নেপালের পাহাড়ে-অরণ্যে ঘুরে ও উড়ে বেড়ানোর গল্প ।। বাহাউদ্দিন ইমরান

দরবার স্কয়ারের সামনে অভিযাত্রী দল 

প্রাণ-প্রকৃতির আরেক অভয়ারণ্য নেপাল। পুরো দেশটাই যেন এক পাহাড়ি অঞ্চল। কোথায় যে সমতল রয়েছে তা হয়ত জানেন না অনেকেই। নেপালের কাঠমন্ডুর ত্রিভূবন বিমানবন্দর থেকে শুরু করে সবখানেই পাহাড়ি মেলা। এই পাহাড়েই ঘরচাষাবাদজীবন-যাপনপর্যটন এবং প্রাকৃতির সৌন্দর্য্যের মহাসমারোহ। আমাদেরও তাই নেপাল ট্যুর ছিলো পূর্বনির্ধারিত। সময়ও পেয়েছিলাম হাতে। টানা চারদিনের ট্যুর প্ল্যান করা হয়। প্রযুক্তি আমাদের প্ল্যানিংকে সহজ করে দিয়েছিলো। ইউটিউবের কল্যানে বুঝতে সুবিধা হয়েছিলো কোথায় কেমন সৌন্দর্য্য উপভোগ্য। যাত্রা ছিলো বিমানপথে। ঢাকা থেকে নেপালের কাঠমন্ডুর ত্রিভূবন বিমানবন্দর। স্বভাবত ত্রিভুবন বিমানবন্দর নিয়ে কিছু ভয় কাজ করেছিলো পূর্বের দূর্ঘটনার কারণে। 

নির্ধারিত দিনে ফ্লাইটের তিন ঘন্টা আগেই সবাই বিমানবন্দরে হাজির হতে শুরু করলাম সাংবাদিকদের অন্যতম সংগঠন ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ)-এর ৩৪ জন সদস্য। সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে ইমিগ্রেশনের প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করে বিমানের অপেক্ষা বসে রইলাম। এরপর বিমানে উঠে নির্দেশনা জানিয়ে কাঠমান্ডুর পথে বিমান আকাশে ভেসে উঠলো। 

নেপালে আগমনকারীদের বরণ করতে আমাদের সবাইকে উত্তরীয় পড়িয়ে বরণ করলেন তিনি। নেপালি ভাষা শেখাবেন বলে কথা দিলেন। তবে ম তিমিলাই মায়াগারচু’ অর্থাৎ আমি তোমাকে ভালোবাসি’ ছাড়া ৩৪জনের টিমকে আর কোন ভাষা সেখানোর সুযোগ হলোনা তার।

নেপালের সীমানায় পৌঁছাতেই বিমানের ডানপাশের জানালা থেকে দূরে সাদা মেঘরাশির দেখা মিললো। বিমানবালাদের সহযোগীতায় জানা গেলোসেসব কোন মেঘরাশি নয়পুরোদস্তর হিমালয়। তুষারে ঢেকে আছে। উঁচু-নীচু ঢেউ হয়ে আশকারা দেওয়া হিমালয় পর্বত। এরপর আরও কিছু সময় পর বিমান ৩৪ হাজার ফিট থেকে নীচে নামতে শুরু করলো। জানালা দিয়ে তখন অস্পষ্ট কাঠমন্ডু শহর দেখা যাচ্ছিল। সবখানেই উঁচু-নীচু খাজকাটা পাহাড়ের সমারোহ। পাতলা হয়ে আসা মেঘের কারণে মনে হচ্ছিলো যেন পানিতে ডুবে যাওয়া কোন ডুবন্ত পাহাড়ি শহর দেখছি। সেসব পাড়ারের ওপর দিয়ে সাপের মতো করে এঁকেবেঁকে গিয়েছে চলাচলের দীর্ঘ পথ। সবুজ ভয়ঙ্কর সে পাহারের ওপর দিয়ে একসময় বিমান ত্রিভুবন বিমানবন্দরের রানওয়েতে এষে থামলো
দরবার স্কয়ারের সামনের অংশ 

