তারাণি গ্রামে এক দুপুর ।। গারো পাহাড়ের গদ্য ।। জ্যোতি পোদ্দার


 

বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকার মতো জল নিয়ে ভোগাইয়ের ওপাড়ে ভারতের বাবুরাম ক্যাম্প এপাড়ে বাংলাদেশের তারাণি পাড়া। শেরপুরের উত্তরে শেষ গ্রাম। ভোগাই নদী সীমান্ত বরাবর প্রাকৃতিক সীমারেখা। এপাড়ে ত্রিভুজের এক কোণ উপর মুখী হয়ে মাটিতে গাঁথা ত্রিভুজের আনুভূমিক রেখা। ত্রিভুজের শরীরে এপাশে ওপাশে খোদাই করে লেখা ভারত আর বাংলাদেশ।

দুই দেশের মানুষ ভোগাইয়ের জল ব্যবহার করে নিত্যদিন। এই সময়ে মোটা লাল বালুতে ছোট্ট ছোট্ট কাঁকর বুকে নিয়ে জাগা চর থাকলেও ভোগাইয়ের বর্ষার রূপ ভয়াবহ। উন্মত্ত তাঁর রূপ। কখন কোন গ্রামের কোন কাছাড় ভাঙে তার কোন লেখাজোঁকা নেই। বাণের ঘোলা জল বালু নিয়ে হু হু করে ঢুকে পড়ে আবাদী জমিনে, বসত ভিটায় কিংবা গঞ্জের হাঁটে মাঠে।

নদী ভোগাই তখন ঠিক ঠিক মানুষকে ভোগায় অনাবাদে অনাহারে। গোড়ার দিকে এই নদীর নাম  ভোগবতী থাকলেও  ফি-বছর এমন উন্মাদ জন দুর্ভোগের কারণেই হয়তো নদীর নামটি ভোগবতী পাল্টে মানুষের মুখে মুখে ভোগাই হয়ে গেছে।

সম্প্রতি এই ভোগাইয়ের সাথে যুক্ত হচ্ছে নতুন একটি চ্যানেল--প্রায় আট কিলো মিটার লম্বা খাল।বরুয়জানির দর্শা খাল হতে কালাকুমা ছুঁয়ে  বৈশাখী বাজারের ডাইভার্সন হয়ে তারাণি গ্রাম মধ্যদিয়ে ভোগাইয়ের বাঁক পর্যন্ত খাল। উদ্দেশ্য উজানের সাথে ভাটি অঞ্চলের সাথে সংযোগ স্থাপনের মধ্যদিয়ে মরসুমে সেচের ব্যস্থাপনা করা।

কৃষিকর্মে জল সিঞ্চন জমির ও ফসলের স্বাস্থের জন্য জরুরী বটে। আমন বোরো আবাদের পাশাপাশি এ তল্লাটের সিজনাল শাক সবব্জিও উৎপাদন করে প্রায় সবাই। অপেক্ষাকৃত উঁচু জমি হবার দরুণ বন্যার প্রকোপ তারাণি গ্রাম থেকে শুরু করে পুরো  মন্ডলপাড়া পর্যন্ত কম।

কখনো প্লাবিত হয়েছে এমনটা শোনা যায় নি। জমির উর্বরতার কারণে উৎপাদন অধিক। যদিও নানা কিসিমের হাইব্রিড উৎপাদনের কারণে মাটির গুণাগুণ হারাচ্ছে। যতটুকু সেচের প্রয়োজন হয় শ্যালো মিশন দিয়েই এতদিন জমিতে সেচ দিয়ে আসছিল কৃষক। 

কিছুদূর পর পর জমির পাশের আলে শ্যালো মেশিনের পয়েন্ট করা। কখনো এককভাবে কখনো যৌথভাবেই পরিচালিত হচ্ছিল এই পাম্পগুলো। জলের লেয়ার উচুঁ হবার কারণে বিশ পঁচিশ ফুট পাইপেই জল পাবার মতো অবস্থা এই তারাণি গ্রামে বিদ্যমান। 

এখানে এখন সারা  পাড়া জুড়ে সর্পিল ঢঙে এঁকেবেঁকে নির্মিত হচ্ছে টি আর কাবিটা অর্থায়নের উন্নয়নের খাল। ফলন্ত মাঠের বুক চিরে চিরে যে দীর্ঘ খাল হচ্ছে সেই খাল খাল নয়এই খাল যেন কাল হয়ে উঠছে এই প্রান্তিক মানুষের জীবনে।

