আম গাছের ডালে গলায় ফাঁস লাগানো হাড় জিরজিরে আশিতিপর একটা লাশ ঝুলছিল। ফেসবুকে এমন একটা ছবি রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে। শেয়ার হয়েছে তের হাজার ছয়শত পঁচাত্তর বার। মন্তব্য পাঁচ হাজার নয়শত ছত্তিশ। প্রতিক্রিয়া দেখিছেছে একলক্ষ ছাব্বিশ হাজার নয়শত তেইশ জন। সাথেই একটি ভিড়িওতে দেখা যাচ্চে একজন বয়স্ক লোককে গ্রাম্য সালিশের বিচারে সাদা বাবরি চুলকে নেড়া করে দাঁড়ি-গোঁফ কামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। লোকটা অপমানে লজ্জায় নীরবে চোখের পানি ফেলছে। বার কয়েক হাতের তালু আর উল্টা পিঠে মুছেছেও সেই পানি। উপস্থিত মাতব্বর গোছের একজন চিৎকার করে বলছে গান-বাজনা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। এই বুড়া বয়সে মুখে পাকা দাঁড়ি নিয়ে তুমি গান-বাজনা করে বেড়াচ্ছ। রাসূলের অপমান। আল্লা-খোদার নাম নাই মুখে। আমরা সমাজের এটা হতে দিতে পারি না। সমাজকে নষ্টের দিকে যেতে দিতে পারি না। কি বলেন আপনারা? বলেই এদিক ওদিক সমর্থন পাওয়ার ভঙ্গিতে তাকালো।
বছর দশেক আগে উত্তর পাড়ার ইউনুস প্রামাণিকের সাথে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি নিয়ে কথাকাটাকাটি হয়েছিল। তার মাসও কয়েক পর ইউনুসের লাশ পাওয়া যায় বিলের ধানক্ষেতে। জ্যৈষ্ঠ মাসে সোলাই মণ্ডলের ছেলে পিতম মণ্ডলের সাথে দুধ কেনা নিয়ে কথাকাটি হয় লোকমান মুন্সির। পরের সপ্তাহেই ডাকাতির দায়ে জেলে যেতে হয় পিতমের।
উপস্থিত জনতার বেশির ভাগই হৈহৈ করে সমর্থন জানালো। একটা কেছড়া গোছের শার্ট-প্যান্ট পড়া মানুষ শুধু বলতে চেষ্টা করলো, এটা অন্যায়। এটা করা ঠিক হচ্ছে না। হোসেন গায়েনের কেউ নেই বলে আজ এমনটা করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ উপস্থিতির রৈরৈ সমর্থনে তার কথা চাপা পড়ে গেল। বিশেষ কোন প্রতিবাদ তৈরী করতে পারলো না।
হোসেন গায়েন। গায়েন আসলে উপাধি। ভালো গানের গলার জন্য গায়েন উপাধিটা পেয়েছে। বংশগত উপাধি ফকির। তবে মানুষ সেটা ভুলেই গিয়েছে। বয়স সত্তরের কোঠায়। গায়েন উপাধি পেলেও গানকে পেশা হিসেবে নিয়েছে বছর পাঁচেক হবে। আগে শরীরে যতোদিন তাগদ ছিল মানুষের জমিতে মজুর খাটতো আর অল্প বিস্তর বর্গা চাষ করতো। বয়সের ভারে এখন মজুর খাটতে পারে না। মানুষ মজুর হিসেবে তাকে আর নিতেও চায় না। গান গেয়ে যা আয়-রোজগার হয় তাতেই স্ত্রী নিয়ে সংসার চালায়। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। সংসার পেতে তারা দূর গ্রামে স্বামীর সাথে। তাদের কারোরই সংসার খুব স্বচ্ছল নয় যে নিজের কাছে নিয়ে রাখবে।
