তখনও কুয়াশা কাটেনি। চারদিকে সাদা পর্দার মতো মিহিদানা কুয়াশা। হাত ছোঁয়া দূরত্বে একে অপরকে দেখতে পেলেও তার চেয়ে দূরত্বে চোখ আটকে যায়। চোখ বুজে আসে পৌষের উষে। চোখের পাপড়ি ভিজে যাচ্ছে। শান্ত জলের শরীর থেকে ক্রমেই ভাপের মতো ধোঁয়া উঠছে—মুখ খুলে শ্বাস ছাড়লেও ছোট ছোট ধোঁয়ার ভাপ মিশে যাচ্ছে ছড়ানো কুয়ার সাথে।
বড় সড়ক ধরে হল্লা। সব্জির খুচরা ও পাইকারি ক্রেতা বিক্রেতার হল্লা। দোকানের ঝাপে বাল্বের আলো বেশিদূর ঠিকরে বের হতে পারছে না কুশার চাপে। পৌষের শীত জাঁকিয়ে বসলেও নিম্নচাপের নানা খবর যে চাউড় হলো সেই চাপের হদিশ এই চরাঞ্চলে নেই। বণ্যা যতটুকু কাবু করে ঠিক ততটুকু নিন্মচাপ বা লঘুচাপ এই চরাঞ্চলের নিত্য লড়াই করা মানুষদের কাবু করতে পারে না।
চরের জমি দখল-মারামারি নিত্য চর সৃষ্টির সাথেই ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। নদীর পেট ফুল ওঠবে আর তার স্বত্ব নিয়ে মারামারি লাঠালাঠি রক্তারক্তি হবে না তাই কি হয় কোন কালে? চরের লেঠেল বাহিনীর নানা কথাবার্তা সব অঞ্চলেই এক। লেঠেল সর্দারের তিতানো গোঁফ, বুকের ছাতি আর তেল কুচকুচে চারহাতি লাঠির ভয়ধরা দুর্ধর্ষ নানা কথা অঞ্চলের মজুদ আছে ঘরে ঘরে।
বন্যা হলেই পাল্টে যায় জীবনের ছক। ঘর বাড়ি জমিজিরাত সব তখন ভেসে বানের কোপে। আবাদী জমিতে পরতে পরতে জমে চিকন বালু। মুছে যায় দখল সীমা। জল নেমে গেলেও কয়েক বছর অনাবাদী। খাওয়া না খাওয়া জীবন নিয়ে কেউ পরে থাকে চরের প্রেমে কেউ কেউ শহরমুখী উদ্বাস্তু জীবন। বন্যার প্রকোপ এই চরাঞ্চল ছাড়িয়ে মেলান্দহ পর্যন্ত জীবন তখন জেরবার হয়ে পড়ে।
ব্রহ্মপুত্রের তলদেশ থেকে জেগে ওঠা এই চর। এই তামাম অঞ্চল ব্রহ্মপুত্রের পেট থেকে ওঠে আসা ভুমি। নিজের পলি আর মিহিদানা চিকচিক বালু উগড়ে দিতে দিতে সে আজ নিঃস্ব। বিস্তৃণ অঞ্চলে গড়ে ওঠেছে মানুষের জীবন ও জীবিকার চাতাল।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র কাগজ পত্রে থাকলেও লোকে মরা ব্রহ্মপুত্র বলেই ডাকে। নদীর পাড়ে টিক থাকা মানুষের স্মৃতি ও শ্রুতিতে আজও রয়ে গেছে প্রমত্তা উন্মাদিনী এই নদীর নানা ঠিকুজি। আজ এই পাড় ভাঙে তো কাল ওপাড়।বসত ভেঙে ভেঙে গিলে ফেলেছে গ্রামের পর গ্রাম আর যুবতী জোত জমি। ফলন্ত বৃক্ষ।
হাতে পায়ে দৈর্ঘ্যপ্রস্থের এই নদী পারাপারের ভয় শংকা আর নৌকাডুবির কথা নাই বা বললাম। নদী জীবনের সাথে ভাঙা গড়া ও মৃত্য গেঁধে আছে মালা করা ফুলের মতো। সেই স্মৃতি ও শ্রুতির প্রতাপে লোকের কথায় মরা ব্রহ্মপুত্র বলে ডাকার ভেতর এক ধরনের অবজ্ঞা বিদ্রুপ রয়ে গেছে।
