স্বপ্নযাত্রা কিংবা উদ্বাস্তুপুরাণঃ জাকির তালুকদার

 


তারা জেগে দেখল পৃথিবী অপেক্ষা করেনি।

অবশ্য এটাই তাে ছিল তাদের প্রার্থনা। দুঃস্বপ্নের মতাে ভয়ঙ্কর সময়টুকু এড়ানাের আর কোনাে পন্থা তাদের সামনে ছিল না। তারা তাই, আসহাবে ক্বাহাফ, ঈশ্বরেচ্ছাকে স্বাগত জানিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল সুগভীর নিদ্রার ছায়ায়। ঈশ্বরের আদেশে সময় এড়িয়ে গেছে আটটি প্রাণীকে।
কিন্তু সময়ের অমােঘ লাঙল ক্রমাগত খুঁড়ে গেছে মহাজগতের মাটি। যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে গেছে সময়ের সর্বংসহা ডানায় ভর করে।
তাই জেগে উঠে দেখল তারা রাহুমুক্ত। যে অত্যাচারী শাসকের রুদ্ররােষ এড়াতে তাদের এই ঘুমের শরণ, সে আজ সুদূর ইতিহাসের অন্তর্গত। তারা সাতজন সমস্বরে গেয়ে উঠল ঈশ্বরের জয়গান। তাদের সঙ্গী কুকুরটিও লেজ নেড়ে প্রকাশ করল নিজের আনন্দ। তারা সাতজন পরস্পরের হাত ধরে গুহার আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এলাে নতুন পৃথিবীতে।
তখন প্রত্যুষ।
তাদের সম্মুখে বুক মেলে দাঁড়াল পরিবর্তিত পৃথিবী। তারা জানত পৃথিবী বদলাবেই। তবু তারা চমকে উঠল পরিবর্তনের অকল্পনীয় চেহারা দেখে। তাদের গুহা থেকে কয়েক শ গজ নিচে অপরূপ নগর। এত ওপর থেকেও বােঝা যায় আকাশমুখাে অট্টালিকার সারি বিছানাে, নাতিপ্রশস্ত গালিচার মতাে রাজপথ, আলােকোজ্জ্বল তােরণ। তাদের দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে যায়। তারা ব্যাকুল মন নিয়ে ভাবতে থাকে তাদের ফেলে যাওয়া চামড়ার তাঁবু, ধূলিওড়ানাে পথ, বালিয়াড়ি, ক্রীতদাসদের চাবুক মারতে থাকা দাসপ্রভুদের নৃশংস মুখ, একটিমাত্র জলাশয় ঘিরে গড়ে ওঠা তাদের গােত্রবসতির কথা।
কিন্তু হায় নিচের নগর দেখে মনে হচ্ছে, তাদের গােত্রবসতির বিবর্তিত রূপ তাে এটা নয়! একপুরুষের বিবর্তন তাে কল্পনাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। তাহলে কী তাদের গােত্রবসতি এখন ঐতিহাসিক যুগের স্মৃতি!
সাত যুবকের মনের উল্লাস ততক্ষণে থিতিয়ে এসেছে। পরিবর্তে জাগছে অনিশ্চয়তার শঙ্কা। কেননা এতটা পরিবর্তন কেউ প্রত্যাশা করেনি। তাদের একজন খুব দ্বিধান্বিত গলায় বলল, 'এ কোথায় পদার্পণ করতে হচ্ছে আমাদের! তার চেয়ে চলাে গুহাতেই থাকি।'
কিন্তু পেছনে ফেরতেই বিস্ময়ে আতঙ্কে জড়ত্ব গ্রাস করল তাদের। নেই! তাদের পেছনে আর নেই কয়েক মুহূর্ত আগে ছেড়ে আসা গুহা। এমনকি উধাও পাহাড়টিও। বরং তারা আবার সামনে তাকাতেই দেখল, তারা দাঁড়িয়ে আছে নগর তােরণে।
তাদের মধ্যে সর্বাধিক প্রত্যুৎপন্নমতি যুবক, যে তাদের অঘােষিত নেতা, বলল, ‘সময় এতদিন আমাদের জন্য গুহাটিকে অক্ষত রেখেছিল। আজ তার ফুরিয়েছে প্রয়ােজন। তাই গুহা এবং পাহাড় নিক্ষেপিত হলাে ইতিহাসের অধ্যায়ে । এখন, এই নগরই আমাদের আবাসভূমি। চলাে, ঈশ্বরের নাম নিয়ে নগরে প্রবেশ করি।'

