কবিতার নতুন প্রস্তাবনার আড়ালে মস্তিষ্কের কিছু সুতো ছিঁড়ে ফেলার কায়দা আছে। কৌশল আছে। এখানে শিল্পের নানান সৌন্দর্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। কোনটা গ্রহণ করবো, কোনটা করবো না, তা একেকজনের রুচির উপর নির্ভর করে। এটাকে বলে হেডওয়ার্ক বা মস্তিষ্কের কাজ। তথাপি কবিতার ব্যাপারে সাধারণ তত্ত্বগুলো বলা যাক।
কবিতার উদ্দেশ্য জগৎ ও জীবনের রহস্যকে সুন্দর ও রসস্নিগ্ধ করে উপস্থাপন করা। কোনো ভাবেই নীতি প্রচার, শিক্ষাদান বা রাজনীতি, সমাজনীতি প্রচার কবিতার উদ্দেশ্য নয়। জীবনের সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্য, ধর্ম-অর্থ-কাম প্রভৃতি কবিতার উপাদান হলেও এগুলো কবিতার দেহমাত্র। কিছুতেই প্রাণ হতে পারে না।
কবিতার উদ্দেশ্য জগৎ ও জীবনের রহস্যকে সুন্দর ও রসস্নিগ্ধ করে উপস্থাপন করা। কোনো ভাবেই নীতি প্রচার, শিক্ষাদান বা রাজনীতি, সমাজনীতি প্রচার কবিতার উদ্দেশ্য নয়। জীবনের সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্য, ধর্ম-অর্থ-কাম প্রভৃতি কবিতার উপাদান হলেও এগুলো কবিতার দেহ মাত্র। কিছুতেই প্রাণ হতে পারে না। কবিতা পাঠে পাঠক জীবনের যে কোনো জিজ্ঞাসা সম্পর্কে অবহিত হতে পারে বটে কিন্তু সার্থক কবিতা জীবন-জিজ্ঞাসা বা কোনো সমস্যার সমাধান দেয় না। এমনকি সিদ্ধান্তেও পৌঁছায় না। কবির কাছে সৌন্দর্যই পরম সত্য রূপে পরিগণিত এবং কল্পনায় তিনি সত্য বলে প্রত্যক্ষ করেন, তা-ই সুন্দর। এই সৌন্দর্য সৃষ্টিই কবিতার সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্যের অন্তঃকরণ ঘট আকার আছে। একে ঘটাকারবৃত্তিও বলা হয়ে থাকে। এই ঘটাকার বৃত্তির উপর চৈতন্যের আলোক পড়লেই সেই কবিতার প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয়। প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া ও প্রত্যক্ষের বিষয় মূলতই সমকালীন। সুখের স্মৃতি প্রত্যক্ষ নয়, কেননা স্মৃতি বর্তমানের মানসিক প্রক্রিয়া হলেও যে সুখের স্মৃতি হচ্ছে তা অতীতের এবং এটাই ধ্রুব সত্য কবিতার ব্যাপারে।
কবিতার নতুন প্রস্তাবনার ব্যাপারে আরো সাধারণ ভাবে বলতে গেলে ক্ষুধা ও জ্ঞানের মধ্যে প্রমাতৃ, প্রমেয় ও প্রমাণ ভেদ আছে। এটা ঠিক প্রমাণিক ধরা যায় না। তবুও আক্ষরিক অর্থে ধরে নেবো কারণ আমাদের জীবনেই শুধু এই তিন অর্থাৎ প্রমাতৃ, প্রমেয় এবং প্রমাণ ভেদের স্বাতন্ত্র্য আছে। ক্ষুধার্ত আত্মার জ্ঞান যখন হয় তখন প্রমাতৃ ও প্রমাণের ভেদ তিরোহিত হয়ে থাকে৷ এটা কবিতার অ-বাধিত ত্ত্বকেই সত্যের মাপকাঠি বলা হয়। কবিতার এই প্রস্তাবনায় ক্ষুধার্ত আত্মার জ্ঞান যথার্থ কারণ এ জ্ঞান-ই অ-বাধিত। আরো সহজ ভাবে বলতে গেলে, যথার্থ শিল্পী বিশ্বময় সুন্দরকে খুঁজে বের করার প্রয়াস করে থাকেন। দুর্দান্ত সুন্দর, মধুর সুন্দর, কঠোর সুন্দর, তরল সুন্দর, গরল সুন্দর কোনোটাকেই একজন যথার্থ শিল্পী বাদ দিতে পারেন না। মূলত সুন্দর তো থাকে অন্তরে। সুন্দর অসুন্দরকে উপলব্ধি করতে হলে নিজের ভেতরের সত্তাকে জিজ্ঞাসা করতে হয়। নিরন্তর জিজ্ঞাসা করতে হয়। জিজ্ঞাসার ভেতরে রাখতে হয়। এই জিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে সূক্ষ্ম রসবোধ, শব্দ ও বাক্যের শাসন ক্ষমতার উৎপত্তি ঘটে।