সংসারে উপার্জনক্ষম এক ছেলে ছিল। সালাম ফকির। ভ্যান চালাত। বছর ছয়েক হয় ট্রাক চাপায় মারা গিয়েছে। তারপর থেকে গানকেই পেশা হিসেবে নিয়েছে হোসেন। বলতে গেলে নিতে বাধ্য হয়েছে। তার কোন দল নেই। একা একাই গেয়ে যায়। বাদ্যযন্ত্র বলতে একটা দোতরা। সারা বছর হাটে-বাজারেই গায়। মৌসুম শেষ হয়ে গেলে যখন কৃষকের গোলায় ধান থাকে তখন উৎসব-পার্বনে দু একটা বায়না আসে। তখন অবশ্য জনা দুই তিনেক মৌসুমী সঙ্গী নিয়ে নেয়। একজন ঢোল বাদক, একজন হারমোনিয়াম আর একজন বাঁশি বাদক।
কোন রকম চলে যাচ্ছিলো। বিপত্তিটা বাঁধলো গেলো সপ্তাহে সনাতন পাড়ায় কিত্তন গাওয়া নিয়ে। লোকমান মুন্সি বাড়িতে খবর পাঠিয়েছিল। মুসলমান হয়ে কিত্তন গেয়ে সে অন্যায় করেছে। সেই অন্যায়ের শাস্তি তাকে পেতে হবে। সেই অন্যায়ের শাস্তি দিতেই গ্রামশুদ্ধ সালিশ বসিয়েছিল। সেই সালিশদাররাই সাভ্যস্ত করেছিল চুল কেটে নেড়া করে দেওয়া হবে। সালিশদারদের সাভ্যস্ত না বলে বলা ভালো লোকমান মুন্সির হুকুম। কারণ কিত্তণ গাওয়া যে অন্যায় সেই সিদ্ধান্ত লোকমান মুন্সিই নিয়েছে। বাকিদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে সমর্থন আদায় করে নিয়েছে। তাছাড়া লোকমান মুন্সির মুখের ওপর কেউ কথা বলে সে শক্তি আর সাহস এই এলাকায় কারও নেই। যা দু একজন সময় সময় বলে তা বেশির ভাগের সমর্থনের কারণে কার্যকারিতা হারায়। তাছাড়া ওই দু একজনের বিরোধিতায় লোকমান মুন্সির কিছু এসে যায় না।
যখন এসে যাবার মতো ঘটনা ঘটে তখন লোকমান অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়। দরিদ্র আর মজুর শ্রেণীর বেশির ভাগই তার জমি বর্গা চাষ করে। ফলে তার কথার বাইরে যাবার কথা চিন্তাও করে না। যদি এদিক সেদিক হয় তবে জমি ছাড়িয়ে নিয়ে শায়েস্তা করে ফেলে। তখন নিজে থেকে এসেই হাতে পায়ে ধরে জমি বর্গা নিয়ে যায়। বছর দশেক আগে উত্তর পাড়ার ইউনুস প্রামাণিকের সাথে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি নিয়ে কথাকাটাকাটি হয়েছিল। তার মাসও কয়েক পর ইউনুসের লাশ পাওয়া যায় বিলের ধানক্ষেতে। জ্যৈষ্ঠ মাসে সোলাই মণ্ডলের ছেলে পিতম মণ্ডলের সাথে দুধ কেনা নিয়ে কথাকাটি হয় লোকমান মুন্সির। পরের সপ্তাহেই ডাকাতির দায়ে জেলে যেতে হয় পিতমের। তাই ভুলেও কেউ লোকমান মুন্সির বিরুদ্ধে যায় না। আবার খুব কাছাকাছিও না। যারা কাছাকাছি যায় তারা নিজেদের স্বার্থের জন্য যায়।
গেল বছর লোকমান মুন্সি হোসেন গায়েনের বাড়ির জমি কিনে নিতে চেয়েছিল পুকুর বাড়াবে বলে। বিক্রি না করলে জমির বদলে জমি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু হোসেন গায়েন রাজি হয়নি। বাপ-দাদার ভিটে এক পুকুরের জন্য ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে এটা কেমন জবরদস্তির কথা! কেও কোন দিন শুনেছে এমন কথা? তবে সেখান থেকেই ত্বক্কে ত্বক্কে ছিল সে। আজ সেই সুযোগ পেয়ে গিয়েছে। তার প্রতিশোধেই হোসেন গায়েনকে অপদস্ত করে নেড়া করে দেওয়া হলো। সেটা হোসেন বোঝতে পেরেছিল। আর বোঝতে পেরেছিল বলেই নীরবে শুধু চোখের পানি ফেলেছে।
