‘সহরবাসের ইতিকথা’ (১৯৪২) এবং ‘ইতিকথার পরের কথা’ (১৯৫২) উপন্যাস দুটির রচনাকালের পার্থক্য ছিল বছর দশেকের কাছাকাছি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৮-১৯৫৬) উপন্যাসের সংখ্যা হিসেবে এ দুটির ক্রমিক যথাক্রমে ত্রয়োদশ ও ত্রয়োবিংশ। অর্থাৎ এ দুটি রচনার মাঝখানে আরো গোটা আষ্টেক উপন্যাস এবং অসংখ্য ছোটগল্প লিখেছিলেন এই রূপদক্ষ কথাশিল্পী। সে যা-ই হোক, বর্তমান আলোচনাটি উপর্যুক্ত দুটি উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থকবে। তার মানে এই নয়, এ রচনায় কেবল এ দুটি উপন্যাসের তুলনামূলক আলোচনা করা হবে। তুলনা যতটুকু আসবে, সময় ও ঘটনার প্রয়োজনে—মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর চরিত্র ও ঘটনাপ্রবাহকে কিভাবে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন তার আলোকে। সমকালে আর পাঁচজন ঔপন্যাসিক থেকে মানিকের আলাদা হবার অন্যতম কারণ, তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা। রাজনীতি ও মানবপ্রবৃত্তিকে কেন্দ্রে স্থাপন করে মানিক তাঁর চরিত্রসমূহকে বিন্যাস করতে সচেষ্ট ছিলেন। শিল্পের এসথেটিকস বিচারে এটি ভালো না মন্দ সে হিসেব আলাদা। কিন্তু মানিক তাঁর ইচ্ছের উপর ষোলআনা প্রভুত্ব করে চিন্তাশীল পাঠকের সহমর্মিতা আদায় করতে পেরেছিলেন। তবে এ রচনার ক্ষেত্রে একটি কৈফিয়ত থেকে যায়, মানিক মূল্যায়নের পক্ষে আমি কেন এ উপন্যাসদ্বয়কে বেছে নিলাম? কারণ, এ দাবি করা ঠিক হবে না যে, ‘পদ্মানদীর মাঝি’ ও ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র রচয়িতার জন্য এ দুটি শ্রেষ্ঠ রচনা। কিন্তু সমগ্র মানিক মূল্যায়নে তার যে কোনো তুচ্ছ রচনাও উপেক্ষণীয় নয়। তাছাড়া এ উপন্যাস দুটি তাঁর লেখক জীবনের পরিণতপর্বে যেমন লিখিত তেমন ভারত-বিভাগের আগে এবং পরে তাঁর রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণাও এতে সম্যকভাবে প্রতিফলিত। এ দুটি উপন্যাস মানিক-মানস পুনর্গঠনে সহায়ক বলে বিবেচনা করা যায়। তাছাড়া মানিকের শিল্পরূপ আলোচনার ক্ষেত্রে এ দুটি উপন্যাস উপেক্ষিত থেকেছে বরাবর।
শুরুতে উপন্যাস দুটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া যাক। ‘সহরবাসের ইতিকথা’র প্রথম আত্মপ্রকাশ শারদীয় আনন্দ বাজার পত্রিকায় ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে। এর প্রায় বছর চারেক পরে ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ডিএম লাইব্রেরি এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশকালে মানিক ‘লেখকের কথা’ নামে একটি লম্বা ভূমিকা জুড়ে দেন এতে। কয়েকটি চরিত্র কিছুটা সংশোধন করেন। তাঁর বিবেচনায় সংশোধিত চরিত্রগুলোর বিকাশ প্রথম সংস্করণে যথাযথ ছিল না। সংশোধনের পরেও চরিত্র বিকাশ যথাযথ হয়েছিল কিনা প্রসঙ্গান্তরে দুএকটি কথা বলা যেতে পারে।
এ উপন্যাসের বিষয় হিসেবে এসেছে গ্রামীণ ও শহর জীবনের দ্বন্দ্বযা মানিক উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘ইতিকথার পরের কথা’তেও আমরা এই সংঘাত দেখতে পাব। তার আগে ‘সহরবাসের ইতিকথা’র কাহিনি-সংক্ষেপ বলে নেয়া ভালো।
এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মনোমোহন। প্রায় সর্বত্র মোহন বলে পরিচিত। তাকে কেন্দ্র করেই এ উপন্যাসের আখ্যান রচিত। গ্রামীণ উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা মারা যাওয়ার পর সপরিবারে শহরে চলে আসে। শহর মানে কোলকাতা। স্ত্রী লাবণ্য, মা ও ভাই নগেনকে নিয়ে সে শহরের একটি দামী বাসায় ওঠে। তার সঙ্গে আসে গ্রাম সম্পর্কের পালিত কর্মকার শ্রীহরি আর ব্রাহ্মণ পরজীবী পীতাম্বর। পড়াশুনা সুবাদে কলকাতায় আগেই কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল মনোমোহনের। তাদের মধ্যে চিন্ময় ও তার স্ত্রী সন্ধ্যা উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া তার বাড়িওয়ালা জগন্ময়, চিন্ময়ের বোন ঝরনা, বারবণিতা দুর্গা, চম্পা ও বাড়ির চাকর জ্যোতিকে নিয়ে এ উপন্যাসের কাহিনি বিস্তৃত। জটিল কোনো ক্লাইমেক্স এ উপন্যাসের কাহিনি নিয়ন্ত্রণ করেনি। গ্রামীণ পুঁজির শহুরে প্রকাশ, গ্রাম শহরের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব, মা ছেলের স্বার্থের দ্বন্দ্ব, শহুরে প্রেম ও যৌনতা এ উপন্যাসের কাহিনিকে গতি দিয়েছে।
‘ইতিকথার পরের কথা’ লেখকের তেইশতম উপন্যাস। ‘নতুন সাহিত্য’ নামে একটি মাসিক পত্রিকায় উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালেমানিকের মৃত্যুর মাত্র বছর চারেক আগে।
জমিদার জগদীশের পুত্র শুভময় এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেও বহুমুখী চরিত্র ও সম্পর্কের দ্বারা এ উপন্যাসের কাহিনি নিয়ন্ত্রিত। উচ্চ শিক্ষায় বিলাত ফেরত শুভময় ওরফে শুভ দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে শিল্পকারখানা করতে চায়। তার বিশ্বাস সদ্য-স্বাধীন দেশের উন্নয়নের অর্থ দেশকে নতুন ও টেকসই শিল্প-কারখানায় সমৃদ্ধ করে তোলা। কারখানা গড়ে তোলা ছাড়া ব্যাপকভাবে কর্ম সংস্থানের বিকল্প নেই। কিন্তু কারখানার ধরন কি হবে শুভ তা জানে না। দেশী মিশেল ছাড়া বিলাতি বিদ্যা কাজে আসে না। তাই চিন্তা ও কর্মসহায়ক হিসেবে সে গ্রামের ডাক্তার নন্দ কর্মকারকে বেছে নেয়। আর আসে কৈলাস। শুভ, নন্দ ও কৈলাস এই ত্রিবেনী সংগমে এ উপন্যাসের কাহিনি ঘনীভূত হয়। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় লক্ষ্মী, গাঁদা ও মায়ার মতো বির্যবতী নারী।
এ উপন্যাসের প্রধান দ্বন্দ্ব সামন্ততান্ত্রিক রক্তের উত্তরাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের কাছে শুভময়ের আস্থা অর্জনের আকাক্সক্ষা। অত্যাচারী জমিদার জগদীশের পুত্র শুভময় কি করে অত্যাচারীত গরীব দুখীর কথা ভাবতে পারেএটি গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না। আর শুভর পিতাই বা কেন বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত জমিদারীর অহংকার ছেড়ে শুভর খামখেয়ালি মেনে নেবে? এছাড়া নারী পুরুষের যৌনতাবাহিত মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা এ উপন্যাসের কাহিনি বিস্তারে গতি এনেছে। শেষ পর্যন্ত শুভময়ের পিতার সঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক বন্ধন অতিক্রম করার মধ্য দিয়ে এ উপন্যাসের পরিসমাপ্তি।