কবিতা অনেক রকম। বৃক্ষ শ্রেণিতে যেমন অনেক ধরণের গাছের সন্ধান মেলে তেমনি কবিতার জগতে হরেক কিসিমের কবিতা আবিস্কৃত হয়। আকাশ মামুন কবি। তার প্রথম কবিতার বই পড়ে সে কথা স্বীকার না করে উপায় নেই। কবি বন্ধু হিসেবে আমি আকাশ মামুনের কবিতায় আশা করেছিলাম, আকাশ, মেঘ, চাঁদ, নক্ষত্রসহ হামুখো আনন্দ—দিগন্ত দেখতে পাবো। কিন্তু সেই ভাবনা পুরোপুরি নব্বই ডিগ্রী ঘুরে গেল। এখন চোখ উল্টিয়ে আমাদের আবৃত্তি করতে হবে মাটি, বায়ু, ধান ও গৃহস্থের ব্যথা ও বেদনা। সত্যিই যা আমাদের নাগরিক জীবনের লোভের সামনে যেন তেতুলে লবণ লাগিয়ে তিনি একের পর এক হাজির করেন তার কাব্য ও জীবনের আরাধ্য।
প্রথম কবিতা ‘বিছন ধানের কথকতা’য় চৈত্রের নোনতা বাতাস, ধানের গোলা, মেটে ইঁদুর, অপক্ক কৃষণী, বিছন ধান, কুশি গজানো, ভোজন ধানের পরিবেশনা পুলকিত করে। চিন্তার নতুন মাতৃপুটে তিনি পাঠকের বিচরণ করান আনন্দ-বেদনার কাব্য পাঠ করিয়ে। এর ‘ধানক্ষেত’ কবিতায় সচ্ছল পুরুষ, আগামীর অঙ্কুর, স্থাবর অধিকার ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে কবিতায় তৈরি করেন ভিন্ন রকমের দ্যোতনা। একই রকম মাতোয়ারা নিয়ে তার কবিতার শব্দ ও শরীর নারীর নিটোল চিবুকের মতো টানটান করে রাখে।
‘মিছিলে এসো’ এই কবিতায় কবির আরেক চরিত্র ধরা পড়ে। পূর্ববতী সচ্ছল পুরুষের স্বরে যেন কম্পমান কোনো প্রতিবাদী তরুণ। সে মিছিলে স্লোগান দেয়া এক বিশ্বপুরুষের কাতারে সামিল হওয়ার তুমুল আগ্রহে তার জীবনের সবকিছু জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত এক যোদ্ধা কবি। এমন কি সমাজের অসময়ে আহবান করেন সবাইকে প্রতিবাদী হতে। ‘রাঙা বৃষ্টি’ শিরোনামের কবিতায় কামুক-প্রেমিক কবির দেখা মেলে। টুপটুপ বৃষ্টি ঝরে পড়লে তার ইসরাফিলী সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে। মাগরিবের আযানের ভেতর দিনের ও মানুষের করুণ সুর আবিস্কার করেন কবি। এই ইসরাফিলী সন্ধ্যার সাথে মাগরিবের করুণ সুর মিলেমিশে একাকার করা এ সত্যিই একদম নতুন ও চমৎকার উপমা। এই অভিনব দৃশ্যধারণে কবি যে মুন্সিয়ানা দেখান তাতে নিঃসন্দেহে তাকে পাঠ করা জরুরি হয়ে পড়ে। শুধু তিনি যদি কবিতার বাক্য গঠনে আরেকটু মনোযোগী হতেন তাহলে তার অনেক কবিতা দীর্ঘ আয়ু নিয়ে বায়ু ছড়াতো ভূমণ্ডলে।
স্মৃতি কাতরতা, অতীত রোমান্থন ‘আচমকা ফিরে আসুন’ কবিতার মূল বিষয়। পাঠে তৃপ্ত এই কবিতার নান্দনিক পশরা উপস্থাপন করেন কাব্যিকভাবে। সত্যিই তো মানুষ তার স্মৃতির ভেতর বেঁচে থাকেন। ‘বিকেল’ খুবই সুরেলা কবিতা। লাইনে লাইনে যেন রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাওয়া যায়। শব্দ একটু সেকেলে হলেও বর্ণনার শক্তিমত্তায় কবিতাটি সার্থক। ঘনঘোর আবহ তৈরি করে প্রেম ও বিরহকে দো-তারার মতো বাজিয়ে রাখা এই দুরুহ কাজটা এই কবিতায় দেখা যায়। ‘এমন তো কথা ছিল না’ কবিতায় ব্যক্তিক চাওয়া-পাওয়াকে নৈব্যক্তিকতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দারুণরূপে। মনোহর শব্দ আর ভাবনার গড়াগড়িতে কবিতাটি সুন্দরী হয়ে ওঠে।