নগর তখনও সুপ্তিমােড়া। পথে গুটিকয়মাত্র পথচারী। প্রভাত-প্রার্থনায় যোগদানেচ্ছু, আর কিছু গৃহচিহ্ন ভুলে যাওয়া মাতাল। কেউ খেয়াল করল না সাতজন যুবকের এই দলটিকে। স্তিমিত আলাে হয়তাে একটা কারণ।
আসহাবে ক্বাহাফের দল শুরু করল নগর পরিভ্রমণ। তারা কেউ ইতােপূর্বে সুরম্য স্থাপত্য দেখেনি, দেখেনি সযত্নেরােপিত বাগিচা, কৃত্রিম ফোয়ারা। শােনেনি সুমিষ্ট কাকলির মতাে নহবতের সুর। একজন বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলল ‘ঈশ্বর কি আমাদের স্বর্গে তুলে নিয়েছেন? আমরা কি এতদিন ছিলাম কবরের আশ্রয়ে? হাশরের পরে কি আমাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে এই স্বর্গনগরী?’
অন্যদের মনেও দোলা দেয় একই চিন্তা। আর তারা বিহ্বলের মতাে ঘুরতে থাকে সুরম্য নগরীর পথে পথে। তাদের শরীরে জেগে উঠছে ক্ষুধার অনুভূতি। তাদের শরীর পরিশ্রান্ত হয়ে ধারণ করেছে লবণাক্ত ঘামের চিহ্ন। তারা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারে, মরণােত্তর স্বর্গজীবন এটা নয়। এ সেই রূঢ় পৃথিবীই, যেখানে ক্ষুধার আগুন প্রাণীকুলকে অবিরত জীবনের কথা মনে করিয়ে দেয়।
তারা পরিশ্রান্ত সাতজন একটি ফোয়ারার ধারে সমবেত হয় আর আঁজলা বিছিয়ে পান করে সুপেয় জয়। এত সুমিষ্ট হতে পারে পৃথিবীর পানি! তারা আবার দ্বিধান্বিত হয়। এতাে সেই প্রতিশ্রুত ‘হাওজে কাওসর'-এর কথা মনে করিয়ে
দিচ্ছে। হাওজে কাওসর'-এর পানির যে স্বাদের কথা পাঠ করেছে তারা ধর্মপুস্তকে, শুনেছে ধর্মপ্রচারকের মুখে, এর স্বাদটি তাে সেই রকমই।
আসহাবে ক্বাহাফ এবার খাদ্যের কথা ভাবে। জানা আছে, পণ্য বিনিময়ের মধ্যস্থতাকারী হচ্ছে মুদ্রা। তারা মুদ্রা হাতড়ায় নিজ নিজ জেবে। তারা কেউ ধনাঢ্য নয়। তবে কপর্দকশূন্যও নয়। মুদ্রাসমষ্টি তাদের খাদ্য সংগ্রহের জন্য যথেষ্ট মনে হলো।ছয়জন বিশ্রামের আশায় শুয়ে পড়ল বৃক্ষছায়ায়। একজন চলল বিপণীর দিকে খাদ্য সংগ্রহে। তার সঙ্গী হলাে কুকুরটি।
সদ্য পসরা বিছিয়েছে দোকানি। দিবসের প্রথম খরিদ্দারকে সব দোকানিই ব্যবসালক্ষ্মী হিসাবে গণ্য করে চিরকাল। তাই সমাদর একটু বেশিই জোটে। খরিদ্দার তাজিমে পুলকিত হয়ে বলল, ‘আমি খাদ্যবস্তু কিনতে চাই।'
দোকানি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর তড়বড় করে কিছু বলল। যুবক একবর্ণও বুঝল না দোকানির কথা। সে পুনরাবৃত্তি করল চাহিদার । জবাব একই রকম।

