কাজের চাপের ক্লান্তি কাটাতে ভাবছিলাম একটা ছুটি কাটানো দরকার। কোথায় যাওয়া যায় সেটা ভাবতে ভাবতেই অফিসের সোহেল ভাই বললেন ইয়েলোস্টোনের কথা। সেখানে জীবন্ত আগ্নেয়গিরিসহ বাইসন ও ভাল্লুকের দেখা নাকি পাওয়া যায়! তাই সিদ্ধান্ত হলো ইয়েলোস্টোনেই যাব। অফিস থেকে লং উইকএন্ডে বাক্সপেট্টা গুছিয়ে রাত তিনটায় বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গী আহমেদ, আনিক, সায়েম এবং শামস। সড়কপথে দূরত্ব সাত ঘণ্টা। রাতে ঘুম ভালো না হওয়ায় বেচারা সোহেল ভাই-ই গাড়ি চালালেন। রোলিংস যেতে যেতেই সূর্যের দেখা পাওয়া গেল। খিদে পেটে জানান দিয়ে যাচ্ছিল। তাই রোলিংস নেমে সকালের নাস্তার আয়োজন চললো। মেকডোনাল্ডসে আবার হালাল খাবার পাওয়া যায় না। বেকনের পেটি ছাড়া সকালের নাস্তা শেষে করলাম। ক্ষুধার কারণেই কিনা-খাবার বেশ ভালোই লাগলো। খাওয়া শেষে এক মগ কফিতে চুমুক দিতে দিতে আবার ছুটলাম। এবার সোহেল ভাই-চোখ বুজার অবসর পেলেন।
যাত্রাপথে টিটন জাতীয় উদ্যান ঘুরে যাবার সিদ্ধান্ত হলো। তাই আপাতত গন্তব্য সেখানেই। জনমানবহীন রাস্তায় একটানা গাড়ী চলছে। ওয়ায়োমিংয়ের পাহাড়ি রাস্তায় ক্ষণে ক্ষণে দেওয়াল তুলে দাঁড়িয়ে আছে জবরদস্ত পাহাড়। যেতে যেতে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেল। পেটও জানান দিচ্ছে—খাওয়া দরকার। দুপুরের খাবারের জন্য থামলাম জ্যাকসন হোল ভ্যালি। হালালের কথা মাথায় রেখে এবারও অর্ধ ভোজন নিয়েই তৃপ্ত হতে হলো। ম্যাকডোনাল্ডস থেকে মাছের বার্গার। আবার যাত্রা শুরু। চল্লিশ মাইল দূরে টিটন জাতীয় উদ্যানের ক্যাম্প গ্রাউন্ড। ওখানের রাতের তাঁবু ফেলার বন্দবস্ত হলো। আহমেদ বেশ কাজের ছেলে। বাসা থেকে মুরগী মেরিনেট করে এনেছিল। গ্যাস স্ট্যুভে পুড়িয়ে রুটি দিয়ে তৃপ্তি নিয়ে খেলাম সারাদিন পর। তখনও সন্ধ্যা নামেনি। হাতে সময় থাকায় বেরিয়ে পড়লাম চারদিকটা দক্ষতে। টিটনের অন্যতম আকর্ষণ জেনি লেক। শহরটা সাজানো গুছানো ছবির মতো। স্থান হিসেবে আমেরিকার অন্যতম খরুচে শহর। সব মিলিয়নিয়াররাই এখানে শ্রান্তি বিনোদনের জন্য সময় কাটাতে আসে-বাড়িও বানায় কেউ কেউ। টাকা দিয়ে স্প্রিড বোট চালানোর ব্যবস্থা আছে। অবে স্প্রিড বোটে কারও অভিজ্ঞতা না থাকায় সে দিকে আর পা বাড়ানো হয়নি। লেকের চারপাশ ঘিরে রেখেছে বিশাল বিশাল পাহাড়। আপাতত ঘুরে ঘুরেই চোখকে শান্তি দিলাম। ছবি তুলে স্মৃতি জমা রাখলাম। সারাদিনের ক্লান্তির পর এবার ঘুমানোর পালা।
বাক্সপেট্রা গুছিয়ে পরদিন সকালে নাস্তা সেরে আবার যাত্রা শুরু হলো। ঘণ্টা আধেক দূরেই ইয়েলোস্টোন জাতীয় উদ্যান। সেখান থেকে ঘণ্টাখানেক দূরে ওল্ড ফেইথফুল। এখানেই আছে দর্শনীয় প্রাকৃতিক গিজার (গরম পানি ভূগর্ভ থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে উঠে ধূয়াসহ)। দিনরাত নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর প্রচণ্ড বেগে ধূয়াসহ পানি সজোরে বেরিয়ে আসে। সময় ধরে