বিমানবন্দরের প্রয়োজন মোতাবেক অন এরাইভাল ভিসা প্রসেস ও অন্যান্য কাজ সেরে সহযাত্রী ও সহকর্মীদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। পাশেই দেখলাম মানি এক্সচেঞ্জার ও নেপালি সিম ক্রয়ের বুথ। তবে বাইরের তুলনায় এখানে খরচ অনেকটাই বেশি হওয়ায় কেউ আর সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইনি। কিছু সময় পর সকলে একত্রিত হয়ে বেরিয়ে পড়লাম বিমানবন্দরের বাইরের সড়কে। সড়ক পেরিয়ে সামনেই দেখা মিললো অভিবাদন এক্সপেডিশন হলিডেজ প্রাইভেট লিমিটেডের জ্যোতি কার্কির সঙ্গে। আমাদের ট্যুর গাইড। তীব্র উচ্ছ্বাস আর হাসিমুখ নিয়ে আমাদের ওয়েলকাম করলেনএরপর আমাদের ৩৪ জনের জন্য রিজার্ভ বাসে তুলে নিয়ে হোটেলের দিকে রওনা হলেন। নেপালে আগমনকারীদের বরণ করতে আমাদের সবাইকে উত্তরীয় পড়িয়ে বরণ করলেন তিনি। নেপালি ভাষা সেখাবেন বলে কথা দিলেন। তবে ম তিমিলাই মায়াগারচু’ অর্থাৎ আমি তোমাকে ভালোবাসি’ ছাড়া ৩৪জনের টিমকে আর কোন ভাষা সেখানোর সুযোগ হলোনা তার।   

বিমান থেকে নেপালি জনপদ 

বিমানবন্দর থেকে থামেলে অবস্থিত কাঠমান্ডু প্রিন্স হোটেলের দূরত্ব ছিলো প্রায় ৬ থেকে ৭ কিলোমিটার বা ৩০ মিনিটের দূরত্ব। শহরের পথ ধরে হোটেলের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেছে বাস। বাসের জানালা দিয়ে বাইরের চালচিত্রের দেখা মিললো। শহরের অনেক জায়গায় জমে আছে নগরবাসীর প্রত্যাহিক আবর্জনা। কোন কোন খাল থেকে ভেসে আসছে পঁচা গন্ধ। শহরের ভেতরের ছোট ব্রিজগুলো দেখতে অনেকটাই হাতিরঝিলের ব্রিজের মতো। এ যেন ঢাকার আরেক রূপ। কাঠমান্ডুর একপাশ কর্পোরেট শহর। অন্যপাশ দেখতে যে কেউ নিমিশে পুরান ঢাকার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলবেন। এপাশের ভবনগুলো দেখে মনে হয় যেন যুদ্ধ পরবর্তী কোন শহর। প্রতিটি ভবন ধুলোয় মলিন হয়ে আছে। সবাই ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলছেন। শহরে জ্যাম খুবই সামান্য। একজন ট্রাফিক পুলিশ দিয়ে চার/ছয় লেনের সড়ক নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সড়কে মোটরসাইকেল চলাচল চোখে পড়ার মতো। তবে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় বাইরে তীব্র রোদ সত্ত্বেও ৭৫ শতাংশ নেপালী গায়ে শীতের পোশাক জড়িয়ে রেখে চলাচল করছে। ট্যুর গাইড জ্যোতি জানালেনশীতের মধ্যে থাকতে থাকতে অভ্যাসবশত নেপালীরা দিনের বেলাতেও রোদের মধ্যে গরম কাপড় পড়তে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এরপর হোটেলে ফিরলাম। সেখানে বসেই ২০০ রুপিতে নেপালী সিম কার্ড ক্রয় ও ডলার ভাঙানোর সুযোগ করে দিলেন জ্যোতি কার্কি। হোটেলে ছিমছাম গোছানো কক্ষ। বাথরুমে গরম-ঠান্ডা পানির সুবিধা। দুপুরের খাবার সেরে রওনা হলাম শম্ভুনাথ মন্দির দেখতে