কিছুক্ষণ এভাবে চলার পরে যুবক উপলব্ধি করল তার ভাষা দোকানির অচেনা। দোকানির ভাষা তারও অজানা। সে এবার অনন্যোপায় হয়ে আশ্রয় নিল ইশারার। পৃথিবীর এই সার্বজনীন ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয় না কারও। দোকানির মুখ থেকে মেঘ সরে গেল। যুবককে ভিনদেশি ভেবে সে ইশারা-মতো দ্রব্যাদি সরবরাহ করল। যুবক হৃষ্টচিত্তে খাবার নিয়ে মুদ্রা অর্পণ করল দোকানির হাতে। কিন্তু সে ঘুরে দাঁড়াবার আগেই দোকানি খামচে ধরল তার কাঁধ। সে অবাক হয়ে দেখল দোকানির চেহারায় জমেছে রাজ্যের ক্রোধ। দোকানি প্রচণ্ড আক্রোশে বর্তমানে অচল মুদ্রাগুলাে ছুঁড়ে ফেলল মাটিতে আর খাবারগুলাে কেড়ে নেবার জন্য হাত বাড়াল যুবকের দিকে। মানুষের সহজাত প্রতিসংবেদনার কারণেই যুবকের খাদ্যধরা হাত সরে যেতে চাইল দোকানির আওতার বাইরে। অমনি দোকানি ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। তাকে আঁকড়ে ধরে শুরু করল চ্যাঁচাতে। যুবকের কুকুর ধরে নিল, আক্রান্ত হয়েছে তার প্রভু। সে-ও ঝাঁপিয়ে পড়ল দোকানির ওপর। পায়ে কুকুরের দাঁত বসতেই দোকানির চিৎকার বেড়ে গেল কয়েক পর্দা। ছুটে এলাে অন্য ব্যবসায়ীরা।

বােঝা গেল, এ ধরনের পরিস্থিতিতে অভ্যস্থ ব্যবসায়ীরা। তারা সম্ভবত মােকাবেলা করছে বহুবার তাদের ব্যবসার ওপর নেমে আসা বিভিন্ন সন্ত্রাস। কেউ কেউ লাঠি এনে আঘাত করল কুকুরটাকে। কয়েকজন একত্রে পাকড়াও করল যুবককে।
দোকানি হাত-পা নেড়ে হাউমাউ করে সম্ভবত ঘটনা জানাল তাদের। তারা যুবককে ঘিরে ধরল। তাদের কথার ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে কৈফিয়তের ক্ষুব্ধ দাবি। কিন্তু যুবক ঘটনার আকস্মিকতায় চরম বিভ্রান্ত। বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে ক্রুদ্ধ মানুষগুলাের দিকে।
এ সময় সম্ভবত দোকানির মনে এলাে ভাষাবিভ্রাটের কথা। অন্যদের সে কথা জানালে তারাও হকচকিয়ে গেল খানিকটা। বেশ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে অভিজ্ঞ একজন এসে মুদ্রাগুলাে কুড়িয়ে গুঁজে দিল যুবকের হাতে। খাবারগুলাে নিয়ে রাখল দোকানের যথাস্থানে আর ইশারা করল তাকে চলে যেতে।
ধস্তাধস্তিতে ছিঁড়ে গেছে যুবকের কামিজ। সে করুণ দৃষ্টিতে দেখল নিজের বিধ্বস্ত শরীর আর ছিন্নভিন্ন কামিজ। এদিক-ওদিক তাকাল সঙ্গী কুকুরের খোঁজে। তারপর ভগ্নমনােরথ পদক্ষেপে ফিরে চলল সঙ্গীদের কাছে।

