আজকাল ঢাকায় গোল্ডেন শাওয়ার ফুল দেখি না। কোনও বাড়ির ছাদ থেকে স্রোতের মতো পাঁচিলের ওপরে, তারপর পাঁচিল থেকে মাটির দিকে ধাবমান কমলা স্রোত দেখার জন্য, কখনও চোখে পিপাসা বোধ করি। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার ধকলে-পরিবেশ বদলে গাছগুলোর অনেকেই মরে গেছে হয়তো। কিংবা বাড়ছে না আর। পৃথিবীর ক্রমশ উত্তাপের ওপরে অভিমান করে-গ্রামোফোন রেকর্ডের মাইকের আকৃতির উজ্জ্বল কমলা ফুলগুলো জেগে উঠছে না। অথচ আমার সহকর্মী, শ্রাবণী আপার মোহাম্মদপুরের বাড়ির সামনে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম, দেখি দোতলার কার্নিশ থেকে ফুলের প্রবাহ নিচের তলার কার্নিশে সামান্য ধাক্কা খেয়ে বেঁকে রাস্তার গেটের ওপরে এসে ঠেকেছে। গোল্ডেন শাওয়ারের কমলা রঙের ওপরে বিকেলের পড়ন্ত রোদ পড়েছে, রঙ খানিকটা গাঢ় দেখাচ্ছে।সেখানে দাঁড়িয়ে আমি দরজার বেল না টিপে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকি। মাথার ওপরে কমলা স্রোতে ফাল্গুনের বিকেলের বাতাস আলোড়ন তুলে যায়। মুগ্ধতায় চোখ সরাতে পারি না। আন্দাজ করতে পারি না ওই কমলা-প্রপাতের নিচে সটান শুয়ে থাকা এক তরুণের মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষার যন্ত্রণা।
করোনাজনিত লকডাউনের ঠিক আগে আগে, শ্রাবণী আপা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া দুই সন্তানের কাছে মাস দুয়েক থাকার জন্য, অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান। তারপর পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও তার আর ফেরা হয় না। তার সঙ্গে দেখা হয় অফিসের অনলাইন মিটিংয়ে বসলে। অফিসে পাশাপাশি চেয়ারে বসে কাজের ফাঁকে গল্প করতাম আমরা। এখন হাতে সময় থাকলে, জুম মিটিংয়ের পরে, স্টুডিও থেকে বেরোই না, দুজনে খানিকক্ষণ টুকটাক গল্প করি। বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতা থাকলেও, পারিবারিকভাবে যাতায়াত হয়নি আমাদের। গল্পে গল্পে জানতে পারি, তার একমাত্র ভাই ঢাকায় তাদের বাড়িতে থাকে। বোন চলে যাওয়াতে সে একেবারে একা। সেটুকু পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে কোনও গুরুতর অসুস্থতা পেয়ে বসেছে তাকে। শুনে এই সময়ের মানুষের অসহায়তার বাস্তবতা আরেকবার সামনে আসে। বাংলাদেশ আর আমেরিকার দূরত্ব চট করে কমিয়ে ফেলা যায় না। তা ছাড়া, ভাই অসুস্থ হলেও শ্রাবণী আপার হুট করে চলে আসার ব্যাপারে আছে নানান নিষেধাজ্ঞা। এরকম দূরত্বে সাধারণ মানুষের যাতায়াত তখন বন্ধই প্রায়। পরপর দুদিন ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে দ্বিতীয় দিনে শ্রাবণী আপা কেঁদেই ফেলে। সান্ত¦না দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে আমিও কান্না ধরে রাখতে পারি না। কী বলা যায়, যখন সে বলে, ‘ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন, বুচ্ছ ? আর হয়তো মাসখানেক। মাত্র পঁচিশ বছর বয়স, হুট করে নাই হয়ে যাবে, ভাবা যায়?’
‘একদম যায় না, আপা। এখনও তো জীবনের কিছুই দেখেনি সে!’
‘সেই তো, কী যে করি বুঝতে পারছি না।’
‘এতদূর থেকে কী যে করবেন, আমিও বুঝতে পারছি না।’
‘উপায় কী, আসা এমনিতেও যাবে না। বিশেষ ব্যবস্থা করে চলে গেলে আর ফিরে আসতে পারব বলে মনে হয় না। এদিকে দুই ছেলেমেয়ে আমার রেসিডেন্ট পারমিটের জন্য অ্যাপ্লাই করেছে। তাদেরকে বিপদে ফেলে চলেও আসতে পারছি না। ওদের এতদিনের চেষ্টা … ওদিকে আমার ভয়াবহ হাঁপানি। এখানে করোনা হলে তো তাও চিকিৎসা পাব, ওখানে নির্ঘাত গেলে মারা পড়ব। তাই ছেলেমেয়েরা যেতে দিতে চায় না।’
‘আসার কথা বাদ দেন, আপা। বরং পারলে ওখানকার ডাক্তারদের সঙ্গে ভাইয়ের ব্যাপারে একটু আলাপ করে দেখেন। মানে, জাস্ট ফর এ সেকেন্ড ওপিনিয়ন।’
‘তা তো বটেই। আমি ওর রিপোর্টগুলো স্ক্যান করে দিতে বলেছি। একা মানুষ তো, এই কোভিডের লকডাউনের সময়ে কে কার বাড়িতে অসুস্থ মানুষের পাশে থাকতে যাবে, বলো? কাজের লোকও ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে দরকারের সময় খুঁজতে গিয়ে পুরোনো লোককে আর পাওয়া গেল না। কী যে বিপদ!’
পরদিনের মিটিং শেষে আমি আবারও জানতে চাইলাম, ‘শ্রাবণী আপা, রিপোর্টগুলো নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন?’