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে কোনো উপন্যাসের মূল্য নির্ধারণে একটি প্রধান সমস্যতাঁর সম্বন্ধে কর্তৃত্বশীল প্রচল ধারণা। ধরে নেয়া হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখক জীবনের শুরুতে মানব জীবনের চালিকাশক্তি হিসেবে দেখেছেন নারী পুরুষের সম্পর্কজনিত মিলনাক্সক্ষা। এ ব্যাপারে ফ্রয়েডের প্রকল্প অনুযায়ী অবচেতন মনের কারসাজি তার উপন্যসের চরিত্রসমূহকে ঘেরাটোপের মধ্যে বন্দি করে রেখেছিল। আর মার্কসবাদে দীক্ষিত হবার পরে সামাজিক স্তরসমূহকে তিনি দেখেছেন শোষক আর শোষিতের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এ ধরনের হাইপোথিসিস সত্য হলেও লেখক সম্বন্ধে পাক-ধারণা শিল্পবিচারে অন্তরায়। মার্কস ও ফ্রয়েডীয় বিজ্ঞান বিকাশের ফলে মানুষের আচরণ ও সমাজ কাঠামোর এমন অনেক রসায়ন আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়েছে যা আগে সম্ভব ছিল না। কিন্তু মার্কসীয়-ফ্রয়েডীয় চেতনা বিকাশের আগে কিংবা পরে যে সব লেখক এ ধরনের সূত্রে দীক্ষিত না হয়েও শিল্পসৃষ্টি করেছেন- তাদের রচনায়ও উপর্যুক্ত আচরণ ও সমাজবিদ্যা দুর্লক্ষ্য নয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমকালীন আরো দুই বন্দ্যোপাধ্যায়বিভূতি ও তারাশঙ্করের ক্ষেত্রেও কি একই ধরনের পাঠ নির্ণয় সম্ভব নয়? অথচ বিষয়ে-বর্ণনায় তারা কতই না আলাদা।
আসলে ‘সহরবাসের ইতিকথা’ এবং ‘ইতিকথার পরের কথা’ উপন্যাসদ্বয়ের আলোচনার ক্ষেত্রে প্রচলপাঠকে মান্য রেখে উপনিবেশিক তথা সমকালীন ব্রিটিশ পুঁজির সম্পর্কের প্রতি বেশি দৃষ্টি দেয়া এ রচনার লক্ষ্য হতে পারে। কারণ লিবিডো এবং ধনাকাক্সক্ষা মানুষের আদিম এবং অকৃত্রিম প্রবৃত্তি। কিন্তু ইতিহাসের কালে এ দুটি মহাস্ত্র বিভিন্ন রূপ ও মর্যাদায় ব্যবহৃত হয়েছে। আমরা দুটি উপন্যাসেই লক্ষ্য করেছি উপন্যাসের পাত্র-পাত্রী, স্থানকাল যা-ই হোক না কেন ব্রিটিশ শাসনের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি সব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করেছে। যে টাইম-স্পেসের উপরে এর কুশীলবগণ সঞ্চালয়নমান তা মূলত ব্রিটিশের তৈরি। এর পাত্রপাত্রীগণের ক্রিয়াকলাপ রোগের প্রতিক্রিয়া বই কিছু নয়।
‘সহরবাসের ইতিকথা’র নায়ক মনোমোহন কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই কোলকতা শহরে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে আসতে চায়। যদিও শহরে আয়-রোজগার ভালো বলে সে নিজেকে একটা বুঝ দেয়; তবু গ্রাম থেকে অর্থ এনে শহরে ভোগবাসনাপূর্ণ জীবনযাপনই তার অবচেতন মনে সক্রিয়। ‘ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনে ধনতন্ত্রের অতি অসম বিকাশের অর্ধস্ফুট কিন্তু বর্ণবাহার ফুল কলকাতা।’ (সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়: বাংলা উপন্যাসের কালান্তর)। গ্রামীণ পুঁজিকে পুঁজি করে ইংরেজের হাতে গড়ে ওঠে কোলকাতা শহর। ইঙ্গ-শাসনের প্রয়োজনে দ্রুত মধ্যসত্ত্বভোগীদের ভিড় জমে ওঠে এখানে। আধুনিক অর্থে শিক্ষা শিল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় কোলকাতা। গড়ে ওঠে আন্তর্জাতিক (উপনিবেশিক) বাজার ব্যবস্থা। আমদানি হয় প্রযুক্তি নির্ভর ভোগ্যপণ্য। কায়িক পরিশ্রমের জায়গা দখল করে বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল। আমার মনে হয় ‘সহরবাসের ইতিকথা’ রচনায় মানিক এমন কোনো মহৎ চিন্তার কথা ভাবেননিযা তার মার্কসবাদী চেতনায় সক্রিয় ছিল কিংবা ফ্রয়েডীয় হাইপোথিসিস। তাঁর এ উপন্যাসের নায়ক উচ্চশিক্ষিত হলেও শিশ্নোদরপরায়ন। শহরবাস এবং আয়বৃদ্ধি ছাড়া এমন কোনো মহৎচিন্তা প্রাথমিকভাবে সে করেনি। এই উপন্যাসের কাহিনি এমন নিস্পৃহভাবে মানিক বর্ণনা করেছেন যে লেখকের মটিভ নির্ণয় দুরূহ। তবে চরিত্র সৃষ্টি ও কাহিনি বিস্তারের ক্ষেত্রে সম্ভবত মানিকপ্রতিভা এই পর্বে কিছুটা দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে কিনা তা চট করে বলা সম্ভব নয় । এই উপন্যাসের কাহিনির ভিতর দিয়ে আমরা কিছুটা এগিয়ে যেতে চাই:
‘পিতা স্বর্গে গেলেন। মনোমোহন ভাবিল, এবার তবে সহরে গিয়াই বাস করা যাক।’ যেই সিদ্ধান্ত ওমনি হুট করে দীর্ঘদিনের গ্রামীণ সম্পর্ক নাড়ির টান উপেক্ষা করে সপরিবারে কোলকাতায় আগমন। যদিও কোলকাতা শহর তার নতুন নয়। শিক্ষাসুবাদে কোলকাতা জীবনের সঙ্গে আগেই তার পরিচয়। এই উপন্যাসে আমরা শ্রম ও সারপ্লাসভ্যালুর একটি সম্পর্ক দেখতে পাই। যখন গ্রাম নির্ভর কৃষিই একমাত্র উৎপাদন ছিল তখন জমিদার ও মহাজন শ্রেণি গ্রামে অবস্থান করতেন। আবার যখন প্রযুক্তি নির্ভর শ্রমের বিকাশ ঘটছে তখন সেই ধনিক শ্রেণি তাদের পুঁজিপাট্টা নিয়ে শহরমুখী হচ্ছে।
‘সহরবাসের ইতিকথা’ নামকরণের মধ্যে সম্ভবত লেখকের একটি নেতিবাচক ধারণা কাজ করে থাকতে পারে। ব্রিটিশ পুঁজির ফলে যে শহর গড়ে ওঠে সে শহর জনবান্ধব নয়। পুঁজির অসম বিকাশ বহুমুখী অন্যায় ও অসামজিক কাজের জন্ম হয় শহরে। অবশ্য গ্রামে তা বহুকাল ধরে চলে আসছে বলে সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য, বহুকাল ধরে চলে আসছে বলেই তাকে ভালো বলা চলে না। শহর ভালো না গ্রাম ভালোএমন নীতিশিক্ষামূলক বর্ণনা এ উপন্যাসে প্রশ্রয় না পেলেও খুব সহজেই লক্ষ্য করা যায় গ্রামীণ অর্থনীতিক কাঠামোর পিতৃতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বেশ টান ধরেছে। এমনকি উপন্যাসের শেষে মনোমোহনের পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতাবলয় রীতিমত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। যদিও ভেঙ্গে যাওয়ার আগে সে নতুন করে চেষ্টা করতে চায়। সে অন্য রকম মানুষ হতে চায়। কিন্তু হোসেন মিয়ার রহস্য যেমন পাঠকের কাছে অনাবিষ্কৃত থাকে তেমন ভালোমন্দের দোলাচল এখানে নায়ক চরিত্রের ক্ষেত্রেও বিদ্যমান। জানি না শেষ পর্যন্ত মানিকের চরিত্রগুলো টিপিক্যাল কিনা। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র শশীর মধ্যেও উপনিবেশিক মধ্যবিত্তের যে উচ্চাকাক্সক্ষা দেখা যায়; ‘সহরবাসের ইতিকথা’র মোহনের মধ্যে তা আরো উৎকট আকার ধারণ করে। ‘ইতিকথার পরের কথা’র শুভও তার বাইরে নয়। আসলে উপনিবেশিক শাসনের ফলে কোলকাতা কেন্দ্রিক যে নগর সভ্যতা গড়ে উঠে তারই প্রেক্ষাপটে বাংলা উপন্যাস। সেটি যেমন আলালের ঘরের মতিলালের জন্য সত্য তেমন শশী, মোহন, শুভর জন্যও সত্য। শশীকে বলা হয় বাঙলা উপন্যাসের প্রথম নায়ক- যার গ্রামীণ জীবন সম্বন্ধে কোনো আবেগ নেই। সেদিক দিয়ে বলা