 

শম্ভুনাথ মন্দির:
উঁচু পথ পারি দিতে বাসকে কিছুটা কষ্ট পোহাতে হলো বটে! ছোট ছোট বহু সিড়ি উঠে মন্দিরের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। দম নিয়ে হাঁটতে হয়। মন্দিরে উঠতেই বেশ কিছু উপাসনার জায়গাপুরাতন নান্দনিক ভবনঘর সাজানোর বেশকিছু সরঞ্জামাদির দোকান ও দেব-দেবীর প্রতিমার দোকান চোখে পড়লো। মনে হবে যেন মেলা বসেছে। একেবারেই চূড়ায় উঠে আসার পর দেখ মিলবে কাঙ্ক্ষিত মন্দিরের। বিশালাকার কেন্দ্রীয় স্তূপের ওপর চৌকো কাঠামোতার ওপর একের পর এক গোলাকার বলয়ে গড়া মন্দিরচূড়া। চৌকো অংশের চারপাশে আঁকা বুদ্ধের চোখ। 

শম্ভুনাথ মন্দির 

কাঠমান্ডু শহরের প্রতীকে পরিণত হওয়া এই ঐতিহ্যবাহী মন্দির ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য। এই চূড়ার কিনারা থেকে পুরো কাঠমান্ডু শহরের একটি রুপ দেখে নেওয়া সম্ভব হবে। এরপর সেখান থেকে নেমে হোটেলের কাছেই অবস্থিত দরবার স্কয়ারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। 

শম্ভুনাথ মন্দিরের চূড়া থেকে কাঠমান্ডু শহর 

দরবার স্কয়ারে আভিজাত্যের স্থাপনা:
পায়ে হাঁটা দূরত্বে পৌঁছে গেলাম দরবার স্কয়ারে। এখানে না এলে বুঝতেই পারতাম না নেপালের অনেক সৌন্দর্য্য এখানে স্তুপের মতো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। পথে হাঁটতে হাঁটতে দেখে নিলাম চারপাশ। পুরাতন ঢাকার মতই ছোট ছোট সড়ক কিন্তু জনপূর্ণ। চারপাশের ভবনগুলোতে এখনো ভূমিকম্পের স্মৃতির মায়া কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এ শহরে রিকশায় চড়া অনেকটাই বিলাসিতার মতো। খরচ অনেক। ইতিহাস বলছেকাঠমান্ডু দরবার স্কয়ার হলো সাবেক কাঠমান্ডু রাজ্যের রাজকীয় বাসভবনের প্লাজা। এটি কাঠমান্ডু উপত্যকায় অবস্থিত তিনটি দরবার ক্ষেত্রের একটি। এই তিনটি দরবার ক্ষেত্রই ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। 

দরবার স্কয়ারের স্থাপত্য শৈলী 

কাঠমান্ডু দরবার ক্ষেত্রের চারপাশে দর্শনীয় স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে। কয়েক শতাব্দীকাল ধরে নির্মিত প্রাচীন নেপালি জাতি শিল্পীদের শিল্পকর্ম এই স্থাপত্যকর্মগুলোতে শোভিত করে তুলেছে। এই দরবার ক্ষেত্রের বেশ কয়েকটি দালান ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দরবার স্কয়ার মূলত মল্ল ও শাহ রাজাদের প্রাসাদ ছিল। এছাড়া এই ক্ষেত্রে বেশ কিছু চতুর্ভুজাকৃতির উঠোন এবং মন্দির রয়েছে। এটি হনুমান ধোকা দরবার ক্ষেত্র নামেও পরিচিতনামটি হনুমান-এর মূর্তি থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। দরবার স্কয়ারে প্রবেশের পথে এই হনুমান মূর্তিটি অবস্থিত। নির্ধারিত সময় বিকাল পাঁচটার বেশি বেজে যাওয়ায় ভেতরে ঘুরে দেখা হয়নি। তবে প্রবেশপথের ভেতরেই এক প্রহরী আদি আমলের পোশাকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাকে দেখে অনেকাংশেই স্মৃতিতে প্রাচীন আমলে ফিরে গেলাম।

