প্রজন্ম একাত্তর ।। আকাশ মামুন সরকার



স্কুল থেকে ফিরে মুখ গুমড়া করে বসে আছে ফাতিন। খাচ্ছে না, ফ্রেস হচ্ছে না। মা কয়েক বার এসে ডেকে গেছে; কিন্তু খাবে না। অন্যদিন ফিরে গেমস নিয়ে মেতে উঠলেও আজ গেমসও খেলছে না। সোফায় শুয়ে রিমোট  হাতে বার বার শুধু চ্যানেল বদলাচ্ছে। কোন চ্যানেলেই থিতু হচ্ছে না। মা এত বার খেতে জোরাজোরি করলো; কিছুই খাবে না। ফাতিনের প্রিয় চকলেট কেক নিয়ে এসেও ঘুরে গেছে মা। 

গুমোট থাকতে থাকতে হঠাৎ দুম করে বিজলী চমক দিয়ে যেমন ঝড় শুরু হয় ঠিক তেমন করে উচ্চ দৃঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-বাবা মুক্তিযোদ্ধা হলো না কেন? ভিমরী খেয়ে মা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো; এ কেমন কথা? যুদ্ধের সময় তোমার বাবার বয়স কত ছিল যে সে যুদ্ধে যাবে? যুদ্ধে যাবার মত বয়তো তোমার বাবার হয়নি তখন। আর তোমার বাবার মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সাথে তোমার খাওয়ার কী সম্পর্ক? ফাতিন রাগে গড়গড় করতে করতে বলল; খাওয়ার কী সম্পর্ক সেটা পরে বলছি। তার আগে বলো দাদা কেন মুক্তিযোদ্ধা হলো না? তার তো নিশ্চয় বয়স হয়েছিল। এবার মা সত্যি সত্যি রেগে গেল। এ কেমন ছিরি কথার। এমন বিচ্ছিরি  কথা  কোথা থেকে শিখলে! মুরুব্বিদের সাথে  বেয়াদবি! মার হলো এ এক সমস্যা_অনেক রাগ করলে কেঁদে ফেলে। এবার ও তাই হলো। কাঁদতে কাঁদতেই বাবাকে ফোন করলো। প্রথমে কান্নার  তোড়ে তো মা কথাই বলতে পারলো না। কিছুক্ষণ পর কান্নার বেগ একটু কমে  এলে বললেন, ওগো ফাতিনের আব্বু শুনছ? ফাতিন যেন কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে। খাচ্ছে না। পড়ছে না। ঘুমোচ্ছে না। তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। কি সব বলছে, বাবা কেন মুক্তিযোদ্ধা হলো না? দাদা কেন  মুক্তিযুদ্ধে গেলো না? 

জরুরী মিটিং ফেলে ছুটে এলেন বাবা মাহবুব মুর্শেদ। হাতে করে নিয়ে এলেন সেরেনাটা  টিপলো ব্রেন্ডের চকোলেট। ফাতিন জানে বাবা এখন কিছুই জিজ্ঞেস করবে না। মায়ের  ভাষায় ফাতিনের অস্বাভাবিক আচরণ, বিচ্ছিরি কথা_এসবের কিছুই এখন বাবা জিজ্ঞেস করবে না। বরং  বাবা এখন ফাতিনের সাথে কার্টুন দেখবে, খেলবে, বিভিন্ন মজার গল্প শোনাবে। তারপর একসময় হয়তো দেখা যাবে ফাতিন নিজের তার অভিযোগ কিংবা রাগের কারণ বাবাকে বলে দিচ্ছে। এমন কৌশলী আচরণই দেখে আসছে ফাতিন। যতবারই ফাতিন ভেবেছে বাবা যতক্ষণ তার রাগের কারণ জিজ্ঞেস না করবে সে মুখ খুলবে না। কিন্তু পারা যায় না। কেমন কৌশলী আচরণে যেন সব কথা বাবার কাছে গড়গড় করে বেরিয়ে আসে। আজও হয়তো তাই হবে। কিন্তু ফাতিন আজ কোন কৌশলের অপেক্ষায় থাকতে চায় না। চকলেটের উপরও কোও লোভ দেখাল না। 