কবিও রাজনীতির বাইরে নয়। প্রাচীন কৃষি সভ্যতার সাথে সাথে রাজনীতি ও সমাজনীতিতে যে পরিবর্তন তার সাথে সময় তাল মেলাতেই যেন হিমশিম খাচ্ছে। তাই রাষ্ট্রের নেতৃত্বে রয়ে যাচ্ছে ক্ষত ও গলদ। ফলে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে আমাদের বারবার পড়তে হচ্ছে দোটানায়। ‘কিংবদন্তির প্রতিক্ষায়’ কবিতা তিনি মুক্তিযুদ্ধের দুই অগ্রসৈনিক বঙ্গবন্ধু ও জিয়ার মতো সঠিক নেতার প্রতিক্ষায় আছেন। যেমনটা আজ পুরো জাতিও অপেক্ষা করছেন। ‘চিরন্তন ক্ষত’ কবিতায় রবীন্দ্র-নজরুল ছাড়াও সুকান্ত ও পঞ্চপা-বের ছায়া ঘোরে। জীবনানন্দের ভাবনা, বুদ্ধদেবের শব্দচয়ন, বিঞ্চুর তেজ, অমিয়’র অমিত বর্ণনা কবিতায় অগ্রজদের মনে করিয়ে দেয়। এ প্রভাব যেমন ভালো তেমনি খারাপও। এটা ঠিক যে বড় বৃক্ষের ছায়া তো ছোট বৃক্ষের উপর থাকবেই। কিন্তু ছোটকে বড় হতে হলে অবশ্য তাকেও ছায়াদানের অধিকারী হতে হবে।
‘ইবাদত’ কবিতায় ইসলামী মেটাফোরের ব্যবহার যথার্থ। ‘তৃষ্ণা’য় ইতিহাস ও ঐতিহ্য ওঠে আসে। ‘তুমিহীনা’ একটি নিটোল প্রেমের কবিতা। প্রতিবাদী যিনি তিনিই প্রেমিক। কথাটা আবারও সত্যে প্রমাণিত করেন কবি আকাশ মামুন। একই সাথে বিভিন্ন ধরণের, নানান গড়নের, বিচিত্র ভঙ্গিমার কবিতা তিনি উপহার দেন এই বইয়ে।
নষ্ট গণতন্ত্র, পচা গণিকার মতো ধুকছে স্বদেশ। এ নিয়েও কবির চিন্তার শেষ নেই। তিনিও উৎকন্ঠিত। ‘নিখোঁজ সংবাদ’-এ তা ধরা পড়ে দারুণভাবে। আবার ‘ঝিনাইয়ের পাড়ের মতো ক্ষয়ে গেছে মহকালের হঠাৎ ঢলে’র মতো মহাকাব্যিক লাইনও চোখে পড়ে। যা ‘দায়মুক্তি’ কবিতায় সমাজ-রাষ্ট্রের গলগলে ক্ষত ও তাদের নৈতিক চরিত্র স্খলনের দৃশ্যগুলো তুলে ধরেন দায়িত্ববানে। ‘উর্বর বৃষ্টি’তে কবি বৃষ্টিতে ভিজে পরিশুদ্ধ নিপাট ভালো মানুষ হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ‘সময়’ কবিতায় একজন পতিতার দিললিপি লিপিবন্ধ করেন শৈল্পিক দৃষ্টিতে। ‘আমার কোনো সাধ্য নেই’ একটি জনপ্রিয় ও আবৃত্তিযোগ্য কবিতা। পড়লেই মন ভালো হয়ে যায়। ‘নাচের পুতুল’-এ আশেক ও মাসুকের প্রেম তথা স্রষ্টা ও মানুষের মধ্যেও সম্পর্কে স্বার্থ ও নিঃস্বার্থেও বয়ান দেন। ‘পিছুটান’-এ নিজের গ্রাম, নিজের দেশ নিয়ে কবির মমত্ব প্রকাশ পায়। সবমিলে মেয়াদোত্তীর্ণ রাজমহল পাঠে যথেষ্ট সন্তুষ্ট প্রকাশ করতে বাধ্য হতে হয়। তাই আর দেরি না করে পড়ে ফেলতে পারেন কবির প্রথম কবিতা কিতাব।
0 Comments