মান্দি সিরিজ ।। আকাশ মামুন



দাদার কাছে শুনেছি গাভিন বাঘের দুধ দুইয়ে তবেই

পাহাড়ের পত্তন নিয়েছিল তার দাদা।  অথচ আজ

আমি নাকি এই পাহাড়ের ওয়ারিশ নই। খানিক আগে

ঘোষিত হয়েছে সরকারি ফরমান। পাহাড়ের ভূমিপুত্র নাকি

পাহাড় না দেখা অচিনপুরের কোন জমিদার।

এই ঘোষণা মানতে পারেনি চলেশ আর পিরেন

তাইতো তাদের রক্ত শুষে পুয়াতি হল আটকুড়ে বাইদ

 

উৎস আর রাত্রি বাবার সমাধিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে

ভাবে, ইকোপার্ক কি মানুষের রক্তের চেয়ে লাল?

 

তফনে গিট দিয়ে আনারস ক্ষেতের ভিতরে বসে

থোরা চুলকাতে চুলকাতে দাদা বলে শহরে যাবে

আনারস আর লেবুর চালান। এবার ওয়ানগালা 

জমবে খুব। আমি খুশিতে জিলজিলা হয়ে বলি

আমিও শহরে যামু। হুকো টেনে খুকখুক কেশে

দাদা দেখায়মিচিকশার বুকের মত উচু ঐ টিলা

শহর কি তার চেয়ে পেল্লাই আর সুন্দর

শিয়ালমতি আর ধুতরা ফুলের ইশারায় শহর কি ডাকে?

 

ঐ যে শুয়ে আছে শহর না দেখা তোর বাবা

কি তফাৎ হবে শহুরে বাবু যখন এসে শুবে তার পাশে?

কি তফাৎ করবি সাংসারেক আর অসাংসারেকে?

জীবন পাহাড়েও সবুজ। চোখ মেলে-না মেলে দেখে যা।

 

শহুরে বাবুরা এসে সকাল থেকে রোদে ঘেমে টিলায় চড়ছে

সুখে থাকা মানুষগুলোও কি তবে টিলার মতো বুকে দুঃখ পুষে?

লেবুর চালানের সাথে আমি যে শহরে যেতে চেয়েছিলাম

সে মানুষগুলো তবে কি সুখে পাহাড়ে আসে?

ওয়াচ টাওয়ারে চড়ে কোন অচিন দুঃখ ছুঁতে চায়?

আলগোছে কোন দুঃখ উড়ায় বাউলা বাতাসে?

 

ঝুলে পড়া গতরের চামড়ার মতো দাদিরও আফসুস ঝরে পড়ে।

ক্ষয়ে যাওয়া দালানে ত্যাকত্যাকে মাটি লেপতে লেপতে কয়

ক্যামন কইরা শহুইরা মানুষেরা ঘর ছাইড়্যা পালায়!

 

ইতিহাস স্বাক্ষীএই পাহাড় কতটা ভার বইতে জানে

স্বাধীকার আন্দোলনে মিচিকসার চিৎকার

টিলায় টিলায় প্রতিধ্বনি হয়ে আজও মাঝরাতে ফিরে আসে

বাঘা সিদ্দিকধীরেন্দ্রদেও শৌর্য মেখে একদিন কান্না থামে

বুকের পাঁজরে ক্ষত সয়ে পাহাড় দিয়েছে ঠাঁই কত বীরকে

ইসতেহার হাতে শাহজাহানের কন্ঠে গর্জে উঠেছিল টিলা

মুজিবের পথ রেখায় সবুজ ঘাসের চাদর বিছিয়ে

একদিন প্রসস্ত বুকের ছাতি মেলে মুচকি হেসেছিল পাহাড়।

 

অতঃপর! বাংলাদেশের সংবিধানের ইতিহাসে আখর হয় পাহাড়

তবু আজও তার পাজর ভাঙ্গে গাছখেকু বনমালির হাতে।

 

নথ নাচিয়ে হেসে ওঠা সোনা বউয়ের মতো হাসে বাইদের সোনা ধান

আলেয়ার মতো যার সোনামুখ আমার হৃদয়ের তাজবীর

সে তাজবীর আজ ভেঙ্গে চৌচির শেয়ালের হুক্কা হুয়ায়

বাইদ হবে বাইজির হামামখানা

বাঘের কাঁধে জোয়াল দেওয়া মান্দি আজ খাটাসের হুংকারে ত্রস্ত

পিরেনের লাশ কাঁধে শোধ করে জন্মের ঋণ।

 