কবিতার নতুন প্রস্তবনা বিষয়ে এতো কথা বলার অর্থই হলো কবি হাসনাইন হীরা'র "বাঁক বাচনের বৈঠা" কবিতা গ্রন্থের সুবাদে। কারণ "বাঁক বাচনের বৈঠা" পাঠ করতে হলে পাঠককে অবশ্যই কবিতার নতুন প্রস্তবনাটি পাঠ করতে হবে নাহলে এক ব্যর্থ দোদুল্যমানতার ভেতর দিয়ে পাঠককে বিস্ফোরিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, ফল শূণ্যের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। মূলত এই প্রস্তাবনার ভেতর রয়েছে কবিতার নন্দন তত্ত্ব বা শিল্পদর্শন। কবি হাসনাইন হীরা এখানে কবি ও দার্শনিক দু- ই। তবে আমি তাঁকে সে হিসেবে খ্যাত করতে চাইনা। একটু উল্টে বলতে পারি শব্দতান্ত্রিক। দর্শনধ্যানি। এই প্রস্তাবনার ভেতর দিয়ে কবি হাসনাইন হীরা খুব সতর্ক ভাবে অন্তর্নিহিত বিবর্তনের পথে চলে গেছেন। সে পথ সীমাহীন পথ। গ্রহণ করার সক্ষমতা থেকে বৃহদাকার মহাশক্তিশালী পথ। তান্ত্রিক যেভাবে কোজাগরী চাঁদকে মর্ত্যে নামিয়ে আনেন, ঠিক তেমনি কবি হাসনাইন হীরা কবিতার নতুন প্রস্তাবনার মাধ্যমে কবিতার নন্দনতত্ত্বকে মর্ত্যে এনে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছেন। এখানে কবি হাসনাইন হীরা নিঃসন্দেহে প্রগতিবাদী কিন্তু তাঁর প্রগতির ভেতর স্বতঃস্ফূর্ত স্বতন্ত্রতা তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রস্তাবনার শুরুতেই কবি হাসনাইন হীরা প্রগতিকে প্রকৃতির বিবর্তনবাদের ভেতর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তবে কবি এড়িয়ে গেছেন যান্ত্রিক প্রগতিকে। তিনি উপলব্ধি করেননি যান্ত্রিক প্রগতিও উদ্দেশ্যমুখী। "ভোরের রোদ, চাঁদের বেহাগ, জোনাকির সংরাগ, কালের তোরণ" এসব কিছুতে দার্শনিক সুলভ যুক্তির উঞ্চতা পাওয়া যায় না, পাওয়া গেলেও তা সৃষ্টির পরীক্ষা-নিরীক্ষালব্ধ অন্তর্নিহিত প্রবণতা। শব্দ থেকে ক্রমশ ধাবিত হয়েছেন সংকেতের দিকে। তবে স্পষ্টতই সাধারণ বাহ্যজগৎ ও মানব জীবনের ভাব-কল্পনাকে মনোরোম করে তুলেছেন। ভাবকে রূপে পরিবর্তন করেছেন। যা অদেহী, অরূপ, সূক্ষ্ম বা ইন্দ্রীয়াতীত, কবি হাসনাইন হীরা এই প্রস্তাবনার ভেতর দিয়ে রূপ ও ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য মূর্তি দান করেছেন। কবিতার নতুন প্রস্তাবনায় চিরন্তন আবেদনকে আমাদের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যবোধের কাছে বিমূর্ত করেছেন। ভাবসঞ্চারী বিচিত্র রসকে প্রস্ফুটিত করেছেন অ-নীতিদ্রোহী হয়ে। এ ধরনের প্রস্তাবনায় যেটি স্পষ্ট প্রতীয়মান তা হলো Rhythm বা ছন্দ স্পন্দন। এই ছন্দ স্পন্দনে ভাব ও লয়ের সৌন্দর্য সুষমা।
কবিতার নতুন প্রস্তাবনা পাঠে সময়ের গ্রন্থিলতা এবং বাচনিক প্রক্রিয়াকে আধুনিকোত্তর নন্দের সন্ধানী করে পাঠককে অন্তহীন যাত্রার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। এখানে সত্তাতাত্ত্বিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক মৌল একককে এমনভাবে প্রচলিত বাস্তবতার আদলে সেলাই করেছেন তা বিছিন্ন হবার নয়। এটাই হলো কবিতার নতুন প্রস্তাবনার ব্যাপারে অর্থবোধক নান্দনিক উৎপাদন ও প্রতীতির পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। "কোন মাঝির সারগেত আমি? কোন ঘাট চেনা উপকূল? ভাবছি। কাতরাচ্ছি। বাইছি বাচনের