দরবার স্কয়ারের প্রহরী 

এর অন্যপাশেই কিশোরী দেবী তৃষ্ণা সখ্যর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। টিকেট কাটতে হলো। ১৫০ রুপি। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর উপরের তলার জানালায় এসে তিনি দেখা করে আবার ফিরে গেলেন। এখানে দেবীর ছবি তোলা একেবারেই নিষিদ্ধ। দেবী দর্শন শেষে বেরিয়ে পাশেই নেপালের সংস্কৃতির বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বসে পড়া ভবনের সামনে সবাই মিলে গ্রুপ ছবি তুলে ফেললাম। 

দরবার স্কয়ারের এই ভবনেই কিশোরী দেবীর দর্শন মিলে 

দরবার স্কয়ার থেকে ফেরার পথে থামেলের পাইকারি সব দোকান থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে রাখতে পারেন। মার্কেট রাত ৮টার পর থেকে বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। 

সুন্দর সব পাহাড় বেয়ে পোখারায় যাত্রা:
কাঠমান্ডু থেকে পরদিন সকালেই যাত্রা শুরু হলো পোখারার উদ্দেশ্যে। ২১০ কিলোমিটারের পথ। প্রায় ৭/৮ ঘন্টার যাত্রা। শহরের গলিপথ শেষ হতেই পাহাড়ি অঞ্চলের শুরুতেই পড়লো নাগডুঙ্গা চেকপোস্ট। তারপর থানকোট। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ের সড়ক বেয়ে ট্যুরিস্ট বাস এগিয়ে চলতে লাগলো। এক সড়কে বসেই বোঝা গেলো পরবর্তী কোন সড়ক আমাদের সঙ্গি হচ্ছে। বলতে গেলে পাহাড়ের কাঁধ বেয়ে আমরা এগিয়ে চললাম দীর্ঘ ৭/৮ ঘন্টার যাত্রার উদ্দেশ্যে।
পাহাড়ি জনপদে মেঘের ওড়াউড়ি 
ত্রিশূলী নদীর পাড় ধরে এঁকেবেঁকে গেছে পখ। নদী পাদদেশের দুপাশে অলস বসে আছে ছোট-বড় পাথর। সুদীর্ঘ পাহাড়ের পাশ ঘেরা সড়কে অনবরত গাড়ীদের চলাচল। কোথাও কোথাও চলছে সড়ক নির্মাণ বা বিনির্মাণ। চারপাশের পাহাড় মেঘের সাথে নীল-সবুজে হয়ে মিশে গেছে। খাঁজ কাঁটা পাহাড়ের শরীরজুড়ে রঙ-বেরঙের ভবন চোখ এড়ায়নি কারো। তীর্যক রোধ। মায়াঘেরা প্রকৃতির অপরুপ পাহাড়গুলোয় রয়েছে মানুষের চলাচলহাটঁ-বাজারস্কুলরেস্টুরেন্ট। মানুষের মতই সেসব পাহাড় আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে বয়ষ্ক বা কিশোর কাঁচা-বুড়ো সবুজ বা শুকনো পাতার বৃক্ষরাজি। পথ যত এগোতে থাকলো ততোই সড়কপথে দেখা মিললো দুপাশে ঘিরে থাকা পাহাড়ি সৌন্দর্য্য। যাত্রা বিরতি হলো হিমালয় লাভা কফি শপে। ছবি তোলার মতো সুন্দর একটি জায়গা। 
পাথুরে খরস্রোতা ত্রিশূলী  নদী 