প্রতাপ প্রভাব কমে গেলে কী মানুষ-কী নদী—কীর্তি কালের প্রকোপে মানুষের মনে অহংকার, স্মৃতিকারতা, শ্লেষ ও ক্ষোভ জন্মে, জন্মে কীর্তিকে নাশ করার নানা কীর্তিনাশা কারবার। ব্রহ্মপুত্র তার ব্যতিক্রম নয়।
চরের জমি দখল-মারামারি নিত্য চর সৃষ্টির সাথেই ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। নদীর পেট ফুল ওঠবে আর তার স্বত্ব নিয়ে মারামারি লাঠালাঠি রক্তারক্তি হবে না তাই কি হয় কোন কালে? চরের লেঠেল বাহিনীর নানা কথাবার্তা সব অঞ্চলেই এক। লেঠেল সর্দারের তিতানো গোঁফ, বুকের ছাতি আর তেল কুচকুচে চারহাতি লাঠির ভয়ধরা দুর্ধর্ষ নানা কথা অঞ্চলের মজুদ আছে ঘরে ঘরে।
নানা কারণে দখল স্বত্বে সবাই চরের দাবিদার—পৈতৃকসম্পত্তির দাবীদার কিংবা জবর দখলের দাবীদার। শুধু কাগজ পত্র নেই। যা আছে সেও জালের উপর জাল। রান্না ঘরের বাতায় কাগজ গুজে রান্না ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় পর্চা বা দলিলপত্রের সাবেকি আমলের কাগজ পত্র বানাবার নানা ফাঁক ফোঁকর চরের মানুষদের দেখিয়ে দেয় ভূমি অফিসের কয়-কর্মচারিরা। তাই নিয়েই মামলা মোকদ্দমা কোর্ট কাচারি। মার্ডার। পুলিশ ওয়ারেন্ট। হ্যান্ডক্যাপ নিয়ে রাতের অন্ধকারের আসামী আর পুলিশের চোর পুলিশ খেলা সে তো বহু পুরাতন গল্প।
নদী এই সব দেখে আর মিটিমিটি মুচকি হাসে যুবতি ছিনাল কন্যার মতো। কার পেট থেকে উগড়ে দেয়া সন্তান আর কে তার ঔরষজাতের দাবী করে! মালিকানা বোধ মানুষের সম্পর্কের রসায়ন ও গণিত পাল্টে দেয়। মানুষের সাথে মানুষের—মানুষের সাথে প্রকৃতির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের সম্পর্কের সহজাত সৌন্দর্যের দিকে তা আর বিকাশের পরিসর পায় না মালিকানা বোধের শৃঙ্খলার কারণে। রক্তের বন্ধনের মতো পল্লবিত সম্পর্কও পাল্টে যায় মালিকানা দাবী ও দখলের কারণে।
সড়কের পাশে খুপড়ি ঘরে চা খেতে খেতে মাথার ভেতর খেলছিল নানা বিষয়। এই ভোরেও এখানে ভীড়। চাঅলা ব্যস্ত। কুশায়া কাটে যাচ্ছে। শীতে একটু উষ্ণতা, চা-ই এনে দেয়। সারি সারি ট্রাক ভর্তি বেগুন, সিম, কপি নিয়ে ট্রাক বড় শহরের দিকে ছুটে যাবার জন্য প্রস্তুত। বাঁধাছাদা হয়ে গেছে। পাইকার আগের দিন বিকেলেই মিটিয়ে দিয়েছে প্রান্তিক কৃষকের সব্জির দাম।
