দেশে পরিযায়ী পাখি কমে যাচ্ছে

জলাশয়ে পরিযায়ী পাখি, ছবি: প্রথম আলো 

পাখি ও পরিবেশবিষয়ক এক সমীক্ষায় ওঠে এসেছেগত পাঁচ বছরের তুলনায় দেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা শতকরা ৪০ ভাগ কমেছে শুধু ২০২১ খ্রিস্টাব্দেই কুড়ি হাজার পাখি কম এসেছে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের তুলনায়। এর কারণ মূলত মানবসৃষ্ট পাখিদের বিভিন্ন আগমনস্থলে দর্শনার্থীদের ভিড়, উচ্চ শব্দে গানবাজনা, ঢিল ছুড়ে পাখিদের বিরক্ত করা এবং গাড়ির হর্ণ বাজানো পাখিদের বিরক্ত করে। এছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণায়ন তো আছেই। এক শ্রেণির দুষ্ট শিকারি কর্তৃক পাখি শিকারের ফলে প্রতিবছর পাখির সংখ্যা কমছে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ অনুযায়ী পাখি শিকারহত্যাআটক ও ক্রয়-বিক্রয় দণ্ডনীয় অপরাধ যার শাস্তি দুই বছর কারাদণ্ড এবং ২ লাখ টাকা জরিমানা তবে এই আইনের যথাযথ প্রয়োগে অবহেলা লক্ষ্যনীয়। 


বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে অতিথি পাখির চলাফেরাতেও। ভারতনেপালতিব্বত, চীন, সাইবেরিয়া, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, রাশিয়া এবং মঙ্গোলিয়া অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ায় কিছু প্রজাতির পাখি শীতের সময়েও এসব এলাকা টিকে থাকতে পারে। ফলে নিজেদের আবাস্থল ত্যাগ করে অন্যত্র যেতে হয় না শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে। 


এছাড়াও জলাভূমি কমে যাওয়া এবং জলাশয় থেকে অনেক প্রজাতির মিঠা পানির মাছ বিলুপ্ত হওয়ায় খাদ্যেরও অভাবে অনেক পাখি এদেশে আসছে না যা বাস্তুসংস্থানের ওপর চরম হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। 


পরিসংখ্যান মতে বিশ্বে প্রায় ৮ হাজার ৬০০ প্রজাতির পাখি রয়েছে তার মধ্যে উপমহাদেশে আছে প্রায় ১ হাজার ৪০০টি বিশ্বের পাখি প্রজাতির মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৮৫৫ প্রজাতিই পরিযায়ী শীত মৌসুমে প্রায় ২৯০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি দেশে আসে আর বাকিগুলো আসে গ্রীষ্মে বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখির ৯৫ শতাংশ আসে শীতকালে বাকি পাঁচ শতাংশ আসে বছরের বিভিন্ন সময় সুমেরু অঞ্চল থেকে একটি পাখি উড়া শুরু করে কুমেরু অঞ্চলে আসতে প্রায় ৩০ হাজার মাইল উড়তে হয় পাখিরা দূর-দিগন্ত পাড়ি দিতে কখনও একা চলে নাদলবেঁধে পাড়ি দেয় দীর্ঘ পথমালা পৃথিবীর চুম্বক ক্ষেত্রই পাখিদের পথ চিনিয়ে থাকে


দেশের যে কয়টি স্থানে অতিথি পাখির সমাগম ঘটে হাকালুকি হাওর তার অন্যতম সুনামগঞ্জের হাওরগুলোতেও পাখি আসে ভোলার চরাঞ্চলচলনবিলখুলনাযশোরদিনাজপুরচট্টগ্রামের বিভিন্ন বিল ও জলাশয়ে অতিথি পাখিদের দেখা যায় সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা চিড়িয়াখানার জলাশয়গুলোসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন খালবিলপুকুরহ্রদনদী অববাহিকায় এরা তাদের সাময়িক আবাস গড়ে তোলে

 