আরেকটু পথ এগিয়ে মালেখু এলাকায় ব্লু হ্যাভেন রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেলাম। এখানকার নদীর মাছ সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। রেস্টুরেন্টের পেছনে ছবি তোলার মতো সুন্দর সব জায়গা দেখতে পাবেন। দুপুরের খাবার শেষে পোখারার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। 

চারটি পাহাড় ডিঙিয়ে নিয়ে গেলো ক্যাবল কার:
পোখারা যাওয়ার পথেই মনোকামনা নামক স্থানে পাওয়া যাবে ক্যাবল কারে ভ্রমণের সুযোগ। ক্যাবল কারে করে অনেকেই মনোকামনা মন্দিরে গিয়েছেন মনের প্রার্থণা পূরণের লক্ষ্যে। প্রতিজন ১০ ডলার করে খরচ। বৃহৎ চারটি পাহাড়ের উপর দিয়ে অতি নিরাপদ ক্যাবল কারগুলো মনোকামনা মন্দিরের কাছে গিয়ে পৌঁছে। ক্যাবল কারে চড়তে গিয়ে পাহাড়ি মানুষগুলোর জীবনচিত্র নিমিশে পরোখ করা গেলো। ওপরে গিয়ে মনে হলো এ যেন আরেকটা শহর। দুইপাশের দোকানগুলো পূজাসামগ্রীতে সাজানো। সেখান থেকে ঘুরে এসে গাড়ী ছাড়লো পোখারার পথে। কতদূর যেতেই মুগলি এলাকা। কাছেই দুটো ব্রিজ। ব্রিজের তলদেশ থেকে ত্রিসুলি নদী ও মৈশালি নদী আলাদা হয়ে গেছে। আমরা মৈশালি নদীর পাড় ধরে পোখারা পৌঁছালাম। পোখারা পৌঁছাতেই দেখা মিললো বৃষ্টির সঙ্গে। সবমিলিয়ে পরিবেশটা আরও আনন্দময় হয়ে উঠলো। রাতে শীত শীত অনুভব নিয়ে সড়কে হেঁটে বেড়াতেও ভালোলাগলো। পোখারার লেকপাড় ও লেকসাইড রোড হেঁটে হেঁটে মুগ্ধ হওয়ার মতো জায়গা। সড়কজুড়ে হোটেলস্পা সেন্টারডান্স বারসুপারশপসহ কাপড়ের দোকান রয়েছে।
 

ক্যাবল কার-গন্ডোলা রাইডে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ 

সারনকোটের সূর্যদয়ে ঘুম ভাঙলো হিমালয়ের:
সূর্যদয় দেখতে সারণকোটের উদ্দেশ্যে ঘুম ভাঙলো ভোর ৫টায়। এরপর পোখারার হোটেল থেকে মাইক্রোতে চড়ে পাহাড় ছেড়ে অন্য পাহাড়ে সারণকোটের উদ্দেশ্যে এগোতে থাকলাম। তখনও শহর ঘুমিয়ে। তবে ঘর-বাড়ির সামনে জমাট হয়ে ছিলো জোনাকির মতো আলোর সমারোহ। নির্জন ওই পরিবেশ। গাড়ী এদিক ওদিক হলেই খাদে পড়ে জীবন হারানোর শঙ্কা সবসময়। তবে ভয়কে জয় করে সারনকোটে পৌঁছে যাই। 
সারণকোটে সূর্যোদয় 