রাতেই দিকেই ট্রাকের বহর ছুটে। এই পাইকার মধ্যস্বত্ত্বভোগী। মুনাফার সর তারাই তুলে নিচ্ছে। কৃষির বিপনন ব্যবস্থা শিল্পের মতো গড়ে না ওঠার কারণে চূড়ান্ত ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক কৃষক আর ভোক্তা—যার কাছে গিযে পণ্যের জীবন চক্র শেষ হয়। পণ্যে যত হাতবদল তত তার গায়ে চরে বসে দাম। মধ্য যাত্রায় দামের এই বাড় বাড়ন্তই উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন মানুষের উন্নতির ভিত্তি। ঠকে শুধু প্রান্তিক কৃষক ও ভোক্তা। মধ্যস্বত্বের চিরকাল এক জপ—"ঠকাই বিনে ঠকি না”।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরও পঞ্চাশ হয়ে গেছে। অথচ প্রান্তিক কৃষক আজও প্রকৃতপ্রস্তাবে প্রান্তিক। যদিও তার হাতে স্মার্টফোন ঘরে রঙিন টিভি সড়কে ওঠলেই থ্রিহুইলার—সাঁসাঁ করে চলে আসছে শহরে—ঝকমারি শহরে।
২
ততক্ষণে সূর্য্য উঁকি দিতে শুরু করেছে। সড়ক থেকে হাতের বামে নেমে প্রাক্তন নদীর পেটে ঢুকে গেছি। ভেজা ভেজা বালু। খাড়া পাড় এখানে এসে নেমে গেছে। শরীর ছেড়ে দিলেই সরসর করে নেমে পড়া যায় অনেকখানি।
সারি সারি ট্রাক। বালুর পাহাড় আর বালুর পাহাড়। একদিকে বালি তোলার ভারি মেশিন নদীর গভীর থেকে বালি তুলে ফেলছে আর অন্যদিকে কয়েকজন শ্রমিক মিলে বেলচা দিয়ে বালুর পাহাড়ের সামনে রাখা ট্রাকে তুলছে বালি। ঘড়ঘড় শব্দে চারদিক প্রকম্পিত। অখন্ড চরাচর খান খান হয়ে ভেঙে পড়ছে বালুর মেশিনের শব্দে।
উচন্ডি আদরের গাছ নয়—আদাড়ে বাদাড়েই নিজের খেয়ালে বেড়ে ওঠে। তেমনি আরেকটি উদ্ভিত ঠোসকা। বুক সমান উঁচু। সবুজ খাঁজকাটা পাতা। কেউ কেউ ফুটকিও বলে। ঝাঁক বেঁধে ফল হয়। সবুজ নীলের খোলসের ভেতর গোল—চুকা চুকা তেতো ফল। চরের ছেলেমেয়েরা এই ঠোসকা গাছ থেকে ছিঁড়ে মুখে ফু দিয়ে ফুলিয়ে কারো মাথায় বা গালে টোকা দিলেই বেলুনের মতো টাস করে ফেটে যায়। তাতেই তাদের আনন্দ। গায়ে ধুলা মাটি মাখানো চরের আট দশ বছরের ছেলে মেয়েরা চুকা তেতো ফল খাওয়া আর উচ্ছ্বিত খেলা—দুই-ই পায় ঠোসকা গাছ থেকে। এই তাদের বিনোদন। দুরন্ত শৈশব। বাবা মায়ের সাথে ক্ষেতে যোগালির কাজ করতে করতে একদিকে যেমন কাজ শেখা আর অন্যদিকে আনন্দে মেতে ওঠা।
যেই না হঠাৎ বালুর মেশিন থামল তখনই আস্ত নীরবতার ভেতর উচ্চকিত হয়ে উঠল পাখির পার্লামেন্ট। এতক্ষণ শব্দে পাখির দেখা নাই। এখন ছুটছে উড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ফিঙে-ঝুট শালিক স্যাঁতারে। তামাম চরের উপর মস্ত নীলাকাশ ধামার মতো উপুড় হয়ে আছে মাথার উপর। আর তাতেই পাখিদের হল্লা।
সব পাখি আমি চিনি না। বার্ডওয়াচারদের সাথে ঘুরতে ঘুরতেই পাখি চিনি। বৃক্ষ চিনি। চিনি পায়ের খুব কাছে ছোট লতা গুল্ম জাতীয় উদ্ভিত উচন্ডিকে। কী চমৎকার ছোট ছোট তারার মতো সাদা উচন্ডি ফুল। নীল সাদা হলুদে উচন্ডিকে মায়াবি মনে হয়। চলার পথে পায়ের কাছেই বেড়ে ওঠে এই ঝাঁক বাঁধা উচন্ডি গাছ।