চলে, মনোমোহন শশীর সম্প্রসারণ- গ্রামে থাকার যার আদৌ ইচ্ছে নেই। কিন্তু শশীর মনোজগৎ যে পরিপূর্ণতা পেয়েছিল। এমনকি কুসুমের সঙ্গে তার যে অসম প্রেমের সম্পর্ক বিস্তার লাভ করেছিলমোহনে আমরা তার দেখা পাই না। বরং শিক্ষিত আর ধনীরা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেলে পক্ষান্তরে গ্রামের উন্নতি। কারণ গ্রামে শিক্ষিতরা বেকার বসে থাকে আর ধনীরা টাকা খরচের জায়গা না পেয়ে টাকা আটকে রাখে। এ ধরনের কথা মোহনের বাড়িওয়ালা জগানন্দের মুখ দিয়ে লেখক বলেছিলেন। সেও এক রহস্যময় চরিত্র। যিনি নিজে পুঁজিপতি। অথচ বই লিখছেন: ভারতবর্ষে সাম্যবাদ, ভারতের সংস্কার আন্দোলনের রূপ, বাংলার শিল্পোন্নতির পথ। পাশাপাশি তার ভাই শ্রীশ্রী পরমানন্দ ঠাকুর হিন্দু অন্ধ গুরুবাদী প্রচারক। সে মোহনের মায়ের পুজ্য। এমনকি মোহনের মা যখন জানল জগানন্দ তার গুরু পরামনন্দের ভাই তখন সে তার পায়ের কাছে শুয়ে পড়ে, তার জুতা মাথায় তুলে জিভে ঠেকাল। মোহনের মা পরমানন্দকে জানাল, ‘আপনাদের বংশের ছোট ছেলেটিও আমাদের নমস্য। আপনাদের পায়ের ধুলো ছাড়া তো আমাদের গতি নেই। অনেক জন্মের পুণ্য ছিল, না ডাকতে নিজে বাড়ীতে পা দিয়েছেন।’ মোহনের মা চায়, তার ছেলের স্ত্রী লাবণ্যও তার মতো গুরুদেবের ভাইকে ভক্তিশ্রদ্ধা করুক। কিন্তু মোহনের আধুনিক শিক্ষা তাতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। উচ্চ শিক্ষিত হলেও সন্তান না হওয়ার কষ্টে মনের জোর হারিয়ে ফেলেছে লাবণ্য। সংস্কারের বাড়িবাড়ি যে কেবল গ্রামীণ জীবনের মধ্যেই তা নয়; শহরজীবনে তার রূপ নিয়েছে ভিন্ন মাত্রায়। মোহনের বন্ধু চিন্ময় ও স্ত্রী সন্ধ্যার চরিত্রে মানিক তা দেখাতে চেয়েছেন। চিন্ময় সন্ধ্যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে বটে; কিন্তু একত্রে থাকার চিরাচরিত পদ্ধতি মানতে সন্ধ্যা নারাজ। এমনকি চিন্ময় চাইলেও সন্ধ্যা চায় না সন্তান ধারণ করতে। একদিকে সন্তান ধারণের জন্য আকুতি অন্যদিকে প্রতিরোধের যাবতীয় চেষ্টা।
শহরের শিল্প-কারখানা, শহরের গণিকালয়, নতুন ব্যবসায়-বাণিজ্য, স্বার্থপরতা ও সম্ভাবনা সবটাই মানিক এ উপন্যাসে আঁকতে চেয়েছেন। কিন্তু ঔপন্যাসিকসুলভ তার এটিচিউড স্পষ্ট হয়নি এ উপন্যাসে। প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে একটি উপন্যাসোচিত বৃহৎ সম্ভাবনা কাজ করলেও দ্রুত লেখনের ছাপ এর সর্বত্র বিরাজমান। যেমন পীতাম্বর চরিত্রের কথা আসা যাক। পীতাম্বর হতে পারত ‘ইছামতী’র লালু ওরফে লালমোহন পাল। কিন্তু হয়ে ওঠার মাঝপথে লেখক তাকে সময় দিতে রাজি হননি। মানিক এ উপন্যাসের ভূমিকাতেও অবশ্য এ কথা বলেছেন। হয়তো তিনি নিজেও এ উপন্যাসে সন্তুষ্ট ছিলেন না। বই আকারে বের করার সময় বেশ ঘষামাজা করেছেন। কিন্তু ঘষামাজার ছাপ রয়ে গেছেনিরপেক্ষ বেড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। বিভিন্ন কারণে হয়তো মানিকের মধ্যে একটি তাড়া কাজ করে থাকবে। কারণ‘সহরবাসের ইতিকথা’ লেখার সময়ে তিনি সরাসরি মার্কসবাদে দীক্ষিত হন। প্রগতি লেখকসংঘে যোগ দেন। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চাপ সমাজ জীবনের সর্বত্র দেখা দেয়। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতিতেও একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তার ওপর শুরু হয় ভয়াবহ মন্বন্তর। এটি অশনিসংকেত লেখার কাল। উপনিবেশিক শাসন সুবাদে ইউরোপের বাঁধানো যুদ্ধের ফলে এদেশের মানুষকেও কম মূল্য দিতে হয়নি। বাঁচার তাগিদে গ্রাম থেকে দলে দলে শ্রমিক শহরে আসছিল। ভেঙে পড়ছিল ভারতের শ্রেণিভিত্তিক আদি পেশা। কামার শ্রীপতি, ভূপাল তাদেরই একজন। যে আশা নিয়ে শ্রীপতি পিতৃপুরুষের আদি ব্যবসা ছেড়ে মোহনের সঙ্গে কোলকাতা আসা তা পুরণ হয়নি। যুবতী স্ত্রী কদমকে ফেলে আসতে হয় শ্রীপতিকে। আর মন না চাইলেও তাকে যেতে হয় গণিকা দুর্গার কাছে। কিন্তু এর জন্য কে দায়ি? এমন কোনো নীতিশিক্ষা শিল্পের উদ্দেশ্য থাকে না বটে। কিংবা এরপক্ষে যুক্তি তৈরিও তার ইচ্ছে নয়। কিন্তু মানিক ঠিকই এর গভীর অসুখ চিহ্নিত করেন। শ্রমের ন্যায্যমূল্য পায় না বলেই তো শ্রীপতি স্ত্রীকে নিজের কাছে আনতে পারে না, গ্রামে কাজ নেই বলেই তো বৌ রেখে শহরে আসতে হয়। বারবণিতা দুর্গা চম্পারও সামাজিক বৈষম্যের শিকার। এ কাজ তো তারা স্বেচ্ছায় বেছে নেয় না। নারীর প্রতি সহিংসতা, পুঁজির বাজার চাঙ্গা রাখতে, অল্পমূল্যে শ্রম পাওয়ার ফিকির হিসেবেই তো অল্পমূল্যে দেহ ব্যবসাকে উৎসাহিত করা হয়। বারবণিতার সৃষ্টির ইতিহাসের সঙ্গে পুঁজির ইতিহাস জড়িত।
এ উপন্যাসের পুরোটা মনোমোহন দখল করে থাকলেও ইতিকথার পরের কথার শুভময়ের মতো চেতনায় সমৃদ্ধি ঘটেনি তার। সুতরাং, তার যে সংঘাত পিতৃতান্ত্রিক ফিউডাল সংঘাত। শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করায় মায়ের সঙ্গে তার সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। নিজের ভাইও তাকে বিশ্বাস করতে পারে না। কারণ, পরিবারের অন্যদের কাছে প্রতিভাত হয়মোহন কেবল পরিবারের বড় ছেলে হওয়ার সুবাদে অন্যদের ওপর আধিপত্য বজায় রাখছে। তাই মোহনের একক খামখেয়ালির ওপর কেউ আর ভরসা করতে চায় না। আশ্রিত পীতাম্বর ও শ্রীহরি পর্যন্ত। শহর তাদের নতুন সম্পর্ক বিন্যাসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এমনকি মোহনও ‘সহরের জীবন স্রোতে কুটার মত ভাসিয়া চলিয়াছে, নোঙরের ব্যবস্থা করে স্মরণ ছিল না।’
যদিও উপন্যাসের শেষাংশে লেখক নায়ক জীবনের পরিবর্তনের ইংগিত দিয়েছেন কিন্তু সে ইঙ্গিতের গতি প্রকৃতি রহস্যময় রয়ে গেছে। হয়তো শহর মোহনকেও স্বজন বর্জিত স্বার্থ সর্বস্ব মানুষে পরিণত করবে।
এ পর্যায়ে মানিকের শৈল্পিক সামর্থ্য কমে আসছিল- তা কিন্তু মোটেও প্রমাণিত নয়। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘চিহ্ন’, ‘চতুষ্কোণে’র মতো উপন্যাস তিনি আর লিখতে পারেননিএ অভিযোগও ঠিক নয়। ‘ইতিকথার পরের কথা’ উপন্যাসটি তার প্রমাণ। সত্যিই যেন শেষ হয়েও হইল না শেষ। উপনিবেশিক ভারতের শেষপাদে যে এটিচিউড নিয়ে তিনি শিল্পীজীবন বেছে নিয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রেক্ষাপটে তার নতুন রূপদানে মোটেও বেগ পেতে হয়নি তাঁকে। একটি পরিণত দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে এর কাহিনিবয়ন করেছেন তিনি। যদিও এ পর্যায়ে মানিক ব্যক্তিগত খারাপ সময় পার করছিলেন। লেখার কাটতি ছিল না মোটেও। দুঃসহ আর্থিক অনটন চলছিল। শরীর আগের মতো ভারবহ ছিল না। তদুপরি মদের নেশা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখছিল। এসব কথা বলার উদ্দেশ্য, এতে তার সহজাত শিল্প প্রতিভা খুব একটা বধাগ্রস্ত হয়নিতার প্রমাণ ‘ইতিকথার পরের কথা’।