রংচুগাল্লার দামার তালে প্রাণ ফিরেছে মান্দি পাড়ায়

আজ পুর্ণিমায় চুমানচি চুকোন সে টিলায় মন হারায়

পাহাড়-জলা-জংলা ঘেরা টিলার নিচে গুপ্তধন

অজাত-বেজাত-সাপদকোলে প্রাণ ভ্রোমরা মান্দিজন

বনজাসকে জানেগানদো—সালজংই জুম শেখালো       

রংচুগাল্লার বলথং রাং চিংজিবিমা নিয়ে এলো 

সংনকমা শেষ করেছে সোনা ধানের মাড়াই-ঝাড়া

নতুন ধানের রংচু দেখে তুষ্ট হবে তাতারা

 

ভরা পূর্ণিমায় চুলাইয়ে চুড় হয়ে নেচে চলা মান্দি

নিস্তেজ হতে হতে ক্ষয়ে যাচ্ছে কালে

সাংসারেকের সোদা গন্ধ নাকি বড় সেকেলে লাগে

চার্চের ফাদারে সপে দেওয়া জীবনেই তৃপ্তি জাগে।

ভিনদেশি জাদুকরে ভিমরতির মান্দি

পথ ভুলে কোন পথে গেলিআলপথ ধরে

তোর কি আর নিয়ন আলোর ঝলকানি ছেড়ে

জ্যোৎন্সায় পথ খোঁজে পোড়া পাহাড়ে ফেরা হবে?

আজ তোর সাংসারেক আমার অতৃপ্ত আত্মার ছাই

করুন বিলাপ করে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে।

 

৮ 

এখানে এই দোখলার পাহাড়ি বনে 

আজ বৃষ্টি হবে—ঝুম বৃষ্টি। 

চৈত্রের মাটির তৃষ্ণার আহ্ববানে 

পাহাড়ি আঁকবাঁকা পথ বেয়ে 

কপালের লাল টিপের মায়া নিয়ে

আজ সন্ধ্যায় প্রিয়ার মতো বৃষ্টি ঝরবে। 

শুকনো পাতা শুকনো ঘাস ভিজবে বৃষ্টিতে

আমি ভিজবো প্রিয়ার চুলের জলসিঞ্চনে। 

তার গহীন চোখে শালবনের স্পর্শিয়া মায়া 

কেবল চেয়ে থাকে মুখপানে—অমলিন আহ্বানে। 

আমি এক লতানো গাছ—আশ্রয় ভেবে  

তাকেই কেবল জড়িয়ে ধরি আষ্টেপৃষ্ঠে। 

 

ওগো বৃষ্টি আজ তুমি একবার দেখা দিয়ে যাও 

শালবনের এই রুক্ষ তৃষিত বাথানে— 

আমার প্রিয়া আজ কিন্নরী বাসন্তী পাখি 

নিথুবিয়া ময়ুরীর মতো পেখম মেলেছে। 

 

৯ 

এখানে এই চুনিয়ার বুকে 

খালের পাড়ে টিলার ঢালে 

বোশেখের প্রথম বৃষ্টির পর 

সার্থক সঙ্গমের সুখ নিয়ে বীজ বুনে।  

নবজাতকের মমতা নিয়ে 

বেড়ে ওঠে অঙ্কুরিত স্বপ্ন।  

জীবনের গতি বদলায় ধীরে 

টিলায় হেলান দিয়ে—

হাজার বছরের বারোয়ারী জীবন 

চুরুটের টানে স্বপ্ন বুনে।

 

১০ 

এসেছে সুউউ দে চুনিয়ার বুকে 

শোনাও তাকে লাল মাটির গান 

শোনাও তাকে জীবনের কলরব 

মান্দি পাড়ার বনেদি উত্থান 

শোনাও শোষিতের মর্ম বেদনা 

শোষকের সর্বগ্রাসী আখ্যান 

নৃপতি আজ উপজাতি হয়ে

হারিয়েছে কুলীন সম্মান 

যেতে হবে বিশ্ব দরবারে 

গাইতে হবে আদিবাসী গান 

অধিকারের স্বপক্ষে গলা চড়াবো 

আসুক যতই নির্যাতনের ফরমান 

আমার এ মাটির গান গাইবো আমি 

যতক্ষণ এ দেহে আছে প্রাণ



Post a Comment

0 Comments