পুর্বপাকিস্তান হিসেবে বাংলাদেশের ব্যবসার যাত্রা শুরু হয় কাগজ আর পাট শিল্প দিয়ে। তবে কালের পরিক্রমায় কৃষি নির্ভব বাংলাদেশ কৃষির সাথে সাথে শিল্পের যান্ত্রিক কলাকৌশলে যুক্ত হয়। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে গড়ে ওঠেছে বেশ কিছু আস্থা রাখার মতো দেশিয় ব্র্যান্ড। ওষুধ শিল্প, পোশাক, ইলেক্ট্রনিক্স থেকে শুরু করে ভোগ্য পণ্য, সাইকেল, মোটর সাইকেল, জাহাজ এমনকি মুঠোফোন শিল্পে নিজের অবস্থান তৈরি করেছে। মোটর গাড়ি শিল্পের যন্ত্রাংশ ইতোমধ্যে দেশেই তৈরি হচ্ছে-সাথে মোটর গাড়ি সংযোজনতো আছেই। পুরোপুরি মোটর গাড়ি তৈরি কারখানা স্থাপনে ইতোমধ্যেই আশাপ্রদ আগ্রগতি হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা সংস্থা কান্টার ওয়ার্ল্ডপ্যানেলের ২০১৮ সালের জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শীর্ষ ৫০ ব্র্যান্ডের অর্ধেকই দেশিয়। আর সেসব ব্র্যান্ড বিদেশি ব্যান্ডের সাথে পাল্লা দিয়ে পণ্যের মান ও দামের দিক থেকে ভোক্তাদের আস্থা অর্জন করেছে। ইলেক্ট্রনিক সামগ্রি, ওষুধ, ভোগ্য পণ্য, নির্মাণ সামগ্রীর বাজার দখল করে রেখেছে এসব স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘরে থাকার পিছনে এসব স্থানীয় ব্র্যান্ডের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের উৎপাদন-জিডিপির অনুপাত ধীরে ধীরে বাড়ছে—বর্তমানে তা প্রায় ২০ শতাংশ। যা এলডিসি গ্রুপের গড় অনুপাতের দ্বিগুণ—এমনকি ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার চেয়েও বেশি।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে স্বাধীন জাতিসত্ত্বা নিয়ে জাতি গঠনে মনযোগী হয় এদেশের উদ্যোক্তারা। নাবিস্কো বিস্কুট ও তিব্বত বল সাবানের মতো ব্র্যান্ডগুলোকে অনুসরণ করে গড়ে ওঠে আরও কিছু ব্র্যান্ড। সময়ের সাথে সাথে তারা সমৃদ্ধ হতে থাকে আর মাল্টিন্যাশনাল কিংবা বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকে। বাংলাদেশি ব্র্যান্ডগুলো এখন অনেক ক্ষেত্রে বাজারে আধিপত্য নিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
আশির দশকে পাটের বাজার হারানোর পর সহজলভ্য ও সুলভ মানবসম্পদ নিয়ে বাংলাদেশ পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও ভোগ্য পণ্যের নিজেদের উৎস নিয়ে স্থানীয়রা এগিয়ে আসে। তখন কে কল্পনা করেছিল বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে একদিন স্থানীয় উদ্যোক্তারা সফল হবে? পৌঁছাবে আজকের অবস্থানে। এক্ষেত্রে দ্রুত বর্ধনশীল ভোক্তাশ্রেণি এবং তাদের ক্রমবর্ধমান ক্রয়ক্ষমতা ও দেশপ্রেম সাহায্য করেছে দারুন ভাবে।
আমদানি প্রতিস্থাপন নীতির মাধ্যমে আশির দশকে ওষুধ শিল্পের বিকাশ শুরু পাবনাভিত্তিক একটি ছোট ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে। এছাড়াও অবদান রাখে বেক্সিমকো গ্রুপ। তাদের প্রসারের ফলে ব্যবসা বিক্রি করে বাজার ছাড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজার। রেনাটা নামে নতুন পথ চলা শুরু হয় ফাইজারের ছেড়ে যাওয়া কারখানায়। স্থানীয়দের কাছে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকতে না পেরে ২০১৮ সালে ওষুধ কারখানা বন্ধ করে দেয় গ্ল্যাক্সোস্মিথ। ক্যান্সারসহ অন্য অনেক রোগের প্রতিষেধক ওষুধ এখন বাংলাদেশেই তৈরি হয়। নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বিশ্বের বাজারে রপ্তানিও করে। সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইডিসিএলও কাজ করেছে বেশ সুনামের সাথে। এখন তৃতীয় বিশ্বের মহামারি কিংবা যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশ ওষুধ দিয়ে বন্ধুত্ব ও সহায়তার হাত বাড়ায়। যা দশক দুয়েক আগেও ছিল অকল্পনীয়।