বিপন্ন নীলগাই ও আমাদের বিপন্ন মানসিকতা

পঞ্চগড়ে স্থানীয়দের তাড়া খেয়ে  মারা যাওয়া নীলগাই 

নামে নীলগাই হলেও আসলে এটি গরুও নয় আবার নীলও নয়। নামে কি এসে যায়! দেখতে নীল কিংবা গুরু না হলেও অদ্ভুত মায়াকাড়া এই প্রাণিটি একসময় বাংলাদেশের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রচুর দেখা যেতো। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৪০ খ্রীস্টাবের পর থেকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে নীলগাইয়ের আর দেখা মেলেনি। তাইতো ১৮১টি বিলুপ্ত প্রাণীর সাথে নীলগাইয়ের নামটাও জুড়ে যায়। তবে ভৌগোলিক দিক থেকে ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এখনও নীলগাই টিকে আছে।

তবে আশার কথা হলো গত শতাব্দিতে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিলুপ্ত হওয়া নীলগাইয়ের আবারও দেখা মিলছে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে। ধারণা করা হচ্ছে খাবাররের সন্ধানে কিংবা বিরূপ পরিবেশে দলছুট হয়ে ভারত থেকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ছে নীলগাই। প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবরের সূত্রমতে ২০১৮ খীস্টাব্দের ৪ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলে প্রথম দেখা যায় একটি স্ত্রী নীলগাই। পরের বছর ২২ জানুয়ারি নওগাঁর মান্দায় ধরা পড়ে আর একটি পুরুষ নীলগাই। ঠিক একই বছর পত্নীতলায় ধরা পড়ে আরেকটি নীলগাই। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে কাঁদায় আটকে পড়া একটি পুরুষ নীলগাই উদ্ধার করা হয় ২০২০ খীস্টাব্দে। এ বছরের ২৩ ফেরুয়ারী ঠাকুরগাঁয়ের বালিয়াডাঙ্গী, ১৭ মার্চ পঞ্চগড়ের আটোয়ারী এবং ২ জুলাই ঠাকুরগাঁয়ের রানীশংকৈলে দেখা মেলে  নীলগাইয়ের। এছাড়াও এ বছরের মে মাসে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের পাহাড়ি অঞ্চলে দুটি নীলগাই ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। তবে পরিতাপের বিষয় হলো প্রতিটি ক্ষেত্রেই উৎসুক গ্রামবাসী অপরিচিত প্রাণীটি দেখামাত্র ধরে ফেলার জন্য উদ্যত হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে রুদ্ধশ্বাস দৌঁড়ে একপর্যায়ে ভীত প্রাণীটি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এবং আরও পরিতাপের বিষয় হলো, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঠাকুরগাঁয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে গ্রামবাসী যে নীলগাইটিকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে তার মাংস খেতে গলায় ছুরি চালায়। সময় মতো বিজিবি চলে না এলে মাংসের জন্যই প্রাণীটিকে প্রাণ দিতে হতো। বিজিবির উদ্ধারকৃত নীলগাইটির ক্ষতস্থানে সেলাই করে ও চিকিৎসা দিলে প্রাণে রক্ষা পেয়ে যায়।  

একটা সময় ছিল যখন মানুষ গুহা জীবন যাপন করতো। তখন বন্যপ্রাণী শিকার করে জীবন ধারণ করতো। তবে সভ্য সমাজের এসে মানুষের বিবেক বোধ জাগ্রত হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে শহরের বাড়ির আঙ্গিনায় হরিণ, বন্য ভেড়া ঘুরে বেড়ায় নিশ্চিন্তে। হরিণ রাস্তা পারাপারের সময় গাড়ি আরোহী গাড়ি থামিয়ে রাস্তায় বসে থাকেন পার হওয়া অব্দি। শহরবাসী তাদের প্রাণ সংহারের কারণ হয় না। সেখানেরও বন্য প্রাণী শিকারের অনুমোদন আছে তবে তা নির্দিষ্ট জায়গায় এবং নির্দিষ্ট সময়ে। তার বাইরে  হলেই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। 

বাংলাদেশেও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ১৯৭৪ অনুযায়ী বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী সংরক্ষণের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। আইন অমান্যকারীকে পাঁচশত থেকে  দুইহাজার টাকা জরিমানা এবং ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ আছে বলে শুনিনি। থাকলে নীলগাই হত্যা বা বিরক্ত করার জন্য  কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে শুনিনি।   এছড়াও প্রতিটি উপজেলায় প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর নামে একটি প্রতিষ্ঠান জনবল নিয়ে কার্যকর আছে। যা প্রাণিসম্পদ সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম গৃহপালিত প্রাণীদের নিয়েই সীমাবদ্ধ। তবে প্রতিষ্ঠানের বিধিমালায় প্রাণীর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে মানুষ ছাড়া অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণী। সেই বিবেচনায় যে কোন প্রাণীর সংরক্ষণই তাদের কাজের আওতায় পড়াটাই অধিক যুক্তিযুক্ত। সেই যুক্তিতে বিলুপ্ত নীলগাই রক্ষায় প্রানিসম্পদ অধিদপ্তরের উচিত ছিল জনসচেতনতা মূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা।

উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে বিশেষ সভা-সেমিনার, সিম্পোজিয়াম প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে নীলগাই রক্ষায় জনমত গড়ে তোলা। বাংলাদেশ সরকারও জনসচেতনা বাড়াতে গণমাধ্যমে প্রচারের পাশাপাশি আইনের ধারাগুলো তুলে ধরতে পারতো। কিন্তু অত্যান্ত পরিতাপের বিষয় কেউই সেই কাজকে দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেনি। ফলে দীর্ঘ প্রায় এক শতাব্দী পর নীলগাই যে আশার আলো দেখাচ্ছিল তা স্থানীয়দের অবিবেচক মানসিকতায় হয়তো দপ করে নিভে যাবে। এখনই সময় মানবিকতায় বলিয়ান হয়ে বিপন্ন প্রাণীকে ফিরে আসার পরিবেশ তৈরি করার। ফিরে আসুক বিপন্ন নীলগাই-জেগে উঠুক আমাদের বিপন্ন মানসিকতা-মানবিকতা।



Post a Comment

0 Comments