‘আরে কী আর বলব, মুখে মুখে ও যা পারে বলল, শরীরটা খুব খারাপ, স্ক্যান করে যে পাঠাবে তারও উপায় নেই।’
‘বলেন কী, কাজের লোকজন কি এখনও পাওয়া যায়নি?’
‘নাহ্। কী যে খাচ্ছে বেচারা এই অসুস্থতার সময়ে ভাবতে পারছি না।’
‘তাহলে?’
‘ভাবছি বলব কোনও হাসপাতালে উঠে যেতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে আবার করোনা হয় নাকি … এদিকে অস্ট্রেলিয়ায় যাতায়াত একেবারে ব্যানড। এক প্রভিন্সের লোককেও ওরা অন্য প্রভিন্সে যেতে দিচ্ছে না। কীসের মধ্যে যে পড়লাম!’
শ্রাবণী আপার হতাশা আর বিপদের কথা শুনতে শুনতে সেদিন রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম বাসার ঠিকানা নিয়ে ছেলেটাকে দেখতে চলে যাব। পরিচিত প্রায় অনেক মানুষেরই বিপদের কথা শুনি, কিন্তু ঘর থেকে বেরোই না। অন্য কেউ মরুক-বাঁচুক, ‘জান বাঁচানো ফরজ’ এটা যেন প্রমাণ না করলেই নয়। এভাবেই তো মাস চারেক চলে গেছে। কিন্তু এখন শ্রাবণী আপার মাত্র পঁচিশ বছর বয়সি ভাইটার জন্য বুকে হু হু করতে লাগল। যে করেই হোক, তাকে আমার সাহায্য করতেই হবে। মানুষের বিপদে মানুষ এগিয়ে আসছে না, এরকম নিষ্ঠুর একটা পৃথিবী আমি কল্পনাও করতে পারি না। তাই শ্রাবণী আপার বাড়ির ঠিকানা চেয়ে মেসেজ পাঠাই। তিনি মেসেজ দেখে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেন। তারপর এমনভাবে কাঁদতে থাকেন যে আমি থতমত খেয়ে যাই। তার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না, ‘তুমি যাবে আমার ভাইকে দেখতে!’ তারপর কান্নায় ভেজা গলায় বলেন, শোন, আমার হয়ে ওকে একটু আদর করে দিও তো। আর দেখ, সেরকম হলে ও যেন হসপিটালে ভর্তি হয়ে যায় … আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম, ‘আরে আপনি ভাববেন না তো। আমি তবে সেখানে যাচ্ছি কেন? যা লাগে ওর সেটাই করব। এ রকম বিপদে কাজে না এলে পরিচিত লোকজন থেকে লাভ কী?’
আমার কথা শুনে শ্রাবণী আপা হয়তো খানিক আশা পেলেন। কান্না থামল। হঠাৎ করে কিছু মনে পড়ে যাবার মতো করে বললেন, ‘ঠিক বলেছ। ঠিক বলেছ।’
পরদিন সকাল সকাল ঘরের কাজ সেরে আমি মোহাম্মদপুরের শেরশাহশুরি রোডের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হই। রাস্তায় বড় বা ছোটো গাড়ি তেমন নেই। তবে প্রচুর মানুষ হেঁটে চলেছে। আমিও হাঁটা ধরি। রিকশা হয়তো ততটা নিরাপদ না। রিকশাওলার থেকে মাত্র দু’ফুট দূরত্বে বসতে হয়। তা ছাড়া, আমার আগে সিটে কে বসে গেছে না গেছে! আমার জন্য হয়তো কিছু কোভিড ভাইরাস ফেলে গেছে। যেতে যেতে মনে পড়ে, আমার এক বন্ধু থাকত এই রাস্তায়, শেরশাহশুরি নামটা এমনভাবে উচ্চারণ করত যে মনে হতো বলছে, শ্বশুরশাশুড়ি রোড। দোকানের গায়ের সাইনবোর্ড পড়তে পড়তে এটা-ওটা ভাবি। রাস্তার নামগুলো দেখে মনে হয় অতর্কিতে মোগল সাম্রাজ্যে ঢুকে পড়েছি। রাস্তার বাঁকে ঘাসবিহীন অযত্নের চতুর্ভুজ মাঠগুলো মোগল সাম্রাজ্যের মরুভূমির আবহই এনেছে বটে। তবে রিকশা থামতে মরুভূমির বুকে আকস্মিক কমলা-স্রোতে বসন্ত নামে, গোল্ডেন শাওয়ার!