কিছুপথ হেঁটে আরও ওপরে এক ছোট ভবনের ছাদে উঠে পড়লাম। এখান থেকে দেখা যাবে অপার মহিমার সূর্যদয় ও হিমালয়। অপেক্ষা বাড়তে থাকলো। সময়ের বহতায় আলোকজ্জ্বল হতে শুরু করলো চারপাশ। পাহাড়ের আড়াল আকাশের সাদা মেঘের লাল আভার চাদর থেকে উঁকি দিতে শুরু করলো কাঙ্খিত সূর্য। মূহুর্তে সূর্যের আলোয় দূরে হিমালয়ের ঘুম ভাঙলো। সূর্যের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার চোখে হিমালয় আরও স্পষ্ট হতে শুরু করলো। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমরা গ্রুপ ছবিটিও তুলে নিলাম। এরপর আরেক অ্যাডভাঞ্চার প্যারাগ্লাইডিংয়ের উদ্দেশ্যে ফিরে এলাম হোটেলে।

সূর্যোদয় দেখতে জাতীয় পতাকা আবৃত লেখক 

মানুষ হয়ে পাখির মতো আকাশে উড়লাম:
ডানা না থেকেও পাখিদের মতো আকাশে উড়ার অভিজ্ঞতা পাইয়ে দিলো প্যারাগ্লাইডিং। আগে থেকেই রুপি/ডলার দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে রাখতে হয়। আমাদের খরচ পড়েছিলো ৩৫০০ রুপি। ওদের অফিস থেকে একটি ফরমে প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে হলো। এরপর মাইক্রোতে করে পাইলট ও প্যারাস্যুট সঙ্গে নিয়ে দল ভাগ করে রওনা হলাম সারনকোটের দিকে। প্রায় ২৫০০ ফিট ওপর দিয়ে আমরা উড়ে বেড়াবো। ওজনভেদে পাইলটরা যাত্রীদের বাছাই করে নিলেন। পাইলট প্রথমে কয়েকবার তার প্যারাস্যুট উড়িয়ে ঠিক আছে কিনা পরোখ করে নিলেন। এরপর যাত্রীকে প্রয়োজনীয় বেল্টসহ তার সঙ্গে বাঁধলেন। প্যারাস্যুটকে পোশাকের সঙ্গে যুক্ত করে বাকি কাজটুকু শিখিয়ে দিলেন। 

পাখির মতো ওড়া-পেরাগ্লাইডিং 

তেমন কিছুই নাপাইলটের সঙ্গে চার/পাঁচ পা হেঁটে পা উঠিয়ে নিলেই হয়ে গেলো। আপনার উচ্চতা নিয়ে ভয় না থাকলে প্যারাগ্লাইডিং আপনার কাছে আনন্দ ছাড়া ভয়ের মনে হবেনা কখনোই। নারী-শিশু কেউ বাদ যাচ্ছেননা অবারিত আকাশের ওড়াউড়ির আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে। পাইলট নিজেই তার ক্যামেরা থেকে ছবি-ভিডিও করে দিলেন। ১৫ থেকে ৩০ মিনিটের মতো আকাশে হাত দুটোকে ডানা বানিয়ে উড়লাম। নীচেই ছিলো সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে ওঠা লেকের পানিপাহাড়ি বসতীদোকান আর উঁচু উঁচু পাহাড়। তবে বেশিক্ষণ উড়তে চাইলে বা উড়ে বেড়ানোকে আরও অ্যাডভ্যাঞ্চার করতে চাইলে রুপিও বাড়িয়ে দিতে হয়। প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে কিছুক্ষণ পর প্যারাগ্লাইডিং শেষ করলাম। এরপর মাইক্রোতে চড়ে আবার হোটেলের দিকে রওনা করলাম।   

গুপ্তেশ্বর কেভ যেন একরাশ ভয় নিয়ে জেগে আছে:
গুপ্তেশ্বর মন্দিরে প্রবেশ করলাম একশত রুপি দিয়ে টিকেট কেটে। কিছূদূর যেতেই মনে হলো হয়ত মন্দিরের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। কিন্তু ভয়ঙ্কর পাথরে মোড়ানো গুহাটি ভেতর থেকে চলে গেছে বহুদূর পর্যন্ত। চোখ বন্ধ করে নিশ্চুপ পাহাড়ের ভেতর ঝর্ণার পানি পড়ার শব্দ শুনতে পাবেন। খুব শীতল পানির ছোঁয়া মনকে প্রশান্ত করে তোলে।
 