সাত দিন পর ফ্রিজিং ভ্যানে হোসেন গায়েনের লাশ গ্রামে ফিরে এলো। সাথে এলো সেনাবাহিনীর গাড়ী। হোসেন গায়েনের লাশ পতাকা দিয়ে মোড়ানো। যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে দাফন করা হলো। কবরে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো শ্বেত পাথরের নাম ফলক। গোটা গোটা অক্ষরে তাতে লেখা মুক্তিযোদ্ধা হোসেন গায়েন। জন্ম সাল অজানা। মৃত্যু ২০ মার্চ ২০০০ খ্রিস্টাব্দ।
একাত্তরের ডিসেম্বরে মুক্তিরা লোকমান মুন্সিকে পাকিস্তানি মিলিটারিদের সাথে ব্রাশ ফায়ার করেছিল। তবে কপারের জোরে লোকমান সেদিন বেঁচে যায়। আহত অবস্থায় মরার ভান করে পড়ে ছিল লোকমান। মুক্তিরা চলে গেলে রক্তে ভেজা শরীরটাকে কোন রকমে টেনেটুনে বাড়ী গিয়েছিল। তবে সেই থেকে এক পা লেংচিয়ে হাঁটে। সেদিন মিলিটারিদের যাওয়া আসার খবর মুক্তিদের হোসেনই দিয়েছিল। হোসেনের রান্নার হাত বেশ ভালো। যুদ্ধের প্রথম দিকে পাকিস্তানি মিলিটারি গ্রামে ক্যাম্প করলে লোকমান তাদের রান্নার জন্য হোসেনকে ধরে নিয়ে যায়। পরিবার আর নিজের প্রাণ ভয়ে সেদিন হোসেনকে রান্না করতে হয়েছিল।
তবে সেদিন রান্না করার কাজে হোসেনকে ধরে নিয়ে যাওয়াতে ভালোই হয়েছিল। মুক্তিদের গুপ্তচর হিসেবে হোসেন কাজ করতো। ক্যাম্পের খবরাখবর যা পাওয়া যেতো তা হোসেনের মাধ্যমেই পাওয়া যেতো। তবে সব খবর হোসেন দিতে পারতো না। কারণ গোপনীয়তার জন্য ক্যাম্পের সব জায়গায় হোসেনের প্রবেশাধিকার ছিল না। যুদ্ধের মাসখানেকের মধ্যেই হোসেন পালিয়ে যুদ্ধে যোগ দিতে চেয়েছিল। তবে মুক্তিরা বলেছিল-তার প্রয়োজন নেই। যুদ্ধে যাওয়ার চেয়ে সে অনেক বড় কাজ করছে। যদি কখনও যুদ্ধে যাবার প্রয়োজন হয় তবে মুক্তিরা তাকে বলবে। তবে সে প্রয়োজন আর মুক্তিরা মনে করেনি। গ্রামের মিলিটারি ক্যাম্প যতোদিনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে তখন দেশ স্বাধীন হয় হয়। যুদ্ধের পর মতি কমান্ডার হোসেনকে সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে খবর পাঠিয়েছিল। তবে হোসেন নেয়নি। বলেছে সার্টিফিকেট দিয়ে কি হবে? যা করেছি দেশের জন্য করেছি। আমি মুক্ষুসুক্ষু মানুষ সার্টিফিকেট দিয়ে কি করবো? না পড়তে পারবো, না ঠিকঠাক যত্ন নিয়ে রাখতে পারবো। ইন্দুরে কাইট্যা ফালাইবো। আপনি কইছেন তাতেই আমার শান্তি-আমি খুশি।
