছেন। তিনি আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন মানুষের পরানপাখি যতক্ষণ আছে ততক্ষণ একটা মানুষের অহং জারি থাকে প্রাণপাখি উড়াল দিলে নিথর দেহের থাকে না কোন দাম...
১.
এত এত মরা মানুষের সাথে থাকি বলেই কি আমার মরে যেতে ভয়...
এখানে মৃতরাই বহন করছে মৃতদের কফিন। (মৃতদের রাজ্যে)
২.
তুমি তো মৃতদের দেহে থাক না
জীবন সৃষ্টির কালে তুমি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলে। (মৃতদের সাথে থেকো না)
কবি এক সংশয়াপন্ন জীবন-যাপন করছেন—যেখানে কোন পরিপূর্ণতা নেই। এই জীবনেই কবি ব্যয় করে চলেছেন তবুও তিনি কোন কিছু পাননি। কোন কালেও তিনি স্বাধীন ছিলেন না। কবি নিজেকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন নিজের খোলস থেকে- বের করতে চান নিজের ভিতর থেকে নিজেকে। কবির কাছে সাধনা থেকে বিচ্ছুরণ মানে নিজের কাছে নিজেরই মৃত্যু। এই অকাল মৃত্যুর কোন মানে হয় না। কবির আজ মৃত্যুর কাছাকাছি থাকতে থাকতে মৃত্যু ভয় দূরভূত হয়েছে।
পরিপূর্ণ সুখ আমি কোনোদিন পাইনি
যদিও আমি একটি মানব জীবনই পার করছি
তবুও আমার অনুভূতিগুলো কখনো স্বাধীন ছিল না। (বিভ্রান্ত রেখা)
গ্রাম-গঞ্জে একসময় বিশাল বটগাছের তলে বাজার বসত। সেখানে নানা লোকের আনাগোনা ঘটত। আসলে আমি এখনও সঠিকভাবে আবিষ্কার করতে পারিনি কেনো বটগাছের তলেই কালিমন্দির গড়ে ওঠে। এই কালিমন্দিরগুলোতে দেখেছি সেখানে কালি থাকত তার গলায় শোভাপেত মানুষের মাথার মালা আর তার অনেকগুলো হাতে থাকত তলোয়ার। সে সামনে যাকে পেত তাকেই হত্যা করত আর তার পায়ের নিচেয় নিজের স্বামী পড়ে যাওয়াই সে তখন তার রাঙা জিহবা বের করে ফেলে। কবি মজিদ মাহমুদের শ্রী শ্রী সন্ন্যাসীতলা নাম কবিতাটা পড়তে গিয়ে ঠিক সেই চিত্রটাই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে।
যেখানে বসেছিল সাপ্তাহিক হাট
সম্মুখে ছিল ভুবনডাঙার মাঠ...
মানুষের থাকিবার সাধ তবু এইখানে
থেমে যায় মৃতদের গানে। (শ্রী শ্রী সন্ন্যাসীতলা)
কবি মজিদ মাহমুদের কবিতা যেন হঠাৎ আলোর ঝলকানি আমাদের মনকে ভরিয়ে দেয় জাগিয়ে তোলে ঘুম থেকে । এ যেন এক মন্ত্রের মতো আমাদের ভাবিত করে। এই শ্রী শ্রী সন্ন্যাসীতলা কাব্যগ্রন্থের সব কবিতায় প্রায় এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে লিখিত হয়েছে। যে সময়টা পৃথিবী এক ভয়ংকর রুপধারণ করে আছে যেখানে পিতা-মাতার সম্পর্কটাও যেন কেমন হয়ে গেছে। একজন অন্যজন হতে দূরে যেতে পারলেই বাঁচে। সেই সময়ে কবিও একাকিত্বের জীবন-যাপন করেছেন এমন কী নিজেকে বারংবার অন্যের আসনে আসীন করে দেখতে চেয়েছেন কতটা নিষ্ঠুর জীবন যাপন করছি আমরা। এখানে আবার অনেকে এই সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ও মেতে উঠেছে। তবু বলতে পারি কবি মজিদ মাহমুদের কবিতা ইন্দ্রিয় তৃপ্তি দেয়, তার কবিতা চেতনাকে জাগ্রত করে বোধিলাভে ফলবান করে তোলে।
১.
