বাংলাদেশি সংস্কৃতি: হিজাব ও টিপ সমাচার ।। আকাশ মামুন সরকার



সম্প্রতি বাংলাদেশে টিপ ও হিজাব পরা নিয়ে অবমাননা ও বিতর্ক চলছে বেশ জোরেশোরেই। হাজার বছর ধরে পারস্পরিক সহাবস্থানের তবে কি ভাটা পড়ছে? না কি নিছক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? এটার স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে তাকাতে হবে সাতচল্লিশের দাঙ্গার দিকে। সাতচল্লিশের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার পরও এ অঞ্চলে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ পারস্পরিক সহাবস্থান করে আসছে দশকের পর দশক ধরে। তবে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ নিজেদের অসৎ স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য মাঝে মাঝে অসহিষ্ণু অবস্থার সৃষ্টি করে-যা সংখ্যাগুরুর অবস্থান নয় বলেই প্রতীয়মান হয়। 


এবার যাওয়া যাক হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতিতে পর্দা প্রথা আর টিপের প্রচলনের সুলোক সন্ধানে। বর্তমানে বাংলাদেশকে বলা হয় নব্বই ভাগ মুসলিমের দেশ। কিন্তু এই অবস্থা চিরস্থায়ী ছিল না। কয়েক দশক আগেও এটা ছিল পঁচাশি ভাগ মুসলিমের দেশ। তারও আগে তাকালে ঊনিশশত সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের সময় ছিল সত্তর ভাগ মুসলিম। কাজেই অবস্থা পরিবর্তন হয়। আর অবস্থা পরিবর্তন হলেই যে মানুষের অধিকার নিগৃহীত হবে এমন আইন ধর্ম বা মানব সভ্যতা অনুমোদন করে না। ভারত বিভাগের সময় যে মুসলিম চেতনা বৃটিশদের সাথে সংগ্রামে বড় হয়ে উঠেছিল এবং ফলশ্রুতিতে ভারত বিভাগ হয়েছে, একাত্তরে সেই মুসলিম চেতনা ছাপিয়ে বাঙালি চেতনা বড় হয়ে উঠেছিল-ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু মাত্র পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে সেই বাঙালি চেতনা ছাপিয়ে কি আবার মুসলিম চেতনা বড় হতে চলছে? স্বাধীনতার মূলমন্ত্রের দিকে তাকালে সেটা হবার কথা নয়। কারণ সাম্য ও ন্যায় বিচারের মন্ত্র নিয়ে মুসলিম পরিচয় ছাপিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল এবং সেই আকাঙ্ক্ষা যে কমে গিয়েছে সেটা ভাবার কোন কারণ নেই। 


সংস্কৃতি তৈরি হয়ে ইতিহাসের পরম্পরায়। বাংলাদেশের মেয়েরা এখন যে শাড়ি পরে সেটার প্রচলন শুরু হয়েছে ঊনবিংশ শতকে। তার আগে এই অঞ্চলের মেয়েরা শাড়ি পরিধান করতো না। আরও আগে মেয়েরা দুই টুকরো কাপড় দিয়ে লজ্জা নিবারণ করতো। যেমনটা বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ে এখনও দেখা যায়। প্রায় দেড়শত বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই সতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী শাড়ি পরে কলকাতার গড়ে বেড়াতে গেলে সেটা খবরের কাগজে  ওঠেছিল। এখন এটাকি বলার সুযোগ আছে শাড়ি বাংলাদেশি বা বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়? আজকের মেয়েরা সে স্যালোয়ার কামিজ পরে তা মূলত উত্তর ভারতের পোশাক ছিল। যে অন্তর্বাস পরে সেটাও দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছে। আজকে বাঙালি পুরুষেরা যে স্যুট-টাই পরে সেটাও তো বাঙালি পোশাক নয়-সেটা নিয়ে তো কাউকে মাতামাতি করতে দেখা যায় না! কাজেই সংস্কৃতি কখনও স্থায়ী কিছু নয়। এটা বহতা নদীর মতো। স্রোতের সাথে যা আসে সেটাকে আপন করে নেয় কখনও-কখনও পরিত্যাগ করে নতুন কিছুকে গ্রহণ করে। তাইতো সত্তরের দশকে কাবুলি নামে পুরুষের যে পোশাক পরতে দেখা যেতো এখন সেটা আর খুব বেশি চোখে পড়ে না। 