বাবা কাছে বসতেই মুখ শক্ত করে বাবার চোখে চোখ স্থির করে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো, বাবা তুমি মুক্তযুদ্ধে যাওনি কেন? বাবা ক্ষণিকের জন্য চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মনে মনে কিছু একটা চিন্তা করলো। হয়তো বা আকষ্মিক ঘটনা  এবং তার কার্যকারণ বোঝতে চেষ্টা করলো। তারপর বাবার  স্বভাব সুলভ  হাসিহাসি মুখে বলতে লাগলো, বাবা মুক্তি যুদ্ধের পরে আমার জন্ম হয়েছে_আমি কী করে যুদ্ধে যাবো বলো? এবার ফাতিনকে চমকে দিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করলো, তার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো ফাতিন। বাবা কখনও এভাবে ফাতিনের কাছে প্রশ্ন করে না। ফাতিনের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বাবার প্রশ্নের উত্তর গুলো জেনে নেন। আজ বোধ হয় ফাতিনের প্রশ্ন এবং প্রশ্ন করার ধরণ দেখে একটু বেশি ঘাবড়ে গিয়েছে। কিন্তু ফাতিন চোখে মুখে গাম্ভীর্য ভাব রেখেই বলে উঠলো, তোমার কোন প্রশ্নের উত্তর এখন নয় বাবা_এখন শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর চাই। ফাতিনের  কর্কশ গলায় বাবা ভড়কে গিয়ে মিনমিন করে বললেন, তা তো হবেই-কিন্তু আমার জানা দরকার আসলে ঘটনাটা কী ঘটছে। তাহলে উত্তর দিতে সুবিধে হয় আর কি। কোন চালাকি নয় বাবা-আগে উত্তর পাই_পরে সব জানতে পারবে। বাবা ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অসহায় আত্নসর্পণে বললো_ঠিক আছে বলো তোমার আর কি কি জানা  চাই।

তোমার না হয় বয়স হয়নি-তবে দাদু কেন মুক্তিযোদ্ধা হলো না? জান আব্বু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড অরিন্দম আরও কয়েক জনের সাথে প্রজন্ম একাত্তর নামে একটা সংগঠ করেছে। আমি সদস্য হতে চেয়েছিলাম আমাকে নেয়নি। বলেছে, যাদের বাবা, দাদা, মা কিংবা নানা মুক্তিযোদ্ধা তারাই কেবল এই সংগঠনের সদস্য হতে পারবে।  ওরা এখন মাঝে মাঝে গোপনে মিটিং করে। আমাকে কাছে যেতে দেয় না। আমার খারাপ লাগে না, বলো বাবা। আজ তুমি বা দাদু কেউ মুক্তিযোদ্ধা হলেই তো আমিও প্রজন্ম একাত্তরের সদস্য হতে পারতাম। বলতে বলতে কেঁদে ফেললো ফতিন। এবার বাবা ফাতিনকে বুকে জড়িয়ে নিল। আদর করতে করতে বললো, কাঁদে না বাবা। তোমার দাদু হয়তো প্রচলিত অর্থে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেননি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধে তার অবদানের কথা শুনলে তুমি নিজেই গর্ব অনুভব করবে। তার আগে তোমার জানা উচিত_একাত্তরে যারা দেশের  স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছে, যারা পাকবাহিনীকে সমর্থন ও সাহায্য করেছে তারা বাদ দিয়ে আমরা বাকীরা সবাই প্রজন্ম ৭১। সবাই আমরা প্রজন্ম বাংলাদেশ। 

তোমার দাদুর ঘটনা শোন। তখনও ফাতিন বাবার কোলে ফুপাচ্ছিল। বাবা বলে চলছেন_মুক্তিযোদ্ধে তোমার দাদা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তি যোদ্ধাদের সাহায্য-সহায়তা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তাদের খাবার দিয়েছেন। তোমার দাদু তখন স্থানীয় কালু বাহিনীকে যুদ্ধের খবর শুনার জন্য একটা রেড়িও দিয়েছিলেন। এছাড়াও রাতের আঁধারে রাজাকার-আলবদরদের খবর পৌঁছে দিতেন মুক্তিযোদ্ধের। একবার যজ্ঞেশ্বর নামের এক মুক্তিযোদ্ধা যমুনার চরে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধে মারাত্মক ভাবে আহত হলে বাবা তাকে বাড়িতে রেখে সেবা করার ব্যবস্থা করেন। এই ঘটনা কিছুদিন পর জানাজানি হলে, হাসু রাজাকার জুড়িডাঙ্গা প্রাইমারী স্কুল মাঠে পাকবাহিনী ক্যাম্পে খবর দেয়। খবর পেয়ে বাবাকে পাকবাহিনী ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেবার বাবাকে ওরা এতো নির্যাতন করেছিল যে শেষ দিন পর্যন্ত বাবা খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। শুনেছি পাকবাহিনী বাবাকে গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন করেছিল। বলতে বলতে বাবার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। কখন যেন মাও বাবার পাশে এসে বসেছে। মা বাবার কাছ ঘেঁষে বসে বাবার একটা হাত ধরে রইল। কিন্তু বাবার কান্না থামানোর কোন চেষ্টাই করল না। বোধ হয় এটা খুবই গর্ব ও আনন্দের কান্না। ফাতিনের গা কাঁটা দিয়ে উঠছে আর রাগ হচ্ছে হাসু রাজাকার ও পাকবাহিনীর উপর। 

