হাঁস-মুখরিত দিন শেষ । পৃথিবী এখন ভিনদেশি পাখিদের গুঞ্জন সরিয়ে বৈষ্ণবীধ্যানে মগ্ন। ধীর পাণ্ডুলিপির মতো আকাশে দু'একটি নক্ষত্র স্তনভারে ফুটে উঠছে। আমার মিতবাক ছায়ার সংসার ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে আধোনীল বিছানায় । স্তব্ধ জানালার ওপারে নিঃসঙ্গ অন্ধকার। হাওয়ায় হাওয়ায় পাগল করা বুনোফুলের গন্ধ ,সেই তীব্র গন্ধে লুঠ হওয়ার আগে শেষবারের মতো উঠে আসি আমার কবিতার পাশে। একি! কবিতাটি হঠাৎ তার সমস্ত পোশাক খসিয়ে একেবারে নগ্ন পুরুষ শবর! পুরুষ্ঠ ওষ্ঠ চুঁইয়ে গড়িয়ে পড়ছে চুম্বন-কণা। তার আকাশের মতো বিস্তৃত বক্ষে শব্দের উল্লাস, লম্বা হোগলা ফুলের মতো দুলে উঠছে শিশ্ন। প্রতিটি দাঁড়ি, কমা, চিহ্ন পা টিপে টিপে চলে যাচ্ছে আদিম উৎসের দিকে। তামাটে পঙক্তির জাদুটানে সেই কবিতা পুরুষের লোমশ ডান ঊরু শিল্পের ভিতর থেকে জেগে উঠছে এক অলিখিত পথ। কোনো কিছু না ভেবেই সেই পথে নেমে গেলাম ...
সেই পথের একপাশে অমৃত ধ্বনির শব্দে বয়ে চলেছে এক স্বচ্ছতোয়া নদী। নদীর জলচিত্রে ভেসে চলেছে পরচর্চার ভাষা, সাঁতার কাটছে অজস্র রূপালী দেহের মাছ, যাদের আঁশগন্ধের ফোয়ারায় ডুব মারছেঝাঁক ঝাঁক শিকারব্রতী মাছরাঙা। একটা দুটো চঞ্চল ডিঙি নৌকা চাঁদের গ্রীবা অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছে রাত্রির নিঃস্বময়তার দিকে। পথের অন্য পাশে স্বপ্নব্যাখ্যাকারী এক নৈমিষ অরণ্যের হাতছানি। আমি ভুল নুড়িপথ বেয়ে ঢুকে পড়িসেই সবুজসমগ্রের ভিতর। কেমন যেন একটা ছমছমে বন্যসুঘ্রাণ চারিদিকে। পশুপাখি সব ঘুমের আশ্রয়ে। একটু এগোতেই দেখি একটি তরুণ ময়ূর পেখম হারিয়ে শব্দের গুহার সামনে অবিরাম ডানা ঝাপটে চলেছে। তার সামনে পড়ে আছে কুণ্ডলী পাকানো একটি ভাষাহীন বিষধর সাপ।
আমি সামনে এসে পড়াতে সেই ময়ূর অত্যন্ত কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, কে তুমি ? জানোনা এ চন্দ্রদগ্ধ পথে মানুষের হাঁটা বারণ।
-আমি পথভ্রষ্ট এক কবি ।
আমার কথায় সেই ময়ূর হাসতে হাসতে হয়ে পড়ে ধূসর বর্ণ নেউল। আর তার হাসির শব্দে পথের অন্যপাশে বয়ে যাওয়া নদীটি তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে আমার পায়ের কাছে এসে, নিদ্রায় ঝুঁকে থাকা অরণ্য জেগে ওঠে ব্যথাতুর চোখে। ঘুমচক্র ছেড়ে পাখিরা সব ডানা ঝাপটাতে শুরু করে। হরিণ পাড়ায় হরিণশাবকরা জুড়ে দেয় পৌরাণিক কান্না। এমন বিস্ময়কর দৃশ্যে আমি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ফিরে আসার জন্য পা বাড়াতেই অসম্ভব দ্রুত গতিতে হরপ্পাযুগের ওপার থেকে এক প্রাচীন ঘোড়া আমার পথ রোধ করে এসে দাঁড়ায়। সেই ঘোড়ার পিঠে বসে আছে আশ্চর্য এক কাচদেহের পুরুষ।
