পদ্মাপুরাণঃ ভিন্নস্বর হয়ে উঠার পথে মুখথুবড়ে পড়া এক সিনেমা

ছবিঃ সংগৃহীত 

প্রমত্তা পদ্মা। দিয়েছে মানুষের জীবনের সংস্থান-কেড়েও নিয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে আবার নতুন চর জেগেছে। সেই তেঁজ কমে গেলেও এখনও পদ্মা বিশাল জনপদের মাঝে মহীরুহ হয়ে আছে। বদলে যাওয়া সে পদ্মা নদী পাড়ের মানুষের একাংশের জীবন নিয়ে চিত্রনাট্য লিখেছেন রায়হান শশী। গত বছরের ৮ এপ্রিল মুক্তি পায় পদ্মাপুরাণ। পরিচালনা করেছেন রাশিদ পলাশ। নতুন আর পুরনো মুখ নিয়ে চার বছরের দীর্ঘ সময়ে ছবিটি তৈরি করেছেন পরিচালক।


আপাদমস্তক মাদকের চোরা কারবার নিয়ে ছবির কাহিনী এগিয়ে গিয়েছে। শুরুতেই গ্রামের এক হত দরিদ্র পরিবারের নিম্নমানের চোরাই মাদকদ্রব্য গ্রাহকের কাছে বিক্রি করার দৃশ্য চোখে পড়ে। কিন্তু দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগতে বাধ্য মাদক ব্যবসা এতটা সরল ভাবে করা সম্ভব কিনা। সিনেমা যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন ধরা পড়ে ছোট একটা চরিত্র তৃতীয় লিঙ্গের। আমাদের স্বভাবজাত রীতি অনুযায়ী কোন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে পরিবারে রেখে ঝামেলা পোহাতে চাই না। সেই ভঙ্গিই সিনেমাতে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এতে করে যে শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষের ওপর সমাজ-পরিবার একটা অন্যায় চাপিয়ে দিচ্ছে সেবোধটা পরিচালক কিংবা কাহিনীকার কখনও চিন্তা করেননি। কিংবা পরে কোথাও দর্শকদের এই বার্তাদেননি যে এটা একটা অমানবিক কাজ। ফলে গৌতমীয় বা ইসলামীয় মানবিকতার যে উদার্যতা দেখাবার কথা ছিল সেটা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। পরিচালক হয়তো খুব সহজেই অদূরেই ক্যারাম খেলায় মত্ত কোন যুবকের কণ্ঠে এর প্রতিবাদ তুলে সেই পথে হাঁটতে পারতেন। সেই পথে তো হাঁটেনই নি উপরন্তু সেখানকার কোন মানুষকেই এই অমানবিক ভাবে বাড়ি থেকে বের করে তৃতীয়লিঙ্গের দলের সাথে চলে যাবার সময় তাদের দৃষ্টি এবং মনোযোগ ফেরাননি।


পর্দায় উপস্থিতি কিংবা ক্ষমতার দিক থেকে মাদক সম্রাজ্ঞী প্রসূন আজাদকেই কেন্দ্রীয় চরিত্র বলে প্রতীয়মান হবে। তবে কেন্দ্রীয় চরিত্রের মূল্যায়নের বাইরে গিয়ে যদি সুমিত সেনগুপ্তকে নায়ক হিসেবে ধরি তবে ইমানুয়েল কান্ট দর্শন থেকে আমরা যে নৈতিকতার ছবক পাই সেটা পুরোপুরিই মার খেয়েছে। কারণ সে মাদক সম্রাজ্ঞী প্রসূনের কথায় নিয়ন্ত্রিত হয়। নায়ক হয়ে উঠবার কিংবা কান্টের নীতিতে বলিষ্ঠ হয়ে উঠবার কোন প্রবণতা তার মধ্যে দেখা যায় না। ফলে চরিত্রটি দূর্বল হয়ে থাকে। প্রসূনের মাদক সাম্রাজ্যের প্রতিদ্বন্দি হিসেবে দুএকটা গ্রুপের নাম বলে কিন্তু বাস্তবে পর্দায় তাদের কার্যক্রম পরিদৃষ্ট হয় না। ফলে অন্ধকার জগতের যে প্রকৃত চিত্র তা ফুটে উঠেনি। ফলে গল্পটা বড় ক্যানভাসে সিনেমার জন্য পর্যাপ্ত নয় বলেই প্রতীয়মান হয়। তাছাড়া চরের যে মাওলানার চরিত্র দেখানো হয়েছে তার উপস্থিতি একেবারেই অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হবে। বরং তার উপস্থিতি পদ্মা নদীর মাঝির হোসেন মিয়ার চরিত্রের ছায়া দর্শকদের মনে করিয়ে দিবে। যদিও হোসেন মিয়ার শক্তিশালী চরিত্র আর দর্শনের দৃঢ়তার ছিটেফোঁটাও এই মাওলানার মধ্যে নেই। 