স্বাধীনতার পর শরীরে তাগত ছিল। মতি কমান্ডার পূর্ব বাংলা সর্বোহার পার্টিতে যোগ দিল। বুঝিয়েছিল এতো কষ্ট করে দেশ স্বাধীন করলাম। কিন্তু কোন লাভ হলো না। এখনও মানুষ খেতে পায় না। সবার অধিকার নিশ্চিত হয়নি। সেটা নিশ্চিত না হওয়া অব্দি স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ আমরা পাবো না। মতি কমান্ডারের কথায় হোসেনও ভিড়ে গেলো লাল পার্টির দলে। ঠিকই তো। দেশ স্বাধীন তবে দেশে এতো হাহাকার থাকবে কেন। ভাতের অভাবে মানুষ না খেতে পেরে মারা যাবে কেন? এখনও কেন মানুষ তার অধিকার ফিরে পাবে না? যে যুদ্ধ আর সংগ্রামের স্বাদ হোসেন মিলিটারি ক্যাম্পে থেকে পায়নি সেই দুঃসাহসী স্বাদ সে লাল পার্টিতে যোগ দিয়ে পেতে চাইলো। তবে মতি কমান্ডার হোসেনকে তখনই খুব বেশি দায়িত্ব দেয়নি। মানুষদের বোঝানো আর দলে ভিড়াতে এবং খবর আদান প্রদানের যেটুকু দায়িত্ব দিয়েছিল তা সে ঠিকঠিক পালন করছিল।
এরমধ্যে এক দুর্ঘটনা ঘটে গেল। রক্ষী বাহিনীর হাতে খুন হলো মতি কমান্ডার। তারপর স্থিমিত হয়ে পড়লো লাল পার্টির কার্যক্রম। হোসেনও থেমে গেল। ধীরে ধীরে দেশ শান্ত হতে লাগলো। হোসেন সংসারে মনোযোগী হতে চেষ্টা করলো। তিন মেয়ের পর ঘরে এলো সালাম। স্ত্রীর অনুনয়ে সংসারে মন দিল।
সংসার অভাব অনটনে আর তার বার্ধক্যে সেই সালামই হাল ধরেছিল। তবে তার মৃত্যু অথৈ সাগরে ফেলেছিল হোসেনকে। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেয় শুনে কমান্ডার অফিসে গিয়েছিল। যদি এই বৃদ্ধ বয়সে কোন একটা ব্যবস্থা হয়। কিন্তু কমান্ডার অফিস জানিয়ে দিয়েছে তাকে কোন কার্ড দেওয়া সম্ভব নয়। এতোদিন সে কার্ড নেয়নি কেন? তাছাড়া যুদ্ধের পর সে লাল পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। সর্বোহারাদের সাথে মিলে খুন রাহাজানি ডাকাতির মাধ্যমে দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। দেশ বিরোধীদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। এক দেশ বিরোধীদের বিপক্ষে কাজ করে কোন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অন্য দেশ বিরোধীদের সাথে হাত মিলাতে পারে না। তাকে মুক্তিযোদ্ধার কার্ড দেওয়া কোন ভাবেই উচিত হবে না।
কমান্ডার অফিসে দেখা হয়েছিল হাসমতের সাথে। সেও মতি কমান্ডারের সাথে যুদ্ধ করেছিল। হাসমত অবশ্য চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কিছু করতে পারেনি। হোসেন যেহেতু এতোদিন কার্ড নেয়নি তাই কমান্ডার অফিস সেই কার্ড দিতেও পারবে না। এখানে ঘুরে তেমন কোন লাভ হবে না। এখন কার্ড করাতে হলে ঢাকা যেতে হবে, মন্ত্রণালয়ে। দুই বেলা খাবারই জোটে না হোসেনের, ঢাকায় যাবার টাকা কোথায় পাবে। অগত্য জীবন বাঁচাতে তাই গান ধরা। সেই গানই আজ তার অপমানের কারণ হলো। রাগে দুঃখে হোসেন হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। সেই নেড়া করে দেবার আর ঝুলন্ত লাশের ছবিই ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুকে।