উচন্ডি আদরের গাছ নয়—আদাড়ে বাদাড়েই নিজের খেয়ালে বেড়ে ওঠে। তেমনি আরেকটি উদ্ভিত ঠোসকা। বুক সমান উঁচু। সবুজ খাঁজকাটা পাতা। কেউ কেউ ফুটকিও বলে। ঝাঁক বেঁধে ফল হয়। সবুজ নীলের খোলসের ভেতর গোল—চুকা চুকা তেতো ফল। চরের ছেলেমেয়েরা এই ঠোসকা গাছ থেকে ছিঁড়ে মুখে ফু দিয়ে ফুলিয়ে কারো মাথায় বা গালে টোকা দিলেই বেলুনের মতো টাস করে ফেটে যায়। তাতেই তাদের আনন্দ। গায়ে ধুলা মাটি মাখানো চরের আট দশ বছরের ছেলে মেয়েরা চুকা তেতো ফল খাওয়া আর উচ্ছ্বিত খেলা—দুই-ই পায় ঠোসকা গাছ থেকে। এই তাদের বিনোদন। দুরন্ত শৈশব। বাবা মায়ের সাথে ক্ষেতে যোগালির কাজ করতে করতে একদিকে যেমন কাজ শেখা আর অন্যদিকে আনন্দে মেতে ওঠা।
এই সব অদরকারি অনাদরীয় ফল চিনে নিতে পারলে জেনে নিতে পারলে মন নেচে ওঠে। বাতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই ফসলের পাশে গড়ে ওঠা এমন লতা গুল্ম উদ্ভিদের বনতল দেখি আর কৃষকের কাছ থেকে চিনি জানি শিখি এই সব গাছেদের কথা। কিছু ভুলি কিছু মনে থাকে। দুই পাশে বাতর—মাঝখান এক দেড় ফুট চওড়া জলের পথ আগলে পথ চলতে হচ্ছে।
গভীর নলকুপ থেকে ভটভট করতে করতে জল আছড়ে পড়ে ছড়িয়ে যায় ক্ষেতে ক্ষেতে। নানা জনের ক্ষেতে যুক্ত এই সংযুক্ত মোর্চার জলের পথ। স্বচ্ছ জলের ধারা ছুটছে দ্রুত বেগে। বাতরে উবু হয়ে হাত মুখ জল দিয়ে ক্লান্তি ধুয়ে নিলাম। কী ঠান্ডারে বাবা!
প্রায় সব জমিতেই শীতের সব্জী। কোনটা সীমের টাল। কোনটা বেগুন টাল—থোকা থোকা সবুজ বেগুন ঝুলে আছে বুক সামন গাছে। আবার পাশাপাশি শর্ষে আর ভুট্টার ক্ষেত। আমার মাথা ছাড়িয়ে গেছে। উঁচুতে নয়া শীষ বাতাসে দুলছে। সবুজ বেষ্টনিতে আস্তে আস্তে বড় হ্চ্ছে ভুট্টা।
যতদূর চোখ যায় ভুট্টা আর শর্ষের ক্ষেত। হলুদ আর সবুজে মাখামাখি করে যেন জড়াজড়ি করে রয়েছে এখানকার মাঠ। এমন উদাম পরিসরে হলুদের সম্ভারে আনন্দে মন আনচান করে ওঠে। শর্ষের গায়ে সবে মেলছে মরিচের মতো খোলস। হালকা সবুজের খোলস। তারই ভেতর লোক চক্ষুর আড়ালে বাড়ছে রাই শর্ষে। চৈত বৈশাখেই শক্ত শর্ষের লালচে দানা কৃষকের ঘরে ওঠবে।
জায়গাটার নাম রায়ের চর। এই অঞ্চলের মানুষের মুখে 'আয়ের চর'। ধ্বনি বিভ্রাটের কারণে রাত হয়ে যায় আইত রাজ্জাক হয়ে যায় আজ্জাক। তেমনি রায়ের চর_আয়ের চর। আবার আয়ের চরও হহতে পারে। এই চর তো কৃষকের আয় উপার্জনেরই চর। লক্ষ্মীর আয়ের চর।