দর্শা থেকে বৈশাখী বাজার পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার খাল পূর্বেই ছিল।সেই জমি খালের রেকর্ডভুক্ত। কিন্তু বৈশাখী বাজার হতে তারাণি পাড়ার ভেতর দিয়ে ভোগাই নদী পর্যন্ত যে প্রায় তিন কিলোমিটার খনন করা হচ্ছে তা একদমই নতুন।

আদিবাসী তেরোটি পরিবার আর অ-আদিবাসী শতাধিক পরিবারের রেকর্ডভুক্ত ব্যক্তিগত আবাদী জমিন আর ফলজ বৃক্ষের চিতার উপর দিয়ে যে নয়া খাল নির্মিত হচ্ছে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে সেখানে প্রশ্ন।বিস্ময়। যা বাংলাদেশের কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যস্থাপনা আইনের পরিপন্থী। 

সম্ভবতাযাচাই সাপেক্ষে যে কোন উন্নয়ন কার্যক্রম হতেই পারে। কেননা জরিপে উঠে আসে জন মানুষের বয়ান। সেখানে অংশগ্রহণের ভেতরই জানা যায় কোন কাজের সম্ভবতা কতটুকু। হয় সরাসরি উন্নয়ন মূলক কাজে অংশ গ্রহণ।

ভোট প্রদানে যেমন নাগরিকের সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকে তেমনটি আর উন্নয়ন কার্যক্রম অংশগ্রহণ থাকে না। ক্ষমতা বিন্যাসের ধরনটাই এমন যাদের জন্য উন্নয়ন তাদের সরাসরি অংশ গ্রহণ নেই।আর সেটি না থাকাতে উন্নয়নের যে ধারণা দিয়ে এখনকার কাজকারবার তা যেমন যেমন জনবান্ধব নয় তেমন নয় পরিবেশবান্ধব ।প্রয়োজন স্থানিকতার গণতন্ত্র। ভোট প্রদান সেই চর্চার একমাত্র উপাদন নয়একটি মাত্র উপাদান।

উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া কোন কাজই টেকসই না।তলে থাকা মানুষের যে দেখা সে তার যৌথ যাপন দিয়ে দেখে।সেই দেখায় বর্তমানতা থাকে থাকে পরম্পরায় জ্ঞান। যা আগামীর জন্য টেকসই হয়। একেক স্থানিকের পাটিগনিত একেক রকম। কাজে কাজেই একই ডাইস দিয়ে যে কোন পরিমাপই জনবান্ধব হয় না। হতে পারে না।

আদিবাসী ও অ-আদিবাসীর লাগালাগি কৃষি জমি—উত্তর দক্ষিন জমি—নয়া খালের পেটে ঢুকে যতটুকু আছে তা একফালি  চলার পথ। বসত ভিটি  গেছে। আর চোট পড়েছে আবাদী জমির উপর। বেঁচে থাকার উপায়ের উপর।বিপন্ন শতাধিক কৃষক পরিবার।মাথায় বাজ পড়েছে তাদের।

জমি থেকে দূরে সরে যাওয়া মানে শুধু স্থানিকতার বদল নয়-- পাল্টে যায় জীবনের ধরণ ধারণ;স্মৃতি ও শ্রুতির ইতিহাস।যে জীবন একদা ছিল মাটির গভীরে শেকড়ের মতো ছড়ানো জড়ানো সে জীবন একবার মাটি থেকে ছিন্ন হলে পাল্টে যায় জীবনের গণিত। সে জীবন ভাসমান বেদে জীবন। এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে ঠোকর খাওয়া জীবন।

কোথাও জিরোবার ফুসরত পায় না। নির্মম কঠিনতার ভেতর ফেলে আসা অতীত তার কাছে আরো বড় আকারে করোটির ভেতর সদা জাগ্রত থাকে। সে হয়ে পড়ে অতীত মুখী। নিজের বসত ভিটি আবাদী জমিন ও জমিনের আশপাশ চোখের সামনে ঝুলে থাকে ত্রিভঙ্গ হয়ে। আর তখনই তার জন্য অসহনীয় হয়ে উঠে বর্তমান।

