পুতিন কেন ইউক্রেনের দখল নিতে চায়? এই প্রশ্নটা না বুঝলে আমরা ইউক্রেন যুদ্ধের মূলে যেতে পারবো না। আমরা এটাও বুঝোতে না পারলে এটাও বুঝোতে পরবো না কার দোষ কতটুকু। সমস্যাটার গভীরে যেতে পারলে আমরা ভূরাজনীতির অনেক কিছুই বুঝোতে পরবো আর নিজেদের জন্য শিক্ষা নিতে পরবো। এই ঘটনা থেকে নিজেদের জন্য শিক্ষা নেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে কয়েকটা বাফার (দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী অঞ্চলের মাঝামাঝি) অঞ্চল আছে। সে অঞ্চলের দখল নিতে দুই পক্ষই মরিয়া থাকে। সরাসরি দখল না নিলেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তুরস্ক হতে পারে একটা উদাহরণ। তুরস্ক ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে একটা বাফার রাষ্ট্র। তাই পশ্চিমা বিশ্ব সবসময় নিজেদের প্রভাব বলয়ে নিতে চায়। তাইতো কামাল আতাতুর্কের হাতে বিপ্লব হয়েছিল এবং সেই বিপ্লবে তথাকথিত “সেকুলারিজম” প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের নিরাপত্তা বাড়িয়েছিল।
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় রাষ্ট্রগুলোকে সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় কে কখন আমাকে আক্রমণ করে। তাই আগে থেকেই নীতিগত বা পরিকল্পনাগত পরিবর্তনের মাধ্যমে সে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাকে প্রতিহত করে। সতেরশতক থকেই কৃষ্ণ সাগরের উত্তর অংশের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার নিরাপত্তা আর অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়। কারণ রাশিয়া যদি কখনও আক্রান্ত হয় তবে কৃষ্ণ সাগরের উত্তর অংশ বা ইউক্রেন দিয়েই আক্রান্ত হবে। সেটা ইতিহাস প্রমাণিত। হিটলার ইউক্রেন দিয়েই সোভিয়েত রাশিয়ায় ঢুকেছিল। ন্যাটো যদি কখনও রাশিয়াকে আক্রমণ করতে চায় তবে সেই পথেই ঢুকবে। তাই ইউক্রেন যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়-সেই বাফার রাষ্ট্র যা তাকে পশ্চিম থেকে আলাদা রাখতো তা আর থাকছে না।
আবার উল্টো দিক থেকে ন্যাটোর জন্য ইউক্রেইন সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ন্যাটোর সবচেয়ে দূর্বল জায়গা হচ্ছে পোল্যন্ড ও লাটভিয়ার মধ্যে ইউক্রেনের (পোল্যন্ড ও লাটভিয়া ন্যাটোর সদস্য) সুভাইকিক গ্যাপ। ঠিক ভারতের চিকেন ন্যাকের (বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্য ছোট অঞ্চল দিয়ে বিভক্তকারী ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো) মতো। ফলে ইউক্রেইনকে নিজেদের দিকে রাখতে পারলে রাশিয়ার নিরাপত্তা অনেকটাই শক্তিশালী হয়। তাহলে কি এই কারণেই রাশিয়া ইউক্রেনের বেপারে খুবই আগ্রহী? সহজ উত্তর হলো না।
