ছেলেটিকে হাসপাতালের সামনে হাউমাউ কান্না দেখে পাশের এক আবেগি ছেলে এগিয়ে এলো। কিছু না বুঝেই সেও খানিকটা কেঁদে নিল। তারপর চোখ মুছতে মুছতে আবেগি ছেলেটা বললো, ‘ভাইয়া, আপনি এভাবে আর কাঁদবেন না। আমি একদম স্থির থাকতে পারছি না। বুকের পাজর কলা গাছের মতো ভেঙে পড়ছে। প্লিজ ভাইয়া, এভাবে কাঁদবেন না। আমি কিন্তু চোখের জল একদম আটকে রাখতে পারছি না।’
ছেলেটির মনে হলো থামা যাবে না, কান্না চালিয়ে যেতে হবে। সে এমন একজনকেই তো মনে মনে খুঁজতেছিল। সে তার মনের মানুষটিকে পেয়ে গেছে। কান্না করার মনের মানুষটি। সুতরাং আরও জোরে কাঁদতে লাগল ছেলেটি এবার। আবেগি ছেলেটির হাত ধরে সে কাঁদছে। কিছুতেই থামছে না। থামার চেষ্টাও করছে না। আহ্, কী দৃশ্য! কান্নায় হালকা বিজ্ঞাপন বিরতি দিয়ে এবার সে তার দুঃখের কথা বলতে লাগল, 'ভাই, আর বলবেন না। আমার কান্নার ইতিহাস জানতে চেয়ে আমাকে লজ্জায় ফেলবেন না। দুঃখের কথাগুলো শুনতে চেয়ে আর আমাকে পেরেসানিতে ফেলবেন না। আপনি নিজেও পেরাসানিতে পড়বেন না। তবে আপনি যেহেতু শুনতে চাইছেন তাই আমি না বলে থাকতেও পারবো না। আমি নিজেও আর কাঁদতে চাই না। চাই না কেউ আমার কথা না শুনে কাঁন্না করুক।
ঘটনাটি হলো ফেসবুকে একটা অচেনা মেয়ে আমাকে রিকোয়েস্ট পাঠায়। মেয়েটির টাইমলাইনে গিয়ে সব ডিটেইলস দেখলাম। কোন ছবি নাই। ডিটাইলস প্রোফাইল তেমন হাই প্রোফাইলও নয়। তবুও কোনো কিছু আর যাচাই না করেই একসেপ্ট করে ফেলি। মেয়ে বলে কথা। একটা ধারণা আছে মনে মধ্যে ফেসবুকে মেয়ে ফ্রেন্ড বেশি থাকলে নিজের ভাব একটু বেশি বাড়ে। বন্ধুদের কাছে বেশি পার্ট নেয়া যায়। আর যদি কোন মেয়ে স্ট্যাটাসে কমেন্টস করে তাহলেতো একবারেই শেষ হয়ে যাবার মতো অবস্থা। তারপর একসেপ্ট করাতে সে ধন্যবাদ দিল।আমিও লুফে নিলাম তার ধন্যবাদ। ইচ্ছে ছিলো আবেগে কেঁদে ফেলি। তার আর করি না।
তবে আমার তখন অন্য রকম ভালো লাগতে শুরু করছিলো। আমার মনে এক অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করতে ছিলো। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতেছিলাম। তাকে কি মেসেজ দিবো। না দিবো না। কিছুক্ষণ পর আমি তাকে মেসেজ পাঠাই। আমি বরং ধন্য আপনার ফেন্ড রিকুয়েস্ট পেয়ে।
সঙ্গে সঙ্গেই সে আমাকে রিপ্লাই দিল, ইট'স ওকে। তার এই ইটস ওকে মেসেজটি আমি যে কতোবার দেখলাম ! তা হিসেব করে বলাও কঠিন। একবার খেতে বসে। আরেকবার বাথরুমে ফোনটি নিয়ে গিয়ে। একবার ছাদে উঠে গিয়ে। পরেরদিন সকালবেলা তাকে মেসেজ দিলাম, গুড মর্নিং। সঙ্গে সঙ্গেই সে রিপ্লাই দিলো, সু-প্রভাত। তখন নিজেকে যেনো সাংবাদিক ভাবা শুরু করলাম। একের পর এক প্রশ্ন। আপনারা ভাই-বোন কতোজন? পরিবারে লোক সংখ্যা কতো? বাবা কি করেন ? আপনি কোথায় স্ট্যাডি করেন ? আরো বহু রকম প্রশ্নের সমাহার।
সেও উত্তর দিচ্ছে আর প্রশ্ন করছে। এভাবে তার সঙ্গে আমার চ্যাট শুরু হলো। এক নাগাড়ে চ্যাট করলাম দুপুর পর্যন্ত। সে খাবার জন্য সময় চাইলো। সে গোসল আর খেয়ে আবার চ্যাট বক্সে আসলো। আমি দুপুরে খাওয়া আর গোসল বাদ রেখেছিলাম। অপেক্ষায় ছিলাম সে কখন আসবে। বহু প্রতীক্ষার পর সে আসলো। আবার শুরু হলো চ্যাট। তার সাথে এই একবেলা চ্যাটে মেসেজিং করেই খুব কাছে চলে গেলাম। যা বলে বুজাতে পারবো না।মনে হলো সে আমার প্রথম আইডির প্রথম ফেন্ড বা সে আমার এক যুগের বেশি পরিচিত।