বেরিয়ে আসে বলেই হয়তো এর নাম হয়েছে ওল্ড ফেইথফুল (পুরনো বিশ্বাসযোগ্য)। ঘুরার ফাঁকে রাতের থাকার জন্য ক্যাম্পগ্রাউন্ড বায়না করে নেওয়া হলো। কারণ দেরি হলে হয়তো আর ক্যাম্পগ্রাউন্ড পাওয়া যাবে না। তখন আবার নিকটবর্তী শহরে দৌঁড়াতে হবে থাকার জন্য। কাছাকাছি গ্র্যান্ডপ্রিজমেটিক স্প্রিং। সরাসরি আমরা চলে গেলাম সেখানে। গাড়ি পার্ক করে কুড়ি মিনিটের হাঁটা পথে পৌঁছে গেলাম স্প্রিং এর কাছে। পানি স্বচ্ছ নীল এবং গরম। তাপমাতা প্রায় ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রাতেও এখানে প্রচুর শৈবাল আর ব্যক্টেরিয়ার থাকে। আর সে কারণে পানি স্বচ্ছ হলেও নীল দেখায়। সেখানেই দেখা হয়ে গেলো পরিচিত কিছু ছোট ভাইদের সাথে। ওরা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ঘুরতে এসেছে। হঠাৎ দেখা হওয়ায় দেশিয় একটা স্বাদ পেলাম। চলতি পথে অসংখ্য গিজার, স্প্রিং আর লেক আছে।
ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। ফিরতে হবে ক্যাম্পে। যাওয়ার পথে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে একপাল বাইসন। গাড়ি থামিয়ে বসে রইলাম। নড়ার নাম নেই। বিষয়টা যেন এমন-আমাদের রাজ্যে এসেছ তবে আমাদের মর্জিতেই চলতে হবে। ধীরে ধীরে এগুতে এগুতে একসময় একটু জায়গা পাওয়া গেল। কোন রকমে বেরিয়ে এসে ছুটলাম ক্যাম্পের দিকে। রাতে আবার সেই মুরগি পুড়িয়ে খাওয়া। ব্যাচেলর জীবনের ছন্নছাড়া জীবনের মতো জোরে জোরে কথা আর হাসাহাসি চলছিল। ধারণাই ছিল না পাশের মানুষদের সমস্যা হতে পারে ঘুমে। কিন্তু সেই সম্বিত ফিরে এলো পাশের ক্যাম্পের একজনের আপত্তিতে। এবার চুপ হয়ে ঘুমাতে গেলাম যে যার মতো।
পরের দিন গন্তব্য ইয়েলোস্টোন নদীর পাড়ে আপার ফলস আর লোয়ার ফলস। যাত্রাপথে একটা জটলা দেখে উৎসুক দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম ভাল্লুক বাচ্চাসহ ঘাস খাচ্ছে। কাছেই ফরেস্ট পুলিশের একটা গাড়ি পাহারা দিচ্ছে যাতে দর্শনার্থীদের কোন ক্ষতি করতে না পারে। মূলত ভাল্লুকের গায়ে ট্রেকার বসানো তাই দর্শনীয় স্থানের কাছাকাছি এলে পুলিশদের কাছে সংকেত চলে যায় এবং তারা সেভাবেই সতর্ক হয়ে যায় দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা দিতে।
ছোট একটা হাইক করে আপার ফলসে উঠে যে যার মতো ছবি তুলে নিলাম। উপর থেকে নিচে নামছে। ঘুরতে ঘুরতেই দুপুরের খাবারের সময় হলো। কাছেই মন্টানার সীমান্ত। একটা সাবওয়েতে ঢুকে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। সেখান থেকে ঢু মেরে আসলাম নরিসের ছোট ছোট কয়েকটা গিজার বেসিনে। দেখতে বেশ ভালো হলেও তীব্র সালফালের (পঁচা ডিমের) গন্ধ খুব বেশি সময় টিকতে দিবে না। বেশিক্ষণ দাঁড়ালে মনে হবে গা থেকেই সালফারের গন্ধ বেরুচ্ছে। তাই আমরা আর বেশিক্ষণ দাঁড়ালাম না।
অনেক তো হলো। এবার ফেরার পালা। ক্যাম্পে ফিরে বাক্সপ্যাট্টা গুছিয়ে ছুটলাম গাড়িতে। ছুটি শেষ। ফিরতে হবে কাজে।
0 Comments