গা ছমছমে গুপ্তেশ্বর গুহা 

ডেভিলস ফলস:
একটি ব্রিটিশ দম্পতি ঝর্ণায় ঢুবে মারা গিয়েছেন। এরপর থেকেই জায়গাটির নাম ডেভিলস ফলস। আশি রুপিতে টিকেট কেটে প্রবেশ করতে হয়। ভেতরে ছোট একটি ঝর্ণাফুলের গাছ আর নেপালি সংস্কৃতির ছায়ামুর্তি রয়েছে। নেপালে আসা বৃটিশদের যেন মিলনমেলা এই ডেভিলস ফলসে।

মায়াময় ফেওয়া লেকে নৌকা ভাসিয়ে মন্দির দেখতে: 
ফেওয়া লেকটি পোখারায় বেশ সুপরিচিত। এই লেকের একপাশে সুউচ্চ পাহাড় ও অন্যপাশে পোখারা শহর। ছোট ছোট নৌকায় চারজন করে যাত্রী নিয়ে রওনা হলাম গ্রুপের প্রায় সকলেই। নানান রঙের নৌকাগুলো বাইতে গিয়ে কেউ গান ধরলেন। কেউ পানিতে হাত ছোঁয়ালেন। এভাবে লেকের মাঝখানের জমাটবদ্ধ চরে গড়ে ওঠা মন্দির থেকে ঘুরে এলাম। বিকাল হতেই চারপাশের আবহাওয়া এক অচেনা মায়ায় জড়িয়ে গেলো। সাদা-কালো মেঘমালা পাহাড় ছোঁয়ার আনন্দে মেতে উঠলো। প্রবল বেগে বাতাস বইতে শুরু করলো। ধুলিঝড় থামলেই বৃষ্টির লুকোচুরি দেখা মিললো লেকপাড়ে।

ফেওয়া লেকে সারি সারি নৌকা 

শহর থেকে অস্পষ্ট পামডিকোট শিব মন্দির:

লেকপাড় থেকেই প্রাইভেট কার ভাড়া করে দেখতে গেলাম পামডিকোট শিব মন্দির। সমুদ্র লেভেল থেকে প্রায় ১ হাজার ৫০০ ফিট ওপরে মন্দিরটির অবস্থান। পোখারা শহর থেকে এই মন্দিরটির আকৃতি বোঝা গেলেও তার ব্যাপ্তি যে কত বড় তা কাছে না গেলে অনুভব করা সম্ভব নয়। বৃষ্টিমেখে পাকা ও কিছুটা কাঁচা পথ ধরে প্রাইভেট কার পাহাড়ে বেয়ে উঠতে থাকলো। রাস্তায় স্লিপ কাটার ভয় থাকতেও সংকোচহীনভাবেই ড্রাইভার লক্ষ্যে নিয়ে পৌঁছালেন। এখান থেকে পুরো ফেওয়া লেকপাড়ের পোখারা শহরকে খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করা যায়। এরপর বিশালাকৃতির শিব মন্দির থেকে পাশেই দোকানের চালার নীচে আশ্রয় নিলাম। সেখানেই বৃষ্টির আরও কিছু সময় ঘন হয়ে আসতে থাকা পাহাড়ী প্রকৃতি উপভোগ করলাম। সন্ধ্যা নামতেই আমাদের ফেরার অপেক্ষা শেষ হলো। পলি ব্যাগে কোনরকম মাথায় মুড়িয়ে বৃষ্টির মধ্যেই আমরা গাড়ীতে এসে পৌঁছাই। এরপর হোটেল এবং সেখান থেকে আবারও রাতের পোখারা শহরে হেঁটে বেড়ানো। 