যারা বলে একাকীত্ব তাদের উপভোগ্য-তারা ঈশ্বরের মতো ভয়ঙ্কর এক
আমারই মতো তোমরাও একদিন একা হতে হতে পেয়ে যাবে তার দেখা। (একাকীত্ব)
২.
মা-পিতা-ভাই-বোন শিক্ষক আত্মীয় স্বজন
যাদের অস্থিতে গজিয়েছে ঘাস
তারা আজ করে পরিহাস। (পরিহাস)
আমরা আজ মৃতদের রাজ্যে বসবাস করি। সবাই বোবার মত জীবন যাপন করছি। এখানে প্রতিবাদের ভাষা জানা নেই। কেননা একসময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করত কবি-সাহিত্যিকেরা আজ আর তাদের কণ্ঠে বিদ্রোহের কবিতা আসে না। তারা আজ কোন না কোন পক্ষের চামচামিতে নিজেকে নিয়োগ দিয়েছেন। মৃতের মত চেয়ে পড়ে থাকা ছাড়া আর আমাদের কিছু করার নেই। প্রতিবাদ করলেই পরিবার নেই হয়ে যাবে—হারিয়ে যাবে নিজের জীবন পাখিটিও। তো এই বেশ ভালো আছি।
মায়ের জরায়ু যদিও আমার প্রথম পছন্দ, তবু
পিতারাও বুঝে নিল তার অর্ধেক অংশ
একটি কোষ, অথচ বিভক্ত ছিল দুইটি ভাগে...
সবাই এ মহাবিশ্বে একাকী ঈশ্বরের সঙ্গী। (উল্টো রথে)
কোন নারীই নিজেকে এককভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে প্রদর্শিত করতে পারেন না। এর জন্য একজন পুরুষকেও নিজের সাথে দাঁড় করাতে হবে। অনুরুপভাবে একজন পুরুষও সম্পূর্ণভাবে মেলে ধরতে পারেন না নারী ছাড়া। আমরা একে অন্যের ছাড়া খণ্ডিত ছাড়া আর কিছুই না। স্বয়ং মানুষ হতে হলে দুজনেরই প্রয়োজন রয়েছে। তবেই পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারব। এই পূর্ণ মানুষের মিলনেই তো জন্ম হয় অন্য মানুষের। তখনই আসে স্বার্থকতা।
শীতের পাখিরা ডানা ঝাপটায়, শূন্যতা আর কতক্ষণ।...
যদিও সঙ্গীত যাবে থেমে অকস্মাৎ ফুরাবে ব্যর্থ আয়োজনে
তবুও থাকবে পৃথিবীর ধূলিকণা-পড়ন্ত নক্ষত্রের গানে। (হেমন্ত চলে গেছে)
কবি মজিদ মাহমুদের বড় গুণ তিনি আটপৌরে শব্দকে কবিতায় ব্যবহার করে আবার তা আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারেন। কবি এখানে একটি সামান্য ঘড়িকে কি অসামান্য উপমা হিসেবে ব্যবহার করার প্রয়াস পেয়েছেন। বাস্তবসত্য এই যে কবির জীবন আজ জীবন নেই আজ তিনি জীবন্ত লাশ। কেননা তিনি মনে করেন আমরা সবাই জীবিতর বদলে মৃতদের সংসারে বসবাস করছি। কারণ জীবিত মানুষের যে সাড়াশব্দ থাকে এখানে তো কোন সাড়া শব্দ নাই।
একটি নগ্ন লাশ হয়ে আমিও সবার সম্মুখে