সঙ্গীরা অপেক্ষায় ছিল নিধারিত স্থানেই। ব্যর্থ যুবকের মুখে সবকথা শুনে মুষড়ে পড়ল তারাও। খাদ্য জোটানাের ব্যর্থতাতে ক্ষুধা যেন বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। এ সময় হাজির হলাে তাদের কুকুর। মুখে হাড়ের টুকরাে। সাত যুবক দীর্ঘশ্বাস ফেলল সেদিকে তাকিয়ে। মানুষের খাবার জোটেনি কিন্তু কুকুরের ঠিকই জুটেছে। কুকুরজন্মের প্রতি মানবিক অসূয়া কী উঁকি দিল তাদের মনে!
ক্ষিধের হাত ধরে আসে অবসন্নতা। তারা আবার ভরপেট পানি পান করল। তারপর শুয়ে পড়ল মাটিতে পিঠ বিছিয়ে। আবার শরণ নিল ঘুমের।
সর্বদুঃখহর ঘুমের।
কিন্তু একটু পরেই তারা জেগে উঠল জনসমাগমের শব্দে। তাদের কুকুর জেগেছে আগেই। এগিয়ে আসতে থাকা সমাবেশের দিকে দাঁত খিচিয়ে চিৎকার করছে অবিরাম।।
সাত যুবক সভয়ে দেখল দারুণ বৈরীভাব সমাবেশের। কেউ কেউ আবার সশস্ত্র ।
আসহাবে ক্বাহাফের একজন কাঁপা গলায় অনুনয়ের সুরে বলল, তােমরা কী চাও? তােমাদের মুখমণ্ডল ক্রোধাচ্ছন্ন কেন? আমরা তাে তােমাদের কোনাে ক্ষতি করিনি!'
উত্তরে সমাবেশে উঠল ক্রুদ্ধ গুঞ্জন। সে গুঞ্জনের ভাষা যথারীতি যুবকদের অচেনা। যুবক আবার গলা উচ্চগ্রামে নিয়ে ব্যক্ত করল পূর্বোক্তি। এসময় ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন একজন সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ। তিনি এই জনপদের একজন শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত। তিনি সমাবেশকে বললেন, তােমরা ধৈর্যধারণ করাে! দেখি আমি আগন্তুকদের ভাষা বুঝতে পারি কি না!'
তিনি একাকী এগুলেন যুবকদের দিকে।
যুবকরা বারবার নিবেদন করছে তাদের সানুনয় বক্তব্য। বৃদ্ধপণ্ডিত খুব মনােযােগসহকারে তাদের কথা শুনলেন। তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি সমাবেশের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি। এরা যে ভাষায় কথা বলছে, সে ভাষায় আমাদের পূর্বপুরুষগণ কথা বলতেন হাজার বছর আগে। আমি এদের বক্তব্য বুঝতে পারছি।' 
এবার তিনি যুবকদের দিকে ফিরলেন। ভাঙা ভাঙা শব্দে জিজ্ঞেস করলেন, “তােমরা কারা? কী চাও? কেন এখানে এসেছাে?'
যুবকরা অকূল পাথারে খোঁজ পেল তৃণখণ্ডের। সবিস্তারে ব্যক্ত করল নিজেদের কাহিনী। জ্ঞানীবৃদ্ধ তাদের বক্তব্য অনুবাদ করলেন জনপদবাসীদের কাছে, ‘এই সাত যুবক সঙ্গী কুকুরসহ হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে ছিল বিলুপ্ত পর্বতের গুহায়। অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে বাঁচানাের জন্য ঈশ্বর ওদের জন্য বরাদ্দ করেছিলেন সেই আলৌকিক ঘুম। ওরা এখন আমাদের সাথে থাকতে চায়, আশ্রয় চায়, খাদ্য চায়। বাকি জীবনটা আমাদের মাঝে কাটাতে চায়।'

জনতা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। কেউ বিশ্বাস করেনি ওদের বক্তব্য। এই জনপদের মানুষ এখন বিজ্ঞানের যুগে বাস করে। বিজ্ঞানের ভিত্তি নেই এমন কোনাে কিংবদন্তি-অলৌকিকত্বে কেউ বিশ্বাস করে না। কেউ বলল, ‘ঐ সাতজন তাে আমাদের বৈরী রাষ্ট্রের গুপ্তচর' কেউ বলল, 'ওরা বদমাশ, গাঁজাখুরি গল্প শােনাতে এসেছে।'
সাত যুবকের আশ্রয়দানের বিরোধিতায় সবাই একমত। বলল, ঐ সাতজন যদি থাকতে চায়, তবে থাকুক নগর সীমানার বাইরে বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে। আর সত্যি সত্যিই ওরা যদি হাজার বছর আগের মানুষ হয়ে থাকে, তবে না হয় ওদের রেখে দেব আমাদের জাদুঘরে, ঐতিহাসিক নিদর্শনের সারিতে।’ নিজেদের রসিকতায় জনতা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল আবার।