পামডিকোট শিবমন্দির 

তৃতীয়দিন কাঠমান্ডু ফিরে আসা:     
সকাল সকাল পোখারাকে বিদায় জানাতে হলো। ট্যুরিস্ট বাসে চড়ে আবারও কাঠমান্ডু শহরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। মাঝখানে ব্রেক দিয়ে ঝুলন্ত ব্রিজে ছবি তোলা ও দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। ফেরার পথেই কাঠমান্ডু হোটেল থেকে সামান্য দূরত্বে থাকা কালাঙ্কিতে অবস্থিত ভটভটিনি সুপার মার্কেটে সকলেই কেনাকাটা করলাম। এখানে কসমেটিকসশুকনা খাবারচকোলেটশ্যাম্পু দেশের বাজারের তুলনায় প্রায় অর্ধেক দামেই পাওয়া গেলো।

বৃষ্টি স্নিগ্ধ রাতের পোখারা 

থামেলজুড়ে দোকানের পসরা বসেছে:
কাঠমান্ডু শহরের অর্ধেকটা আমাদের মতিঝিল এলাকার মতো। সেখানে পার্লামেন্টসহ সব বড় বড় কর্তা-ব্যক্তির অফিসওয়ার্ল্ড হেরিটেজ মন্দির পার্ক রয়েছে। আর বাকি অর্ধেক শহর পুরাতন ঢাকার মতো সীমিত সড়ক কিন্তু জনসমাগমপূর্ণ। থামেল এলাকাটিও ঠিক তেমনই। প্রচুর দোকান। দামদর করতে পারলে এখান থেকে স্বল্পমূল্যে নেপালী-কাশ্মীরি শালনেপালী টুপিমাফলারপিতলের বাটি-মূর্তিশোপিচ সহ অনেককিছুই কিনে নিতে পারবেন।

নেপালের স্মৃতি নিয়ে ফেরা:
পরেরদিন সকালেই কাঠমান্ডু ত্রিভূবন বিমানবন্দরের দিকে যাত্রা করলাম। আমাদের ট্যুর গাইড জ্যোতি কার্কির ব্যবহার খুবই ভালো ছিলো। ডলার ভাঙানো থেকে বাড়তি খরচ করা থেকে রক্ষা পেতে তার পরামর্শ বেশ কাজে দিয়েছে। যেভাবে জ্যোতি আমাদের বরণ করেছিলো সেভাবেই হাসিমুখে বিদায় জানালো। বহির্বিশ্বে এমন ট্যুর গাইড পাওয়া সৌভাগ্যের। বাংলা ভাষা বুঝতে পারায় আমাদের অনেকেই তার দ্বারা ভাষাগত অসুবিধা এড়াতে সক্ষম হয়েছিলো। তাকে বিদায় জানিয়ে আমরা বিমানবন্দরে ফিরলাম। ইমিগ্রেশনের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে জানতে পারলাম বিমান দেরীতে আসার কথা। সুতরাং অপেক্ষা করতেই হলো। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। রানওয়ে থেকে ওঠার পর সাদা মেঘের বারংবার ধাক্কা সত্ত্বেও বিমান বাংলাদেশের ফ্লাইটে আমরা ১ ঘন্টা ২০মিনিট পর বাংলাদেশের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালাম। সেখানেও ইমিগ্রেশনের কিছু কাজ শেষ করতে হলো। এরপর আনন্দঘন স্মৃতিময় দিনগুলোকে সঙ্গী করে প্রিয়ঘর ও প্রিয়জনদের কাছে ফিরে এলাম। 


জাতীয় পতাকার সাথে অভিযাত্রী দল 

লেখক: সাংবাদিক ও আইনজীবী 

ইমেইল: emran.bae71@gmail.com


Post a Comment

2 Comments

  1. সুন্দর সুন্দর জায়গা!

    ReplyDelete
  2. ভালো লাগলো।

    ReplyDelete