চ্যাটের মাধ্যেমে একবেলাতেই তার প্রেমে পড়ে যাই। আমার আবার ধৈর্য শক্তি কম। সেই দিনই তাকে প্রেমের অফার করে বসি। সে আমার অফার গ্রহণ করে। উভয়ের সম্মতিতে আমাদের প্রেম হয়ে যায়। দেখা নেই, কথা নেই প্রেম হয়ে যায় চ্যাট বক্সে। হায়রে ভালোবাসা। বিকেলবেলা নম্বর আদান-প্রদান করি। সঙ্গে সঙ্গেই তার ফোনে কল করি। তার ভয়েজ শোনার পর পুরোই পাগল হয়ে যাই।
সে ফ্রি.ফেসবুক চালায় তাই নাকি মেসেঞ্জারে কথা বলতে পারে না। রাতে আবার কথা বলি। বেশ মায়ার ছকে পড়ে যাই। হয়ে যাই পাগল প্রেমিক। একদিনে চ্যাট করেই এবং না দেখেই যে আবেগ সৃষ্টি হলো তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এক পর্যায়ে পরের দিন তার সঙ্গে দেখাও করার ডেট ফিক্সড করি।'
'তারপর ভাই, তারপর?' তারপর তার সাথে আমার দেখা করার ডেট হয় নিউ মার্কেটে। কি পোশাক পড়বো তাও ফিক্সট করি। যখন বের হবো ঠিক তখনি মনির মামার মোবাইল করলো। মনির মামা হল আমার রুমমেট। তার ফোন পাওয়া মানেই একেটা ঝামেলার খবর পাওয়া। বহুবার এরকম ঘটনা ঘটেছে। এই যেমন, বাসার নীচে এসে বলবে খুচরা টাকা নেই খুচরা টাকা নিয়ে নীচে নাম, চাবিটা রুমে রেখে তালা দিয়েছি। এখন রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। চাবিটা নিয়ে রুমের সামনে আয়। নিশ্চয় আজো এর ব্যতিক্রম হবে না।
কে বলব মিথ্যা কথা! যা আন্ধাজ করলাম তাই হলো। ওর নাকি মানিব্যাগ লোপাট হয়ে গেছে। নিউমার্কেটে দাঁড়িয়ে আছে। বিকাশে ঝামেলায় না গিয়ে নিউমার্কেটে যেতে বললো। আমাকে দ্রুত যেতে হবে। আমি ভাবলাম মেয়েটির সাথে দেখা করতে তো নিউমার্কেটেই যাচ্ছি। মেয়েটির সাথে দেখা করে মনির মামাকে নিয়ে বাসায় ফিরব।তারপর তড়িঘড়ি করে বাসে উঠি। তিন সিট বিশিষ্ট একটি সিটে বসি। কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলাম দুটি মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার তারা আমার দিকে আসছে। আমি মনে করলাম হয়তো আমার পরিচিত।
ইতোমধ্যে আমি ভাবতে শুরু করেছি, মেয়ে দুটোকে কোথায় যেনো দেখেছি। অতঃপর মেয়ে দুটি আমার কাছে এসে বললো, ‘এক্সকিউজ মি, এটা মহিলা আসন।’ আমি অনেকটা লজ্জিত হলাম। সিট ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম।বাসের ভিতর সকল যাত্রীকে এক নজরে দেখে নিলাম। কেউ পরিচিত আছে কিনা। ঘটনাটি আশে পাশের কেউ ফলো করছে কিনা। পিছনের দুয়েক জনের চাহনী আমার কাছে বেশ সন্দেহজনক মনে হলো।
মনে হচ্ছে আমি মহিলা আসনে বসে অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছি। জগতে কতো মানুষ কতো ধরনের অপরাধ করে তাদের কিছু হয়না। আর আমি না হয় একটু মহিলা আসনেই বসেছি। যদিও নতুন আইন হয়েছে।মহিলা আসনে বসলে জেল জরিমানা দিতে হবে। একবার ভাবলাম বাস থেকে নেমে যাই। আবার ভাবলাম প্রয়োজনটা তো জটিল । বেশ জরুরী। তাই এবার পেছনের সিটে একটা লোকের পাশে বসলাম। লোকটিকে দেখতে ভালোই মনে হচ্ছিল। তেমন কথা বলছিল না। আমি মনের শঙ্কাটা দূর করার জন্য কথা বলার প্রস্তুতি নিলাম। ভাবলাম নিজের লজ্জাটা একটু কাটিয়ে তুলি। লোকটাকে বললাম, ‘এক্সকিউজ মি, আপনি কোথায় যাবেন?'