কালো গে’টের পাশে দারোয়ান দাঁড়িয়ে। দোতলায় যাব। শুনে দারোয়ান চোখ মোছে, ‘আপনে বর্ণ ভাইয়ের লগে দেখা করতে আসছেন ? আহা রে দুইডা সপ্তাহে কী পোলা কী হইয়া গেল! কার যে অভিশাপ লাগছে, আফা!’ আমি চুপচাপ তার বিলাপ শুনি। পিছনে গে’ট আটকে সে আমার সঙ্গে সিঁড়ি ভাঙে। ‘বিছানা থেইকাই উঠতে পারে না। হ্যার বইন গেছে গা অস্ট্রেলিয়ায়। যখন যা দরকার পড়ে আমিই আইনা দেই। ডাক্তারের কাছেও আমিই নিয়া গেছিলাম। বহুত টেস্ট। ভাই হসপিটালে গেছেন তো তাই করুনার ভয়েতে কেউ ভিড়ে না। খালি আপনে আসছেন… বর্ণ ভাইয়ের কী লাগেন, আফা ?’ শেষ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তাকে বলি, ‘কিছু লাগি না।’
দারোয়ান চাবি ঘুরিয়ে দরজার তালা খোলে। আমি বলি, ‘বাইরে তালা দিয়ে রেখেছেন কেন ?’ দারোয়ান সামান্য হাসে। হাসিটা কান্নার মতো। তালার গায়ে হাত বুলিয়ে বলে, ‘আফা যে কী কন, উইঠা আইসা দরজা খোলনের শক্তি বর্ণ ভাইয়ের শইলে আছে নাকি কুনো ?’ এবারে আমার সত্যি আর পা চলে না। এমন অসহায় অবস্থা হয় মানুুষের! দরজা খুলে যেতেই সুনসান বসার ঘর দেখতে পাই। তিন দিকে তিনটি দরজা। একটি দরজা খোলা, সোজাসুজি চোখ পড়ে বিছানায় পাশ ফিরে শোয়া শরীরটার দিকে। দরজা খুলে আমাদের ঢুকে পড়াতেও শরীরটা নড়ে না বিন্দুমাত্র। পড়ার টেবিলের চেয়ার টেনে বিছানার পাশে বসি। শীর্ণ শরীরটা ছাড়া বিছানার বাকি জায়গাটুকু স্তূপ করা বই আর ম্যাগাজিনে ভরা। হাতে খোলা একটা বই নিয়ে উল্টোদিকে ফেরা শরীরটা ঘরে মানুষ আসার শব্দেও কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায় না। শেষে দারোয়ান ডাকে, ‘ভাই, বর্ণ ভাই, আপনারে উনি দেখতে আসছেন।’
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টায় তরুণের মুখের এক দিকটা দেখি। বিচ্ছিন্নভাবে গজানো দাঁড়ি থুঁতনির ওপরে পোটলা হয়ে আছে। জোর করে মেলা সরু চোখে রাজ্যের ক্লান্তি। তবু কৌতূহল বাঁধ মানে না। প্রশ্ন করার কষ্ট দিই না তাকে, নিজেই বলি, ‘আমি আনিকা। আপনার বোন, শ্রাবণীর কলিগ।’ শুনে নিরাসক্তভাবে চোখ বোজে সে। পরমুহূর্তে যেন উঠতে চেষ্টা করে সামান্য। দারোয়ান এসে হাত ধরে বসায়।
‘আপা আপনাকে আসতে বলেছে?’
‘নাহ্, আমি নিজেই এসেছি।’
‘কেন?’
‘শ্রাবণীর কাছে তোমার কথা শুনে মনে হলো …’
‘মনে হলো আমার সাহায্য লাগবে?’
প্রশ্নটা করে ছেলেটা আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকল। অদ্ভুত সে দৃষ্টি। অহংকার যেন ঠুসে ঠুসে ভরা হয়েছে। এই বয়সের তরুণকে যা মানায়। বিব্রত আমি চুপ করে থাকি কয়েক সেকেন্ড। তারপর ধীরে ধীরে বলি, তেমন কিছু না। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হলো শুধু। তুমি বিরক্ত হলে অবশ্য …’
‘আমি কেবল বলতে চাই যে, আমার কিছু লাগবে না। আমি মেনে নিয়েছি।’
‘তা কী করে হয়, মেনে নিয়েছ বলে কি চিকিৎসা লাগবে না?’
‘চিকিৎসা নেই যে! পুরো ইনটেসটাইনে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে। যখন জানা গেল তখন জেনে কোনও লাভ হলো না। চাইলে কেমোথেরাপি করে জীবনের শেষ কয়েকটা দিন জটিল করে তোলা যায়। মানে আমার ডাক্তার তেমনই বললেন আর কী।’
‘কিন্তু তাই বলে হাসপাতালে না থেকে বাড়িতে এভাবে পড়ে থাকাটা ঠিক …’
‘হাসপাতাল তো আর হোটেল না, চিকিৎসা না নিলে সেখানে থাকার কী আছে, বলেন? বর্ণ কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে ওঠে যেন। বেশ জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নেয়। ওকে বিশ্রাম দেবার জন্য আমি চুপ করে থাকি। তারপর বলি, ‘আসলে এভাবে একা থাকার চেয়ে হাসপাতালে থাকলে তুমি …’
‘থাকলে কয়েকজন ডাক্তার, নার্স আর বেশ কিছু রোগে ভোগা মানুষের সঙ্গে দেখা হতো অবশ্য। কিন্তু তাতে কী, নিজের বিছানায়, নিজের বাড়িতে তো মরা হতো না। আমার চেয়েও সামান্য কিছু বেশি দিন বাঁচবে, এ রকম অনেকেও কিন্তু ক্যান্সার হলে সিদ্ধান্ত নেয় বাড়িতেই শান্তিতে মরবে। কেউ কেউ গহিন গ্রামে শৈশবের ঠিকানায় চলে যায়। একে আপনি কী বলবেন? হাসপাতালে থাকলে ওরা এর চেয়ে ভালো থাকত?’
‘কিন্তু তুমি তো একদম একা ভাই!’