বাঙালি হিন্দু মেয়েরা অনেক আগে থেকেই টিপ পরে। বাঙালি মূলত একই জাতি। ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দু থেকে মুসলিম হয়েছে। এখন ধর্মান্তরিত হবার কারণে তার টিপ পরার বৈধতা থাকবে কি থাকবে না সেটার তাত্ত্বিক আলোচনা হতে পারে। তাই বলে কেউ টিপ পরলে তাকে আক্রমণ করা যাবে এমন বৈধতা কোন আইনই দিবে না। 


আবার পর্দা প্রথার কথায় গেলে ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় ভারতবর্ষে মুসলমানরা আসার আগেই পর্দাপ্রথা ছিল। খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে অবরোধবাসিনী এবং অসূর্যম্পস্যা শব্দ দুটি পাওয়া যায়। রামায়ণে সীতাকে রামের সঙ্গে বনে যাবার সময় বিলাপ করে বলতে শোনা যায়-যার মুখ কেউ কখনও দেখেনি তিনি আজ পায়ে হেঁটে বনে যাচ্ছেন। জাতকের কয়েকটি গল্পে পাওয়া যায় রাজমহিষীরা আচ্ছাদিত চতুর দোলায় চড়ে রাজপথে বের হয়েছেন। প্রাচীন ভারতে অবরোধ ছিল অভিজাত মহিলাদের যৌনসূচিতার প্রতীক। আমার ছোট বেলায় দেখেছি নানী-দাদীরা শাড়ি বা চাদর দিয়ে রিক্সা বা গরুর গাড়ি আচ্ছাদিত করে বাপের বাড়ি বা আত্মীয় বাড়ি যেতেন। গত দশকেও যশোরের প্রত্যন্ত গ্রামে এরকম রিক্সা-ভ্যান দেখেছি। সংস্কৃতি নাটক মৃচ্ছকটিকে গণিকা যখন কূলবধুর সম্মান পায় তখন অবরোধের চিহ্ন হিসেবে তার মুখ ঘোমটায় ঢেকে রাখে। এই ঘোমটা যেন তেন ঘোমটা নয়-লম্বা করে টানা। যেমনটা এখনও পুরনো আমলের দাদী-নানীদের মাঝে কোথাও কোথাও দেখা যায়। আবার বর্তমানের মতো তখনও কেউ কেউ পর্দার প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন। ললিতবিস্তারে বুদ্ধের বাগদত্তা গোপা পর্দার বাইরে এসে বলেছিলেন স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে আমার পর্দার প্রয়োজন নেই। মেয়েদের পর্দা যে শুধু আরব বা ইসলামের সংস্কৃতি তাই নয়-প্রাচীন ভারতেরও সংস্কৃতি। অথচ এই পর্দাপ্রথাকে পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশের একশ্রেণি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জুলুম বলে চিহ্নিত করতে চান। 


পর্দা প্রথা আসলে জুলম কিনা সেটা দেখার জন্য একটু ইতিহাস দেখতে হবে। এই উপমহাদেশের নারীরা প্রচণ্ড স্বাধীনচেতা। তাদের উপর কোন কিছুই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। বৃষ্টিশ ভারতের আন্দোলনের দিকে তাকালে দেখা যাবে প্রীতিলতা, কনকলতা, বীণা দাস,  সরোজিনী নাইডুমাতঙ্গিনী হাজরা, নাচোলের কৃষক বিদ্রোহে ইলা মিত্র কিংবা একাত্তরে তারামন বিবি, সেঁতারা বেগমদের মতো স্বাধীনচেতা নারী। এই অঞ্চলের নারীদের উপর কোন কিছুই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না-যদি না তারা নিজে থেকে গ্রহণ করেন। তাইতো পশ্চিমা সংস্কৃতি আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জেঁকে বসলেও মেয়েদের বড় একটা অংশ এখন অব্দি পশ্চিমা পোশাক গ্রহণ করেনি। তাই তারা হিজাব বা টিপ পরলে সেটা ঠেকাবে কে?


Post a Comment

1 Comments

  1. বিশ্লেষণাত্মক পোস্ট!

    ReplyDelete