সেই পুরুষ অত্যন্ত জলদগম্ভীর স্বরে বলে ওঠে -কেন, কেন সবার ঘুম ভাঙালে? কেন এই অরণ্যে প্রবেশ করেছ? আমাকে চুপ থাকতে দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ স্বরে বলে ওঠে -তুমি কি জানো এই অরণ্যের নৈঃশব্দ্য থেমে আছে ঘুমন্ত এক অন্ধ পাখির ডানায়? সেই পাখি জেগে উঠলেই শুরু হবে মহাঅশান্তি, ফেটে পড়বে অরণ্যের কৌমার্য, দুরন্ত যা কিছু সব জেগে উঠবে, সমস্ত তরুণ ময়ূর হয়ে পড়বে ধূসর নেউল, আর শব্দহীন সাপ হয়ে উঠবে বিষাক্ত নীলপদ্ম, যার ঘ্রাণেমড়ক লেগে যাবে এই অরণ্যে। শুনতে পাচ্ছো এর মধ্যেই নক্ষত্রের আর্তনাদ উঠছে... তোমার কারণে আজ থেমে গেছে পিঁপড়ের গান, শুরু হতে চলেছে মহাপ্রলয়। তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে। এমনিতে তুমি মানবী তার উপর কবি! না আর মানতে পারছি না, শাস্তি পেতেই হবে।
মুহুর্তে সেই কাচপুরুষ তার দীপ্র আঙুল নেড়ে কিসব ধ্বনির সৃষ্টি করল, সাথে সাথে আমাকে ঘিরে ধরে মহানিসর্গের কুয়াশা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রাচীন ঘোড়াটি আমাকে পিঠে নিয়ে ছুটে চলে শব্দহীন এক সমাধিস্বপ্নের দিকে। আমি শুয়ে আছি অশ্বপিঠে, দেহে ঠেকছে কাচপুরুষের শীতল ঊরুদ্বয়। পাশে পাশে ছুটে চলেছে অসংখ্য স্বপ্নের মূর্তি, যাদের শরীর ঘিরে মৃত গোলাপের ঘ্রাণ। তাদের চোখ থেকে ঝরে পড়ছে কাম, ক্রোধ, ভালোবাসা। তাদের মুখের ছায়ায় জমে উঠছে মুদ্রিত পঙক্তির মতো কৌতুক। একসময় হঠাৎ ঘোড়াটি আমাকে নিয়ে অসীম একখাঁ খাঁ প্রান্তরের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর খুব যতনে কাচপুরুষ আমাকে সেই প্রান্তরের মাঝে নামিয়ে দেয়, তারপর অত্যন্ত শান্তকণ্ঠে বলে -এই তোমার অক্ষরভূমি, এই তোমার নির্বাণ তীর্থ। এই নির্বাসনক্ষেত্রে তুমি যুগ যুগ ধরে যত ইচ্ছে কবিতা লিখে যাও, এটাই তোমার শাস্তি।
কথাগুলো বলতে বলতে কাচপুরুষ ও সেই সব স্বপ্নমূর্তি হাওয়ার শরীরে মিশে যেতে থাকে আর হরপ্পাযুগের ঘোড়াটি ধুলো উড়িয়ে হারিয়ে যেতে থাকে আধো সাদা জোছনা প্রান্তরের বাঁকে। সেই থেকে আমি এই প্রান্তরে একা একা বসে কবিতা লিখি মাটির রোমাঞ্চে, যখন খুব একা লাগে আমার কবিতাপুরুষের সাথে লিপ্ত হই শব্দসঙ্গমে ।যতবার ধ্বনি মৈথুনে ভেসে যাই দূর বহুদূর থেকে শুনতে পাই নৈমিষ অরণ্যের ডাক...
0 Comments