এই তো সামনে। আপনার বাসা কোথায়?
দেখতে চান, নাকি শুনতে চান?
লোকটির কথা শুনে একটু আশ্চর্য হলাম। এমন করে কেউ বলে! তাই বললাম, দেখতে পাইলে কী আর কেউ শুনতে চায়?
লোকটিকে এই কথা বলা মাত্রই আমার গলা চিপে ধরল। আমি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি ছিলাম না। আমি ও মাগো ও মাগো বলে চিৎকার শুরু করলাম। বাসের মধ্যে যাত্রীরা রেগে আগুন।
সামনের এক লোকতো বলেই ফেলল, এই ছেলেটি পিছনে গিয়েও ঝামেলা পাকাচ্ছে। আমি যে মহিলা সিটে ছেড়ে পিছনে গেয়েছি সে সেটাই বার বার বলছে। অনেকেই আমার কাছে আসলেন। আমি সব খুলে বললাম। বেশির ভাগ যাত্রী আমার পক্ষ নিলো।
এবার লোকটিকে সবাই প্রশ্ন করল আপনি ওর গলা চিপে ধরলেন কেন? দোষটা লোকটির উপর চাপানো দেখে আমার মনে বেশ আরাম পাচ্ছিল। বেশ সুখানুভূতি হচ্ছিল।
লোকটি এবার পাল্টা প্রশ্ন করল। ওমা গলা চিপে ধরব না তো কী করব? উনি তো দেখতে চাইছেন আমার বাসা কোথায়। আমার বাসা তো গলাচিপা, পটুয়াখালী। তখন সবাই চুপ মেরে গেলেন। যে যার সিটে গিয়ে বসলেন।
আমি আর কি করবো। আমিও ভিন্ন দিকে চেয়ে সিটে বসলাম। বাস নিউমার্কেটে গিয়ে থামল। আমি বাস থেকে নামলাম। মনির মামার কথা ভুলে গেলাম। মেয়েটিকে ফোন দিলাম। সে বলাকা সিনেমার পাশে দাঁড়াতে বললো। আমি বলাকা সিনেমার পাশে দাঁড়ালাম। আর যে মেয়ে দেখছি তার দিকেই তাকিয়ে থাকছি।
এবার সে আবার ফোন করে বলল, কি ব্যাপার তুমি কোথায়। আমাকে দেখতে পাচ্ছো না। আমিতো বলাকা সিনেমার সামনেই দাঁড়ানো। আমি পাশেই দেখলাম একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। আমি তার কাছে গেলাম। বললাম, হায়। চিনতে পেরেছো?
আপনি কে?