সিনেমার মাঝামাঝি যখন প্রমাণ হয় যে শুরুতে যাকে ছোট বেলায় বাড়ী থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল সেই কেন্দ্রিয় চরিত্র আসলে তৃতীয় লিঙ্গের নয়। এমনকি খারাপ লোকের লালসার স্বীকার হয়ে সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যায়। সে সবকিছু হারিয়ে যখন নিজের বাড়ী ফিরে আসে তখন গ্রামবাসী পুলিশ দিয়ে তাকে গ্রাম থেকে বের করে দেয়। এখানেও কান্টের নৈতিকতা ভূলুণ্ঠিত হয়। কারণ গ্রামবাসী বের করে দিলে হয়ত এতটা সমালোচনার জায়গা থাকতো না। যখন রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী পুলিশ কোন কিছু বিচার বিবেচনা না করেই বের করে দেয় তখন নীতি-নৈতিকতার বিপর্যয় হয় চরম ভাবে। তবে ফ্রয়েডীয় মনঃস্তত্ত্ব বা ব্যক্তিত্ব বিকাশের তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে দারুন ভাবে। সেটা সাদিয়া মাহির চুল কেটে ফেলার মধ্যে যেমন প্রচ্ছন্ন ভাবে প্রকাশ পায় তেমনি প্রকট ভাবে প্রকাশ পায় সাদিয়া তানজিনের সন্তান লাভের বাসনায় পুলিশ সদস্যের সাথে বিবাহ বহির্ভুত শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে। 


তাছাড়া কয়েকটি চরিত্র সর্বস্ব ছাড়া সিনেমার মোটা দাগে কোন পরিপার্শ ওঠে আসেনি। পদ্মা পাড়ের গল্প বলা হলেও সেভাবে কোন গল্পই ওঠে আসেনি। ফলে কাহিনীর বিস্তারে পরিবেশ যে সহায়ক ভূমিকা হয়ে সিনেমা হয়ে ওঠে আদতে তা হয়ে ওঠেনি। 

 

সিনেমার প্রতিটি চরিত্রই নিখুঁত অভিনয় শৈলী প্রদর্শনের আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। নতুন পাত্রপাত্রীরাও চমৎকার অভিনয় করেছে এবং সেই অভিনয় দক্ষতাই দর্শকদের হয়তো শেষ পর্যন্ত সিনেমাটা দেখতে ধরে রাখবে। তবে শম্পা রেজার অভিনয়কে আরোপিত মনে হয়েছে। তার কণ্ঠে স্থানীয় ভাষা তুলে দিলে চরিত্রের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়ত বলেই মনে হয়েছে। সিনেমায় সংযোযিত ভরাট কণ্ঠের হাহাকার করে উঠা গানগুলোও দর্শকদের ছোঁয়ে যাবে। লং আর ক্লোজ শর্টে ক্যামেরা ধরে পরিচালক বেশ সুন্দর ভাবেই চিত্রধারণ করেছেন। তবে কাহিনীর বিস্তার আর ছোটখাটো দিকগুলোতে খেয়াল রাখলে সত্যিকারে সিনেমা হয়ে উঠত পদ্মাপুরাণ। 


-আকাশ মামুন সরকার

 

Post a Comment

0 Comments