‘কী যে বলেন, একা হব কেন!’ বলে নিয়ে বর্ণ এক পলক দারোয়ানের দিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। তারপর সামান্য হেসে বলে, ‘আসলে হয়েছে কী, আমার একা থাকতেই ভালো লাগে। তা ছাড়া, এই করোনাকালে কাউকে বিরক্ত করার মানে নেই। আপনি অবশ্য যখন এসেই পড়েছেন …’
‘হ্যাঁ, আমি যখন এসেই পড়েছি তখন তোমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। চিকিৎসা নিতে হবে।’
‘আপনি মনে হয়, বুঝতে পারছেন না যে আমার চিকিৎসা বলতে এখন নানান থেরাপি। মানে, ডাক্তারদের যদি জোর করে চিকিৎসা দিতে হয় আর কী। সর্দিকাশি, ওষুধ খেলে সাত দিন আর না খেলে এক সপ্তাহ―শোনেননি ছোটোবেলায়? সেরকম। কথা হলো অসুখটা সর্দিকাশির মতো সাধারণ না; ইনটেসটাইনে ক্যান্সার, একেবারে লাস্ট স্টেজে জানা গেছে। কিছুই করার নেই। আমি বুঝি। তা ছাড়া, ওসব থেরাপিটেরাপির সাংঘাতিক সাইড এফেক্ট আছে। ডাক্তার আমাকে বুঝিয়ে বলেছেন। আমার শরীরের যা অবস্থা সেটুকু নেওয়ার ক্ষমতা নেই।’
কথা বলতে বলতে বর্ণ হাঁফায়। তবে জোর করে মাথাটা আরেকটু ওঠানোর চেষ্টা করে। ‘তারপর ধরেন, হাসপাতালে অচেনা বিছানায় পড়ে থাকতে হবে দিনের পর দিন। তার চেয়ে এই ভালো, আমার চেনা ঘর, যে ঘরে আমি জন্মেছি, যে ঘরে আমার মা মারা গেছেন। এখানে শুয়ে টিভি দেখি আর আমার চেনা পরিবেশ আর কী।’ বর্ণের হাতে টেলিভিশনের রিমোট। রিমোটসহ হাতটা সামান্য উঁচুতে ওঠে। জানালার দিকে ইশারা করে বলে, ‘দেখেন, এই ঘরে কেমন কমলা রোদ! দেখতে পাচ্ছেন?’
আমি কৌতূহলে ঘরের মাঝখানের শূন্যের দিকে তাকাই। কমলা ফুলের স্রোত চুইয়ে আসা পশ্চিমের আলো সেখানে ঝলমল করে। জানালার কাচের বাইরে গোল্ডেন শাওয়ারের কমলা কুঁড়িসমেত ফুলগুলো ঝাপসা দেখা যায়। কিন্তু জানি না তখনই আকাশে কোনও মেঘ সরে যায় কি না। নাকি বর্ণের মৃত্যুশয্যার ইচ্ছের মতো এক পশলা রোদ এসে কমলা ফুল ফুঁড়ে ঘরে ঢুকতে চায়। বর্ণের রক্তশূন্য মলিন মুখটাও কমলা দেখায়। আমি মনে মনে বলি, অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল …
‘ঠিক আছে বর্ণ, তোমার যেমন ইচ্ছা। তোমাকে তুমি বললাম বলে রাগ করনি তো?’
‘না না, রাগ করিনি। চাইলে আমিও তোমাকে তুমি বলতে পারি।’
‘বলেই তো ফেলেছ!’
দুজনে হাসি। হাসি থামলে বলি, ‘তুমি খুব ভালো একটা ছেলে, বর্ণ। বিরক্ত না হলে আমি তোমার কাছে মাঝেমাঝে আসতে পারি?’
‘পার। আমার ভাল্লাগবে। অবশ্য তোমার যদি সময় থাকে, যখন খুশি আসতে পার। শ্রাবণী আমার পনেরো বছরের বড়ো। অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে বড়ো বড়ো ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে ওর। তবু আমি তাকে তুমি ডাকি। তুমি তো তত বড়ো নও, নাকি?’
‘হা হা হা … হ্যাঁ, তত বড়ো নই, তবে ছোটোও নই তেমন, বর্ণ! তোমার থেকে তো বেশ বড়ো। যা হোক, আমি যখন সময় পাই চলে আসব, কেমন ? আর তোমার যা লাগবে ফোন করে জানিও। আমি আসার সময়ে সঙ্গে নিয়ে আসব। ডাক্তারের কাছে যেতে হলেও বলবে, আমি নিয়ে যাব। শ্রাবণী নেই সেটা দুঃখজনক, কিন্তু মনে রেখো, প্রতিদিন আসতে না পারলেও আমি তোমার খেয়াল রাখব।’
‘থ্যাংক ইউ। আমি আসলে আমার অবস্থা কাউকে জানাই না। ভাইরাসের ভয়ে মানুষ আসতে পারবে না, শুধু শুধু হা-হুতাশ করবে―এটা আমার ভালো লাগে না। তবে জানো, তুমি এসেছ, এটা আমার ভালো লাগছে। আমি শ্রাবণীকে ফোন করে বলব, তুমি কিন্তু খুব ভালো।’
এরকম সাধারণ একটা কথা বলতে গিয়ে বর্ণ কেন চোখ ভিজিয়ে ফেলে বুঝি না। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের বুঝি মন খুব নরম হয়? নাকি ওকে দেখতে আসাতে সে অনেক বেশি খুশি হয়েছে, মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করি। এরকম বয়সের একটা ছেলে অসুস্থ অবস্থায় একা ঘরে পড়ে আছে, এ ব্যাপারটা মানতে পারি না। আত্মীয়-স্বজন বলতে কি কেউ নেই ? এই বয়সের ছেলেদের তো বন্ধুবান্ধবের হিড়িক লেগে থাকার কথা। কিন্তু প্রথম দেখাতেই এত ব্যক্তিগত কথা জানতে চাওয়া যায় না। বিষণ্নতার ছাপ পড়া বর্ণের তরুণ মুখটা কমলা রোদের মধ্যে ফেলে আমি বেরিয়ে আসি।
দারোয়ানের কাছ থেকে টুকটাক তথ্য নিই। মোহাম্মদপুরের আনাচেকানাচে খাবারের দোকানের অভাব নেই। বর্ণ যা খেতে চায় সে তাই এনে দেয়। মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে ডাক্তাররাও বঞ্চিত করতে চান না। সমস্ত কিছু খাওয়ার অনুমতি আছে তার। বহুবিধ বাস্তব সমস্যা যে কোনও সমস্যাই নয়, এমনটা শুনতে শুনতে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আসি। বাইরে বেরোলে দারোয়ান গে’ট লাগিয়ে দেয়। কমলা-স্্েরাতের নিচে দাঁড়িয়ে দেখি রোদ ম্লান হয়ে আসছে। বসন্তের বিকেলের বাতাস ছুটেছে তখন। বর্ণ কি জানে বাইরে বর্ণহীন বাতাস ঘরে চুইয়ে আসা কমলা রোদের চেয়েও বেশি স্মৃতি জাগানিয়া? সেখানে দাঁড়িয়েই মনে মনে ঠিক করি, এর পর যেদিন আসব, বিকেলে এসে বর্ণকে জোর করে ঘর থেকে বের করে নিয়ে কোথাও যাব। যে কদিন পৃথিবীতে আছে, ধূসর হোক আর সাদা, আকাশ দেখবে না?