ইউএনও ইকবাল হায়দার স্থানীয় কমান্ডার অফিস আর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলে হোসেন গায়েন সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছে। হোসেন গায়েন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি তবে মুক্তিযুদ্ধের গুপ্তচর হিসেবে প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধে দুর্দান্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। গুপ্তচর হিসেবে যুদ্ধকালীন সময়ে সারাক্ষণ তিনি মৃত্যু মাথায় নিয়ে ঘুরেছেন। তাঁর অবদান যে কতোবড় তা হয়তো হোসেন গায়েন অনুমান করতে পারেননি। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কিংবা কমান্ডার অফিসও সেই অবদানের মূল্যায়ন করতে পারেনি। দেশও ব্যর্থ হয়েছে একজন খাঁটি দেশ প্রেমিকের সঠিক মর্যাদা দিতে। অন্তত মৃত্যুর পর হলেও সেই ব্যর্থতাকে ঢেকে দিয়ে তাঁর অবদানের মূল্যায়ন করাকে উপজেলার কর্তা ব্যক্তি হিসেবে ইকবাল হায়দার নিজের কর্তব্য হিসেবেই মনে করলো।
মন্ত্রণালয়ে জরুরী ভিত্তিতে ইমেইল করে পুলিশ নিয়ে বেরিয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধা হোসেন গেয়েনের গ্রাম মোঘল চণ্ডীর উদ্দেশ্যে। যতক্ষণে মোঘল চণ্ডী পৌঁছাল তখন বেলা পড়ে গিয়েছে। একটা আম গাছের ডালে ঝুলে আছে হোসেন গায়েনের দেহ। ইকবাল হায়দারের মনে হলো চুলহীন নেড়া মাথা আর হাড় জিরজিরে দেহ নিয়ে যেন ঝুলে আছে পুরো বাংলাদেশ। ঝুলে থাকা নত মাথার মতো অপমান আর লজ্জায় নত হয়ে আছে বাংলাদেশের মুখ। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া শুষ্ক রক্তের ধারা বাংলাদেশের হৃদয়ের রক্তক্ষণের প্রতীক হয়ে আছে। চোখ থেকে চশমা খুলে চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়া দু’ফোঁটা পানি মুছল ইকবাল হায়দার।
হোসেন গায়েনের লাশ ময়না তদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যাবার আগে হোসেন গায়েনের স্ত্রীর সাথে দেখা করে গিয়েছে ইকবাল হায়দার এবং বলে গিয়েছে যে কোন প্রয়োজনে সে সরাসরি তার সাথে দেখা করতে পারে। প্রয়োজন মনে হলে ফোন ও করতে পারে। পুলিশ বাদি হয়ে হত্যা প্ররোচনায় একটা মামলা করেছে। সেই মামলায় লোকমান মুন্সিসহ আরও দুই জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
সাত দিন পর ফ্রিজিং ভ্যানে হোসেন গায়েনের লাশ গ্রামে ফিরে এলো। সাথে এলো সেনাবাহিনীর গাড়ী। হোসেন গায়েনের লাশ পতাকা দিয়ে মোড়ানো। যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে দাফন করা হলো। কবরে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো শ্বেত পাথরের নাম ফলক। গোটা গোটা অক্ষরে তাতে লেখা মুক্তিযোদ্ধা হোসেন গায়েন। জন্ম সাল অজানা। মৃত্যু ২০ মার্চ ২০০০ খ্রিস্টাব্দ।
0 Comments