ইউনিয়নের নামও লক্ষীর। তারই অধীনে এই রায়ের চর। নদীর কোল ঘেষেই লোকটি ট্রাকটরে চাষ দিচ্ছে জমিন। একবার এই পাশ করতে না করতেই আবার ঘুরে আসছে। কলের চাকায় উঠে আসছে নরম কালো ভেজা মাটি। আর তাতেই হামলে পড়ছে শালিকের ঝাঁক। ট্রাক্টরে চাকায় উঠে আসা পোকামাকড় কেঁচো খুটে খুটে খাচ্ছে গাঙ শাালিকের দল।
লাঙল, জোয়াল, মাথাল, পাজন কৃষক ছেড়েছে বহুকাল। "এইসব এখানে খুজিয়া পাওয়া যাইবে না। তাহারা থাকেন এখন যাদুঘরে। গুগলের চেম্বারে। ক্লীক করিলেই গুগল মশাই ইমেজ দেখাইয়া দেবে।" ট্রাক্টের সামনে দাঁড়িয়ে কেবলই মনে হচ্ছে আমরা দ্রুত এক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। একদিকে আমাদের স্মৃতিতে প্রথাগত চাষাবাদের প্রবল উপস্থিতি অন্যদিকে কলের চাষাবাদের ভটভটের ভেতর ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে হেট হেট হেট বামে হেট এর আওয়াজ। হালের গরুর তাগড়া শরীর।
৩
“দেখাদেখি চাষ আর লাগালাগি বাস” এমন একটা বার্তা গ্রামীণ সমাজে জারি আছে বহুদিন। এই চরে তেমনি দেখাদেখি চাষ জীবন জীবিকার জন্য; আর লাগালাগি বাস এই চর ছাড়িয়ে আরেকটু পুবদিকে; কিছুদূর হেঁটেগেলেই ব্রহ্মপুত্রের আরেক ধারা উত্তর দিকে মিশেছে চন্দ্রকোনার দিকে। তারই কোল জুড়ে যে পাড়া তার নাম সুজনপুর। একটা গেরস্থ পাড়া। গ্রামের নাম চর যথার্থপুর।
এই গ্রামের হোসেন আবাদ করেছে পিয়াজের পইল। পইল মানে চারা—পিয়াজের চারা। আরেকটু বড় হলেই ব্রিক্রি করবে অন্য চাষীদের কাছে। নকলা, চন্দ্রোকোনা, মেলান্দহ, ইসলামপুরের হাটে। এই চরে পিয়াজের পইলের বীজতলা বেশ উর্বর। চরের মাটি নিজের গরজেই পইলের দেখাশুনা করে।
একটু উঁচু জমিতে সারি সারি মরিচ আর হলুদের টাল। সুতার মাঁচা করে যে চিচিঙা ও করলার আবাদ করেছিল তা আর টিকে নি। হাইব্রিড করলা। শুধু করলা নয় সব সব্জিই হাইব্রিডের বীজ। উচ্চ ফলনশীল। অধিক উৎপাদন—বিজ্ঞাপনে শিকার এই কৃষকেরা। অবশ্য উচ্চ ফলনশীল না হয়ে উপায় নেই-মানুষের যে বাড়-বাড়ন্ত! সার-বীজ-কীননাশকের ব্যবহারেও করলার টাল টিকিয়ে রাখতে পারলা না অনেক কৃষক। পাতাগুলো শুকিয়ে ঝুলে আছে সুতার তারে।
টমেটোর টাল বেশ টগবগিয়ে উঠেছে। থোকা থোকা ছোট বড় সবুজ সবুজ টমেটো। সার ও কীটনাশক নিয়মিতই দিচ্ছে জানালেন কৃষক। খুব যত্নের সাথে গাছের ডগাটি একহাতে ধরে অন্য হাতে বড় হওয়া টমাটোগুলো তুলে চটের বস্তায় একে একে ভরছেন।
বাঁশের আগায় লেজ নাচিয়ে এসে বসল ফিঙে। নিজের যতটুকু ওজন তার চেয়ে দেড়গুন পোকা ধরে খায় এই ফিঙে। কৃষক বান্ধব এই পাখি। এমন টালের পর টাল বেগুন সিম টমেটো ক্ষেত শেষ করে দিতে পারে পোকা। ফিঙে সেই পোকা নিধনে তৎপর। কৃষক অনেক সময় নিজেই জমির বাতরে বাঁশের খুঁটি পুঁতে দেয় পোকা খেকো পাখির জন্য।