পরের দুদিন সময় পাই না মোটে। বাড়িতে বসে অফিস আর বাড়িরও কাজ, একসঙ্গে করতে গিয়ে প্রায়ই কুলিয়ে ওঠা যায় না। মনে মনে ভেবে লজ্জিত হই, আগে অফিস থেকে যতটা ছুটি চাইতাম, এখন সংসার থেকে ততটাই ছুটির আশায় থাকি। কোনওদিন ভেবে দেখিনি অফিসটাই ছিল আমার সংসার থেকে ছুটির উপায়। এখন আর ছুটি হয় না জীবনে, কোনও সপ্তাহে, কোনও দিনে। সকাল-দুপুর বিকেল যায়, বর্ণের কাছে যাওয়া হয় না। ধানমন্ডি থেকে মোহাম্মদপুর দূরে নয় মোটেও। তবু যাওয়া হয় না। শ্রাবণী আপা জানতে চান, কী দেখলাম। অনেক কিছু লুকিয়ে রেখে বলি। বর্ণের বিষণ্ন মুখ লুকাই, পৃথিবীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ মন আর মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত তার মনোবলের কথাও লুকাই। কী লাভ বোনকে কষ্ট দিয়ে! বাস্তবতার বাইরে সে যেতে পারবে না।
ফাঁক পেয়ে পর পর দুদিন বর্ণের কাছে যাই। খাবার নিয়ে গেলে সে খাবারের দিকে তাকায় না। আমি বলি, ‘নতুন একটা দোকানের কাবাব আনলাম, বর্ণ। কাবাবের নাম, খাটাখাট। দুটো বড়ো ছুরি দিয়ে কাবাবটা কুচি কুচি করে ওরা, তখন খাটাখাট করে শব্দ হয়। একদিন যাবে দেখতে?’ বর্ণ কাবাবের দিকে তাকায় না। ওকে বাইরে নেবার কৌশলের ফাঁদেও পা দেয় না। আমি আবার বলি, ‘সন্ধ্যার বাতাসটা কেমন, তুমি দেখতে চাও না? ভয়াবহ মন কেমন করা, শরীরটা শীতল হয়, আর আমাদের মনের ভিতরে হয় ঠিক উলটো। দেখবে না?’ বর্ণ চুপ করে থাকে। পরে বলে ‘বাতাস গায়ে না লাগা পর্যন্ত কি তুমি বাতাসের প্রবাহ টের পাও না? আমি তো ঘরে বসেই বুঝতে পারি অনুভূতিটা। দু মাস হলো ঘরের ভিতরে পড়ে আছি বলে কি ঋতু পরিবর্তনের স্মৃতি হারিয়ে গেছে আমার?’
আমার কাছে বর্ণকে কবি কবি লাগে। কেন যেন ওর দিকে তাকিয়ে প্রায় চাপ দাড়ি দেখে আমার বিশ্বাস হয় যে বর্ণ হয়তো কবিই একজন। আমি বলি, ‘বর্ণ, তুমি কি কবিতা লেখ?’ সে হাসে, বলে, ‘লিখতাম তো একসময়, অনেকে যেমন টুকটাক লেখে।’
‘কই? আমাকে দেখাবে?’
‘সেসব কই জানি না তো! দরকারি মনে হয়নি। পুরোনো পেপারের সঙ্গে বেচে দিয়েছি মনে হয়।’
‘আহ্হা রে! বন্ধুবান্ধবকে কখনও দেখিয়েছিলে?’
কথায় কথায় যে চেহারাটা অনেকটাই উদ্ভাসিত হয়ে উঠছিল, আমার প্রশ্ন কেন যেন তার ওপরে কালি ঢেলে দিল। না বুঝেই আমি আবারও জানতে চাইলাম, ‘তা তোমার কবিতা দেখে বন্ধুরা কী বলেছিল? পছন্দ করেছে?’
প্রশ্ন করে নিয়ে ভালোমতো তাকাই বর্ণের দিকে। শুধু অন্ধকার নয়, মুখটা নতও, যেন থুতনি গিয়ে বুকে ঠেকে। প্রসঙ্গ পালটে জানতে চাই, ‘বর্ণ, শরীর খারাপ লাগছে নাকি তোমার?’ সে দুদিকে মাথা দোলায়। তারপর ধীরে ধীরে বলে, ‘আমার কোনও বন্ধু ছিল না।’
‘মানে? স্কুলে? আই মিন, কলেজ বা ভার্সিটিতেও?’