২.
খাটিয়া চেপে গােবিন্দ ড্যাঙডেঙিয়ে শ্মশানে চলল।

গােবিন্দ মানে বুড়ি মা, বউ, দুই বােন, চার মেয়ে। নুন থেকে পরমান্ন, পূজার ভােগ। ভাের থেকে রাত আটটা অব্দি নাকগুঁজে কাজ। ফাঁকফোকড় খুঁজে নাকেমুখে কিছু গুঁজে দেয়া। মেয়ের মাস্টার, বােনের পাত্র খােঁজা। মাসে-দুমাসে সিনেমা দেখা।
বুড়ি মায়ের অত্যাচার ক্রমেই বাড়ছিল- ‘ও বাবা গােবিন্দ গােপাল, ও পাড়ের একখান ব্যবস্থা করতি পারলি? এই মেলেচ্ছাে দ্যাশেই আমারে পােড়াবি? মুখে এট্টু গঙ্গাজলের ছিটে, একবার বেন্দাবন-কাশি দশশন কি কপালে জুটপি নারে বাপ?'
‘চুপ চুপ! কেউ শুনি ফেলবি!’ 
‘তা শুনুক না। শুনলি ক্ষতি কীসের? চল বাপ আমাগের নিয়ি চল!' 
‘ওখেনে গিয়ে যে রাস্তায় পড়ি থাকতি হবি।’
বুড়ি অবিশ্বাসে চোখ গােল্লা বানায়- ‘শুনাে কথা! রাস্তায় থাকতি হবি ক্যানে? ঐটে যে রামরাজ্য! ইন্দেরা গান্ধীর রাজ্য।'
‘তাের ইন্দেরা গান্ধী তােরে কোলে নেবার জন্যি বসি আছে না?’
‘কী যে কস বাবা! তাের খালি ব্যাঁকা ব্যাঁকা কথা। ওরে ইন্দেরা যে আমাগের মা। কলির দুগ্ গা, অসুরনাশিনী।'
‘হ্যাঁ অসুরনাশিনী! আর ওদিক যে তিনিই নাশ হয়ি গেছেন, সে খবর তাে পাসনি?’
‘মরেনি রে বাবা মরেনি! দেবী কি মরে? দেবী দেহ বদলায়।’
গােবিন্দ ক্ষেপে গেল- “না মরেনি! গুলিত ঝাঝরা হয়ি মলো, আর বুড়ি কয় মরেনি।'
বুড়ি এবার ডুকরে উঠল- 'সেও তাে ঐ মেলেচ্ছোরা মেরি ফেলল। সব ঐ মেলেচ্ছো মুছলমানেরা।’
‘চুপ থাক তাে!' গােবিন্দ ধমকে ওঠে- 'মুসলমান না, তানি মরিছে শিখগের হাতে।'
ঐ একই কতা। তুই আমারে নিয়ি চল বাপ! আমি পুণ্যিদ্যাশে গিয়ি মরব। এট্টু গঙ্গাজলের ছিটে, ক্যাওড়াতলার চিতা।
তাে বুড়ি ইন্দিরা গান্ধীর রামরাজ্যের স্বপ্ন দেখতে থাকুক; গােবিন্দ ড্যাঙডেঙিয়ে খাটিয়া চেপে শ্মশানে চলল।