এ বছর ২ ও ৩ ফেব্রুয়ারি পাখিশুমারি অনুষ্ঠিত হয় এই দুই দিনে টাঙ্গুয়ার হাওরে মোট ৩৯ প্রজাতির পাখি দেখা গেছেযার মধ্যে ২৭টি পরিযায়ী প্রজাতির সবচেয়ে বেশি ১২ হাজার ৭৬০টি পিয়ং হাঁস দেখা গেছে এরপর লালমাথা ভূতিহাঁস দেখা গেছে ৯ হাজার ৯০৩টি এ ছাড়া কুট পাখি দেখা গেছে ৯ হাজার ৩৯৮টি এবারের শুমারিতে পৃথিবীজুড়ে মহাবিপন্ন প্রজাতির পাখি বেয়ারের ভূতিহাঁস দেখা গেছে বিরল প্রজাতির বৈকাল তিলিহাঁসফুলুরি হাঁসকুঁড়া ইগলখয়রা কাস্তেচরাউত্তুরে টিটি ও কালোলেজ জোড়ালি পাখিও দেখা গেছে

 

জাতীয় পাখিশুমারির তথ্যমতে২০১৯ সালে শুধু টাঙ্গুয়ার হাওরে ১ লাখ ৪৬ হাজার পরিযায়ী পাখি দেখা গিয়েছিল। সে বছর দেশের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমিগুলোতে প্রায় আড়াই লাখ পরিযায়ী পাখি এসেছিল। এত বিপুল পাখি দেখা যাওয়ায় দেশের প্রকৃতিপ্রেমীরা বেশ আনন্দিত হয়েছিলেন। পরিসংখ্যান মতে, ২০১৯ সালে ২,৪৬,৬৬৫ টি পাখি দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে দেখা যায়। কিন্তু এর পরের বছর থেকেই বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখি আসা কমতে শুরু করে

২০২০ সালে পরিযায়ী পাখি

টাঙ্গুয়ার হাওর

৫১,৩৬৮টি

হাকালুকি

৪০,১২৬টি

উপকূল

৩৫,০০০টি

পদ্মার চর

৪০২৫ টি

অন্যান্য

১৫,০০০টি

১ লাখ ৪৫ হাজার ৫১৯টি


২০২১ সালে পরিযায়ী পাখি

টাঙ্গুয়ার হাওর

৬১,১২৫টি

হাকালুকি

২৫,০০০টি

উপকূল

৩০,০০০টি

পদ্মার চর

,০০০টি

অন্যান্য জলাভূমি ৫০০০টি

মোট ১ লাখ ২৫ হাজার ১১৫টি


বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও আইইউসিএনের পর্যবেক্ষণ বলছেগত ২০ বছরে বাংলাদেশে এসব পাখির বসতি এলাকাও ৩৫ শতাংশ কমেছে। মূলত টাঙ্গুয়ার হাওরহাকালুকি হাওরবাইক্কার বিলউপকূলীয় এলাকানদীর চর ও দেশের অভ্যন্তরীণ বিল এবং জলাশয়গুলোতে বসতি গড়ে পরিযায়ী পাখি। দেশে যে ৭১১ প্রজাতির পাখি দেখা যায়তার মধ্যে ৩৮৮ প্রজাতি হচ্ছে পরিযায়ী।

 

পরিযায়ী পাখি শুধু সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না, দেশের বাস্তুসংস্থানে অনন্য অবদান রাখে। কিছু কিছু পরিযায়ী পাখি ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফসলের খেত রক্ষা করে। কিছু কিছু ফুলের পরাগায়নও হয়ে থাকে পাখিদের দ্বারা। এছাড়া পাখিদের বিষ্ঠা জলাশয়ের অনেকে মাছের খাদ্য এবং জমির উর্বরা শক্তি বাড়ায়। সর্বোপরি বাস্তুতন্ত্রে পরিযায়ী পাখির ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই সরকারের উচিত জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করা। এছাড়া বন্যপ্রানি ও পাখি রক্ষা আইন কার্যকর করে শিকারিদের হাত থেকে পাখিদের রক্ষা করে পাখিদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা। 





Post a Comment

0 Comments