‘বর্ণ আবারও দুদিকে মাথা দোলায়।’
আমি চুপ হয়ে যাই। আমার মাথার ভিতরে বিচিত্র তথ্য কিছু জট লাগানোর চেষ্টা করে হয়তো। তাই ধীরগতিতে খানিক পরে বলি, ‘ও।’ বর্ণ হয়তো আমাকেই হালকা করতে চায়। বলে, ‘পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু নিয়ে ভাবতাম না। কারও গল্প বা হাসি-ঠাট্টায় যোগ দিতাম না। কেউ নিজ আগ্রহে ডাকলেও বিরক্ত বোধ করতাম। এরকম করলে কেউ বন্ধু পায়? ওরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। ইউনিভার্সিটিতে আমার নাম, নার্ড বর্ণ। সারাদিন বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রাখলে মানুষ আর কী বলবে, বলো? ওদিকে, আমি আসলে কথা বলার মতোই কাউকে খুঁজে পেতাম না। করোনার লকডাউনে ক্লাস বন্ধ হবার পরে আমার খুব ভালো লেগেছে। একা থাকা মজার ব্যাপার।’
মাত্র পঁচিশ বছরের ছেলেটার অদ্ভুত কথা আর মানসিকতা দেখে আমি বিস্মিত হই। মনে পড়ে কখনও জানতে চাইনি যে, এভাবে একা সে পড়ে আছে অথচ বন্ধুবান্ধবের দেখা নেই! এরকম বয়সে এক বন্ধু তো আরেক বন্ধুর জন্য জান দিয়ে দেয়। দিনের পর দিন আসি বর্ণ-র কাছে, কোনও বন্ধু আসতে দেখি না। ধরে নিই করোনাকালীন দূরত্ব রক্ষার জন্যই হয়তো। কিন্তু বাস্তবটা হয়তো এমনই যে, বর্ণ বন্ধুহীন। মোটামুটি মিশুক একটা ছেলে যতটাই পড়ুয়া হোক, তার কিছু বন্ধু তো থাকবে। এই বয়সে সচরাচর কেউ বলে না―একা থাকা কত মজার ব্যাপার। আমার জানতে ইচ্ছে করে সে একা থাকাকে ভালোবাসল কী করে।
‘বর্ণ, তুমি এত মিশুক মানুষ, দেখা হতেই তুমি আমাকে তুমি করে বলেছ, কত গল্প করেছ, আর তুমি কিনা বলছ একা থাকাই মজার?’
‘আসলে আমি কারও সঙ্গে কথা বলি না। শ্রাবণী আমাকে যখন বলেছিল যে তুমি আসবে, তখন সত্যি বলতে কী, আমার বেশ বিরক্ত লাগছিল। আমি এদিকে মরার জন্য অপেক্ষা করছি, তার মধ্যে এসব কী উৎপাত!’
‘সো স্যরি। তুমি চাইলে আর আসব না। শুধু বাইরে এসে খবর নিয়ে যাব।’
‘না না, তা কেন! ক্লাসের ছেলেমেয়েরা আমাকে ঘাঁটায় না। জানে যে আমার এসব গল্প, আড্ডা, আর আপনজনের মতো ভাব দেখান একেবারে ভালো লাগে না। কেউ কেউ অবশ্য বলে, ভালো ছাত্র বলে অহঙ্কার বেশি। কিংবা ভেংচি কেটে বলে, বর্ণ শেয়ারিং শেখেনি মোটেও। কিন্তু আমার আসলে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না। শ্রাবণী তোমার আসার কথা বলার পরে আমি বিরক্তি নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। নিজের দুর্বলতা বা বিপদের কথা কাউকে বলার অভ্যাস নেই আমার।’
‘অথচ তুমি আমার সঙ্গে কত স্বাভাবিকভাবে কথা বলো! আমার একবারও মনে হয়নি যে তুমি আমাকে উৎপাত মনে করছ।’
‘করিনি। কখনও খারাপ লাগেনি তুমি আসাতে। ইন ফ্যাক্ট তুমি আসার পরেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে তোমার সঙ্গে কথা বলব। জীবনের শেষ কয়েকদিনে দেখে যাই, সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব কেমন হয়।’
‘কেমন হয়, বর্ণ?’
‘সুন্দর। তুমি খুব ভালো। তোমার কাছে আমার সঙ্কোচ হয় না। তাই তো রাত এগারোটায় ফোন করেও আমি বলতে পারি, আমার খাটাখাট খেতে ইচ্ছে করছে। ওখানে গিয়ে শব্দটা শুনতেও।’
‘আমি খুব খুশি হয়েছি, জানো? সে কারণেই আজ তাড়াতাড়ি তোমাকে নিতে চলে এলাম। চলো তাহলে।’
রিকশায় বসে বর্ণ জানতে চায়, ‘তুমি কি সুখী?’
আকস্মিক এরকম প্রশ্নে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। কী উত্তর দেব বুঝতে পারি না। আমাকে কি আগে কেউ এরকম কিছু জিজ্ঞাসা করেছিল? মনে পড়ে না। সংসারের নিয়মে সংসার চলে, বাড়িতে সবার প্রয়োজনে ছোটাছুটি করি, কারও মুখে হাসি ফুটলে আনন্দ হয়, চাকরির দায়িত্ব পালনে টাকা আর তৃপ্তিও আসে, কিন্তু সেভাবে কি কখনও ভেবেছি যে আমার সুখ হয়েছে কি না? অন্য কেউও হয়তো ভাবেনি আমাকে নিয়ে। ভালো চাকরি আর সফল সংসার, এর বাইরে আর কী লাগে সুখী হতে? তাই এই প্রশ্নটা হয়তো অবান্তর ছিল আমার জীবনে।
বর্ণ এক হাতে রিকশা ধরে থাকে শক্ত করে। তার আরেক হাত ধরে থাকি আমি। হঠাৎ কেন যেন তাকে কাহিল লাগে। ঘর থেকে বের করে এনে বিপদে ফেললাম নাকি, চিন্তা হয়।
‘বর্ণ, খারাপ লাগছে তোমার? বসতে কষ্ট হচ্ছে?’
‘বসতে একটু হচ্ছে কষ্ট, তবু আমি যাব।’
‘গুড।’
‘কিন্তু বললে না তুমি সুখী কি না? বলতে খারাপ লাগছে?’