এ উপন্যাসটি প্রকাশিত হচ্ছে ভারত বিভাগের বছর চারেক পরে। আমরা জানি, মার্কসবাদী বীক্ষণ থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় খ-িত ভারত-বিভাগের পক্ষে ছিলেন না। তাই বলে উপনিবেশিক শাসনের পরিপুষ্টতাও তিনি চাননি। চিন্তার স্বাধীনতা ও শ্রমবান্ধব একটি দেশ গড়ে উঠুক মানিকের স্বপ্নে তা ছিল ষোলআনা। কিন্তু এর কোনো প্রস্তুতি না থাকায় অচিরেই সে অসারতা ধরা পড়ে। নানামুখী পীড়নের মধ্যে থাকলেও এসময়ে মানিকের সৃষ্টিশীলতা বেশ তুঙ্গে অবস্থান করে। একই বছরে তার চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয় দুই খন্ডে ‘সোনার চেয়ে দামী’ ‘পাশাপাশি’, ‘সর্বজনীন’ আর আলোচ্য উপন্যাসটি তো রয়েছেই। এছাড়া খতিয়ান গল্পগ্রন্থটিও এ সময় প্রকাশিত হয়।
আমার মনে হয়, ভারত-বিভাগের পরে মানিক উপন্যাস লেখার নতুন কিছু প্লট পেয়েছিলেন। অথবা সময়ের প্রেক্ষাপট থেকে পুরনো প্লটগুলো নতুন করে সাজিয়ে নিয়েছিলেন। তাই দুটি ভিন্ন পরিবেশে রচিত হলেও শশী আর শুভকে আলাদা করা যায় না। কিন্তু ‘ইতিকথার পরের কথা’র কাহিনি শুরু হচ্ছে পুরনো বিপ্লবী জীবনবাবুকে দিয়ে। যৌবনে হয়তো এসব বিপ্লবী স্বাধীনতার জন্য কিছুটা সেক্রিফাইজ করেছিলেন। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে ত্যাগ ও প্রাপ্তিকে মেলাতে পারেননি। দেশ স্বাধীনের পরে তাই তাদের অনেকেরই হয়েছে অধোপতন। বেঁচে থাকার দায় মেটাতেই তাদের ইঁদুর দৌড়ে শামিল হতে হয়েছে। জীবনবাবুর নাটকীয় ঘটনার রাতে পুলিশের দারোগা বন্দুক ঠেকিয়ে লক্ষ্মীকে ধর্ষণ করে। লক্ষ্মী এ উপন্যাসের কুসুম। নিম্নবর্ণের কর্মকার শ্রেণি। কিন্তু নিজের ব্যক্তিত্বগুণে এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রসমূহের কর্মসহায়ক হিসেবে কাহিনির গতিশীলতা ও নাটকীয়তা দান করেছে। নারী চরিত্র নির্মাণে মানিকের শৈল্পিক চূঁড়া স্পর্শ করেছে লক্ষ্মী চরিত্র। মনের দোলাচল, দ্বিচারিণীক বৈশিষ্ট্য ছাড়াই সে শুভ ও কৈলাসের কর্ম অনুপ্রেরণার সঙ্গী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অথচ সে না কুমারী, না বিধবা- তার স্বামী দীর্ঘকাল ধরে পলাতক। সে তার হদিস জানে না। নারী পুরুষের যৌন সম্পর্কের অবচেতন বিষয়গুলো এখানে সূক্ষèভাবে ব্যবহার করেছেন মানিক। নারী পুরুষের সম্পর্কের ধরন, মিলিত হবার উপায় যে সব সমাজে সবকালে একমাত্রায় প্রবাহিত নয়- লক্ষ্মী ও কৈলাসের সম্পর্কের সূত্র ধরে লেখক তা তুলে ধরতে চেয়েছেন। বহুদিন আগে সাপের কামড়ে কৈলাসের স্ত্রী বিগত হয়েছে; বহু বছর ধরে লক্ষ্মীর স্বামীর কোনো পাত্তা নেই। কিন্তু কৈলাস এবং লক্ষ্মীর মিলিত হবার সুযোগ সমাজ রাখেনি। এমনকি বিয়ের মাধ্যমেও নয়। এ উপন্যাস রচনার শতবছর আগে বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় হিন্দু বিধবা বিবাহ চালু হলে সমাজ বাস্তবতা তাকে মেনে নেয়নি। অথচ ঘরে রাস্তায় ক্ষমতার ছত্রছায়ায় বিধবা