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বাংলাদেশি ভোক্তাদের কাছে জুতা বলতেই বুঝানো হত বাটা। উৎসব-পার্বনে বাটার জুতা ছাড়া অন্য কিছুই ভাবা যেতো না। ১৯৯০ সালে জাপানি ও ইতালীয় ব্র্যান্ডের চুক্তিভিত্তিক প্রস্তুতকারক হিসেবে যাত্রা শুরু করে স্থানীয় উদ্যোগের অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পর গত দশকের শুরুতে কোম্পানিটি নজরকাড়া সব ডিজাইন ও উন্নত মান নিয়ে স্থানীয় বাজারের দিকে মনোযোগ দেয় এবং ভোক্তাদের আগ্রহ ও মনযোগ আকর্ষন করতে সমর্থ হয়। দীর্ঘদিন ধরে একচেটিয়া বাজার দখল করে রাখা বাটা সময়ের সাথে সাথে সমৃদ্ধ ও হালনাগাদ ডিজাইন দিতে না পারায় ধীরে ধীরে ভোক্তাদের হারাতে থাকে। সাথে বে ট্যানারি বাহারি ডিজাইন নিয়ে বাজারে প্রবেশ করে। এছাড়াও আরও কিছু স্থানীয় পর্যায়ে উদ্যোক্তারা জুতা বানিয়ে গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করছে।
গত এক দশকে ইলেক্ট্রনিক পণ্যের বাজারে অভাবনীয় সাফল্য নিয়ে এসেছে দেশি ব্র্যান্ড ওয়ালটন। ওয়াল্টনের ফ্রিজ এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিভিন্ন মহাদেশের নতুন নতুন রপ্তানি গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে।
বাজার জরিপে দেখা যায় রেফ্রিজারেটরের বাজারের ৭০ শতাংশ এখন ওয়ালটনের দখলে। আর সিঙ্গারের দখলে বাজারের মাত্র ১০ শতাংশ। এছাড়া বাকিটা বাজার চাহিদা পূরণ করে যমুনা, মিনিস্টার এবং অন্যান্য কয়েটি ব্র্যান্ড।
স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো এখন এয়ার কন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিনসহ নানা রকমের ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জাম তৈরি করছে। দেশিয় বাজারে মিয়াকো এখন বেশ খানিকটা বাজার দখল করেছে।
ভারতীয় হিরো ও চায়নার ফনিক্স সাইকেল বাংলাদেশের বিশাল বাজার ধরে রেখেছিল দীর্ঘ দশক ধরে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিয়েতে পর্যন্ত হিরো কিংবা ফনিক্স সাইকেল উপঢৌকন দেবার রীতি ছিল। ধীরে ধীরে সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে আরএফএল গ্রুপের দুরন্ত বাইসাইকেল বাংলাদেশের বাজার দখল করে নিয়েছে। শিশু থেকে সকল বয়সীদের জন্য রকমারি সাইকেল বাজারে নিয়ে এসেছে দুরন্ত। এখন স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে বাণিজ্য ও চাকুরী নির্ভরতা বাড়ায় সমাজের বড় একটা অংশের নারী-পুরুষ সংসার জীবনে কম সময় দিয়ে থাকেন। ব্যস্ত জীবনে তাইর তাদের ছুটতে হয়ে বাজারের তৈরি মশলার দিকে। এক্ষেত্রে রাঁধুনি আর প্রাণ গুড়া মশলার বিকল্প বাজার এখনও তৈরি হয়নি। রাঁধুনি এবং প্রাণ এখন দেশের বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে। লবণে এসিআই এবং চায়ের ক্ষেত্রে ইস্পাহানি গ্রাহকদের কাছে খুব জনপ্রিয়। এছাড়া বিস্কুট, চিপসের মতো হালকা খাবারের বাজারে অলিম্পিক ও প্রাণের পণ্য বেশ জনপ্রিয়।
পোশাক খাতে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের পাশাপাশি আড়ং, ইয়েলো, রঙ, অঞ্জন’সসহ অন্য আরও কিছু স্থানীয় ব্র্যান্ড গ্রাহকদের আগ্রহের তালিকায় আছে।
ভারি শিল্পের মধ্যে আছে আনন্দ শিপিয়ার্ড। নেদারল্যান্ডে জাহাজ রপ্তানির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জাহাজ প্রস্তুত কারী দেশের তালিকায় নিজেদের নাম লেখায়। এছাড়া খুলনা শিপইয়ার্ড বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জাহাজের চাহিদা মিটায়। তারা নৌবাহিনীর জন্য যুদ্ধ জাহাজও তৈরি করছে। ইস্পাত শিল্পে বিএসআরএম, আরএসআরএম, সিরামিক শিল্পে আরএকে এবং সিমেন্ট শিল্প ফ্রেস, শাহ সিমেন্টসহ বেশ কিছু কারখানা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে ভারতে রপ্তানি করছে।
গাড়ি প্রস্তুতের জন্য তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যেই নরসিংদী, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে সংযোজন কারখানা স্থাপন করেছে বেশ কিছু কোম্পানি। নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটীতে অত্যধুনিক সুবিধাসহ সংযোজিত গাড়ি বাজারে এনেছে বাংলা কার। সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়—সংযোজন করতে করতেই নিজেরাই দক্ষ হয়ে ব্র্যান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
0 Comments