মেয়েটি এই কথা বলতেই এক ছেলে টিকিট নিয়ে এলো মেয়েটির কাছে। ছেলেটি বলল, ইনি কে? দেখোতো। চিনি না তাকে। অথচ সে এসে আমাকে হায় দিচ্ছে। না চিনলে একজন বুঝি এমনিতেই হায় দেয়। থাকো আজ সিনেমায় দেখবো না। আমি বুঝলাম মিসটেক করেছি। যে কোন মুহূর্তে আমার উপর কোন ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই দ্রুত তাদের সামনে থেকে চলে এলাম।
কিছুক্ষণ পর আবার ফোন পেলাম। মেয়েটি বলল, আসলে তুমি কোথায়? আমি বলাকা বলতেই মেয়েটি এসে আমার সামনে বলল, তুমি সেই। মেয়েটি অ্যাপ্রোন পরা। দেখতে বেশ সুন্দরী। চোখে কাজল। কপালে টিপ। হাতে চুড়ি। হাতে ও পায়ের আঙুলে নেইলপালিশ লাগানো। আমিতো অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলাম। নজর ফেলছিলাম না।
মেয়েটিও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটি এবার মিটমিটিয়ে হাসছে। তার হাসিটা অসাধারণ। আমি হয়ত স্বপ্নে এমন হাসিই খুঁজতেছিলাম। তার সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য এবার মরিয়া হয়ে উঠি। মেয়েটি বললো সে মেডিকেলের ছাত্রী। ফেসবুকে সে তার ছবি দেয়না। বেশী সুন্দরী বলে। আর আমাকে বিষ্মিত করতে তার পরিচয় লুকিয়ে রেখেছে। আমি তার কথা শুনে থমকে গেলাম। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
এবার সে আমাকে বললো, ‘তোমাকে এর আগে কোথায় যেন দেখেছি? তুমি কি ঢাবির ছাত্র? সত্যি করে বলবা। তুমি কি আমার মতোই পরিচয় আড়াল করেছো। তার এই কথা শুনে আমি একবার সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলতে চাইছিলাম। কিন্তু আশে-পাশের অবস্থা বেশি ভালো না। লোকজন আর লোকজন। আমি ঢাবির ছাত্র না হয়েও মাথা নাড়ালাম। আর বললাম হ্যাঁ, কিন্তু তোমার পুরো পরিচয় দিবে?
আমার আসল নাম সোহানা। ফেসবুকে অবুঝ বালিকা আমার ফেইক আউডি। আমার বাসা বরিশাল। ঢাকা মেডিকেলে নতুন ভর্তি হয়েছি। এ এলাকা আমার কাছে অপরিচিত। তাই তোমার ফেসবুক দেখলাম তুমি ঢাকার। তাই পরিচিত হবার আগ্রহ বাড়ল। তুমি কি এখন আমাকে এলাকাটা একটু ঘুরিয়ে দেখাবে? চেনাবে? তার আগে কোনো ফাস্টফুডে যাওয়া যাক। আমার প্রচন্ড তৃষ্ণা পেয়েছে সে বললো।
এর মধ্যে আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। অপরিচিত নম্বর। যদি মনির মামা হয় তাহলে এ মেয়েটার সাথে আর আড্ডা দিতে পারবো না। তাই ফোন রিসিভ করলাম না। ফাস্টফুডে যাওয়া হলো। খাবার শেষে বিলটা আমিই দিলাম। মেয়েটি দেওয়ার জন্য তোড়জোড় করল; কিন্তু আমি দিতে দিলাম না। মেয়েটি এবার বললো, চলোনা কোনো ফাঁকা গলির ভেতর যাই। যেখানে অনেক কথা বলতে পারব।
আমি গলির ভেতর যাচ্ছি আর ভাবছি, মেয়েটিকে যদি প্রেম করে বিয়ে করি বাবা-মা কি কিছু বলবে? কেন বলবে? কতো সুন্দরী!
তারপর আবার মেডিকেলের ছাত্রী। মেয়েটি বললো, তুমি কিছু ভাবছো না তো?'
কই না তো। বলতেই মাথায় একটু আঘাত অনুভব করলাম। জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। যখন জ্ঞান ফিরল দেখলাম হাসপাতালের বেডে। অ্যাপ্রোন পরা একটি মেয়ে আমায় ডাকছে। আর বলছে, ভাইয়া ওষুধটা খেয়ে ঘুমান। আমি জোরে চিৎকার দেই। আর বলি, ছিনতাইকারী। এবার দেখি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। কী ব্যাপার! সব বুঝে ফেলল নাকি আমি যে প্রেমের কারণে হাসপাতালে!
'তারপর, তারপর ভাই?'
তারপর আর কী, এখন বসে বসে কাঁদছি। ভাই, যাকে ভালোবাসলাম সে কি—না ছিনতাইকারী দলের সদস্য! বলে ছেলেটি এবার আরও হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল! আবেগি ছেলেটিও আবার কাঁদতে শুরু করল। দু'জনের চোখের জলে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিল!
0 Comments