নয়া খালের নির্মাণে যে ক্ষোভ প্রতিবাদ ক্ষতিগ্রস্থদের ভেতর ছিল ক্ষমতার দাপটে চুপসে গেছে। ভেঙে গেছে মন। বহু সংখ্যাক মানুষের বিপন্নতায় নির্বিকার স্থানিক প্রশাসন। কাজে কাজেই ক্ষোভ দানা বাঁধে নি। চোখে মুখে বিষন্নতার ছাপ। উদাস দৃষ্টিতে কেউ কেউ তাকিয়ে আছে তার জমির দিকে। কেউ কেউ সবে জালা বুনেছে মাত্র—হাইব্রিডের জালা। হলুদ গায়ে মেখে সবুজ চারা বাতাসে দুলেছে।

আমাদের দেখেই দল বেঁধে এগিয়ে এলেন একে একে এই জমিহারা মানুষগুলো। যে আনোয়ারা বেগম ঢাকায় বাসাবাড়িতে কাজ করে তিলে তিলে টাকা জমিয়ে কাঠা পাঁচেক আবাদী জমি রেখেছিলেন দুই মেয়ের ভবিষ্যতেরর কথা ভেবে তাঁর সবটাই গেছে খালের পেটে।হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি। এই মধ্য বষস্ক নারীর আর্ত চিৎকার খোলা মাঠে খান খান হয়ে ভঙে পড়ল। তাঁর স্বপ্ন ইচ্ছা সব এখন বাণের জলে ভেসে গেছে।

আনোয়ারা বেগম কাঁদছে।মলিন মুখ নিয়ে হাত বুকের কাছে শক্ত করে বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে জমি বসত ভিটা হারা মানুষেরা। ছোট ছোট বাচ্চারা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে। এই কয়দিন ধরে ঘরে রান্না চড়েনি। আচিক মান্দি কয়েকজন যুবক দৌড়ঝাঁপ করছে। ছুটছে থানা শহরে কিংবা পার্টির নেতাদের কাছে প্রতিকারের আশায়।কোথাও কোন তল খোঁজে পাচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কথা শুনবার কেউ নেই। আছে গোপন বা প্রকাশ্যে হুমকি ধামকি।পুলিশির ভয়।

জনউদ্যোগের প্রযত্নে নানা পেশার নাগরিক আমরা এখানে এসেছি। জনউদ্যোগ একটি নাগরিক প্লাটফর্ম। ভাষাহীন পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য একটা পাটাতন। যারা নির্বাহী কাজে যুক্ত তাদের সাথে এই মানুষদের একটা আলাপচারিতার পরিসর নির্মাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে জনউদ্যোগ। এই কারণেই এখানে আসা। 

শুধু আনোয়ারা বেগম নয় রয়েছে আচিক মান্দিদেরও জমিজিরাত। এ তল্লাট একদা আচিক মান্দিদের গ্রাম হলেও এখন আদিবাসী অ-দিবাসীদের যৌথ আবাস। দেখাদেখি চাষ আর লাগালাগি বাস তাদের।যদিও ক্ষতিগ্রস্তরা উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে লিখিত আর্জি পেশ করেছে। তাদের অভিযোগ অনুযোগের প্রতি এখনো নজর না পড়লেও  ইতোমধ্যে খাল কেটে কুমির আনার সকল ব্যবস্থাপনা সারা। বেকু দিয়ে মাটি কেটে খাল প্রায় সম্পন্ন হবার পথে।

এতোবড় প্রকল্প অথচ কোন সম্ভবতা যাচাই হয়নি জরিপ হয়নি। টেন্ডার নেই। শুধু টি আর কাবিটা অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে এই খাল। পনেরো বিশ ফুটের প্রস্থের খাল। বর্ষার ভরা মৌসুমে ভোগাইয়ের উন্মাদ দাপটে এই খাল শুধু ভরে উঠবে না ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়বে খালের উঁচু পাড়। তখন প্লাবিত হবে জমি জিরাত আর বসত ভিটা। অপেক্ষাকৃত উঁচু এই তারানি গ্রাম হয়ে উঠবে তখন বন্যা প্রবণ এলাকা।