‘না না, বর্ণ। কী বলব জানি না। আমি কখনও ভাবিইনি আমি সুখী কি না। বা সুখী হতে আমার আর কী লাগবে। আমার কেবল চলে যাচ্ছে আর কী।’
বর্ণ চুপচাপ শোনে। কিছু বলে না। ওই মুহূর্তে রিকশায় বসে মনে হয়, বর্ণ মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে আর আমিইবা কী করছি। আমিও হয়ত জীবনের এই সমস্ত তাগিদ মিটিয়ে একটা পরিণতির দিকে যাচ্ছি। বর্ণ পরিণতিটা দেখবে আগে আর আমি পরে। তবে দুটোই এক। কোনও পার্থক্য নেই। এরপর আরেকজন কেউ গুটি গুটি পায়ে পরিণতির দিকে এগোবে। তারপর আবার অন্য কেউ। হুট করে বর্ণ-র মৃত্যুটা আর আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগে না; এমনকি পৃথিবীর কোনও মৃত্যুও।
কাবাবের দোকানে আমি ধারের দিকের টেবিলে বসতে চাইলেও বর্ণ খাটাখাট বানানোর কাউন্টার ঘেঁষা একটা টেবিলে বসে। তারপর কাঠের ওপরে ক্রমাগত আছড়ে পড়া দুই ছুরির আওয়াজে খিল খিল করে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে বলে, ‘এই শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে তুমি যা বলবে তাই হয়ে যাবে, দেখো।’
আমি হাসি, ‘ঠিক। ওরা বলে খাটাখাট।’
‘ধরো, আমি বললাম, মরণফাঁদ মরণফাঁদ মরণফাঁদ … কিংবা ধরো, বর্ণ বাদ বর্ণ বাদ বর্ণ বাদ … দেখবে একেবারে মিলে গেছে।’
‘সে কী, বর্ণ বাদ যাবে কেন! কী যে সব বলো না।’
‘বলি তো, আমার ঘরের ফ্যানটা ধীরলয়ে চললে ক্যাচর ক্যাচর শব্দ করে। তখন রাতের পর রাত আমি ওটার তালে তালে কথা বলি।’
‘কী বলো?’
‘শ্রাবণী আসবে শ্রাবণী আসবে শ্রাবণী আসবে… কিংবা বলি, বর্ণ মরবে বর্ণ মরবে বর্ণ মরবে। এমনটা বললে সে রাতে আমার ঘুমটা একটু খারাপ হয়। কথাটা মাথা থেকে বেরোতে চায় না তো, তাই।
আমি বর্ণের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। বিষাদ না, কেমন একটা অপরাধী ভাব। যেন এই অসুস্থ হওয়া, এই একা হয়ে যাওয়া আর মানুষের জন্য নিজের অজান্তে যে কোনও অপেক্ষাকে মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা ভাবাটা ওরই অপরাধ। আমার অসহায় চাহনি দেখে বর্ণ মুচকি হাসে। অন্য কিছু বলবে বলে মনে মনে কথা গোছায়। কেন যেন কথা ঘুরিয়ে চট করে বলে ফেলি, ‘বর্ণ, তোমার তো বাইরে এসে ভালোই লাগছে মনে হয়। আর কী কী ইচ্ছে করে তোমার আমাকে বলবে ?’
‘তুমি আমার লাস্ট উইশ জানতে চাচ্ছ?’
‘লাস্ট কেন হবে, তুমি অসুস্থ অবস্থায় একা আছ, আমি তোমাকে একটু খুশি রাখতে চাচ্ছি। এই সময়টা কেটে যাবে একদিন আর শ্রাবণী আপা সত্যিই চলে আসবে। তখন সে তোমাকে খুশি রাখবে, আমি আর আসব না হয়ত।’
‘তুমি জানো এরকম হবে না। তবে তুমি যখন জানতেই চাচ্ছ তখন আমি তোমাকে আমার একটা লাস্ট উইশ বলব। তুমি কি যা চাই তাই দেবে?’
‘আমার সামর্থে থাকলে নিশ্চয় দেব, বর্ণ। বলো কী চাও।’
‘আজ না। আরেকদিন বলব।’
সপ্তাহ যায়। এর মধ্যে বর্ণের কাছে দুবার যাই। দুবারই জানতে চাই, ‘কী চাও তুমি?’ সে বারবারই বলে, ‘আরেকটু ভেবে নিই। শেষ চাওয়া বলে কথা, যা-তা তো চাইতে পারি না।’ আমিও ভাবি, তাই তো! তারপর একদিন বলে, ‘ডাক্তার তো বলেছিল মাসখানেক, কিন্তু দেখো, পাঁচ সপ্তাহ হয়ে গেল দিব্যি বেঁচে আছি। আর এক সপ্তাহও থাকব, কী বলো?’ আমি বলি, ‘থাকবে না মানে? শরীর তো আগের চেয়েও ভালো দেখা যাচ্ছে। ডাক্তারের কথা মিথ্যা হয়ে যাবে, দেখো।’
‘প্রদীপ নেভার আগে জ্বলে ওঠা আর কী,’ বর্ণ হাসে। তারপর সামান্য কঠিন মুখ করে বলে, ‘ডাক্তার মিথ্যা বলেনি, আমি জানি। আমি মেনে নিয়েছি।’
‘এসব কথা বাদ দাও তো, বর্ণ। শেষ ইচ্ছেটা বলো,’ আমি অধৈর্য হই।
‘দেখেছ, তুমিও মেনে নিয়েছ। তাই তো শেষ ইচ্ছে বলছ। বলব কী ইচ্ছে?’