ধর্ষণ বন্ধ হয়নি। কৈলাস লক্ষ্মীকে পাওয়ার জন্য মুসলমান হওয়ার কথাও ভেবেছিল। কারণ মুসলমান সমাজে বিধবা বিবাহ স্বীকৃত। কিন্তু বুঝেছিল কেবল বিয়ের জন্য মুসলমান হওয়ার হাঙ্গামা কম নয়। কারণ, ধর্ম জিনিসটাও যে নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করা যায় না; সমাজ তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে সামাজিক অনুশাসনের কাছে ব্যক্তিজীবন উপেক্ষিত থেকে যায়Ñ তার খোঁজ কেউ রাখে না।
‘ইতিকথার পরের কথা’ উপন্যাসে মানিক গাওদিয়ার মতো বারতলা গ্রামের একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন চিত্র অঙ্কন করতে চেয়েছিলেন। ছোটবড় মিলে প্রায় অর্ধশত চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়েছেন তিনি। যদিও ‘চিহ্নে’র মতো তা খেই হারিয়ে ফেলেনি। গ্রামের ডাক্তার নন্দ কর্মকার, জমিদার জগদীশ, সুদখোর মহাজন ধরণী, পুলিশের দারোগা ভুবন মোহন, কালীপুজারী ত্রিভুবন, শুভর হবু শ্বশুর ভুদেব, শুভর মা সাবিত্রী, বাগদত্তা মায়া, কৃষক ভূষণ, রসিক তোরাব আলী, ঘনরাম, বিপিন, ফজলু, নবমন্দির কারখানার শ্রমিক-কর্মচারী, জমিদারের নায়েব, লেঠেলÑ বহুমুখী চরিত্রের সমাহার ঘটেছে এখানে। ব্রিটিশোত্তর এদেশের একটি গ্রামের আর্থ-সামাজিক পূর্ণাঙ্গ চিত্র এঁকেছেন মানিক। বোধহয় সফলতার সঙ্গেই তিনি এ কাজটি করতে পেরেছেন। বিলাত ফেরত শুভময় স্বাধীন দেশের জন্য কিছু একটা করতে চায়। ফিউডাল রক্তের উত্তরাধিকার তাকে টানে না। কিন্তু জানে না কিভাবে তার মুক্তি। গড়ে তোলেন নবশিল্প কারখানা। পিতল-কাসার তৈজসপত্র। কিন্তু কারখানা শুরু করতে টের পায়- কাজটি এত সহজ নয়। বৃহদাকারের শিল্পকারখানা যে দেশের কুঠিরশিল্পকে ধ্বংস করে দেবে সেটিও সে অনুভব করে। কিন্তু উপায় নেই। প্রযুক্তর আগ্রাসন থেমে থাকবে না। কিভাবে যেন শুভ স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ে। গায়ের লোককে বোঝাতে চেষ্টা করে, সে আসলে তাদের পর নয়। তার বাবা যদি অন্যায় করে থাকে তার জন্য সে দায়ি নয়। এভাবে বাবার সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। প্রথমে মনে হয়েছিল খুব সাময়িক। কিন্তু শুভ স্বাধীন দেশের নতুন পথে তার কর্মপন্থা নির্ধারণ করে ফেলে। সে তার শিক্ষা ও শ্রম দিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে অর্থনীতিক মুক্তির পথে এগিয়ে যেতে চায়।
আমরা শুরু থেকেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে ইতিকথাধর্মী রচনার প্রবণতা লক্ষ্য করি। এর অর্থ কি মানিক কল্পনা নির্ভর রূপকথার গল্প রচনার চেয়ে সমকালীন সমাজের ইতিহাস রচনা করতে চেয়েছিলেন। যার মধ্যে শোনা যাবে সব মানুষের বিশেষ করে নিম্নবর্গের মানুষের হৃদস্পন্দন- যাদের ইতিহাস মূলত ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায় না। তাদের সংগ্রাম, বেঁচে থাকার লড়াই, রাজা বদলের কাহিনি আর তাদের নারী পুরুষের মিলিত হবার অদম্য সব কাহিনি। মানিক জন্মের শতবর্ষ পরে- তাঁর এসব রচনার সমাজ বাস্তবতা অবিকৃত নেই বটে; কিন্তু মানিকের সমকাল নির্মাণ, মানিকের শুভ ও সংগ্রাম মানব প্রজন্মকে মানুষ হিসেবে সব সময় কিছুটা এগিয়ে নিতে সক্ষম।
0 Comments