এই সব দেখতে দেখতেই কে যেন ভিড়ের মাঝে বলে উঠল "এটি খাল নয়—আমাদের কাল।" বুঝতে পারলাম নিজস্ব যাপনে থেকে কী ভীষণ কঠিন বাস্তব কথা তিনি বলে ফেললেন। স্থানিক মানুষের যাপনের সাথে সংগতি পূর্ণ না হলে কোন উন্নয়নই মানুষের জন্য টেকসই হয় না।

অপরিকল্পিত কাজকারবার মানেই জনস্বার্থ ও প্রকৃতি বিরুদ্ধ। ডেকে আনে মানবিক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তার দায় ও সংকটের মুখোমুখি হতে হয় সেই ক্ষতিগ্রস্থদের যারা এই উন্নয়নের কার্ক্রমের উদ্যোগ বা পরিকল্পনার সাথে জড়িত নয়। যাদের জন্য এই যজ্ঞ তাদের ফুটনোটেরও বাইরে রেখে চলে উন্নয়নের যজ্ঞ।

আজকাল এই টেকসই উন্নয়নের কথাই চারদিকে চাউর হচ্ছে। প্রকৃতি ও মানুষের বিরুদ্ধ যে কোন কাজই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে। অথচ শিল্প বিপ্লবের পর দেশে দেশে  তেল ও জীবাশ্ম ভিত্তিক শিল্পায়নের কারনে একদিকে যেমন বেড়েছে ভোগবাদিতা তেমনি পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে জীবন ও প্রকৃতির নিজস্ব গণিত।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের প্রকোপে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জমিলগ্না কৃষক, আদিবাসি আর কারিগর শ্রেণি। আর টেকসই উন্নয়নের অভাবের কারণে আঘাতও পড়ছে এই শ্রেণির উপর সরাসরি।

তারাণি গ্রাম একটি মিশ্র বৃক্ষের গ্রাম। নদী কূলবর্তী হবার কারণে বনজ ফলজ ভেষজ বৃক্ষের সমাহার চারিদকে।অন্যদিকে আবাদী জমির অখন্ড প্রান্তর। এখন খাল দিয়ে দুই পাড়ের দুই জীবন। বৈশাখী মোড়ের পাক্কা সড়কে আসবার পথ কাঁচা হলেও খুব সহজেই কাছের থানা বা জেলা শহরে আসবার ফুসরত আছে নানা কাজে বা আপদ বিপত্তিতে;বিশেষ করে  অসুখ শিশু বা পোয়াতি  নারীদের হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু এখন খাল দিয়ে বিভক্ত তারাণি নতুন সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে। নতুন বাস্তবতায়।

নয়া খালের উঁচু পাড় দিয়ে কিছুদের এগুলেই চোখ পড়ল একটি প্রাক- প্রাথমিক স্কুল।কারিতাসের প্রযত্নে পরিচালিত। চৌচালা টিনের পাকা ঘর। রোদের ঝলক আর বাতাসে কাপঁছে বেগুনি রঙের কাগজি ফুল। ভারি সুন্দর দেখতে।স্কুল ঘরের প্রশস্ত বারান্দার পাশেই বেড়ে উঠেছে গাছটি।

হাঁটু পর্যন্ত দেয়াল ঘেরা সবুজ ঘাসের খেলার মাঠ। মাঠের পাশেই সুধিন মানকিনের লেবুর বাগান। পাতা ছিঁড়ে হাতে কচলে নাকে ধরতেই টের পেলাম পাহাড়ি লেবুর কড়া গন্ধের ছটা। সেই বাগানেও দ্বিখণ্ডিত। গাছে গাছে সবে লেবুর থোকা থোকা সাদা ফুল ফুটেছে। চৈতের শেষেই গাছ ভরে ঝুলে থাকে উজ্জ্বল সবুজ রঙের লেবু।

 বিশুদ্ধ জলের জন্য স্কুল দেয়ালে সাঁটা ' বালি ও পানির কর্ণার" এর পোস্টার। নিরাপদ পানীয় জল পানের সতর্কতার পোস্টার।স্কুল মাঠের দেয়াল ঘেষেই খালের পাড় হবার কারণে ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের জন্য শিক্ষক ও অভিভাবকদের এই নতুন বিপদ নিয়ে নিশ্চয়ই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠবেন। দেয়ালে সাঁটা হবে নতুন সতর্কতার নোটিশ।

 

 

Post a Comment

0 Comments