ঠাণ্ডা মেঝের উপরে শুয়ে রইলাম। (ঘড়ি)
‘দুঃখকে, বিচ্ছেদকে, প্রতীক্ষাকে যে উৎসবে পরিণত করতে পারে সে’ই সুফী। এখানে একটা কথা বলতেই হয়—তামাম দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ঘটনা ঈশ্বরের মানুষ আবিষ্কার, অথবা অন্যভাবে, মানুষের ঈশ্বর উদঘাটন। ঈশ্বরও নিজের চেহারা প্রত্যক্ষ করতে চান তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। কারণ আমরা জানি—পরমাত্মা এবং জীবাত্মা সর্বদা মিলিত হওয়ার জন্ম উন্মুক হয়ে থাকেন। আর মিলিত হতে পারলেই তো তারা একে অপরের মধ্যে লীন হয়ে যান। আল্লার ধন রসুলে দিয়া আল্লাহ গেল গায়েব হইয়া। যে ঈশ্বর দেহে জন্মায় না, তার আর মূল্য কি? নিজেকে অন্যের মধ্যে লীন করে দিলে বা প্রেমে মাতায়ারা করলে তখন আর সে নিজেকে নিয়ে ভাবেন না।’ কবির চেতনা জগৎ আজ নানা চিন্তায় জরজরিত। এই সত্তা দুটি অংশে বিভক্ত। এই সত্তা দুটির একটি ‘আমি’ অন্যটি ‘তুমি’।
তুমি আর আমি মিলেই এই সম্পূর্ণ গোলক। (মহাপ্রলয় শেষে)
পৃথিবীতে সর্বদা ক্ষমতাশালীদের কুক্ষিগত হয়েছে। সব ক্ষমতাকেই তারা নিজেদের দক্ষলে রাখতে চেয়েছেন। তাই শাদা কালো, পুরুষ-নারীর উপরে তার ক্ষমতাকে প্রয়োগ করেছেন। শোষণ করে নিজের আসনকে আরো পরিপক্ক করতে চেয়েছেন এই ক্ষমতাবানেরা। এই রীতি আজকের নয়—দীর্ঘ দিন থেকেই এই ক্ষমতার বাহাদুরী চলমান। পৃথিবীতে আমরা যা কিছুই দেখি না কেনো সবকিছুর মূলেই রয়েছে ক্ষমতা। যে কারণে কবি বলতে পারেন—
শাদা সর্বদা কালোর উপর
পুরুষ সর্বদা নারীর উপর
ধনী সর্বদা গরীবের উপর দেখাতো পোদ্দারি
ঈশ্বর নিয়েও তাদের মধ্যে ছিল ভাগাভাগি
অনেক রক্তপাত ঘটেছে তার মালিকানার দাবি নিয়ে
উপাসনালয় গুলো ক্ষমতা প্রকাশের উপায়... (মহাপ্রলয় শেষে)
এখন আর উচ্চারণ করে বা শব্দ করে ইবাদত করার সময় না। এখন নিরবে নির্জতায় সন্ন্যাস জীবন-যাপনের মধ্য দিয়েই সেই বিধাতাপুরুষের সন্ধ্যা করার পালা। চারিদিকে এখন মৃত্যুর ঘনঘটা হলেও সবাই নিজের জীবন বাঁচানোর বাসনায় বিধাতার দ্বারে নিজের হাত তুলে তার শুকুর গোজার করেন।
১.
আমি আর প্রার্থনা করব না—শব্দে ও উচ্চারণে...
অদৃশ্য ধূলায় আজ পেতেছি প্রার্থনার সংসার। (নির্জন প্রার্থনা)
২.
আমার যাত্রার পথ যেহেতু অনির্ণিত তোমার ইচ্ছার অধীন...