পাড়ার ক্লাবের থিয়েটারে গােবিন্দ পারমানেন্ট অ্যাক্টর। ‘কাঁটার ফুলশয্যা', ‘সিংহদরজা’, ‘গরিবের ছেলে’ থেকে ‘নূরজাহান' পর্যন্ত করেছে। গােবিন্দর কখনাে প্রম্পট লাগেনি, পার্ট মুখস্থ। একবার ওরা করেছিল ‘একই বৃন্তে দুইটি কুসুম'। দুই সম্প্রদায়ের সহমর্মিতার জন্য সে কী প্রবল আকুতি নাটক জুড়ে। আবেগ ফুঁসে উঠত গােবিন্দর ভেতরে। ডায়লগ বলতে বলতে কান্নার সিন এলে বুক ঠেলে বেরিয়ে আসত বিশুদ্ধ কান্না। শুধু নাটকে নয়, জীবনেও করে দেখাতে হবে একটা কিছু। সেই একটা কিছু কী- তা ভাবল গােবিন্দ ঝিম মেরে কয়েকদিন ধরে। থিয়েটারের পরে সবাই দল বেঁধে খেতে গিয়েছিল পচুর হােটেলে। দোকানভর্তি মানুষের সামনে গােবিন্দ ঝট করে একটুকরাে গরুর মাংস তুলে মুখে দিল। সবাই হা। অধ্যাপক আনােয়ার ওদের পরিচালক, বললেন, ‘এটা কী করলি তুই?’
‘আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলন চাই!' ধরা গলায় বলল গােবিন্দ।
‘তার জন্য গরুর গােস্ত খেতে হবে তােকে? বােকা কোথাকার! ধর্মে নিষ্ঠা রেখেও অসাম্প্রদায়িক হওয়া যায় বুঝলি?'
গােবিন্দ বােঝেনি।
সেই গােবিন্দ চলল শ্মশানে। আর বুড়ি রইল ইন্দিরা গান্ধীর রামরাজ্যের আশায়। বুড়ি ডুকরাতে ডুকরাতে পাথর হয়, পাথর ফাটিয়ে নামে ফের বিলাপের সুর- ‘ওরে আমার অন্দের ষষ্টি কেড়ে নিল রে! কে আমার বংশ রক্ষা করবি! কে এখন আমার ধম্ম বাঁচাবি রে!’

কাউকে না কাউকে তাে এগিয়ে আসতেই হয়। সুধাকান্ত মহাপাত্র এগিয়ে এলাে- ‘কেন আমি!’
ভিটেমাটি রেজিস্ট্রি হলাে মহাপাত্রের নামে। নইলে যে এনিমি প্রপার্টি হয়ে যাবে। বাড়ি বিক্রির অর্ধেক টাকায় হলাে শ্রাদ্ধ। অর্ধেক টাকা আর বোঁচকা নিয়ে গােবিন্দর বউ, দুই বােন, চার মেয়ে নিয়ে বুড়ি রামরাজ্যে চলল। সুধাকান্ত মহাপাত্র অভয় দিয়েছে- ‘যাচ্ছ তাে তীর্থভূমিতে। ওটাই আসল দেশ। মাথা গুঁজার ঠাই, লজ্জার বস্ত্র, সতীত্বের নিশ্চয়তা- সব পাবে!' 
বুড়ির ক্যাওড়াতলা জুটেছে। গঙ্গাজলের ছিটে।
তারপর এক রমণী, দুই যুবতী, চার কিশােরী মােট সাতজন নারী উঠে বসেছে ট্রেনে। হাতবদল ট্রেনবদল। ট্রেনবদল হাতবদল। ট্রেনবদল... হাতবদল...

৩.
সাতজন বিধ্বস্ত নারী একসারিতে হেঁটে যাচ্ছে রুক্ষ মাটিতে পা ঘষটে ঘষটে। তাদের মুখমণ্ডল অভিব্যক্তিহীন। তারা যেন আবছা কারও পদরেখা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। অনন্তকাল ধরে। সাতজনের একজন জিজ্ঞেস করল, 'কদ্দূর?’
সাতজনের একজন পাল্টা জিজ্ঞেস করল, ‘কী কদ্দূর?’
 ‘উদ্বাস্তুপুর।’
‘ কী জানি!'
তারা হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে গান ধরে ‘রামরাজত্ব পেইছি... নিজের মাটি হারাইছি..এখন খুঁজি...উদ্বাস্তুপুর।’
বহুদূরের দূরত্ব পেরিয়ে, ভাষার ব্যবধান পেরিয়ে সাত নারীর গান পৌঁছে যায় আসহাবে ক্বাহাফের কাছে। তারা তখন ক্ষুধায় কাতর থেকে কাতরতর। তাদের গোত্রবসতি হারিয়ে গেছে নগরঅরণ্যে। তাদের ঈশ্বরভক্তি রূপান্তরিত হতে থাকে ক্ষোভে। একজন আকাশমুখো হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে--‘হায় ঈশ্বর! আমরা তোমার কাছে চেয়েছিলাম অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে মুক্তি। তুমি কেন আমাদের বানালে উদ্বাস্তু!’

জাকির তালুকদারের অন্য গল্প 

Post a Comment

0 Comments