যতক্ষণ পাখি ততক্ষণ ফসলের দাম। পোকায় ধরে ফেললে সব্জির দাম পড়তে থাকে। টাকায় তখন এক কেজি বেগুন। বাঁধাকপিতে গরুও মুখ ফিরিয়ে নেয়। সুজন পুরে জাঙলায় ফনফনিয়ে উঠেছে লাউ। ভারি মিষ্টি দেখতে সাদা সাদা লাউয়ের ফুল। বুক সমান উঁচু জাঙলার নীচে ঝুলছে কচি কচি লাউ। হলদেটে কচি থেকে সবুজ রঙের লাউ হতে বেশি দিন লাগে না।
সূর্য়ের তাপ বাড়ছে ক্রমে। শুকিয়ে যাওয়া নদীর পাড়ে বসে তামাটে মতো এক গৃহিনী পাটকাঠির শরীরে গোবর লাগতে লাগাতে মুইঠা বানাচ্ছে ঘোমটা টেনে। নীল পাড় সবুজ জমিনের সুতি শাড়ির গৃহিনীর হাত কী দ্রুত মুইঠা তৈরি করে রোদে শুকিতে দিচ্ছে! সারি সারি মুইঠার শরীর গৃহিনী চার আঙুলের স্পষ্ট ছাপ নিয়ে চুলার মুখে পতপত করে জ্বলবে। সিলিন্ডার হিটার ইনডাকসন চুলার প্রভাবে মফস্বলেও ঘুটে বা মুইঠার প্রয়োজনীতা ফুরিয়েছে আজকাল।
ব্রহ্মপুত্রের স্বচ্ছ জলে উড়ে এসে ডুব দিচ্ছে পানকৌড়ি। জলবিন্দু গোল হতে হতে ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত নদীতে। দেখতে দারুণ লাগে। ছোট ছোট জলের কম্পন জলের শরীরে লেগে লেগে ভেসে যাচ্ছে বহুদূর। এর মাঝে হঠাৎ উড়ে এসে বসল পাকড়া মাছরাঙা। জলের খুব কাছে ভাসানো নৌকার বৈঠার উপরে। কালো আর সাদা সাদা বুটি বুটি পাখনা ছড়িৃযে জলের উপর পাক খেতে খেতে যখন বৈঠার উপর বসল তখনই ভিউফাইন্ডারের মাঝে ঝটপট ক্লিক।
দ্রুত গতিতে উড়ে যাওয়া পাকড়া মাছরাঙার ছায়া পড়েছে জলে। সকালের রোদে আরো সুন্দর হয়ে উঠল পাকড়া মাছরাঙা। সাদা কালোয় রোদের ঝলক নিয়ে পাক খাচ্ছে জলের উপর। কী চমৎকার! ঊড়ন্ত পাখি আর তার ছায়া দুই-ই অনন্য হয়ে ধরে রাখলাম চোখের ভিউফাইন্ডারে।
ঝুরঝুর সাদা বালি রোদের প্রতাপে চিকচিক করছে। বালির পেলব শরীরে শালিকের পায়ের ছাপ। শত শত। ফুঁড়ত ফুঁড়ত উড়ছে ধানি তুলিকা।। জলাধারেই এই ধানি তুলিকার বিস্তার। ঝাঁক বেঁধে উড়ছে আর শাই করে নেমে যাচ্ছে ধানের ক্ষেতে। সবেই ধান কেটেছে। এখন এখানে সোখানে ধানের ছড়া। খুচরো ধানের ছড়াছড়ি। তাই নিয়ে হুড়োহুড়ি করছে ধানি তুলিকার দল।
৪
বলছিলাম শালিকের কথা। চোখ মেললেই শালিক। হাত বাড়ালেই শালিক। রেলিঙে শালিক। উঠানে শালিকের ঝাঁক। আর দুই শালিক তিন শালিক দেখা ও দেখাবার শৈশবের কথকতা আর স্মৃতি কার না আছে? জোড়া শালিকে শুভ দিন—দুই আঙুলে চুমু দিয়ে উচ্ছ্বাসিত হওয়া আর একে বা তিন শালিকে না জানি দিনটি কেমন যায়!