বাবা বলে চলছেন_পরে তিনদিন আটকে রেখে নির্যাতনের পর গরু আর খিরসাপাত চালের পোলাও খাওয়ানো আর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য না করার শর্তে বাবাকে ওরা ছেড়ে দেয়। বাবা তারপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করে গিয়েছিলেন। যুদ্ধের শেষদিকে একবার  বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তার দলবল নিয়ে আমাদের বাড়িতে রাতের খাবার খেয়েছিলেন। বাবার কিছুটা লেখালেখির হাত ছিল। বঙ্গবীরের বীরত্বগাথা নিয়ে একটি পালা লিখিছিলেন বাবা। সেটা শুনে বঙ্গবীর বাবাকে একটা বন্দুকের গুলি উপহার দিয়েছিলেন। আমাদের গ্রামের বাড়ি সেটা এখনো সংরক্ষিত আছে। আগামী গৃষ্মের ছুটিতে তোমাকে দেখিয়ে আনবো। যুদ্ধপরবর্তী অনেকদিন পর্যন্ত বাবার সে পালাগান গ্রামে গ্রামে আসরে গাওয়া হতো। যুদ্ধের পর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী স্থানীয় মতি কমান্ডারের কাছে খবর পাঠিয়েছিলেন_বাবা যেন মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে যায়। বাবা যুদ্ধের পর বঙ্গবীরের সাথে দেখা করেছিলেন, কিন্তু সর্টিফিকেট নেননি। বলেছিলেন দেশের জন্য কাজ করেছি, তার আবার সার্টিফিকেট কিসের? দেশ পেয়েছি এটাই বড় সার্টিফিকেট। বাংলাদেশ অর্জনের পিছনে এমন বহু জানা-অজানা মানুষের অবদান আছে। তাদের অবদানকে তুমি কি ভাবে খাটো করে দেখবে? তাদের প্রজন্ম কি প্রজন্ম ৭১ নয়?

আমরা কালই একটা সংগঠন করবো। নাম হবে প্রজন্ম বাংলাদেশ। এর প্রাথমিক সদস্য তুমি, তোমার মা আর আমি। তোমার কোন বন্ধু এতে যোগ দিতে চাইলে আমরা তাকে সদস্য করে নিবো। এমনকি ঐ প্রজন্ম ৭১ এর কেউ সদস্য হতে চাইলে-সেও পারবে। আমরা খুব শিঘ্রই মিটিং করে আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করে ফেলবো। তবে প্রজন্ম বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য হলো আগামীর বাংলাদেশ। মনে রাখতে হবে শুধু যুদ্ধের সময়ই নয় শান্তির সময়ও দেশকে ভালোবাসা যায়। তোমার পড়াশুনা ঠিক ভাবে করে আগামী আদর্শ নাগরীক হওয়া দেশকে ভালবাসার অংশ। ফাতিন কথা দিল সে ঠিক ভাবে পড়ালেখা করবে, বাবা-মা তার দায়িত্ব ঠিক ভাবে পালন করবে। আর ঝগড়া করবে না। ফাতিন বলে উঠলো ঠিক আছে বাবা চলো এই গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্তের একটা সেলফি তুলে ফেলি। যে কথা সেই কাজ। বাবা স্মাইল, মা স্মাইল বলতে বলতেই হাসিময় মূহুর্ত মোবাইল ক্যামেরাই বন্দী হয়ে রইলো। 

   


Post a Comment

1 Comments