প্রথমত পুতিনের একটা সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাভিলাষ অবশ্যই আছে। এটা ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটা কারণ আছে। সেটা বুঝতে হলে রাশিয়ার অর্থনীতি ও বিদেশ বাণিজ্যের দিকে তাকাতে হবে। ইউরোপে যে গ্যাস আসে সেটার যোগানদাতা রাশিয়া। যা ইউক্রেইন দিয়ে পাইপ লাইনে ইউরোপে ঢুকে। সোভিয়েত জামানায় ইউক্রেইন যখন রাশিয়ার অংশ ছিল তখন পাইপ লাইনগুলো বসানো। সোভিয়েত ভেঙে গেলে ইউক্রেইন গ্যাস ট্রানজিটের জন্য রাশিয়ার কাছও থকে উচ্চ হারে ফি নিয়ে যাচ্ছে। পোল্যন্ডের মধ্য দিয়ে এক হাজার ঘনফুট গ্যাস একশত কিলোমিটার ফি নেয় এক ডলার আর ইউক্রেইন নেয় আড়াই ডলার। এটা নিয়ে রাশিয়া বেশ নাখোশ। তাছাড়া ইউক্রেইন মাঝে মাঝে পাইপ থেকে গ্যাস অবৈধ ভাবে নিজেদের কাজে ব্যবহার করে। সেটা ধরা পড়ে স্বীকারও করেছে। যেটা একেবারেই নিম্নস্তরের কাজ।
ইউক্রেনকে এইসব বেপারে শাস্তি দিতে ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। দুইটা কারণ আছে ক্রিমিয়া দখলের। ক্রিমিয়ায় ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সেটা রাশিয়া নিজেদের দায়িত্বে তুলতে চায়। দখলের পিছনে অন্য যা কিছুই যুক্তি দিক না কেন-গ্যাস উত্তোলনই প্রথম উদ্দেশ্য।
দ্বিতীয় কারণ হলো—ক্রিমিয়ার বন্দর সেবাস্তাপল। সেবাস্তাপল শীতে বরফে ঢাকা থাকে না। অন্যদিকে অউরোপের বন্ধরগুলো শীতে বরফে ঢাকা পড়ে যায় ফলে জাহাজ চলাচল বিঘ্নিত হয়। যেহেতু এই বন্ধর বরফে ঢাকা থাকে না তাই সারাবছর এই বন্দর যুদ্ধ জাহাজের জন্য রাশিয়া ব্যবহার করতে পারবে। আর অবস্থানগত ভাবে এখান থেকে পুরো ইউরোপে যুদ্ধ জাহাজ পরিচালনা করা যাবে। কিন্তু ক্রিমিয়া দখলের পর অন্য সমস্যা দেখা যায়। ক্রিমিয়াতে মিঠা পানির উৎস নেই। যেটা আসে ইউক্রেন থেকে একতা খাল দিয়ে। রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়াও ইউক্রেইন সেই খালে বাঁধ দিয়ে পানি আসা বন্ধ করে দিয়েছে ইউক্রেইন।
মূলত এই তিনটা বিষয় সমাধানের জন্য রাশিয়া আক্রমণ করেছে ইউক্রেইনে। তাড়া নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যএ সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। যারা ভাবছেন রাশিয়া পশ্চিমকে দেখাতেই এই যুদ্ধ করছে তাদের সাথে আমি একমত নই। এটা পশ্চিমকে শক্তি দেখানো নয়। এটা মূলত রাশিয়ার অস্তিত্ব অর্থনৈতিক টিকে থাকার লড়াই। দায় দুই পক্ষেরই আছে । তবে আগ্রাসন সমর্থন যোগ্য নয়। সেটা আমার শত্রু দেশেহলেও নিন্দনীয়। যুদ্ধে মূলত মরে সাধারণ মানুষ আর সৈনিক-রাজনীতিবীদরা নয়। যুদ্ধ দেখে আমরা যেন উল্লসিত না হই। যুদ্ধ কখনও খন অনিবার্য হয়ে পড়ে । কিন্তু মানুষতো ধ্বংসের জন্য আসেনি—এসেছে সৃষ্টির জন্য। আমরা কখনও কখনও নান জাতি-ধর্ম-বর্ণ-আদর্শে বিভক্ত হয়ে একে অন্যকে নিশ্চিহ্ন করতে মরিয়া হয়ে উঠবো,না সবাই মিলে একটা বসবাসযোগ্য পৃথিবী বানাবো সেই প্রশ্ন রেখে গেলাম সভ্য পৃথিবীর কাছে।
লেখকঃ লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
0 Comments