কত ধরনেই না শালিক আছে! কোনটা ভাত শালিক কোনটা গোবরে শালিক, ঝুট শালিক আবার কোনটা গাঙ শালিক—ছিপছিপে ঘণ হলুদের ঠোঁটের শালিক গাঙ শালিক। চোখের চারদিকে কমলা রঙের রিঙ। মাঝে কালো চোখের মণি। দেখতে দারুণ।
এই চর গাঙ শালিকের চর। বেলা বাড়তেই গাঙ শালিক বের হয়ে আসছে খোড়ল থেকে। খাড়া পাড়ের উপর দিকে হাত দেড়েক মাটির ভেতর খোড়ল করে বাসা বানায় গাঙ শালিক।
রায়ের চর পাড় হতেই হাতের ডানে যে খাড়া পাড় আছে সেখানেই পরপর খোলড়। সেখান থেকেই ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে বের হয়ে ছুটছে ট্রাক্টের পেছনো পেছনে। হলুদ ঠোঁটে খুটিয়ে খুটিয়ে তুলছে কেঁচো-পোকামাকড় আর নষ্ট হয়ে যাওয়া কোন শস্যদানা।
খাড়া পাড়ের বসত ঘরেই গাঙ শালিক ডিম পাড়ে। উজ্জ্বল নীল রঙের ডিম। তা দেয়া আর ডিমের খোলস থেকে বের হয়ে ছানা পাখিটি উড়তে না পারা পর্যন্ত। মা-গাঙ শালিক বাবা-গাঙ শালিকের মুখের খাবার খেয়ে ডাঙ্গর হলেই ফুড়ুৎ করে একদিন বের হয়ে পড়ে নিজের প্রযত্নে খাবার আর খাড়া কোন পাড়ে বসত নির্মানের জন্য।
গাঙ শাকিলের হল্লায় চুপচাপ চর ক্রমেই পাখিদের রাজ্য হয়ে গেল। গাঙ শালিক কয়েক রকমের ডাক পারে।ধানি তুলিকা উড়ছে—তাই দেখে কালো চিল মাথার ঠিক উপরে কয়েক পাক ঘুরেই সুড়ুত করে উড়ে গেলো নদীর ওপারে।
ফিঙেও কম নয়। লেজ উচিয়ে খেতের মাঝে পোঁতা বাঁশের কঞ্চিতে যে ফিঙে বসেছিল তাকে হটিয়ে দুই পায়ের নখ শক্ত করে ধরে বসে ঘাড় এদিক ওদিক করে দেখছে কেউ আছে কি না? আর সামনের ঝাঁক মাথার বড়ই গাছে স্বর্ন তলিকার বিস্তারে পাতা দেখাই যাচ্ছে না। স্বর্ণালি লতার ঝাঁক মাথা রোদের ছটায় ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে স্বর্ণালি আভা। সেই বড়ই গাছের ডালে ঝাঁকে ঝাঁকে টুনটুনি।
আমাদের ঘরের জন টুনটুনি। আর কত না পাখ পাখালি ডানা মেলে উড়ে উড়ে বসছে মুসুরি খেতে ধানি তুলিকার সাথে যৌথ ভোজের আশায়।
খাড়া পাড়ের বসত ঘরেই গাঙ শালিক ডিম পাড়ে। উজ্জ্বল নীল রঙের ডিম। তা দেয়া আর ডিমের খোলস থেকে বের হয়ে ছানা পাখিটি উড়তে না পারা পর্যন্ত। মা-গাঙ শালিক বাবা-গাঙ শালিকের মুখের খাবার খেয়ে ডাঙ্গর হলেই ফুড়ুৎ করে একদিন বের হয়ে পড়ে নিজের প্রযত্নে খাবার আর খাড়া কোন পাড়ে বসত নির্মানের জন্য।
সকল প্রাণের জীবন জীবিকা ও বেঁচে থাকা শর্ত আর তার ব্যবহার নির্দেশনা খুব দূর থেকে প্রকৃতি নিজেই উস্কে দেয় তারই সৃষ্ট প্রাণ ও প্রকৃতিকে। কোন প্রাণীই একা বেঁচে থাকতে পারে না। তাঁর বাঁচার শর্ত ও পরিসর অন্যন্যা উপদানের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ্ ভাবে নির্ভরশীল।
কী গাঙ শালিক কী খাড়া পাড় বা উচন্ডি অথবা ভুট্টা আর শর্ষের হলুদের প্লাবন কিংবা মানুষ—সকলের সাথে আমাদের অবারিত যোগ আছে। একের অন্যের গাঁটছড়া বাঁধা। মানুষ নিজের ভাষা কাঠামোর জোরে নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের নিক্তিতে তোলে অপরকে ফেলে দেয় প্রান্তিকের প্রান্তিকে। অথচ গভীর নিমগ্নে ডুব দিলে অনুভব করতো বহুর সাথে বহুর জীবন যাপনই প্রকৃতির অভীপ্সা।
0 Comments