আমি বর্ণের দিকে তাকিয়ে থাকি। কিছু বলি না। শুনতে চাই না। সে নিজে থেকে বলা শুরু করবে। ঘটেও তাই। সে এগিয়ে আসে আমার দিকে। গভীর চোখে তাকায়, বলে, ‘বন্ধুত্ব সত্যিই দারুণ ব্যাপার। মাত্র দুটো সপ্তাহে জীবনটা অন্যরকম হয়ে গেল। বন্ধুত্ব দেখার চোখ বদলে দিতে পারে। প্রেমও তো এক রকমের বন্ধুত্বই, তবে আমার জানা নেই প্রেম ঠিক কেমন। ঠিক জানা নেই শরীর কী করে প্রেম করে। তাই আমার ইচ্ছে করে …’ বর্ণ সরাসরি তাকিয়ে কথা বলে, আমিও তাকিয়ে থাকি তার দিকে। হঠাৎ মাঝপথে কথা থামিয়ে মুখ নামিয়ে ফেলে সে। তারপর ধীরে ধীরে মুখ তুলে হড়বড় করে বলতে থাকে, ‘আমার জীবন আর কয়েকটা দিনের হয়তো, কিংবা আজ রাতেই …। আমার জানতে ইচ্ছে করে শারীরিক আনন্দটা ঠিক কী রকম। তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ নিশ্চয়। তুমি কি আমাকে …’ কথা থামিয়ে বর্ণ আবারও চোখ নামায়। ওর একটা হাত কাঁপতে কাঁপতে আমার হাতের দিকে আগায়। পড়ার টেবিলের কোণটা খামচে ধরে দাঁড়াই আমি। দৃঢ় গলায় বলি, ‘বর্ণ, আমি তোমার বছর দশেকের বড়ো। তুমি চট করে আমাকে এই প্রস্তাব দিতে পার না কিন্তু, মানে, আমি বলতে চাচ্ছি …।’ বর্ণ দুই পা পিছিয়ে যায়। বিছানায় বসে পড়ে ধপ করে। আমি টেবিলের ওপর থেকে হ্যান্ড ব্যাগটা কাঁধে চড়িয়ে সোজা বেরিয়ে পড়ি। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে দারোয়ান কিছু বলতে চায়, ‘আপা, বর্ণ ভাই কইছিলেন কী … ’ আমি তার কথা শুনেও না শোনার ভান করে বেরিয়ে আসি।
চার দিন হয় আমি বর্ণকে ফোন করি না। পাঁচ দিনের দিন শ্রাবণী আপা জানতে চান আমার শরীর খারাপ নাকি। দারোয়ান বলেছে আমি সেখানে যাচ্ছি না। শ্রাবণী আপা বর্ণের শরীর বেশি খারাপ হবার কথা জানায়। উথালপাতাল ভাবনায় সন্ধ্যানাগাদ শেরশাহশুরি রোডে গিয়ে উপস্থিত হই। অবস্থা দেখে আর কেমন আছে সে জানতে চাইতে ইচ্ছে করে না। আমি শুধু বর্ণের মাথায় হাত রাখি। সে নিজের হাতে আমার হাত ধরে। মনে হয় যেন কোনও গোপন শক্তিতে জেগে ওঠে। বিছানায় উঠে বসে বলে, ‘আমার না খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে।’
‘করবেই তো, করবেই তো,’ আমি আওড়াই। তাকে জড়িয়ে ধরি। সে আমার বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে। তাকে আগে কখনও ওভাবে কাঁদতে দেখিনি। কান্নার দমকে ফুঁপিয়ে সে জানতে চায়, ‘তুমি কি আমার ওপরে রাগ করেছ?’
‘না। রাগ করিনি, বর্ণ। তুমি শান্ত হও।’
‘তাহলে আমাকে আদর করছ না কেন? আমাকে কিছু কল্পনা, কিছু স্মৃতি দিতে পার? আর কিছু পাওয়ার আছে বলে মনে হচ্ছে না যে!’
‘বর্ণ, তুমি আমার ছোটো ভাইয়ের চেয়েও ছোটো। মানে, আমি কী করে … তা ছাড়া, আমি সেরকম না আসলে, আমি কেবল নিজের ভিতরে থাকি। তুমি যদি আমাকে সেরকম মনে করো তাহলে কিন্তু …’
আমাকে জড়িয়ে ধরা বর্ণের হাত শিথিল হয়ে যায়। এই প্রথম সে নিজে থেকে বলে, ‘তুমি যাও।’ আমি ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়াই। কখনও বর্ণের সামনে কাঁদিনি। কেঁদেকেটে ওকে দুর্বল করা তো আমার উদ্দেশ্য ছিল না। মুখে তাই ওড়না চেপে ধরে ছুটে বেরিয়ে আসি।
সিদ্ধান্ত নিতে আমার ছয় দিন সময় লাগে। বর্ণ যা চায় তাই হবে। কিন্তু ওর কি আর সময় আছে ? সময় কারও কাছে কখনও এত গুরুত্ব পায়নি হয়তো। ভাবতে ভাবতে সামান্য সাজগোঁজ করি আমি। বর্ণ একদিন হালকা বেগুনি রঙে আমাকে দেখে প্রশংসা করেছিল। সেই টপটা গায়ে চড়াই। রিকশায় বসতেই শ্রাবণী আপার মেসেজ পাই, ‘সব শেষ। শেষের কয়েকটা দিন তুমি বড়ো আনন্দে রেখেছিলে তাকে, আনিকা!’
গোল্ডেন শাওয়ারের কমলা-স্রোতের নিচে যখন এসে দাঁড়াই তখন সেখানে কয়েকজন দাঁড়িয়ে। সৎকারের পরিকল্পনা চলছে। বর্ণের মৃত্যুর প্রতীক্ষা শেষ হয়েছে।
0 Comments