বৈঠা'' প্রস্তাবনার এই অংশে চরিত্রের স্বভাব ও বাচন ভঙ্গিকে তাৎক্ষণিক তৎপরতার সঙ্গে গেঁথে দিয়েছেন। দৃষ্টি ভঙ্গিকে এতদূরে থ্রো (নিক্ষেপ) করেছেন যাতে ভবিষ্যতে ঐতিহাসিক বিকাশের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াকে স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্রতা প্রদান করা যায়। এ কথা সত্য যে, শিল্প মতাদর্শের প্রতিফলন করা ছাড়াও সমাজে মানুষের জীবনযাত্রার পদ্ধতির সঙ্গে আরো জটিল সম্পর্ক বজায় থাকে। এরপরেও শিল্পরূপ জ্ঞান না থাকলে কোনো সৃষ্টি কিংবা নীতি সুষম, সুন্দর হতে পারে না। সবকিছুরই Supremely real এর প্রতিধ্বনি আছে যা নিষ্প্রয়োজনকে অন্তরের প্রতীতি বা প্রত্যয়-ই শিল্পের জন্ম দিয়ে থাকে। পরিমাণ ও পরিমাপ প্রকাশ রূপেই সুন্দর। প্রস্তাবনার উক্ত অংশে সৌন্দর্য-বিধায়ক শক্তিকে সেভাবেই প্রয়োজনীয় করে তোলা হয়েছে। কবি হাসনাইন হীরার এই প্রস্তাবনার সুবাদে যেমন তান্ত্রিকতার পরিচয় দিয়েছেন তেমনি আত্মকেন্দ্রিক উদাত্ত কল্পনার প্রতিভূ হিসেবে আবিষ্কার করেছেন।
নতুন কবিতার প্রস্তাবনা বিষয়ে লেখা হয়েছে…" স্বাধীনতা এক 'বিনুনিবিতান'। যে কেউ নিতে পারে __নিক। নেওয়াটা আবশ্যিক।" এখানে উপলব্ধি করতে পারা যায় কবি হাসনাইন হীরা অস্তিবাদ মূর্ত মানুষের স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য যেকোনো মূল্যে বদ্ধ পরিকর। অস্তিবাদ কোনো বস্তু বা বস্তু সামগ্রীর দর্শন নয়। এ হলো মনুষ্য-পরিস্থিতির দর্শন। এ দর্শন বিষয়ীর দর্শন, বিষয়ের দর্শন নয়।
নতুন কবিতার প্রস্তাবনা বিষয়ে লেখা হয়েছে…. " স্বাধীনতা এক 'বিনুনিবিতান'। যে কেউ নিতে পারে __নিক। নেওয়াটা আবশ্যিক।" এখানে উপলব্ধি করতে পারা যায় কবি হাসনাইন হীরা অস্তিবাদ মূর্ত মানুষের স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য যেকোনো মূল্যে বদ্ধ পরিকর। অস্তিবাদ কোনো বস্তু বা বস্তু সামগ্রীর দর্শন নয়। এ হলো মনুষ্য-পরিস্থিতির দর্শন। এ দর্শন বিষয়ীর দর্শন, বিষয়ের দর্শন নয়। কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াকে ভেঙে সামনে এগিয়ে যেতে পারলেই কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা সম্ভব। সেটাকে কবি হাসনাইন হীরা কবিতার নতুন প্রস্তাবনার ভেতর জুড়ে দিয়ে কর্কশ ও মধুর জটিলতর প্যাটার্ন আবিষ্কার করেছেন। ঘাত-প্রতিঘাতের ধ্বনিগত রূপ এখানে সিলেবল গঠন করে নিরবচ্ছিন্ন অবস্থানে অবস্থান করছে। মোদ্দাকথা Freedom is everywhere, কবি হাসনাইন হীরা প্রস্তাবনায় সেটাকেই তুঙ্গে তুলেছেন বেশি করে। নিষ্কর্ষ ও বহির্ভূত অতিরিক্ত বাচনের স্থান দেননি। রচনা প্রকরণকে জিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে দশ দিগন্তের দিশা দেখিয়েছেন। উপলব্ধি করিছেন এই প্রস্তাবনা আধুনিকোত্তর নন্দনের মুখে অভিনব ইশতেহার। উত্তেজনা হতে পারে। উত্তেজিত করায় কবি হাসনাইন হীরার মূল টার্গেট। সঞ্চরমান উপলব্ধির বয়ান যেখানে একবার আঘাত করে সেখানে বিনির্মানকে অনায়াসে স্বাগত জানানো হয়। এই অভিব্যক্তির কারণেই কবিতার এই নতুন প্রস্তাবনাকে আমি দুর্জয় উত্তেজনার স্মারক হিসেবে ঘোষণা করছি। আরও স্বীকার করছি দশ দিগন্ত পার হলেই সমতল, ধীর পায়ে হাঁটা।
0 Comments