অবশ্য যেখানেই গেছি রুপান্তরের কষ্ট শরীরে পেয়েছি টের
তবু তোমাকেই মাতৃরুপে পুত্র ও কন্যা রুপে ফের। (তোমার লাসভেগাস)
কবি মজিদ মাহমুদ তার কবিতায় বলছেন—মিলন ততটা শারীরিক নয় যতটা মনে। আসলে বাস্তবিক অর্থে আমাদের সম্পর্কটা আজ শারীরিক সম্পর্কে এসে দাঁড়িয়েছে। ভালোবাসা মানেই আমরা মনে করি কে কত তাড়া তাড়ি বিছানাসঙ্গী করে তুলতে পারি এবং নিজের পুরাতন সঙ্গীকে বাদ দিয়ে নতুন সঙ্গীর যোগাড় করে নিতে পারি আসলে এটার মধ্যে কোন প্রেম-ভালোবাসা থাকে না। এখানে থাকে কাম আর শারীরিক অনুষঙ্গ এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ থাকার কথা না। কিন্তু সুফিজমের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাব যে এখানে প্রেম পাবার জন্য সবাই ব্যাকুল থাকে। যেখানে প্রেম মুখ্য কাম গৌণ হিসেবেই প্রকাশিত হয়। এক সময় তারা প্রেমে মাতয়ারা হতে থাকে সেখানে কোন কাম থাকে না—থাকে প্রেম আর প্রেম যে প্রেমের বাসনা থাকে আমি আর তুমির লীন। দুই সত্তা এক সত্তাই রুপান্তর। কিন্তু আজ যে যত ছলাকলা করে টিকে থাকতে পারে। ছলাকলা বন্ধ করলে তো মরলে সত্যটা বললেই প্রেমিকা হারানোর সম্ভাবনা শতভাগ।
মিলন ততটা শারীরিক নয় যতটা মনে
এই পৃথিবী নয় প্রেমিকের উপযুক্ত স্থান
ছলনার ঘাটতি হলে যারে তুমি ভালোবাসো
সেও তোমারে দেবে অসহ্য অপমার। (অপেক্ষা)
কবি তার বিধাতাপুরুষকে মেনে নিয়ে সবকিছুই করছেন আবার মাঝে মাঝে তার প্রতি সংশয় প্রোষণ করছেন। আসলেই কি তিনি আছেন? এই সব সংশয়ের জন্য কবি দ্বিধার ঘরে বসবাস করছেন। বিশ্বাসের ক্ষমতা দিলে আবার অবিশ্বাসের ক্ষমতা দিলে কেনো? অবিশ্বাসের ক্ষমতা না দিলে তো আমরা কেউ তাকে অবিশ্বাস করতে পারতাম না।
১.
কেন তুমি দিয়েছিলে তোমায় অবিশ্বাসের ক্ষমতা, সংশয় (তুমি আছ)
২.
আমাদের মা আগেই মরেছে
তাই শুনতে পাইনি পদ্মাপাড়ের মায়ের কান্না। (নদীর কান্না)
পৃথিবীতে কেউ কোনদিন খারাপ হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। এই পৃথিবীতে এসেই তারা নানা কাজ বা পেশায় জড়িয়ে যায়। আমরাই তাকে বেশ্যা বানায় আবার আমরাই তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তার বিচার করার জন্য উদ্বিগ্ন হই। এই পৃথিবীতে তবুও বিচিত্র মানুষের চাষাবাদ হচ্ছে দিনকেদিন।
তবু তারা কেউ বেশ্যা ভবঘুরে দালাল ভিক্ষুক
কারো বাবা মারা গেছে জন্মের আগে
কারো বোন নিয়ে গেছে বেগুনবাড়ি বস্তিতে। (বিচিত্র জীবন)
কবি মজিদ মাহমুদের এই কবিতাগুলো যেন আমাদের সাধনাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাই তাই বলতে হয় এই কবিতা যেন আমাদের জীবনবোধের কবিতা, ধ্যানের কবিতা। একই সাথে এই কবিতা স্তব্ধতার কবিতাও বটে। এই কবিতা আমাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করে। কবি এই কবিতার মাধ্যমে গুরু-শিষ্যের মধ্যকার ভেদেরও পরিসমাপ্তি ঘটান। আর দূরে বসে ঋষি কিংবা সাধক আমাদের নিজের অজান্তেই তার সুস্পষ্ট সাধনবাণী দ্বারা আমাদের মোহবিষ্ট করে শুধুই তার দিকে টানছেন... শুধুই টানছেন।
0 Comments